নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৮

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৮
Mousumi Akter

আমি কি ম’রে গিয়েছি না কি বেঁচে আছি?এই মুহূর্তে কি আমি কবরের মাঝে আছি, চারদিকে এত অন্ধকার কেন? গায়ের উপর সাদা কাপড় কেন? ও আমাকে মে’রে ফেলবে। কেউ বাঁচাও আমাকে। চোখ বন্ধ করে অচেতন অবস্থায় বিড়বিড় করে যাচ্ছে রজনী। ডাক্তার অনিমেষ সাহা বিশ মিনিট ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রজনীর জ্ঞান ফেরানোর জন্য। কিন্তু জ্ঞান ফিরছে না।পাশেই প্রান্তিক দাঁড়িয়ে আছে।

ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। অস্থিরতায় উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে। জ্ঞান ফিরছে না দেখে চট করে বাইরে গেল প্রান্তিক। খুব বেশি টেনশন হচ্ছে তার। বেশি টেনশন হলেই স্মোক করা লাগে। প্রান্তিক বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। তিন চার টান দিয়ে সিগারেট ফেলে জুতার নিচে আ’গুন পিষে দু’মিনিটের মাঝে ফিরে এলো। সিগারেটও তাকে টানতে পারছে না। রজনীর মুখের দিকে প্রান্তিক তাকিয়ে মনে মনে বলল, “তুমি আমায় কীসের নেশায় জড়ালে রজনীগন্ধা? স্মোকের নেশা আমার কেউ ছাড়াতে পারেনি। আজ তোমার নেশা আমাকে স্মোক থেকে চুম্বকের ন্যায় তোমার কাছে টেনে এনেছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনিমেষ সাহাকে একটু ব্যস্ত দেখাচ্ছে।বারবার ফোন আসছে আর হাত ঘড়ি দেখছেন। ডাক্তার অনিমেষ সাহার সাথে দুজন নার্সও দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার অনিমেষ সাহা নার্সদের বললেন, “তোমরা খেয়াল রাখো, আমি রাউন্ড দিয়ে আসছি।কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান ফিরে আসবে।”– বলেই ডাক্তার অনিমেষ সাহা ইমারজেন্সি ওয়ার্ড ত্যাগ করার জন্য উঠলেন।

আচমকা ডাক্তার অনিমেষ সাহার সামনে ক্রোধান্বিত চোখে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াল প্রান্তিক।থুতনিতে হালকা ক্ষত এখনও র*ক্ত লেগে আছে। থুতনি বেয়ে গলা বরারবর সাদা শার্ট ভিজেছে র* ক্তে। আচমকা এমন ভয়ানক চেহারার একটা ছেলেকে সামনে দাঁড়াতে দেখে ডাক্তার অনিমেষ সাহা ভ*য় পেয়ে গেলেন। অনিমেষ সাহা হসপিটালে নতুন।তাই প্রান্তিককে চিনেন না। তবে বুঝতে পারলেন সাধারণ কেউ নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “এ কি! আপনার থুতনি কাটল কীভাবে? নার্স এনাকে ড্রেসিং করে দিন।”

প্রান্তিক থমথমে গম্ভীর-রাগান্বিত মুডে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এখনি ডাক্তার অনিমেষ সাহাকে ভস্ম করে দিবে। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে কঠিন মেজাজে বলল, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন ডাক্তার?”
“আমার রাউন্ড আছে।”
“এখানে একটা মেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে আর আপনি রাউন্ডে যাচ্ছেন?”
“দেখুন, আপনি শান্ত হন। আপনার ওয়াইফ এখনি সুস্থ হয়ে যাবে। আমি সবরকম ভাবেই চেক করেছি। কোনো প্রব্লেম নেই।”

ওয়াইফ কথাটা শুনেই প্রান্তিক রজনীর মুখশ্রীতে দৃষ্টি দিল। লিপলাইনার দিয়ে আঁকানো ঠোঁট দুটো যেন কৃত্তিম সাজে আরও বিশ্রী করে ফেলেছে রজনী। কী দরকার এসব লিপলাইনার দিয়ে আঁকানো বা গাঢ় লিপিস্টিক পরার? তার ঠোঁট দুটো তো এমনিতেই সৃষ্টিকর্তার অপুর্ব সৃষ্টি। ঠোঁট থেকে চোখ সরিয়ে রজনীর চোখের দিকে তাকাল। এই হরিণী চোখে দুটো কত সুন্দর।রজনীর মুখশ্রী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রান্তিক বলল, “প্রব্লেম নেই তাহলে ও এখনও চোখ খুলছে না কেন? আনসার মি, কীসের ডাক্তার আপনি? একটা মেয়ের চোখ খোলাতে পারছেন না!”

“খুলবে।”
“খুলবে আর খুলেছে এর মাঝে বহুত তফাত।”
“একটু শান্ত হন। আমি রাউন্ড থেকে এসেই আবার দেখছি।”
“ রাউন্ড ফাউন্ড সব বাদ। ও সুস্থ না হলে আপনি জাস্ট নড়তেও পারবেন না। কোনো রাউন্ড হবে না।”
“মিস্টার প্রান্তিক, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। শান্ত হন আপনি। আপনার নিজেরও ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। আপনার চোট লেগেছে।”

“এসব সামান্য চোটে প্রান্তিকের কিচ্ছু হয় না। আমার যা হয়ে যাচ্ছে আপনি তা বুঝবেন না ডাক্তার। ওর অচেতনতা আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে। আপনি আমার শরীরের সামান্য ক্ষত দেখতে পাচ্ছেন বাট ভেতরের ক্ষত দেখতে পাচ্ছেন না।”
“আপনাকে তো বলেছিলাম আমরা ভিন্নভাবে ট্রাই করি। বাট আপনি বললেন ও ব্যথা পাবে।”
“ওর চোখের শিরা চেপে ধরলে তো ও ব্যথা পাবেই।”
“ও ব্যাথা পাবে না। এটা আমাদের ট্রিটমেন্টেরই একটা অংশ।”
“ওকে, বাট ও যেন ব্যথা না পায়।”
“ওকে, আমরা চেষ্টা করছি। নার্স, দেখো।”

প্রান্তিক বলল, “একদম সাবধানে। ও যেন একটুও ব্যথা না পায়।”
নার্স রজনীর ভ্রুর নিচে চোখের উপরের শিরা চেপে ধরল। সাথে সাথে রজনী চিৎকার দিয়ে উঠল। নার্সের হাতে ছিল বড়ো নখ।নখের আঁচড়ে চোখের উপরে খানিকটা কেটে গেল। সাথে সাথে র* ক্ত গড়িয়ে পড়ল। ডাক্তার অনিমেষ সাহা বললেন, “ওহ শিট! এটা কী করলে?”

প্রান্তিকের সমস্ত শরীর রাগে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। ডাক্তার অনিমেষ রজনীর চোখের উপরে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে বললেন, “কুইকলি তুলা এগিয়ে দাও।”
ডাক্তার অনিমেষ এবং নার্স প্রান্তিকের অগ্নিমূর্তির ন্যায় চেহারা দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলেন। প্রান্তিক গর্জে উঠে বলল, “এটা কী করলেন আপনি?”

বলেই নার্সের হাতের অতিরিক্ত নখ ভেঙে দিল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “চাঁদে কলঙ্ক লেপে দিলেন আপনি। আমার চাঁদে কোনো দাগ নেই, কোনো কলঙ্ক নেই। আপনি সেই সর্বনাশটা করলেন। একদমই ছাড়ব না আপনাকে।”
“অসাবধানবশত লেগে গিয়েছে।”
“অসাবধান হতে কে বলেছে? আর হাতে নখ রেখেছেন কেন? নখ রেখে বলছেন অসাবধানবশত লেগেছে। এখানে কি মডেলিং করতে এসছেন?”

ডাক্তার অনিমেষ বললেন, “মিস্টার প্রান্তিক, আপনার ওয়াইফের জ্ঞান ফিরে এসছে।”
সাথে সাথে রজনী চোখ মেলে তাকাল। সে কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে না।আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল এটা হসপিটাল। ডাক্তার আবারও বললেন , “মিস্টার প্রান্তিক, দেখেছেন কেমন হাইপার হয়ে গিয়েছিলেন আপনি আপনার ওয়াইফের জন্য? নিন এবার তার পাশে আসুন; এসে বসুন।”

প্রান্তিকের সেই রাগান্বিত চেহারা সাথে সাথে শান্তশিষ্ট হয়ে গেল। সেই ভয়ানক চেহারা আর নেই। শান্ত চোখে রজনীর দিকে তাকাল। রজনীও প্রান্তিকের দিকে তাকাল। ব্লু জিন্স, গায়ে সাদা শার্ট, হাতে ঘড়ি, থুতনিতে কাটা দাগ, এই ভয়ানক দানবের ন্যায় লম্বা-ফরসা ছেলেটাকে ডাক্তার তার স্বামী বলে আখ্যায়িত করছে কেন? এই খারাপ মানুষটা তার স্বামী হতে যাবে কেন? এই মানুষটাকে রজনী প্রচণ্ড ভ*য় পায়।কারণ তার জীবনে এর আগে এত ভয়ংকর মানুষ আর দেখেনি।
প্রান্তিক রজনীর মাথায় হাত রেখে বলল, “কেমন লাগছে তোমার?”

ভ*য়ে রজনীর ঠোঁট কাঁপছে। এখনি কেঁদে দেবে দেবে ভাব। প্রান্তিক বুঝতে পারল রজনী ভ*য় পাচ্ছে।
প্রান্তিক স্বাভাবিক স্বরে বলল, “এখন কেমন লাগছে?”
“আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন, আমি এখানে কেন?”
প্রান্তিক রজনীর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সেদিনের মতো আজও আমার বুকে এসে পড়েছিলে। উফফ! একদম হার্টফেইল হয়ে যাচ্ছিল আমার রজনীগন্ধা।”

রজনী রাগী চোখে তাকাল প্রান্তিকের দিকে। প্রান্তিক এটাই চাইছিল। রেগে গেলেই ভ-য় কেটে যাবে। রাগী চোখে তাকালেই ভ-য় উধাও হয়ে যাবে রজনীর। রজনীর এই রা’গী চোখের চাহনিতে প্রান্তিক আরও বেশি মুগ্ধ হয়। মুগ্ধতার পরিমান বাড়াতেই বলল, “আমার তোমাকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে– তোমার ঠোঁটে। তোমার ঠোঁটে কেমন একটা নেশা কাজ করে। আমার আদর করতে ইচ্ছা করে। তোমারও কি তাই ইচ্ছা করে রজনীগন্ধা? আমার বুকে এসে বার বার পড়ছ।”

“আমি বাড়ি যেতে চাই।”
“এখন নয়, অতিরিক্ত শরীর দূর্বল তোমার।দু-ঘণ্টা না গেলে যাওয়া যাবে না।”
“দু’ঘণ্টা কী করব আমি? আমার বাবা চিন্তা করবেন।”
“শ্বশুরকে জানিয়ে দিয়েছি– তার মেয়ে তার জামাইয়ে কাছেই আছে।”
“মানে?”
“মানে আবার কী? শ্বশুর বুঝে নিয়েছে বাকিটা।”
“বাকিটা মানে?”

“তার মেয়ে আর জামাই একটু বিশেষ সময় কাটাচ্ছে।”
“আপনি আমার বাবাকে এসব বলেছেন?”
“বলিনি; তবে এখনি যেতে চাইলে বলব। একজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি তুমি একটু কেনাকাটা করছ। খবরটা তোমার হয়েই দিয়েছে সে।”
“অদ্ভুত!”
প্রান্তিক নার্সকে বলল, “স্যরি ফর মিসবিহেভিয়ার। ওকে কেউ আঘাত করলে আমার বুকে এসে লাগে। আপনিও আর এমন বড়ো নখ রাখবেন না। এটা ভালো নয়। আর আমরা দু’ঘণ্টা থাকব। কেবিন দিন একটা রেডি করে। দু’দিনের পেমেন্ট করে দিচ্ছি।”

নার্স কেবিন রেডি করে দিল। রজনী, প্রান্তিক আর শ্রাবণ কেবিনে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর প্রান্তিক একটু বাইরে গেল। শ্রাবণ রজনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবি, আপনি ভাইকে ভুল বুঝছেন? ভাই কিন্তু অনেক ভালো মানুষ।”
প্রান্তিক নেই এই সুযোগে রজনীর একটু সাহস হলো কথা বলার। রজনী ফুঁসে উঠে বলল, “এই চামচা, আপনি এত চামচামি করেন কেন?”

“ কী! আমাকে চামচা বললেন ভাবি?”
“এ্যাই, আমি আপনার কোন জন্মের ভাবি?খবরদার ভাবি ডাকবেন না।”
“ভাবিকে কী ডাকব?”
“কিছুই না। গুণ্ডা বদমায়েশের মুখে কিছুই শুনতে চাই না আমি।”
“দেবরকে এগুলা কী ডাকেন ভাবি?”

“ উফফ! আবার ভাবি! আমি ম’ রে গেলেও আপনার ভাইকে বিয়ে করব না। আমার একজন পরিচিত আছে। আপনার ভাইকে টাইট দিয়ে ছাড়ব। এমন শিক্ষা দিব না….”
এরই মাঝে প্রান্তিক রুমে প্রবেশ করে বলল, “ম’রে গিয়ে বিয়ে করে ভূ*ত-পে* ত্নী হয়ে সংসার করলেও আমার সাথেই সংসার করতে হবে।”

প্রান্তিককে রজনী ভীষণ ভ*য় পাই। তাই প্রান্তিকের সামনে কিছুই বলতে পারে না।কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
প্রান্তিক রজনীর পাশে বসে বলল, “নিজের বরকে কাকে দিয়ে টাইট দেওয়াতে চাও? পৃথিবীর কারো তো সেই ক্ষমতা নেই। চাইলে তুমিই টাইট দিতে পারো।”
রজনী কোনো উত্তর দিল না। প্রান্তিক বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। কয়েক প্রকার খাবার। গোরু, খাসি, মুরগি এই তিন প্রকার মাংস, কয়েক প্রকার মাছ, ড্রিংক্স, দধি সব নিয়ে এসেছে। রজনীর সামনে সব খাবার খুলে খেতে বলল। শ্রাবণও খাওয়া শুরু করল। রজনীকে চুপচাপ থাকতে দেখে প্রান্তিক বলল, “খাবে না কি খাইয়ে দিতে হবে?”

“আমি খাব না।”
“বুঝেছি, আমার হাতে খাওয়ার বাহানা।”
বাধ্য হয়ে রজনী এক টুকরো মুরগির মাংস নিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করল। এরই মাঝে শ্রাবণের ফোন বেজে উঠল। শ্রাবণ বাম হাত দিয়ে ফোন রিসিভ করে কাঁধের উপর ফোন রেখে কান চেপে কথা বলছে। সাথে সাথে ফোনটা লাউডস্পিকার হয়ে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠে বলে উঠল, “আচ্ছা দেবর জি, তোমার ভাই কোথায়?”
শ্রাবণ প্রান্তিকের দিকে তাকাল। প্রান্তিকও তাকাল। শ্রাবণ বলল, “কে আপনি আন্টি?”

“আন্টি! বেয়াদব একটা। প্রান্তিক কোথায়?”
“ভাই বিজি আছে। কে আপনি? কিছু বলবেন?”
“ওই, আমি জারা। প্রান্তিক ফোন তুলছে না কেন? কাল আমাদের রিসোর্টে দেখা করার কথা। এক মাস আগে ডেট ফিক্সড করা।এখন সে ফোন তুলছে না।”
“আপনি রং নাম্বারে ফোন দিছেন খালা।”– বলেই শ্রাবণ ফোনটা কেটে দিল।
রজনী খুব বাজেভাবে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ঠিক কয়টা প্রেমিকা? কেউ কামিনী ফুলের সুবাস, কারো সাথে রিসোর্টে যান। ছি!”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৭

প্রান্তিক বিরক্ত চোখে মুখে বলল, ‘শিট!শ্রাবণ, হু’জ দ্যা গার্ল?”
“চিনি না ভাই।”
“তোর ভাবি আমাকে এইবার আরও ক্যারেক্টারলেস ভাববে।”
রজনী খাবারে পানি ঢেলে দিল। হঠাৎ কী কোনো কারণে রাগ হলো? রাগের কারণ কী নিজেও বুঝল। কেন রাগ করল? মানুষ নিজের অজান্তেই ঘৃণাভরা মানুষের মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে নিজেই বুঝতে পারে।রজনীরও কি তেমনই হলো? এই মুহূর্তে উত্তরটা ঘোলাটে।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৯