নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৮

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৮
লেখিকাঃ Tamanna Islam

মাঝখানে চলে যায় আরো ৭ দিন। আব্রাহাম আঠার মতো আইরাতের পেছনে লেগেই থাকে। তাকে জ্বালানো, তাকে এটা-ওটার অর্ডার করা, হুট হাট কোন প্ল্যান ছাড়াই আইরাতকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে পরা। এগুলো যেন আব্রাহামের প্রতিদিন কার কাজ। আজও অফিসের কাজ বাদ দিয়ে এই দুই ল্যায়লা-মাজনু বাইরে বের হয়ে পরেছে। তবে আইরাত কথা বলছে না, কারণ সে জানে যে এখন আব্রাহাম কে জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। কথার ভাজে কথা ঘুড়িয়ে দিবে সে। তাই দুই হাত ভাজ করে শুধু বসে আছে। আব্রাহাম গাড়ি এনে সোজা তার বাসার সামনে থামে। আইরাত আব্রাহামের দিকে তাকায়। সে এই সময়ে তাকে তার বাসায় নিয়ে এলো কেন!

আইরাত;; আপনি এখানে কেন আনলেন আমায়?
আব্রাহাম;; মন চাইলো তাই এনে পরলাম।
আইরাত;; কিন্তু…
আব্রাহাম;; জলদি নামো।
আইরাত নেমে পরলো। আব্রাহাম একটা গার্ড কে চাবির থুকা টা ঢিল দেয় আর সে তা ধরে ফেলে। তারপর গাড়ি টা পার্ক করে দেয়। আব্রাহাম আইরাতের হাত ধরে ভেতরে আসে। ভেতরে এসেই দেখে আব্রাহামের দাদি ইলা পানের বাটা নিয়ে বসে আছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আব্রাহাম;; ওইতো আবার শুরু হয়েছে। দাদি তোমার এই পান খাবার অভ্যাস টা গেলো না এখনো। তুমি জানো এগুলো কত্তো ক্ষতি করে মানুষের বডিতে।
ইলা;; আরে আমি তো।
আব্রাহাম;; রাখো তুমি এগুলো, রাখো।
আব্রাহাম এক রকম জোর করেই তার দাদির হাত থেকে পানের বাটা টা সরিয়ে দেয়৷ আর আইরাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাদি-নাতির এগুলো কান্ড দেখছিলো। ইলা এতোক্ষণে আইরাতকে খেয়াল করে।
ইলা;; আরে আইরাত!
আইরাত;; জ্বি
ইলা;; কেমন আছো?

আইরাত;; আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনি?
ইলা;; হ্যাঁ এইতো ভালো, আরে বসো বসো।
আইরাত গিয়ে ইলার পাশে বসে। কিছুক্ষন খোশগল্প করে। আব্রাহাম হুট করেই বলে ওঠে…
আব্রাহাম;; বেবিগার্ল!
আইরাত;; কি?
আব্রাহাম;; বড্ড বেশি ক্ষুদা পেয়েছে আমার যাও রান্না করো।
আইরাত;; এহ?
আব্রাহাম;; হ্যাঁ যাও৷

ইলা;; এই পাগল হয়েছিস তুই? মেয়েটা এসেছে মাত্র আর তুই ওকে রান্না করতে বলছিস?
আব্রাহাম;; আরে দাদি রাখো তো। আইরাত জান তুমি যাও।
আইরাত;; হারামি তুই এখানে নিয়ে এসেছিস আমাকে দিয়ে রান্না করানোর জন্য (মনে মনে)
আব্রাহাম;; যেভাবে তাকিয়ে আছো দেখে মনে হচ্ছে মনে মনেই প্রচুর গালি দিচ্ছো।
আইরাত;; আরে না না।
আব্রাহাম;; তো যাও রান্না করো। রান্নাঘর ওইদিকে।
আইরাত;; আচ্ছা কি রানবো?
আব্রাহাম;; বিরিয়ানি।

আইরাত;; কিহ বিরিয়ানি?
আব্রাহাম;; চেহারার নকশা পালটে ফেললে কেনো, যাও
আইরাত;; আব..আসলে আমি না পারি না।
আব্রাহাম;; কি?
আইরাত;; আসলে মানলাম যে আমি এর আগে রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি কিন্তু সেখানে আমি রান্না করতাম না। খুব কম। ফাস্ট ফুড গুলো তাও। এইসব বড়ো বড়ো খাবার আমি পারি না।
আব্রাহাম;; প্রব্লেম নেই, যেমন পারো তেমন ভাবেই রানবে। আমি খাবো। নাও গো
আইরাত;; আচ্ছা।

আইরাত চুপচাপ রান্না ঘরে চলে গেলো। একজন স্টাফ এসে আইরাতের সামনে সব কিছু রেখে গেছে। আইরাত কোমড়ে হাত দিয়ে মুখ কে বাংলার পাচ বানিয়ে রেখে দিয়েছে। বুঝতেই পারছে না যে কীভাবে কি করতে হয়। ইলা এসে আইরাত কে একটু হেল্প করতে চাচ্ছিলো কিন্তু তাকেও আব্রাহাম এসে টেনে নিয়ে চলে গেছে। এখানে বেশ গরম আইরাত দরদর করে ঘামছে। আর হাতের উল্টো পাশ দিয়ে বারবার কপালের ঘাম মুছে ফেলছে।

আইরাত আর না পেরে গলার ওরনা টা এক পাশ করে কোমড়ে বেধে ফেললো। আইরাত বিরিয়ানি রান্না করতে যা যা লাগে সব ঠিক ঠাক করে নিলো। একটার পর একটা কাজ করছে। আর তখনই আব্রাহাম এসে রান্নাঘরের দরজার আড়ালে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়ায়৷ আইরাতের এমন হাল দেখে আব্রাহাম মুখে হাত রেখে হাসছে। হঠাৎ আব্রাহাম গলা কিছুটা খাকাড়ি দিয়ে ওঠে। আইরাত পেছন ঘুড়ে তাকায়। দেখে আব্রাহাম দাঁড়িয়ে আছে। আব্রাহামের দিকে তাকাতেই আব্রাহাম তার ভ্রু দুটো নাচায়।

আইরাতের এখন মন টা চাচ্ছে হাতে থাকা খুন্তি টা দিয়ে আব্রাহামের মাথা ফাটাতে। একে তো এত্তো গরম তার ওপর এই রান্না যা সে ঠিক ভাবে পারেও না। উফফফফফ বিরক্তিকর!
আব্রাহাম;; জানপাখি তোমাকে দেখতে এখন পুরোদমে একটা টিপিকাল ওয়াইফ লাগছে জানো!
আইরাত;; আর আপনি একটা কশাই৷
আব্রাহাম;; আমি বাজারে মাংস কাটি না বেইব।
আইরাত;; হ্যাঁ তবে মানুষ কে ঠিকই কাটেন।
আব্রাহাম;; হুমম।

আব্রাহাম সেখান থেকে চলে গেলো। আর আইরাতের অবস্থা কাহিল। তার ঠিক এক ঘন্টা পর আইরাতের বিরিয়ানি রান্না শেষ হয়। একটা পাত্রে বিরিয়ানি নিয়ে আইরাত ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে দেয়। স্মেল তো মোটামুটি ভালোই আসছে৷ আইরাত হাত কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। না জানি কি হয়েছে। ফোনে যে একটু ইউ টিইব থেকে হেল্প নিবে সেই সুযোগ টাও পায় নি। কারণ আব্রাহাম তার ফোন কেড়ে নিয়ে নিয়েছিলো। এত্তো কঠিন তো স্কুলের ফাস্ট ব্রেঞ্চে বসে অংক পরিক্ষাও হয় না। ইলা আগে থেকেই ডাইনিং টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলো। উনি বুঝতে পারছেন আইরাতের অবস্থা টা। মেয়েটা যে কি করেছে আল্লাহ জানেন। আইরাত খুব বেশি নারভাস তা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আইরাতের টেবিলে বিরিয়ানি রাখতেই আব্রাহাম দ্রুত এসে বসে পরে।

আব্রাহাম;; হুমমম স্মেল গুড।
আইরাত;; আমি জানি না এটা কি হয়েছে। বিরিয়ানি নাকি জগা খিচুড়ি ?।
আব্রাহাম;; রাখো তো তুমি। আমাকে খেতে দাও।

আইরাত কাপা কাপা হাতে আব্রাহামের প্লেটে বিরিয়ানি বেড়ে দেয়। ইলার প্লেটেও দেয়। আইরাত ডাইনিং টেবিলের সামনে তার ফিংগার ক্রোস করে চোখ খিচে বন্ধ কিরে দাঁড়িয়ে আছে। “আল্লাহ প্লিজ যেন খেতে ভালো হয়” এটাই বারবার জপ করে চলেছে মুখে। ইলা একবার খেয়েই আইরাতের দিকে তাকায়। আইরাত বেকুল নয়নে তাকিয়ে আছে ইলার দিকে। আইরাতের এমন ভোলাভালা চেহারা দেখে ইলা আর কিছু বলতে পারে না।

শুধু আইরাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। পরক্ষণেই আব্রাহামের দিকে তাকায়। কিন্তু তাকে দেখে আইরাতের কপাল গুলো যেন আরো কুচকে গেলো৷ কারণ আব্রাহামের মাঝে কোন হাবভাব কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে তার মতো করে গপাগপ খেয়েই যাচ্ছে খেয়েই যাচ্ছে। আব্রাহামের খাওয়া দেখে মনে হলো যে বিরিয়ানি বেশ ভালোই হয়েছে। কিন্তু তাহলে ইলা খাচ্ছে না কেন। আইরাত আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললো….

আইরাত;; আচ্ছা খেতে কেমন হয়েছে?
আব্রাহাম;; বেস্ট বিরিয়ানি এভার।
আইরাত;; তাই নাকি? তাহলে তো আমার একটু খেতেই হয়।
যেই আইরাত এই কথা বলে তার সাথে সাথেই ইলা আর আব্রাহাম একসাথে চিল্লিয়ে বলে ওঠে….
ইলা-আব্রাহাম;; না না না না।

আইরাত শুকনো শুকনো মুখে তাকায়। কিন্তু আইরাত জেদ করেই আব্রাহামের হাত থেকে চামচ নিয়ে নেয়। তারপর একটু বিরিয়ানি তুলে মুখে পুড়ে নেয়। ওদিকে ইলা তার হাত কপালে দিয়ে দিয়েছে। আর আব্রাহাম তার বাম হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। কিন্তু আইরাত তো বিরিয়ানি একবার খেয়েই দিন দুপুরে চোখে সরষে ফুল দেখছে৷ আইরাত কি করবে কি না করবে কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। দৌড়ে বেছিং এ চলে যায়। এত্তো জোরে জোরে কাশি দিচ্ছে যা বলার বাইরে। একদম নাকে-মুখে হয়ে গেছে৷ আব্রাহাম গিয়ে আইরাতের পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে থাকে আর পানি খাইয়ে দিচ্ছে। কাশি কিছুটা কমলে আইরাত এসে আবার বসে পরে।

আইরাত;; এটা বিরিয়ানি নামে কলঙ্ক। আপনি খাচ্ছেন কীভাবে?
আব্রাহাম;; তোমার কাছে খারাপ হতে পারে কিন্তু আমার কাছে না।
আইরাত;; দাদি আপনি ঠিক আছেন৷ আপনার কিছু হয় নি। ইশশশ এটা খাওয়ার অযোগ্য।
আব্রাহাম;; এই একদম চুপ৷ খবরদার যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছো তো৷ ঠিকই আছে আর আমার কাছে এটাই ভালো।
ইলা হেসে দেয় এই দুইজনের কথা শুনে।

আইরাত;; দাদি প্লিজ আমাকে আগে বিরিয়ানি রান্না করা শিখাবেন।
ইলা;; একটা শর্তে!
আইরাত;; সব শর্ত রাজি। কিন্তু শর্ত টা কি?
ইলা;; এই যে এই আপনি আপনি ডাক বন্ধ করতে হবে। আব্রাহাম যেভাবে ডাক ওইভাবেই ডাকতে হবে।
আইরাত;; আচ্ছা রাজি৷

আইরাত উঠে গিয়ে ইলার পাশে বসলো। আইরাত আর ইলা মুখে হাত দিয়ে আব্রাহামের কান্ড দেখছে৷ আব্রাহামের কোন কিছুই হচ্ছে না এগুলো খেয়ে৷ বিরিয়ানি প্রচুর ঝাল হয়েছে,, চাল গুলো কেমন যেন শক্ত শক্ত, হ্যাঁ তবে মাংস অনেক সুন্দর ভাবেই হয়েছে। তবে আর বাকি কিছু ঠিক হয় নি। দেখতে দেখতেই এভাবে আব্রাহাম পুরো প্লেট শেষ করে উঠলো। আইরাত অবাক হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছে।
আইরাত;; দেখুন পরে যদি ফুড পইজন হয় তাহলে প্লিজ আমায় বকবেন না৷
আব্রাহাম;; আহা, এখন তো আমার এই বিরিয়ানি প্রতিদিন চাই।
আইরাত;; ?
আব্রাহাম;; ?

আব্রাহামের সব উলটা পাল্টা কাজ শেষ হলে তারা এসে পরে সেইদিন কার মতো।
আইরাত;; এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আব্রাহাম;; কেন আরো কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
আইরাত;; আব.. না।
আব্রাহাম;; তাহলে এখন বাসায়।
আইরাত;; আচ্ছা।

আব্রাহাম আইরাতকে তার বাসার সামনে রেখে চলে যায়। আব্রাহাম যখন আইরাতকে তার বাসার সামনে ড্রপ করে দেয় তখন তা ইকবাল সাহেব ওপর থেকে দেখেন। তারপর ভেতরে চলে যান। আইরাত বাসায় ভেতরে গিয়ে দেখে কলি রান্না করছে। আইরাতকে দেখে কিন্তু কিছু বলে না। আইরাত সোজা তার রুমে চলে যায়। তার কিছুক্ষন পরেই রনিত আসে তার রুমে।

আইরাত;; কিরে ছোটু কিছু কি বলবি?
রনিত;; তুমি জানো বাড়িতে কি হচ্ছে?
আইরাত;; না তো। কেন কি হয়েছে?
রনিত;; আরে বিয়ে।
আইরাত;; বিয়ে মানে?
রনিত;; তোমার বিয়ের কথা চলছে।

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৭

এই বিয়ের নাম শুনতেই আইরাতের মাথায় আব্রাহামের কথা আসে আর আইরাত হেসে দেয়।
আইরাত;; আচ্ছা বুঝলাম,, ঠিকিআছে কথা বার্তা চলতে থাক৷ দেখি কি হয়৷
রনিত;; তুমি না বলো যে পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবে না।
আইরাত;; হ্যাঁ তা তো করবোই না।
রনিত;; তাহলে!
আইরাত;; আরে দেখি না কি হয়। আর রইলো কথা বিয়ের তো আমি এতো সহজে তা করছি না বুঝলি।
রনিত;; তাহলে কি করবে?
আইরাত;; আগে আগে দেখ কি করি৷
রনিত;; আচ্ছা।
রনিত এটা বলেই চলে যায়। কিন্তু আইরাতের মাথায় আসে এক ধামাকাদার বুদ্ধি।

রায়হান কেন জানি এখন আস্তে আস্তে চেঞ্জ হচ্ছে কিছুটা। আগে সে আইরাতকে অন্য মেয়েদের মতো ভাবলেও এখন আর না। সেও হয়তো আইরাতের প্রেমে তলিয়ে গেছে৷ যাই হোক তাকে যা ই করার দ্রুত সব কিছু করতে হবে। সে চায় না আব্রাহাম যাতে কোন কিছুতে ঝামেলা করে।

ওদিকে আইরাত যে কি করবে তা একমাত্র সেই ভালো জানে। বিয়ের পিড়িতে সে তো এতো সহজে বসবে না। আর আব্রাহাম একবার যদি জানে যে আইরাতের বিয়ে ঠিক বা বিয়ের কথা চলছে তখন কি হবে জাস্ট ভাবা যায় না। তবে আব্রাহাম কে জানতে দিবে না আইরাত কেননা তার আগেই আইরাত কিছু না কিছু তো অবশ্যই করবে।
আর আব্রাহাম, তার পক্ষে সম্ভব হলে তো সে সেইদিনই আইরাতকে নিজের বউ করে ঘরে তুলে আনতো যদি আইরাত তাকে বুঝিয়ে না বলতো।
এ যেন এক ত্রিকোণমিতির ন্যায় হয়ে গেলো। আব্রাহাম-আইরাত-রায়হান।

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৯