দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৮

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা

“নিশীথ, আমি চাইছিলাম তোমার বিয়েটা খন্দকার সাহেবের মেয়ের সাথে হোক!”
আয়মান সাহেবের কথায় নিশীথ চমকে উঠে। বিস্ময়ের সাথে শুধায়,
—খন্দকার সাহেবের মেয়ে মানে? কোন মেয়ে?
—ওইযে সেদিন ডিনারে এসেছিলো। তোমার সাথে কথাও হয়েছিলো ওর, আমি দেখেছি।
বাবার কথায় নিশীথ সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করে। কিছু মাথায় আসতেই বলে উঠে,

—ওহ বুঝেছি। লিরার কথা বলছেন?
আয়মান সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হলো। দ্রুত মাথা নেড়ে বুঝালেন তিনি লিরার কথাই বলছিলেন। একিসাথে আশেপাশে তাকিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেন,
—আমি যে অকারণেই এ বিয়ের ব্যাপারে ভেবেছি ব্যাপারটা এমন না। এর পেছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমত, নিশীথ যেহেতু বিয়ে করতেই চাইছে এবং নিজ থেকেই বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছে তাই ওর বাবা হিসেবে আমার দায়িত্ব ওকে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেওয়া। এজন্য আমি…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আপনাকে কষ্ট করে ভালো মেয়ে খুঁজতে হবেই বা কেন? যেখানে আমি অলরেডি নিজের জন্য সবচেয়ে ভালো মেয়ে খুঁজে পেয়েছি!
নিশীথ মাঝখান দিয়ে কথা বলে। ওর কথায় আরেফিন সাহেব ও ইউনুস সাহেব ঠোঁট টিপে হাসলেন। কিন্তু আয়মান সাহেব ছেলের এমন আগ বাড়িয়ে কথায় বাধা দেওয়ায় বেশ বিরক্ত হলেন। নিশীথকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

—আমাকে কথা শেষ করতে দাও। তোমার মতো যাকে মন চাইলো তাকেই বিয়ে করতে চাইলেই সব হয়না, নিশীথ। একটা মানুষের বিয়ে পেছনে সবার মত থাকতে হয়, কোনো উদ্দেশ্য থাকতে হয়। এ কারণেই আমি তোমার জন্য লিরাকে পছন্দ করেছি। তো যা বলছিলাম, দ্বিতীয় এবং অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিরা আমাদের স্ট্যাটাসের মেয়ে। ওর ফ্যামিলির সাথে আমাদের ফ্যামিলি সবদিক দিয়ে যায়। প্লাস আমি ভেবে দেখেছি, যদি কোনোভাবে তোমার সাথে লিরার বিয়েটা হয়ে যেতে পারে তবে আমাদের বিজনেসের দিকেও বেশ লাভ হবে! ইট উইল বি আ ভেরি গুড প্রপোজাল ফর আওয়ার বেনিফিটস!

বাবার কথায় নিশীথ এর শুভ্র মুখশ্রী ক্রো’ধে লাল হয়ে এলো। এবার ও সবকিছু ধরতে পারলো। কেন-ই বা আয়মান সাহেব ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছেন, আবার কেন-ই বা ওর বিয়ে নিয়ে এত আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন সবটাই ওর নিকট পরিষ্কার হয়ে এলো! নিশীথ যেমন অবাক হলো, তেমনিভাবে ওর মনে বিরাজ করলো আকাশসমান রাগ ও দুঃখ! রাগ এ কারণে যে, ওর বাবা ওর বিয়ের মতো ব্যাপারেও নিজের স্বার্থটাই বড় করে দেখছেন। আর দুঃখ এ কারণে যে, ওর বাবা একটাবারের জন্য ওর ভালোবাসা বুঝার চেষ্টা করলেন না বরং এক্ষেত্রেও নিশীথের উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন শুধু!

ক্লান্তিতে, হতাশায় নিশীথ এক বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আয়মান সাহেবের দিক অভিমানি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—নিজের ছেলের বিয়ের মতো ব্যাপারেও আপনি নিজের বিজনেসের লাভ-লসটাই আগে দেখছেন। আমি অবাক না হয়ে পারছিনা, বাব..(থেমে)
মিস্টার তালুকদার!
আয়মান সাহেব চোখমুখ গম্ভীর করলেন। নিশীথ তার কথা বুঝতে পারছেনা। তাই তিনি ওকে বুঝানোর জন্য বললেন,

—তুমি আমার কথাটা ভুলভাবে নিচ্ছো, নিশীথ। বিজনেসের লাভ-লস দেখাটা কি ভুল কিছু? এমন নয় যে আমি নিজের স্বার্থের জন্য এসব বলছি। বরং এ বিজনেসের লাভ হলে ভবিষ্যতে তোমাদেরই উপকার হবে। আমরা আর ক’দিন বা আছি?

—ভবিষ্যতের লাভ-লস দিয়ে আমি কি করবো যদি আমার বর্তমানটাই ন’ষ্ট হয়ে যায়? আপনি কেন আমার দিক থেকে ব্যাপারটা ভাবছেন না?
আয়মান সাহেব রুষ্ট হলেন। ছেলে তার কথা মানতে নারাজ। বাপ হিসেবে তিনিও কম যান না। পালটা যুক্তি দেখিয়ে বললেন,

—তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন আমি খুব বাজে মেয়ের সাথে তোমার বিয়ের কথা তুলছি? লিরা কি ভালো মেয়ে নয়? সেদিন তো দেখলেই ওকে। কোনোদিক দিয়েই ও অপছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে নয়!
নিশীথ দু’চোখ বুজে ফেলে। সেকেন্ডের মাঝেই আবার তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে। বাবার উদ্দেশ্যে শান্ত কণ্ঠে বলে,
—লিরা মেয়ে হিসেবে যেমনই হোক না কেন, ও সেই মেয়ে নয় যাকে আমি ভালোবাসি। এই সিম্পল কথাটা আপনি বুঝতে চাচ্ছেন না কেন? আমি দোলনচাঁপাকে ভালোবাসি। ওকেই বিয়ে করতে চাই। অন্য কাউকে নয়! আমি শিওর আপনি বাদে আমার এ সিদ্ধান্তে আর কারও কোনো প্রব্লেম নেই। আমি কি ঠিক বলেছি?

বাকি সবার দিকে তাকিয়ে নিশীথ প্রশ্ন করে। আরেফিন সাহেব, ইউনুস সাহেব ও সকলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। আসমা বেগম নীরব রইলেন। নিশীথ তা লক্ষ্য করলো ঠিকই। কিন্তু এ মুহুর্তে কিছু বল্লোনা। মায়ের সাথে পরেও একান্তে এ ব্যাপারে কথা বলা যাবে। এখন আপাতত বাবাকে রাজি করালেই হলো! নিশীথের ভাবনার মাঝে আশেপাশে তাকিয়ে আয়মান সাহেব থমথমে গলায় বললেন,

—আর যদি আমি রাজি না হই তবে?
আয়মান সাহেব ভেবেছিলেন নিশীথ হয়তো খানিকটা বিচলিত হবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নিশীথ এবার হাসলো। ঠোঁট যুগল স্বভাবমতো বেকে গেলো দু’পাশে। বরাবরের ন্যায় একরোখা স্বভাবে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে সে বললো,

—রাজি না হলে আর কি করার? দুনিয়াতে বিয়ে করার অন্য উপায়ও আছে।
নিশীথের শান্ত-শিষ্ট বাণীতে যেন রুমের মাঝে বড়সড় কোনো বি’স্ফোরণ হলো! আয়মান সাহেবের চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুক্ষণ লাগলো তার। খানিকবাদে থতমত কণ্ঠে তিনি বললেন,
—কি বলতে চাইছো তুমি? তুমি কি আমায় না বলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে?
নিশীথ যেন শুনেও শুনলোনা বাবার কথা। উল্টো সে যেন অন্য কোনো দুনিয়ায় আছে এমন ভাব ধরে চুলের ভাজে হাত চালিয়ে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বললো,

—এত্ত গরম পড়েছে আজকে! যাই একটু বাইরে থেকে গায়ে বাতাস লাগিয়ে আসি।
আয়মান সাহেব একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন সেদিকে। নিশীথ নিজের মতো বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।বাকিরা নিঃশব্দে দর্শক হলো বাপ-ছেলের এ বাক-বিতন্ডায়!

বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেন শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারলো নিশীথ। এতকিছুর চাপ মাথায় নেওয়া যাচ্ছিলো না! আধার রাতের ঠান্ডা বাতাসে মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেলো ওর! বরাবর বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো নিশীথ আজ ঠিক করলো ও গাড়ি নিয়ে বের হবে। মনের শান্তির জন্য একটা লং ড্রাইভে বের হবে! তারপর এলাকার মোড়ে এসে দোলনচাঁপার সাথে দেখা করে বাসায় চলে যাবে!

যে ভাবনা সে কাজ। কানে ব্লুটুথ গুজে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে নিশীথ বেরিয়ে পড়লো গাড়ি নিয়ে। বেশ কিছুদূর যেতেই দোলাকে ফোন দিলো। এতক্ষণ মেয়েটা নিশীথের ফোনের আশায় চিন্তায় জড়সড় হয়ে বসে ছিলো। এবার ওর ফোন পেয়ে এক্সাইটমেন্টে হাত কাপছিলো যেন। কোনোমতো ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিশীথ বললো,
—বিয়ের কেনাকাটা কবে করবে? ভেবেছো কিছু?

দোলা চমকালো। ভীষণভাবে অবাক হলো! ও ভাবেনি নিশীথের পরিবার এত তাড়াতাড়ি এবং এত সহজেই রাজি হয়ে যাবে। আনন্দে, আবেগে মেয়েটার চোখমুখ টলমল করলো। শুধু কোনোমতে বললো,
—সবাই রাজি হয়েছে?
নিশীথ জবাব দিলোনা। বরং বললো,

—যেটা জিজ্ঞেস করেছি আগে ওটা বলো। পাল্টা প্রশ্ন করো কেন হু?
দোলা চুপ হয়ে গেলো! মনে মনে ভাবলো, তাইতো! সে পালটা পশ্ন করছে কেন? নিশ্চয়ই রাজি হয়েছে দেখেই তো নিশীথ বিয়ের শপিং এর কথা বলছে, তাইনা? সুতরাং, আর কিছু না ভেবে দোলা লাজুক হাসলো। কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে কথাবার্তা হলো। নিশীথকে আজ অন্যদিনের তুলনায় একটু চুপচাপ ও মনমরা লাগছে, ফোনের ওপাশ থেকে দোলা বুঝলেও এ মুহুর্তে প্রশ্ন করলোনা। ভাবলো, হয়তো নিশীথও ওর মতো ঘোরে আছে তাই বেশি কথা বলছেনা আজকে। দোলা নিজ থেকেই প্রশ্ন করলো,

—খেয়েছেন কিছু? রাত তো হলো অনেক।
—নাহ। তুমি রান্না করে খাইয়েছো যে খাবো?
যদিও নিশীথ খেয়েছে তবুও মজার ছলে মিথ্যে কথা বললো। দোলা তা ধরতে পারলোনা। ও হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। নিশীথ বললো,
—আমি এখন বাইরে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। ঘণ্টাখানেক পরে বাসার ওদিকে ফিরবো। তোমার সাথে দেখা করবো কিন্তু। কল দিলেই বেরিয়ে আসবে, ঠিকাছে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৭ (২)

—হুম।
দোলা ছোট্ট করে জবাব দিয়ে ফোন রাখলো। নিশীথও আর কিছু বললোনা। ও একমনে ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। এদিকে দোলা মিনিট পাচেক লাগিয়ে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর দুপাশে আড়াআড়ি করে ওড়না বেধে রান্নাঘরে ঢুকলো। ওর উদ্দেশ্য, আজ প্রথমবারের মতো নিশীথের জন্য নিজ হাতে কিছু রান্না করা!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৯