নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৫ (২)

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৫ (২)
Mousumi Akter

সৈয়দ মুনসুর আলী বললেন, “তুমি দ্যাখছ পোলাডারে?”
“হ, দেখছিলাম। আমাগো জমিন নিয়া শালিস হইলে পোলাডা মেম্বারের বাড়িত আইছিল। তাছাড়া আগেও নাম হুনছি বহুবার। গেরামের পোলাই তো।”
“হ, বেশি একটা আহে না গেরামে। ওর বাপ আহে মাঝে মাঝে। বড়ো কোনো ঝামেলা হইলে মিটমাট করতে আহে।”
“আমাগো জমিন নিয়া ঝামেলা হইলে আইছিল তাই দেখার সুযোগ হইছিল।”
“কতা কইছ?”

“না, আমি দূর থেইকাই দেখছি। পোলাডারে আমাগো বাড়িতে একদিন দাওয়াত দিয়া আইনা একটু আপ্যায়ন করতে হইব।আমাগো জমিনের ঝামেলাটা যাতে মিটাইয়া দেয়। সেই ব্যাপারেও কইতে হইব।”
“গরিবের বাড়িতে কি আর হাতির পা পড়ব রজনীর মা?”
“পোলাডা বিলাতও গেছিল লেখাপড়ার লাইগা। আল্লাহ সব দিক দিয়াই গুণ দিছে।”
“মাইনষের অনেক সাহায্যও করে হুনছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আর আমাগো বে**জন্মার লাইগা মুখ দেখান যায় না।”
“ওরে নিয়া ভাইবা সময় নষ্ট না কইরা আমার মাইয়ার বিয়ার ব্যবস্থা করো। মাইয়্যাডারে ভালা ঘরে দিতে পারলেই শান্তি। রজনীর জন্য যে পাত্রডা আয়ছিল তারা কি কোনো সংবাদ পাডাইছে?”
“তারা কইতাছে বিয়া করব না। কাহিনিখান কী বুঝলাম না। আমারে বাড়িতে দাঁড়াইতে দেয় নাই। এই মাইয়াই লাগব। এহন এমন পস্তাবের কারণ খানাই বুঝলাম না। গাউ-গেরামের লোক ধরছে আমার মাইয়ার জন্য, এহন কাইল রাইতে খবর দিয়া পাডাইছে যে, এখন তাদের অসুবিধা আছে বিয়া করতে পারবে না।”

“বিয়া না করুক আলহামদুলিল্লহা। কিন্তু কারণডা কী তা কিছু কইছে?”
“আজ গিয়া হুনুম দেখি কারণডা কী।”
রজনী বেশ অবাক হলো তার মা-বাবার কথা শুনে। কার-ই বা এত প্রশংসা করল আর কার সাথেই বা বিয়ে ঠিক করল! রজনী লেখাপড়া শিখতে চায়। সে আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। বিয়ে করার ইচ্ছা নেই। এই গ্রামে এসএসসির পরে মেয়েরা আর কেউ তেমন লেখাপড়া করে না। কিন্তু রজনী চায় পড়তে।

রজনী আস্তে করে এসে বাবার পাশে দাঁড়াল। সৈয়দ মুনসুর আলী মেয়েকে দেখে বললেন, “মা চিরুনিডা নিইয়া আসো।মাথাডা এমন পা’গ’লীর মতো আছে ক্যান? আমার কি নারকেলের অভাব? আমার রজনীর মাথায় ত্যাল থাকে না!”
রজনী তেলের শিশি এনে বাবার হাতে দিল।মুনসুর আলী তার বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমারে না কইছি সব কাজকাম পরে। আগে আমার মাইয়ারে সাজায়-গুছায় রাখবা।”

“আমি করার আগেই তো তুমি কইরা দাও।”
“তা করুম না? আমার তো একটামাত্র মাইয়া।”
মুনসুর আলী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আইজ কলেজে যাইবা না।?”
“না বাবা, শরীর ভালো লাগছে না।”

“আইজ বাড়িতে শুইয়া থাহো। যাওনের দরকার নাই। আমি তোমার মাথায় ত্যাল দিয়া দিতাছি। আরাম লাগব মা।”
রজনী একটা টুলে বসেছে। মুনসুর আলী মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। বাবা মেয়ের কী অপূর্ব সুন্দর মুহূর্ত। রজনী ছোটোবেলা থেকে মা-বাবার পরম আদরের। বেশ মন খারাপ করে রজনী বলল, “আব্বা, আমি পড়তে চাই, চাকরি করতে চাই। তোমাদের দায়িত্ব নিতে চাই।”
“পড়বা মা, সমস্যা কী? যত ইচ্ছা পড়বা।”

“তাহলে বিয়ে দিতে চাইছ ক্যান আব্বা? আমি কি বোঝা হয়ে গেছি আব্বা? এত ভালোবাসার পরেও আমাকে তোমরা ঝামেলা মনে করছ, বিদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছ। তোমাদের ভালোবাসা কি তাহলে দেখানো আব্বা?”
মুনসুর আলীর বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল।মেয়ের কথায় যেন হৃদয়টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তার মেয়ের এমন মলিন মুখ সে সহ্য করতে পারে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মুনসুর আলী। মলিন কণ্ঠে বলল,

“মাইয়্যা কখনো বোঝা হয় না রে মা। সৃষ্টির শুরু থেইকাই এই নিয়ম চইলা আইতাছে মা।”
“নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর মেয়েরা বোঝা হয়ে যায় আব্বা। এটা বুঝে গেছি আমি।মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটা এত কষ্টের আগে বুঝিনি আব্বা। আগে নিজেকে রাজকুমারী ভাবতাম; কিন্তু আমি ভুল জানতাম এই রাজ্য আমার নয়।”
আয়েশা বেগম রান্নাঘর থেকে মেয়ের কথা শুনে বললেন, “মা, তুমি সত্যি রাজকুমারী।আজ তোমার বাবার কাছে রাজকুমারী; এর পরে এক রাজকুমার আইসা তোমাকে তার রাজ্যর রাজরানি কইরা নিয়া যাইব।”
“পরের ছেলে আমাকে রাজরানি করবে কেন? অকারণ কেউ কেন এত দাম দেবে আম্মু?”

আয়েশা বেগম হাসলেন। হেসে বললেন, “তোমার আব্বা দুইডা ট্যাহা হইলেও আমার হাতে আইনা দেয়। ক্যান দেয় কও? তোমার আব্বার রোজগারে এই সংসারডা চলে; অথচ সব সিদ্ধান্ত আমিই লই। তোমার আব্বা আমার থেইকা পরামর্শ নিয়াই সব সিদ্ধান্ত নেয়। কেন নেয় কও মা? এই সংসারের সব কিছুর রাজত্ব তো আমিই করি। তোমার আব্বা কোনো রাজ্যের রাজা না হইলেও এই সংসারের রাজা হেই। আমি রানি আর তুমি রাজকুমারী।”
“আমার আব্বার মতো কি সবাই ভালো আম্মু?”

“সব পুরুষই ভালা মা। একটা জিনিস মাথায় রাইখবা শুধু। পুরুষ মাইনষে কারো দাসত্ব করতে পছন্দ করে না। তাদের সাথে জোরে কথা কওন যাইব না, হুকুমও করোন যাইব না। তারা হুকুম মানতে চায় না। তাগো লগে বেশি বাড়াবাড়িও করোন যাইব না। তাগোরে ভালোবাসতে হইব। ভালোবাইসা কইলে পুরুষ মাইনষে জা’নও দিবার পারে।”
মায়ের কথায় ভাবনার অতলে বিভোর হলো রজনী।

কলেজ টাইমে কলেজে গেটে দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তিক। সকাল দশটা অভার হয়ে গিয়েছে।রজনী কলেজেই প্রবেশ করেনি। খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। রজনী আজ খেয়াও পার হয়নি। শ্রাবণের থেকে নিউজ নিয়ে সিগারেট ধরাল। একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। কেন আসেনি? ওর কি শরীর খারাপ? দুশ্চিন্তায় কেমন অস্থির হয়ে পড়ল প্রান্তিক। পকেট থেকে ফোন বের করে শ্রাবণকে কল দিয়ে বলল,

“ঘাটেই দাঁড়া, আমি আসতেছি।”
“কোথায় যাবেন ভাই?”
“শ্বশুরবাড়ি।”
“ভাবিদের বাড়ি যাবেন।”
“হ্যাঁ।”
“গিয়ে কী বলবেন? মাইন্ড করবে না?”
“আমি গেলে জামাই আদর করবে শ্বশুর-শাশুড়ি।”
“আর ভাবি? ভাবি তো রে’গে যাবে।”

“তোর ভাই কি যেমন-তেমন চিজ? কীভাবে রা’গকে প্রেমে পরিণত করতে হয় তা তোর ভাই ভালোই জানে।”
দশমিনিট পরে প্রান্তিক শ্রাবণের কাছে পৌঁছাল। শ্রাবণ গিয়ে প্রান্তিকের বাইকের পিছনে বসল। প্রান্তিক বাইক চালাতে চালাতে আয়নায় নিজের চেহারা দেখছে বারবার। শ্রাবণকে বলল, “দ্যাখ তো আমাকে কেমন লাগছে?”
“পুরাই ড্যাশিং ভাই।”
“পাম?”

“ভাই আপনি নিজেও জানেন আপনি কত সুন্দর। তবুও এইসব কী জিজ্ঞেস করেন?শ্রাবণের ভাই নিঃসন্দেহে একজন হিরো।তাও সুপার হিরো।”
“তোর ভাবি পছন্দ করে না কেন?”
“ভাই, ভাবি আপনারে দেখেই ক্রাশড। বাট অন্য কোনো কারণে রাগান্বিত। বিষয়টা পরে জানা যাবে।”

আরও দশ মিনিট পরে প্রান্তিকের বাইক গিয়ে থামল মুনসুর আলীর উঠানে। তখন মুনসুর আলী বাড়িতেই ছিলেন। খেত থেকে তাজা সবজি তুলে এনেছেন। আয়েশা বেগম সাথে সবজি মে’পে দিচ্ছেন। প্রান্তিককে দেখে মুনসুর আলী ভীষণ অবাক হলো। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে, দেখো দেখো ক্যাডাই আইছে। আজই না আমরা বাজানের কথা কইতেছিলাম?”
আয়েশা বেগমও ভীষণ অবাক হলেন। সাথে আনন্দিত হয়েই বললেন

“হ কইতেছিলাম তো। গরিবের বাড়িতে হাতির পাড়া! ভাবতেই তো পারতাছি না।”
প্রান্তিক নমনীয়ভাবে বলল, ‘প্লিজ আপনারা এভাবে বলবেন না। আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কিন্তু।”
আয়েশা বেগম মেয়েকে ডেকে বললেন, “মা রজনী, শিগগিরি দুইডা চেয়ার নিয়া আয় মা।”
রজনী দু’টো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে ঘর থেকে বের হলো।
শ্রাবণ এগিয়ে গিয়ে চেয়ার দু’টো ধরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম ভাবি, সুপ্রভাত। কেমন আছেন? ভাইকে দেখুন– আজ পুরাই ড্যাশিং লাগছে।”

রজনী হিংস্র চোখে তাকাল শ্রাবণের দিকে।শ্রাবণ চেয়ার দু’টো এনে রাখল।
মুনসুর আলী বললেন, “বাজান, কিছু মনে কইরো না। তুমি আইছ আমি অনেক খুশি হইছি; কিন্তু ক্যান আইছ বাজান? না মানে– তুমি তো এমনে আসা পোলা না।”
“মনে হচ্ছে– জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে এসেছি।”
“কী কাজ বাজান?”

প্রান্তিক রজনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার জমির দলিলটা নিয়ে আসুন।জমিটা আপনারই থাকবে। চিন্তা করবেন না।”
মুনসুর আলী খুশি মনে জমির দলিল আনতে গেলেন। যাওয়ার সময় আয়েশা বেগমকে বললেন, “যাও, দ্রুত সেমাই রান্না করো।”
আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ছুটল। রজনী মনে মনে বলল, “কী মিথ্যুক! দলিল দেখতে এসছে!”
প্রান্তিক রজনী দিকে তাকিয়ে বলল, “কলেজ নেই আজ?”

“আছে।”
“যাওনি কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
প্রান্তিক শ্রাবণকে উদ্দেশ্য করে বলল, “শ্রাবণ, তোর ভাবি সব সময় রেগে থাকে কেন?”
“ভাই, বাড়িতে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৫

রজনীর মুখের উপর সোজা সূর্যের কিরণ পড়ল। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। প্রান্তিক এগিয়ে গিয়ে রজনীর মুখের সামনে চওড়া হাতটা ধরে বলল,
“তুমি না হয় রোজ রোদ্র হয়েই এসো আমার আঙিনায়। আমি রোজ গায়ে রোদ্র মেখে তোমায় অনুভব করব।”
রজনী আবারও হিংস্র চোখে তাকাল।
প্রান্তিক আবারও বলল, “এত নেশা কেন বালিকা তোমার দু’চোখ জুড়ে? এই নেশা আমি কাটিয়ে উঠতে পারব না কখনোই।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৬