নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪৬+৪৭+৪৮

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪৬+৪৭+৪৮
লেখিকাঃ Tamanna Islam

আব্রাহাম আইরাতের পাশেই বসে ছিলো তার ঠিক দশ মিনিট পর ডক্টর আসে। আব্রাহাম আইরাতের কাছ থেকে সরে আসে তারপর ডক্টর তার চেকাপ করে।
আব্রাহাম;; What happened doctor? Anything serious?!
ডক্টর;; না তেমন কিছু না। সব ঠিকই আছে।
আব্রাহাম;; তাহলে হুট করেই সেন্সল্যাস?

ডক্টর;; দেখুন উনার বাইরের জিনিস অনেক খাওয়া হয়। মানে আসলে পুরোপুরি জাংক ফুড’স না তবে হাবিজাবি বেশি। এই ধরুন চিপ’স, পপকর্ন, আর স্পেশালি ফুচকা। ফুচকা টা টক-ঝাল জাতীয় খাবার আর এই দুইটা জিনিসের মাত্রা অত্বাধিক হলে বমি বা ফুড পয়জনের মতো সমস্যা দেখা দেয়। তাই উনি আজ বমিও করেছেন একাধিক বার। আর রইলো কথা অজ্ঞান হয়ে পরার তো মিস্টার আব্রাহাম চৌধুরী আপনার ওয়াইফ আইরাতের কিছু জিনিসে বিরাট ফোবিয়া আছে। এই ধরুন অন্ধকার, অনেক উচ্চতা আর ব্লাড। মানে উনি এই তিনটে জিনিস অতিরিক্ত পরিমাণে দেখলে বেশ ভয় পেয়ে যান। তার ভেতরে একটা ভয় কাজ করে তাই অজ্ঞান হয়ে পরেছেন। আচ্ছা আজ কি উনি রক্ত দেখেছিলেন নাকি মানে অনেক বেশি???

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ডক্টরের কথায় আব্রাহাম কিছুটা চুপ থাকে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে তার রক্তে মাখা হাত গুলো নিয়ে সোজা আইরাতের সামনে আসা একদম ঠিক হয়নি। মোটেও না। আব্রাহাম কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ইলা বলে ওঠে….
ইলা;; কই না তো। কারো শরীরে কোন আঘাতও লাগে নি। আর মাচ বা মাংস এই সবের তো প্রশ্নই আসে না।
ডক্টর;; জ্বি না মাছ-মাংস না উনার মানুষের রক্তেই ফোবিয়া আছে। একসাথে অনেক রক্ত দেখলে উনার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চাপ পরে যারফলে তার অবস্থা এমন হয়। যাই হোক ভয়ের কোন ব্যাপার নেই। সব ঠিকই আছে। শুধু একটু রেস্ট আর ঠিকঠাক ভাবে খাওয়া-দাওয়া করলেই ভালো হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ খেয়াল রাখবেন উনি যেনো এই বাইরের জিনিস বেশি একটা না খায়। আর উনি কিন্তু প্রচুর ঝাল খাবার খান এটা কমাতে হবে।

চেকাপ শেষ হলে আব্রাহামের একটা গার্ড গিয়ে ডক্টর কে এগিয়ে দিয়ে আসে। ইলা আব্রাহাম কে আইরাতের ওপর নজর রাখতে বলে চলে যান। আব্রাহাম একটা ক্ষীণ দম ছেড়ে আইরাতের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুটা ঝুকে আইরাতের কপালের চুল গুলো সরিয়ে একটা চুমু খেয়ে এসে পরে। সোজা শাওয়ার নিতে চলে যায়। এখন এই মূহুর্তে তার মাথা ঠান্ডা করা বেশ প্রয়োজন। কেননা আব্রাহাম সত্যি সত্যিই একজন কে মেরে রেখে এসেছে। আব্রাহামের কাছে তখন রাশেদের ফোন এসেছিলো। কথায় আছে না যে “” লাতো কে ভূত বাতো সে নেহি মানতে “” বিষয় টা ঠিক তেমনই।

রায়হান এতো সহজেই হাল যে ছেড়ে দিবেনা তা আব্রাহাম আগে থেকেই জানতো কিন্তু রায়হান যে এতো পরিমাণে হারামি বের হবে তা সে জানতো না। রায়হান তো আইরাতকে বিয়ে করতে পারে নি আর তার জন্যই নিজের মনে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। আইরাতের চাচার বাড়িতে সে জাসুছ লাগিয়েছে। সে সব খবরাখবর এতোদিন ধরে রায়হান কে দিয়ে আসছিলো। কিন্তু রায়হানের থেকেও আব্রাহাম বেশ কয়েক কদম এগিয়ে। অর্থাৎ রায়হান তার কিছু চেলাপেলা দের কে আইরাতের চাচার বাড়ির ওপর নজর রাখতে বলেছিলো কিন্তু আব্রাহাম রায়হান-তার সব গার্ড”স, এমন কি আইরাতের চাচার বাড়িতে সব জায়গায় A-Z বডিগার্ড দের পাহাড়া দিয়ে রেখেছে। পান থেকে চুন খসার আগেই সেই খবর আব্রাহামের কানে পৌঁছে যাবে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয় নি।

আজ একজন লোক সোজা রাশেদের হাতে পরে। রাশেদ তাকে ধরে বেধে রেখেছিলো। আব্রাহাম কে ফোন দিয়ে বলে দেয়, আব্রাহাম সেখানে চলে যায়। প্রথম চান্স তো জেলের আসামী দেরও দেওয়া হয়। আব্রাহাম প্রথমে ভালোভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলো। বলে নি, কিন্তু তারপর হাতুড়ি দিয়ে তার এক পায়ের সবগুলো আঙুল থেতলে দেওয়া হয়েছে তারপর গরগর করে সব বলে দিয়েছে। আর যখন আব্রাহাম শুনলো যে ” রায়হান আব্রাহাম-আইরাতকে আলাদা করতে চায়” তখন যেনো আব্রাহাম আর ঠিক থাকতে পারলো না।

একদম কুরবানির গরুর মতো করে কেটে দিয়েছে লোকটাকে। আর কি একদম সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেছে সে। আর আব্রাহামের কানে যেনো তাদের আলাদা হবার কথা টাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কোন ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিলো না। তাই রাগের বসে নিজের রক্তমাখা হাত নিয়ে আইরাতের সামনে এসে পরেছিলো। আর আইরাতের এই দশা।

আব্রাহাম শাওয়ার অন করে দিয়ে শূন্য গায়ে পানির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাত দেওয়ালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়ে আছে। পানির বিন্দু গুলো সারা বডিতে বেয়ে বেয়ে পরছে তার। কতোক্ষন এভাবে থেকেই আব্রাহাম একটা গ্রে কালারের টি-শার্ট পরে টাওয়াল দিয়ে তার চুল গুলো মুছতে মুছতে বের হয়ে পরে।
রাগের চোটে আব্রাহাম কিছু খায়ও নি। সে ল্যাপটপ নিয়ে সোফাতে বসে পরে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে আইরাতের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষন পর আইরাতের জ্ঞান ফিরে এলে আব্রাহাম দ্রুত আইরাতের কাছে চলে যায়। আইরাত পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। মাথায় হাত দিয়ে কোন রকমে বসে পরে। আব্রাহাম আইরাতের পেছনে বালিশ রেখে তাকে হেলান দিয়ে শুইয়ে দেয়।

আব্রাহাম;; Feeling better?!
আইরাত;; হ্যাঁ আগে থেকে ভালো আছি।
আব্রাহাম;; হাজার বার, হাজার বার বারণ করলাম এতো ফুচকা খেয়ো না এতো ফুচকা খেয়ো না। কিন্তু না তুমি তো নিজের মর্জির মালিক। ইচ্ছে মতো খেলে এখন বুঝো মজা। ভমেট করেছো আমাকে বলো নি কেনো?
আইরাত;; আমি তো আ………..

আব্রাহাম;; না মানে প্রব্লেম কি কথা শুনবে না তুমি। বাচ্চা তুমি যে কিছু দেখলেই এভাবে লাফাও। বড়ো হয়েছো বুঝো না। কাল থেকে না না আজ থেকে এখন থেকেই বাইরের সব জিনিস খাওয়া বন্ধ। কোন আজাইরা জিনিস খাবা না। শুধু হ্যালথি খাবার খাবে। মরিচ হাতে দেখলে হাত কেটে দিবো। ঝাল খাবে না। দিন-রাত ২৪ ঘন্টা ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখবে, ছাদে যাওয়া বন্ধ সেটা অনেক উঁচু, আর ব্লাড যেখানে আছে তার থেকে একশ হাত দূরে থাকবে।

আইরাত;; __________________________
আব্রাহাম;; বুঝেছো কথা?
আইরাত;; ??
আব্রাহাম;; আবার কি হলো?
আইরাত;; আপনি বকা দিছেন কেনো ???
আব্রাহাম;; আরে….
আইরাত;; আপনি যেভাবে রুটিন বানিয়ে দিলেন এর থেকে আমি মরেই যাই। আমি এভাবে থাকতে পারবো না। ছাদে না গেলে আমি তো দম আটকে মরে যাবো। আর ঝাল কমিয়ে খাই কিন্তু খাই। তা নাহলে আমি কি খাবো। (নাক টানতে টানতে)

আব্রাহাম;; আইরাত রাগ তুলবে না আমার খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। এমনিই আমার মেজাজ ভালো না।
আইরাত;; সরি ?
আব্রাহাম বেশিই চিল্লা-পাল্লা করে ফেলেছে আইরাতের ওপর। আব্রাহাম আইরাতকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। তারপর মাথাতে চুমু দিয়ে দেয়।
আব্রাহাম;; সরি রাগের মাথায় চিল্লিয়ে ওঠেছি। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যখন তুমি সেন্স হারালে। আমি ভেবেছি না জানি কিনা কি হয়ে গেলো।
আইরাত;; ছাড়ুন আমাকে।
আইরাত উঠে আসে।
আইরাত;; আব্রাহাম সত্যি সত্যি বলবেন। কাকে মেরে এসেছেন আপনি?
আব্রাহাম;; _______________________

আইরাত;; আব্রাহাম বলুন প্লিজ। চুপ করে থাকবেন না। আমি জানি কিছু তো একটা হয়েছে অবশ্যই, বলুন না। কি হয়েছে, আবার কাকে মেরে এসেছেন। আমি আপনার হাতে তখন রক্ত দেখেছি।
আব্রাহাম;; রায়হানের একজন লোককে। তোমার বাড়িতে সবার ওপর নজর রাখছিলো। আমার গার্ড রা আবার তাদের ওপর নজর রাখছিলো তাই আজ রাশেদের হাতে-নাতে একদম ধরা পরেছে। আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই মেরে দিয়েছি।
আইরাত;; তাকে ভালোভাবে বুঝালেও তো হতো নাকি?
আব্রাহাম;; কিহ? আমার এখন হাসি পাচ্ছে তোমার কথা শুনে।
আইরাত;; ??

আব্রাহাম;; একটা কথা মাথায় রেখো এখানে না “ভালো” বলে কোন শব্দ নেই বুঝলে। আর কাকে বুঝাবো, কেনো বুঝাবো ?৷ ছেড়ে দাও এইসব তুমি বুঝবে না।
আইরাত;; তাই বলে একটা লোককে এভাবে মেরে দিবেন। হাত কাপে না আপনার মানুষ মারতে?
আব্রাহাম;; না কাপে না।
আইরাত;; ইশশশ আমার তো দেখেই গা গুলিয়ে যায়। ইয়াক।
আব্রাহাম;; হ্যাঁ তবে বাড়ি ফাকা মানে শশুড়আব্বু-আম্মু নেই বাড়িতে।
আইরাত;; হ্যাঁ তারা বাইরে গিয়েছেন মানে চাচির মায়ের বাড়ি আর কি। আমাকে ফোন করেও বলেছিলেন।
আব্রাহাম;; ওহহ আচ্ছা। বাই দি ওয়ে তোমার ফোন টা দাও।

আইরাত;; কেনো?
আব্রাহাম;; ট্রেক করবো আমি।
আইরাত;; কি আপনি আমার ফোন ট্রেক করবেন কেনো? আমি কি করেছি?
আব্রাহাম;; আরে আস্তে। মানে কেউ ফোন দিলে বা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসলে বা যা কিছুই হলেই আমি জানতে পারবো সো আমার লাগবে দাও।
আইরাত;; মানে কি এইসবের?
আব্রাহাম তার একহাতে আইরাতের কোমড় জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে গালে ধরে নিজের কপালের সাথে আইরাতের কপাল ঠেকিয়ে দেয়।
আব্রাহাম;; Because i Don’t wanna lose you Babygirl…..
আইরাত;; _____________________
আব্রাহাম;; আমি হারাতে পারবো না তোমাকে। কখনো নাই। কোন ক্রমেই না।
আইরাত;; এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?
আব্রাহাম;; তা তুমি বুঝবে না।

এভাবেই চলে যায় সেইরাত। পরেরদিন সকালে আব্রাহামের ঘুম ভাংে ফোনের আওয়াজে। আব্রাহামের চোখ খুলতেই দেখে আইরাত তার বুকে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। আব্রাহাম আস্তে করে আইরাতকে সরিয়ে ফোন রিসিভ করে। যার যা শুনে তাতে আব্রাহামের নিজের কানেও বিশ্বাস হয় না। আর এটা আইরাতের স্বভাব যে আব্রাহাম যদি আইরাতের পাশে থেকে উঠে চলে যায় তাহলে আইরাত টের পেয়ে যায় আর তার ঘুম ভেঙে যায়। আইরাত আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। দেখে আব্রাহামের কপালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

আইরাত;; আব্রাহাম..!
আব্রাহাম আইরাতের দিকে ঘুড়ে তাকায়৷
আইরাত;; কি হয়েছে আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?
আব্রাহাম;; না মানে…..
আইরাত;; আব্রাহাম কি হয়েছে এমন করছেন কেনো? চিন্তিত আপনি কিছু নিয়ে? কি হয়েছে, কে ফোন করেছে?
আব্রাহাম;; লাশ পাওয়া গেছে।
আইরাত;; লাশ? কিসের লাশ, কার লাশ?
আব্রাহাম;; ____________________

আইরাত;; আব্রাহাম কিছু তো বলুন প্লিজ। এভাবে চুপ করে থাকবেন না।
আব্রাহাম;; রাশেদ ফোন করেছিলো বাড়ির কাছে লাশ পাওয়া গেছে।
আইরাত;; কাদের লাশ? (কিছুটা চিল্লিয়ে)
আব্রাহাম;; শশুড়আব্বু-আম্মুর।
আইরাত;; কিহহহহ?

আব্রাহামের কথা শুনে আইরাত ধপ করে নিচে বসে পরে। আইরাত কি শুনলো যেনো তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কি বলছে আব্রাহাম এগুলো। আইরাতের যেনো মাথায় পুরো আকাশ টা ভেঙে পরেছে। আব্রাহাম বুঝলো যে এখন আইরাতকে সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য। আব্রাহাম আইরাতের সামনে বসে পরে।
আব্রাহাম;; আইরাত প্লিজ সামলাও নিজেকে। এভাবে এখনই ভেঙে পড়ো না। আমাদের সেখানে যেতে হবে। তারপর দেখি কি হয়েছে। প্লিজ এভাবে ভেঙে পরো না এখনই।

আইরাত;; আব্রাহাম দেখুন সকাল সকাল এগুলো ভালো লাগে না। প্লিজ আমার সাথে মজা করবেন না। কি বলছেন আপনি এগুলো? মানে আমার চা চাচ্চু আর চা চাচি কী কীভা কীভাবে তারা। আর মানে কা কা কাল না ভালো ছি ছিলো আজ কীভাবে কি? রনিত, রনিত কোথায়? ও কোথায়, ওকে পাওয়া গেছে? আব্রাহাম রনিত কোথায়?
আব্রাহাম;; আইরাত আমি জানি না কিছু এখন আমাদের আগে সেখানে যেতে হবে তারপর বাকি কিছু।
আইরাত;; জলদি চলুন।

আইরাত কোন রকমে উঠে ফ্রেশ হয়ে আব্রাহামের সাথে বের হয়ে পরে। আইরাত বাইরে এসেও ঠিক ভাবে দাড়াতে পারছিলো না। পা গুলো যেনো রীতিমতো কাপছে। ইলাকে এখনো খবর টা বলা হয় নি। উনি বয়স্ক মানুষ। এই কথা বললে সামলাতে পারবেন না তাই আগেই কিছু বলা হয় নি। আব্রাহামের পাশেই গাড়িতে আইরাত বসে আছে। দরদর করে ঘেমেই যাচ্ছে। আইরাত তার হাতের উলটো পাশ দিয়ে কোন রকমে নিজের কপাল আর মুখ টা মুছে ফেলে।
আব্রাহাম;; আইরাত প্লিজ শান্ত হও, এভাবে থাকলে তুমি নিজে অসুস্থ হয়ে পরবে। প্লিজ সামলাও নিজেকে।
আইরাত এবার হু হু করে কেদেই দিলো।

আইরাত;; কীভাবে সামলাবো আব্রাহাম। আমি জীবনেও আমার বাবা-মার আদর পাই নি। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি এই চাচ্চুই আমার সব ছিলো। চাচি আগে দেখতে না পেলেও আমাকে এখন চাচি ঠিকই ছিলো আমার সাথে। আমার আপন বলতে চাচা-চাচি ছাড়া কেউ ছিলো না। আর এখন কিনা…….! কাল আমার সাথে কথা বললো আজ এসে পরার কথা ছিলো তাদের কিন্তু এখন কিনা লাশ। না জানি রনিত কি হালে আছে এখন।
আব্রাহাম;; চিন্তা করো না রনিত কে পাওয়া গেছে। তারা আমার গার্ডের কাছেই আছে সেখানে।
আইরাত;; আব্রাহাম, প্লিজ দ্রুত চলুন।

প্রায় ত্রিশ মিনিট পর আব্রাহাম আর আইরাত ইকবাল সাহেবের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থামতেই আইরাত দ্রুত নেমে পরে। আইরাতকে দেখে রনিত দৌড়ে এসে আইরাতকে জড়িয়ে ধরে। রনিত কান্না করছে অনেক। আইরাত রনিতের সামনে বসে রনিতের চোখের পানি গুলো মুছে দিতে দিতে বলে ওঠে….
আইরাত;; কি হয়েছে ভাই? কে কে এগুলো করেছে দেখেছিস কাউকে? কীভাবে হলো?

রনিত;; জানি না আপু। কাল আমরা গাড়িতে করে আসছিলাম। বাবা দেখলো যে একটা গাড়ি অনেক সময় ধরে আমাদের গাড়ির পিছু নিচ্ছে। তবে আমরা যেই না আমাদের বাড়ির সামনে এসে থামলাম। তখনই ওই গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে পরলো আমাদের সামনে। আম্মুর সাথে কি যেনো কথা বলে তারা। হয়তো আম্মু ওদের আগে থেকেই চিনতো। একসময় আম্মুর সাথে কথা কাটাকাটি লেগে গেলো তাদের। তারা আব্বু-আম্মু সবাইকেই মেরে দেয়। জানো আমি না খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই ছুটে এসে গাড়ির ডিকির পিছনে লুকিয়ে পরি। তাই তারা আমাকে দেখতে পারে নি। নইলে তো আমাকে, আমাকেও তারা………….

আইরাত;; চুপ চুপ চুপ।
আইরাত রনিত কে জড়িয়ে ধরে চুপ করায়। তারপরই দেখে যে বাড়ির আঙিনায় দুটো লাশকে সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেয়া হয়েছে। সাসা কাপড়ের ওপর দিয়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। তা দেখেই আইরাতের বুকের ভেতর টা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। আইরাত রনিত কে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায়। রনিত আব্রাহামের কাছে চলে যায়। আব্রাহাম তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। বাচ্চা টা অনেক ভয় পেয়ে আছে। আইরাত কাপা কাপা পায়ে লাশ গুলোর দিয়ে এগিয়ে যায়। আইরাতের সেখানে যেতেই লাশ গুলোর মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেওয়া হয়।

রক্তে মাখা লাশ হয়ে আছে ইকবাল সাহেব আর তার স্ত্রী কলি। আইরাত তাদের দেখেই চিৎকার দিয়ে ওঠে। আব্রাহাম আইরাতের দিকে এগিয়ে যায়। আইরাত তো কোন কূল কিণারা খুঁজে পাচ্ছে না। পাগলের মতো করে কেদেই যাচ্ছে। আব্রাহাম গিয়ে আইরাতকে ধরে কিন্তু আইরাত ইকবাল সাহেবের গালে ধরে চাচ্চু চাচ্চু করে ডেকেই যাচ্ছে। কলির কাছে গিয়ে ডাকছে। কিন্তু লাভ নেই, তারা আজীবনের জন্য চলে গিয়েছে সেই না ফেরার দেশে।

আইরাতের কানতে কানতে নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে। আব্রাহাম বুঝলো যে এভাবেই এখানে আইরাত থাকলে সে অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই এক প্রকার জোর করেই আইরাতকে আব্রাহাম নিয়ে এসে পরে৷ ইকবাল সাহেবের থেকে কলিকে যেনো আরো বাজে ভাবে খুন করা হয়েছে। কলির লাশের ওপর থেকে সাদা কাপড় টা উঠিয়ে নিলে আব্রাহাম তার হাত দিয়ে আইরাতকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে তার বুকের সাথে চেপে ধরে। আইরাতের কান্না করতে করতে খুব খারাপ দশা হয়ে গেছে। আব্রাহাম কোন রকমে তাকে সামাল দিচ্ছে।

আইরাতের চাচা-চাচির লাশ কে আব্রাহামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশ অফিসার রা ইনভেস্টিগেশন করতে চেয়েছিলো কিন্তু আব্রাহাম সোজা মানা করে দেয়। কেননা আব্রাহাম জানে যে এগুলো কার কাজ। আইরাত যেনো পাথর হয়ে গেছে। চুপ মেরে খালি এক জায়গায় বসেই আছে রনিত কে নিয়ে। এদিকে আব্রাহাম পুরো শহরে তার গার্ড দের লাগিয়ে দিয়েছে রায়হান কে খোঁজার জন্য। কিন্তু পাচ্ছে না। পাগল কুকুরের মতো করে খুঁজে যাচ্ছে এই রায়হান কে একটা বার হাতে এলে সেখানেই ইন্না-লিল্লাহ হবে তার।

আব্রাহাম এই মূহুর্তে ঠিক কি বলে আইরাতকে শান্তনা দিবে জানা নেই তার। আব্রাহামের দাদি ইলা খবর টা শুনেছেন। তিনিও যেনো একটা শকের মধ্যে আছেন। কি থেকে কি হয়ে গেলো। আব্রাহাম ফোনে কথা বলছিলো রাশেদের সাথে। এই পুরো শহরে নাকি রায়হান কোথাও নেই। যেইভাবে গার্ড গুলো খুঁজেছে তাতে রায়হান যদি সত্যি সত্যি এখানে থাকতো তাহলে পেয়ে যাবার কথা। তার মানে রায়হান গুম হয়েছে। আব্রাহাম আইরাতের দিকে তাকিয়ে দেখে আইরাত মুখ গোমড়া করে একধ্যানে বসে আছে। আব্রাহাম ফোন টা কেটে দিয়ে আইরাতের দিকে এগিয়ে যায়। আইরাতের পাশে বসে পরে।

আব্রাহাম;; জানপাখি….!
আইরাত মাথা টা তুলে এক নজর আব্রাহামের দিকে তাকায়। তার চোখের পাতাগুলো ফুলে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আব্রাহাম কিছু বলতে যাবে তখনই সাথে সাথে আইরাত আব্রাহামের বুকে ঝাপিয়ে পরে হাউমাউ করে কেদে দেয়। আব্রাহাম তাকে জড়িয়ে ধরে৷

আইরাত;; আমি এখন কীভাবে থাকবো। আমার দম আটকে আসছে। আমি, আমি তো এমন কিছুই চাই নি। স স সব আমার জন্য তাই না। আমাকে, আমাকে রায়হান বিয়ে, বিয়ে কর করতে পারি নি তাই জিদের জন্য এগুলো করেছে ওরা আমার চাচা-চাচির সাথে তাই না। স, সব আমার দোষ। এর থেকে আমিই মরে যেতাম।
আব্রাহাম;; চুপ চুপ একদম চুপ।

আব্রাহাম আইরাতকে নিয়ে বসে ছিলো তখনই একজন গার্ড বেশ দ্রুত পায়ে আব্রাহামের কাছে আসে। আব্রাহাম তার দাদি কে বলে আইরাত আর রনিত কে এখান থেকে নিয়ে যেতে বলে। ইলা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে আইরাত কে নিয়ে যায়।
আব্রাহাম;; কি হয়েছে?
গার্ড;; স্যার খুব কষ্টে রায়হানের ফোন নাম্বার ট্রেস করতে পেরেছি। তবে সেটা তার বাসার কোন এক ফোন হবে। রায়হান ধরেনি ধরেছে অন্য একজন। হয়তো ওর কোন গার্ড হবে। আমি রায়হানের ঠিকানা জানার জন্য অনেক কথার প্যাচ কেটেছি কিন্তু লাভ হয় নি।
আব্রাহাম;; নাম্বার টা আমাকে দাও।
গার্ড;; স্যার রায়হান উনার আসল বাড়ি……

আব্রাহাম;; না রায়হানের তার মায়ের সাথেও তেমন একটা ভালো সম্পর্ক নেই। রায়হান দরকার হলে দেশের বাইরে চলে যাবে কিন্তু তার মায়ের কাছে না। হেই ওয়েট রায়হান কোন ভাবে দেশের বাইরে চলে যায় নি তো। কারণ সে প্রায়ই দেশের বাইরে যায়। আর শশুড়আব্বু-আম্মুর মার্ডার হয়েছে গতকাল রাতে……
গার্ড;; কিন্তু স্যার একদিনেই সব ভিসা-পাসপোর্ট এইসব ম্যানেজ করা কীভাবে সম্ভব?
আব্রাহাম;; আমি কি বললাম রায়হান প্রায়ই দেশের বাইরে যায়। সো তার কাছে ভিসা- পাসপোর্ট এইসব থাকা বড়ো কোন ব্যাপার না।

গার্ড;; তাহলে স্যার?
আব্রাহাম;; রায়হান বাইরে চলে গিয়েছে। হয়তো ভোররাতের কোন ফ্লাইটেই চলে গিয়েছে। তুমি যাও।
গার্ড;; জ্বি স্যার।

আব্রাহাম কপালে এক আঙুল ঠেকিয়ে রেখেছে। এই রায়হান তো হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলো। কিন্তু যে করেই হোক একে ধরতেই হবে। তবে রনিতের ভাষ্যমতে গতকাল রাতে বেশ কয়েকজন লোক ছিলো এক বা দুইজন ছিলো না। রায়হানের সাথে সাথে সেখানে আরো লোক ছিলো। রায়হান বাইরে থাকলেও বাকিরা অবশ্যই এখানেই রয়েছে। আব্রাহাম তাদের আবার খোঁজা শুরু করে দিলো। এভাবেই সারাটা দিন গেলো।

আইরাত যেনো পাগল পাগল হয়ে গেছে। কিচ্ছু খায় না, কথাও বলে না। বিকেলের দিকে ইকবাল সাহেব আর কলির লাশ কে আনা হয়। জানাজা পরাতে হবে। লাশগুলোকে পুলিশদের ছুয়েও দেখতে দেয় নি আব্রাহাম। আইরাত কে যেনো আর রাখা যাচ্ছে না ঘরের ভেতরে। ছুটে চলে আসতে চাইছে। অবশেষে আব্রাহাম আর না পেরে আইরাত কে যেতে দেয়। আইরাত দুটো লাশের মাঝখানে বসে আবার হাউমাউ করে কাদছে।

রনিত কে আসতে দেয় নি এখানে। আইরাত চাচ্চু বলে চিৎকার করে উঠে। আব্রাহাম খেয়াল করলো যে আইরাতের কেমন তার চোখ গুলো বন্ধ করে আসছে। আইরাত পরে যেতে ধরলে আব্রাহাম দ্রুত গিয়ে আইরাতকে ধরে ফেলে। আইরাত অজ্ঞান হয়ে গেছে। আব্রাহাম গার্ড দের লাশ গুলোকে নিয়ে জানাজার ব্যাবস্থা করতে বলে। আব্রাহাম আইরাতকে কোলে করে বাসার ভেতরে নিয়ে আসে। সোজা নিজের রুমে গিয়ে আইরাতকে শুইয়ে দেয়। আইরাতের কপালে চুমু দিয়ে আব্রাহাম এসে পরে।

একসময় সন্ধ্যা নেমে আসে। মাগরিবের আজানের পরে জানাজা পরে ইকবাল সাহেব আর কলিকে কবর দেওয়া হয়। আব্রাহাম জানাজার নামাজ টা পরে বাসায় আসে। এসে দেখে আইরাত হলরুমে বসে আছে। আব্রাহাম কে দেখেই আইরাতের চোখ গুলো আবার ভিজে আসে। আইরাত ফুপিয়ে ফুপিয়ে নাক টানছে আর কাদছে। মাথা নিচে নামিয়ে ফেলেছে। আব্রাহাম আইরাতের কাছে গিয়ে তার মাথা টা নিজের বুকে নিয়ে নেয়।

আইরাত কিচ্ছু খায় না। অবশেষে ইলা তাকে জোর করেই খাইয়ে দেয়। রনিত তো ছোট বাচ্চা। তেমন কিছু বুঝে না। তাকে একটু কিছু দিলেই চুপ হয়ে যায়। মোট কথা সে যে এখন আইরাতের সাথে থাকবে তাই তার খুশির সীমা নেই। রাত হয়ে গেছে, আইরাতকে মেডিসিন খাইয়ে ঘুম পারানো হয়েছে। আর কোন পায় ছিলো না এছাড়া। আব্রাহাম আইরাতের পাশে বসে ছিলো। রনিতকে দাদির সাথে রাখা হয়েছে। রায়হান কে কি থেকে কি করা যায় তাই ভাবছে আব্রাহাম। হঠাৎ করেই আব্রাহামের ফোনে কল আসে।

আব্রাহাম;; হ্যালো।
রাশেদ;; স্যার জলদি গেস্টহাউজে আসুন। দুইজনে কে ধরা হয়েছে।
আব্রাহাম;; ফোন রাখো আসছি।
আব্রাহাম সোজা তার রিভলবারে বুলেট লোড করে খালি জেকেট টা হাতে নিয়ে সোজা বাসা থেকে বের হয়ে পরে। এখন যে সে কি করবে নিজেও জানে না। গভীর রাত মানুষ নেই রাস্তায়। তাই যেনো উড়ে এসেছে গাড়ি নিয়ে। গাড়ি গেস্টহাউজের বাইরে রেখেই আব্রাহাম দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে যায়। গিয়েই দেখে দুটো আধমরা লোককে বেধে রাখা হয়েছে।

রাশেদ;; স্যার এরা সেইদিন রাতে রায়হানের সাথে ছিলো। আইরাত ম্যামের চাচা-চাচিকে মেরেছে।
আব্রাহাম শুধু একটা কথাই বলে।
আব্রাহাম;; রায়হান মেরেছে তাই না?
লোক দুটোকে এতোই মারা হয়েছে যে তারা আর মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। কোন রকমে মাথা দুলায়। ব্যাস আব্রাহাম চোখ বন্ধ করে রিভলবারে যতো বুলেট গুলো ছিলো সব মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। শেষ, মারা গেছে তারা। আব্রাহামের রাগে যেনো শরীর কাপছে। রায়হান কে না মারা অব্দি তার মনে শান্তি নেই।

অন্যদিকে রায়হান এসে পরেছে লন্ডন। তবে একা আসে নি রায়হানের সাথে এসেছে প্রিতিও। যে কিনা বলতে গেলে আব্রাহামের পেছনে পাগল। আসলে আব্রাহাম-আইরাতের বিয়েটা রায়হানের সাথে সাথে মেনে নিতে পারে নি প্রিতিও। কথায় আছে না

“” শত্রুর শত্রু একে-ওপরের বন্ধু হয় “”। এখানে ঠিক তাই। রায়হান চায় আইরাতকে আর প্রিতি চায় আব্রাহাম কে। রায়হানের সাথে প্রিতিও এখন লন্ডনেই আছে। রায়হান যে আইরাতের চাচা-চাচি কে মেরে রেখে এসেছে তা প্রিতি জানে। আসলে ইকবাল সাহেবের গাড়ির পেছনে যে গাড়ি টা ধাওয়া করে আসছিলো তা রায়হানেরই ছিলো। একসময় তারা গাড়ি থামায়। রায়হান গিয়ে সোজা কলি কে ধরে।

আব্রাহামের সাথে আইরাতের বিয়ে কেনো দিলো, রাজি কেনো হলো, কলি তো রায়হানের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছিলো তাহলে কেনো তাদের দুইজনের বিয়ে দিলো?? এইসব সহ নানা প্রশ্ন করে। কিন্তু কলি এবার যেনো রুখে দাঁড়ায়। সে রায়হানকে বলে আইরাতকে ভুলে যেতে কিন্তু জেদ খুব খারাপ জিনিস। একসময় কলির সাথে রায়হানের রেশারেশি হয়ে গেলে রায়হান ছুরি বের করে এক ঘা বসিয়ে দেয়। ইকবাল সাহেব এবং কলি দুইজনেই খুন করে দেয়।

রায়হান;; তো প্ল্যান কি?
প্রিতি;; প্ল্যান যাই বানাও না কেনো। আমি আব্রাহাম কে ভালোবাসি।
রায়হান;; আর আমি আমার আইরাতকে।
প্রিতি;; হাহ, আচ্ছা আইরাতের পেছনে তোমরা দুই ভাই ই এতো পাগল কেনো। কি আছে কি ওই মেয়ের মাঝে?
রায়হান;; চুপ একদম চুপ। মুখ সামলে। ধরতে গেলে তো তুমি আইরাতের কানি আঙুলেরও যোগ্য হবে না তার ওপর আবার বড়ো বড়ো কথা। শোন আমি এখানে কোন তর্ক করতে আসি নি। তুমি যেমন আব্রাহাম কে চাও আমিও আইরাতকে তাই এখন আমাদের মিলেই এই কাজ করতে হবে বুঝলে। তো নিজের মুখ চালানো বন্ধ করে মাথাটা চালাও।

প্রিতি;; তুমি যেহেতু আইরাতের চাচা-চাচি কে মেরেছো তাই আব্রাহাম এখন তোমায় হন্ন হয়ে খুঁজবে৷
রায়হান;; কিন্তু পাবে না।
প্রিতি;; হাহ, আব্রাহাম অনেক হাই লেভেলের মাল বুঝলে। ওর মতো ছেলে হাতে হাত রেখে বসে থাকবে তা তো হবেই না।
তখনই রায়হানের ফোন আসে।
রায়হান;; হ্যালো।

রায়হান;; কিহহ? কীভাবে হলো এটা?
রায়হান;; বি কেয়ারফুল। আর হ্যাঁ সব লুকিয়ে করবি। যেনো টের না পায়। আর দরকার হলে তোরাও পালিয়ে যা সেখান থেকে।
রায়হান ফোন কেটে দেয়।
প্রিতি;; কি হলো?
রায়হান;; সেইদিন রাতে আমার সাথে যারা ছিলো আব্রাহাম তাদের মাঝে দুইজন কে মেরে ফেলেছে।
প্রিতি রায়হানের কথায় হেসে ওঠে….
প্রিতি;; বলেছিলাম না যে আব্রাহাম হাতে হাত রাখার মতো মানুষ না। রায়হান পারবে তো আমার আব্রাহামের সাথে?
রায়হান;; এক্সকিউজ মি. এখানে আমি তোমাকে আমার সামনে আব্রাহামের গুন-গান গাওয়ার জন্য আনি নি। ভাবো কীভাবে আইরাত-আব্রাহাম কে আলাদা করা যায়।
প্রিতি;; আলাদা তো করতেই হবে।

আব্রাহাম বাড়ি ফিরে আসে। রুমে গিয়ে দেখে আইরাত হাত-পা কাচুমাচু করে শুয়ে আছে ছোট বাচ্চার মতো। আব্রাহাম গিয়ে আইরাতের পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখে। আইরাত আব্রাহামের হাত টা খপ করে ধরে ফেলে। চোখ মেলে তাকায়।
আব্রাহাম;; বেবিগার্ল ঘুমাও নি??
আইরাত উঠে বসে।

আইরাত;; আমি আপনাকে না বলতাম যে এই সব খুন-খারাবা করবেন না। বাদ দিন এই মাফিয়া জগৎ। কিন্তু না আমি আর এমন বলবো না। আব্রাহাম যারা চাচ্চু আর চাচি কে মেরেছে প্লিজ তাদের এমন মৃত্যু দিবেন যেনো তাদের দেখে রাস্তার কুকুর অব্দি কাদে। জানে মেরে ফেলবেন একদম। কেউ যেনো বেচে না থাকে, কেউ না।
আইরাতের রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে। আব্রাহাম আইরাতকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা সারাটাদিন কেদেছে। আইরাত আব্রাহামের কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে। আর আব্রাহাম আইরাতের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। তার যেনো সারারাত আইরাতকে দেখে দেখেই কেটে গিয়েছে।

পরেরদিন সকাল হয়। কারো মন ভালো নেই। রনিতের স্কুল ছিলো কিন্তু আইরাত পাঠায় নি। রায়হানের যে চেলা দের আব্রাহাম সেইদিন রাতে মেরেছে তাদের মুখ থেকেই শুনেছে যে সেইদিন রাতে নাকি তারা মোট পাঁচজন ছিলো। দুইজন কে তো মেরেই ফেলেছে। আর বাকি দুইজনের খবরও পেয়ে গেছে আর পাঁচ নাম্বার বাকি রইলো রায়হান। আব্রাহাম তার প্রায় অনেক গুলো গার্ড দের নিয়ে গিয়ে রায়হানের বাসায় তালাশি করেছে। ঘর একদম ভেঙে ভেতরে গিয়েছে। ঘর টাকে গোয়াল ঘর বানিয়ে দিয়েছে।

তবে অবাকের বিষয় হচ্ছে এটা যে রায়হানের বাড়ি থেকে দুটো ভুয়া পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। সেখানে শুধু রায়হানের ছবি টা আসল। এমনকি রায়হানের নাম অব্দি ফেইক ছিলো। রায়হানের বাড়ি থেকে প্রচুর বেআইনি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। রায়হানের আসল বাড়িতে তো তার মা থাকে। আর রায়হান এমনই এক ব্যাক্তি যে কিনা তার মাকেও সহ্য করতে পারে না। তাই সেখানে অর্থাৎ তার আসল বাড়িতে কিছু রাখার প্রশ্নই আসে না। যা বা যেগুলো থাকার কথা সব এই বাড়িতেই আছে। আব্রাহাম রায়হানের পুরো বাড়িটা পুলিশের আন্ডারে রাখে। রায়হানের ব্যাপারে যা যা জানার তার প্রায় সবই জেনে গেছে। অনেক ধুলাই দেওয়া হয়েছে লোকগুলোকে যেনো রায়হানের ব্যাপারে আর বাকি যা যা জানে সব বলে দেয়। এত্তো পরিমাণে কেলানি দেওয়া হয়েছে যা বলার বাইরে। পরিশেষে একজন বলেই দেয় যে রায়হান লুকিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছে।

তারপরের দিনই আব্রাহাম সবকিছু রেডি করে ফেলে। যে করেই হোক লন্ডন যেতে হবে। তবে আইরাত কে এই ব্যাপারে কিছুই বলা হয় নি। সে অযথা চিন্তা করবে তাই। আব্রাহামের কাছে বর্তমানে রায়হানের মূল ঠিকানা বা ফোন নাম্বার সব আছে। ইন ফ্যাক্ট ফ্লাইটও রেডি। আব্রাহাম আজ যদি রায়হান কে নিজের সামনে পায় তাহলে কি যে করবে বলা বড়ো দায়। এখন আব্রাহাম ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন একটা করছে। আইরাত এসে আব্রাহামের পাশে বসে।

আইরাত;; কি করছেন?
আব্রাহাম;; আমাকে ইমিডিয়েটলি লন্ডন যেতে হবে।
আইরাত;; কিন্তু কেনো?
আব্রাহাম;; কাজ আছে ইম্পর্ট্যান্ট।
আইরাত;; কিন্তু হুট করে লন্ডন! ভিসা……
আব্রাহাম;; ভিসা-পাসপোর্ট সব রেডি। ইভেন ফ্লাইটও।
আইরাত;; কবে আসবেন?
আব্রাহাম;; একদিন পর। কেননা আজ সেখানে গিয়ে আবার আজকেই এখানে বেক করা কঠিন। তো আগামীকাল আসবো।

আইরাত উঠে আব্রাহামের পাশ থেকে চলে আসতে ধরলে আব্রাহাম আইরাতের হাত ধরে ফেলে। টেনে নিজের কাছে বসিয়ে দেয়। আইরাত কে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে তার দুই হাত নিজের দুই হাতের ভাজে রেখে দেয়।
আব্রাহাম;; কি হয়েছে?
আইরাত;; কই কিছু না তো।
আব্রাহাম;; মন খারাপ?
আইরাত;; আমার না কিছুই ভালো ঠেকছে না। কেনো যেনো মনে হচ্ছে যে সামনে বড়ো কোন বিপদ আছে। মানে কিছু তো একটা হবেই। আমার মন কু ডাকছে। কোন কিছুতেই আমি মন বসাতে পারছি না। এক অজানা চিন্তা-ভয় মনে এসে বাসা বাধছে।

আইরাতের কথা শুনে আব্রাহাম মুচকি হাসে। আইরাতের গালের পাশে নিজের হাত রেখে দিয়ে বলে ওঠে….
আব্রাহাম;; এগুলো তোমার মনের ভূল ছাড়া আর কিছুই না ওকে। ভয় পেয়ো না কিছুই হবে না, কিচ্ছু না।
আইরাত;; আচ্ছা আপনি লন্ডন কেনো যাচ্ছেন বলুন না?
আব্রাহাম;; রায়হান লন্ডনে আছে।
আইরাত;; ____________________।
আব্রাহাম;; আমি জলদি এসে পরবো।
আইরাত;; আমি যাই, রনিত কে খাওয়াতে হবে আর দাদি কে মেডিসিন দিতে হবে। আপনিও নিচে আসুন।
আব্রাহাম;; আসছি।

আইরাত উঠে রুমের দরজার দিকে যেতে ধরবে তখনই ইলা কিছুটা চিন্তা মাখা মুখ নিয়েই রুমের ভেতরে আসেন।
ইলা;; আব্রাহাম…!
আব্রাহাম;; বলো দাদি।
আইরাত;; দাদি তোমরা কথা বলো আমি যাই।
আইরাত চলে আসে সেখান থেকে। ইলা আব্রাহামের কাছে বসে পরে।
ইলা;; আব্রাহাম রাগ করিস না!
আব্রাহাম;; দাদি হয়েছে কি?
ইলা;; রুকশানা এসেছে (রায়হানের মা)
আব্রাহাম;; উনি এখানে কেনো?
ইলা;; আমি জানি না হলরুমেই বসে আছে। তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। প্লিজ সোনা তুই রাগ করিস না।
আব্রাহাম;; দাদি! মানলাম আমি একটু রাগি কিন্তু এতো টাও না যে যার তার সাথে খারাপ বিহেভ করে দিবো। যাই হোক উনাকে পাঠিয়ে দিয়ো।

ইলা;; আচ্ছা।
ওদিকে আইরাত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে পরে। নিচে নেমেই দেখে একজন মাঝবয়সী মহিলা বসে আছে। আইরাত তাকে চিনে না। তাই সাধারণতই আইরাত কপাল কুচকে সেখানে যায়। আইরাতের কিছু বলার আগেই রুকশানা হাসিমুখে আইরাতের দিকে এগিয়ে যায়।
রুকশানা;; তুমি বুঝি আব্রাহামের বউ?
আইরাত;; জ্বি।

রুকশানা;; বাহহ, মাশআল্লাহ ভারি মিষ্টি দেখতে তুমি। (আইরাতের গালে হাত রেখে)
আইরাত;; জ্বি কিন্তু আমি আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। (আমতা আমতা করে)
রুকশানা;; না চেনারই কথা। আর এছাড়াও চিনেই বা কি করবে তেমন কিছু বা কেউই লাগি না আমি তোমার।
আইরাত;; আপনি কি আব্রাহামের কিছু হন?
রুকশানা;; সৎ মা। আমি রায়হানের মা।
আইরাত;; ওহহ আচ্ছা। আপনি দাঁড়িয়ে কেনো বসুন বসুন।
রুকশানা;; না না মা আমি ঠিক আছি।
আইরাত;; আপনি কি আব্রাহামের সাথে দেখা করতে এসেছেন?
রুকশানা;; হ্যাঁ।
আইরাত;; ওহহ আচ্ছা। আপনি বসুন।

আইরাতের এখন ঠিক কি করা উচিত জানা নেই তার। রায়হান যে তার চাচা-চাচি কে মেরে ফেলেছে তাই যেনো আইরাতের মাথায় এখন ঘুরছে। রুকশানার ব্যাবহারেই বুঝা যাচ্ছে যে সে কত্তো নরম মনের একটা মানুষ। কিন্তু রায়হান এমন জানোয়ার হয়েছে কেনো। তবুও একজনের রাগ আরেকজনের ওপর তুলতে নেই তাই আইরাত চুপ থাকে। রুকশানার সাথে যথেষ্ট ভালো আচরণ করে। আইরাত টুকটাক কথা বলছিলো তখনই ইলা ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। রুকশানা ইলা কে দেখে দাঁড়িয়ে পরে।

রুকশানা;; মা…!
ইলা;; হ্যাঁ আব্রাহাম ওপরেই আছে তুমি যাও।
রুকশানা;; জ্বি।
রুকশানা আব্রাহামের রুমের দিকে পা বাড়ায়। আইরাত কতোক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে ইলা কে বলে….
আইরাত;; দাদি..!
ইলা;; হুমম
আইরাত;; আব্রাহামের সাথে কি কথা বলতে এসেছেন উনি?
ইলা;; জানি না রে নাতবউ।
আইরাত;; আব্রাহাম রাগারাগি করবে না তো?
ইলা;; তাই তো বলে এলাম। দেখি কি হয়।
আইরাত;; আচ্ছা ধরো মেডিসিন নাও।

রুকশানা গিয়ে আব্রাহামের রুমে চলে যায়। আব্রাহাম করিডরে ছিলো। রুকশানা কে দেখে সে ভেতরে আসে।
আব্রাহাম;; কেমন আছেন?
রুকশানা;; আলহামদুলিল্লাহ বাবা, তুমি?
আব্রাহাম;; আপনার গুনোধর ছেলে ভালো আর থাকতে দিলো কই।
রুকশানা;; ___________________
আব্রাহাম;; তো আমার কাছে এতো বছর পর কি মনে করে?
রুকশানা;; কি করবো বাবা বলো, ছেলে হাজার ভুল করলেও। এমনকি মাকে ভুলে গেলেও মা তো আর তা করতে পারে না তাই না।

আব্রাহাম;; কথা টা বলার জন্য আমাকে মাফ করবেন কিন্তু আপনি আপনার ছেলের ভালোভাবে লালন-পালন করতে পারেন নি। একদম না। তা নাহলে এমন অমানুষ হতো না।
রুকশানা;; আমি জানি রায়হান আর তোমার মাঝে কিছুই ঠিক নেই, কিছুই না। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি।
আব্রাহাম;; বলুন।
রুকশানা;; আব্রাহাম বাবা এখনো কি রাগ করে আছো আমার সাথে?

আব্রাহাম;; না। হ্যাঁ যখন ছোট বেলা রৌনক চৌধুরী আপনাকে বিয়ে করে আনে তখন সবার জন্যই ঘৃণার
পাহাড় জন্ম নিয়েছিলো আমার মনে। কিন্তু যখন বড়ো হলাম, বুঝতে শিখলাম তখন বুঝলাম যে আপনারও যাওয়ার মতো কোন জায়গা ছিলো না তাই বাধ্য হয়েই আপনি এখানেই থেকেছেন। নয়তো একটা সুখের সংসার কে এভাবে তছনছ করে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আপনাও ছিলো না।
রুকশানা;; আমি জানি আমি কখনোই তোমার মায়ের জায়গা নিতে পারবো না। আর আমি নিতে চাইও না। যার‍ যার মায়ের প্রতি একটা আলাদা মায়া থাকে। হয়তো আমার ছেলের তাও নেই।

আব্রাহাম;; আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কেনো এসেছেন।
রুকশানা;; বাবা, আমি জানি রায়হান আইরাতের চাচা-চাচি কে মেরেছে। পুলিশ অফিসার রা আমার বাসাতেও এসেছিলো তাদের মুখ থেকেই সব শুনেছি। সব জানি আমি। তুমি তো রায়হান কে মেরেই ফেলবে যদি তাকে কাছে পাও। এটাও আমি জানি। কিন্তু কি করবো বলো মা আমি। ছেলের সাত খুন মাফও করে দিতে পারি। এতে হয়তো তুমি আমাকে স্বার্থপর ভাবতে পারো। কিন্তু………
আব্রাহাম;; কি হয়েছে তা সোজাসাপটা বলুন।

রুকশানা;; আব্রাহাম বাবা, আমি তোমার সামনে হাত জোর করছি প্লিজ রায়হান কে মেরো না। আমি জানি ও অনেক বেশি অন্যায় করেছে। কিন্তু আমি তোমার কাছে হাত জোর করে মিনতি করছি প্লিজ ওকে মেরো না। (হাত জোর করে)
আব্রাহাম গিয়ে রুকশানার হাত দুটো ধরে ফেলে।
আব্রাহাম;; না না এভাবে হাত জোর করবেন না। মানলাম আপনি আমার মা না কিন্তু আমার মায়ের মতোই। প্লিজ এভাবে হাত জোর করে আমাকে লজ্জা দিবেন না।
রুকশানা কেদে মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে।

রুকশানা;; রায়হান কে মেরো না আব্রাহাম, আমার কোল খালি হয়ে যাবে। রায়হান শান্তি পাওয়ার যোগ্য আমি জানি কিন্তু ওকে একদম মেরে দিও না। আমি অনুরোধ করছি।
আব্রাহাম;; আমি ওকে মারবো না।
রুকশানা;; সত্যি?
আব্রাহাম;; হ্যাঁ মারবো না ওকে আমি। ছেড়ে দিলাম।
রুকশানা;; ধন্যবাদ বাবা। আর পারলে আমাকেও মাফ করে দিও। এতে আইরাতের সাথেও ভুল হবে কেননা ওর বাবা-মা সমতুল্য চাচা-চাচি কে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার ওপর আজ হয়তো স্বার্থপর চিহ্ন টা লেগে গেলো।
আইরাত;; একদম না।

আব্রাহাম আর রুকশানা পেছনে তাকিয়ে দেখে আইরাত দাঁড়িয়ে আছে। আইরাত এগিয়ে আসে।
আইরাত;; আমার কথা ছাড়ুন। আন্টি আমি বুঝতে পারছি যে আপনার কেমন লাগছে। পৃথিবীতে এমন কোন মা ই নেই যে নিজের ছেলের মরণের কথা শুনে ছুটে আসবে না। আপনিও এসেছেন ঠিক আছে। হ্যাঁ মানলাম রায়হান আমার চাচা-চাচি কে মেরেছে। তবে খুনের প্রতিশোধ যে সবসময় খুন করেই নিতে হবে এমন তো কোন কথা নেই তাই না। মাফ করে দেওয়া সবচেয়ে বেশি ভালো কাজ। আর যে মাফ করে দেয় তার মাথা এমনিতেই উঁচু হয়ে যায়। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন রায়হানের গায়ে একটা আচড় অব্দি আসবে না। বাবা-মা বা নিজের আপন কেউ নিজের থেকে চিরতরে দূরে সরে গেলে কেমন লাগে তা আমি বুঝি। আমি চাই না যে এই বুঝটা আরো কেউ বুঝুক। আব্রাহাম কাউকে মারবে না ?।

রুকশানা কেদে কেদে আইরাতকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর সবার সাথে কথা বলে রুকশানা চলে যায়।
আইরাত বাইরে রুকশানা কে বিদায় দিয়ে এসে পরে। নিজের ওরনা তে টান লাগলে আইরাত তাকিয়ে দেখে রনিত গোলগোল চোখে তার ওরনা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আইরাত তার সামনে ঝুকে পরে।
আইরাত;; কিরে মোটু কি করিস এখানে? (গালে ধরে)
রনিত;; উনি কে?
আইরাত;; বললেই কি তুই চিনবি?

রনিত;; আম্মু-আব্বু কে এই মেরেছে?
আইরাত কি বলবে খুঁজে পায় না। রনিতের সামনে এক হাটু ভাজ করে তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে….
আইরাত;; না না, একদম না। কে বলেছে এইসব কথা। কেউ মারে নি।
রনিত;; আমি শুনেছি।
আইরাত;; কেউ কাউকে মারে নি রনিত। তুমিই না বলেছিলে যে ওরা পাঁচজন ছিলো। তাহলে এদের মাঝে এই কি করে আসবে বলো। এই তো একা। আর ওরা সবাই ছেলে ছিলো তাই না। কেউ কাউকে মারে নি।
রনিত;; আপু আম…….
আইরাত;; সবজি খেতে দিয়েছিলাম তোকে খেয়েছিস?
রনিত;; ?

আইরাত;; এখন যদি সবগুলো সবজি না খাস তুই তাহলে আমি তোকে মেরে আলু ভর্তা বানাবো।
রনিত দৌড়ে চলে যায়। আর হ্যাঁ রনিত মোটাসোটা।
আইরাত;; এই মোটু দাড়া, একদম দৌড়াবি না দাড়া।
আইরাত রনিতের পেছনে পেছনে ছুটে চলে যায়। আইরাত হলরুমে এসে ওপরের দিকে তাকায়। আব্রাহাম না জানি কি করছে। সে রুমে চলে যায়।
গিয়েই দেখে আব্রাহাম দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো তার বাইরের দিকে। আইরাত গিয়ে আব্রাহামের কাধে হাত রাখে….

আইরাত;; কি হয়েছে?
আব্রাহাম;; মায়েরা এতো অদ্ভুত হয় কেনো?
আইরাত;; কারণ আল্লাহ তাদের সবার থেকে আলাদা ভাবে বানায় তাই।
আব্রাহাম;; না মানে তুমি ভাবতে পারছো যে দু-দুটো মানুষ কে খুন করা হয়েছে আর তারই মা কিনা আজ এসে নিজের ছেলের জন্য আহাজারি করছে আমার কাছে।
আইরাত;; আপনি লন্ডন রায়হান কে মারার জন্য যেতে চাইছিলেন তাই না?
আব্রাহাম;; হ্যাঁ।

আইরাত;; ছেড়ে দিন। যেভাবে আছে সেভাবেই থাক। মাফ করে দিন। আর ঝামেলা করতে হবে না। হয়তো আমার চাচা-চাচির ভাগ্যে তাদের মৃত্যুটা এভাবেই লিখা ছিলো তাই মারা গেছে। আমি তো এই ভেবে খুশি যে আমার রনিতের কিছুই হয় নি।
আব্রাহাম;; কোথায় ও??

আইরাত;; এক একটা সবজি তুলে তুলে মুখের সামনে নিয়ে দেখছে তারপর নাক-মুখ কুচকাচ্ছে আবার রেখে দিচ্ছে।
আব্রাহাম;; তুমিও না বাচ্চাদের কি না কি খেতে দাও। দরকার কি সবজি খাওয়ার, চকোলেট দাও।
আইরাত;; হ্যাঁ আমার তো মাথা খারাপ হয়েছে। বেশি করে বাইরের জিনিস খাওয়াই ওকে।
আব্রাহাম;; হয়েছে, নিজে কি কম খাও নাকি!?
আইরাত;; আগে থেকে অনেক কমেছে আমার।
আব্রাহাম;; আমাকেও আমার মা আর দাদি মিলে ঠেসে ঠেসে আগে সবজি খাওয়াতো। ধুর কি ঘাস-ঘুস এগুলোও মানুষ খায়।

আইরাত;; না গরু-ছাগলে খায়।
আব্রাহাম;; আমাদের বেবি হলে না জানি তুমি কি করো।
আইরাত;; এই চুপ করুন। আপনি বাইরে যাবেন না তাই আমার হ্যাপি লাগছে।
আব্রাহামের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপে বসে। সে আইরাতের কোমড়ে একটান দিয়ে নিজের বুকের ওপর ফেলে দেয়।
আব্রাহাম;; ওহ তাই না, আমি বাইরে যাবো না এতে তুমি খুব খুশি কেনো বলোত?
আইরাত;; আব..না মানে, মানে আসলে আমি তো।
আব্রাহাম;; হুম হুম তুমি কি বলো।

আব্রাহাম আইরাতের কোমড়ে-পেটে সুরসুরি কাটতে লাগলো। আর আইরাত ছটফট করছে, আব্রাহামের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলে আব্রাহাম যেনো আরো আকড়ে ধরে।
আইরাত;; আব্রাহাম কি করছেন ছাড়ুন। আমার কাতুকুতু লাগছে ?? ছাড়ুন।
আব্রাহাম;; না বাইরে যেহেতু যাবোই না তাহলে সারাদিন তোমার সাথে চিপকে থাকি। (আইরাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে)

ইলা;; আইরাত! আইরাত!
আইরাত;; ওই যে দাদি ডাকছে। আব্রাহাম ছাড়ুন তো আমাকে।
আব্রাহাম আইরাতের ঘাড়ে চুমু দিয়ে দেয়। আইরাত কোন রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে আব্রাহামের দিকে একটা ভেংচি কেটে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে পরে।
আব্রাহাম মুচকি হেসে করিডরে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করেই নিজের ফোন বেজে ওঠে। আব্রাহাম গিয়ে তা ধরে। আননোন নাম্বার।

আব্রাহাম;; হ্যালো..
রায়হান;; হ্যালোওওওওওও বড়োভাই।
আব্রাহাম;; কেনো ফোন করেছিস?
রায়হান;; আরে আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমি তো তুই কেমন আছিস তা জানার জন্য ফোন করেছি।
আব্রাহাম;; হুমম আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আর তোকেও ভালো রেখেছি।
রায়হান;; আমি তো ভালোই থাকবো।
আব্রাহাম;; হুমম। মরনের মুখ থেকে ফিরে আসলে কেউ না খুশি থেকে পারে বল।
রায়হান;; মানে?

আব্রাহাম;; বেশ ভালো হয়েছে যে তুই আমাকে কল করেছিস। আর শোন কথা বলার পর সিম ভেঙে ফেলার দরকার নেই। আমি তোকে ট্রেস করবো না। ছেড়ে দিয়েছি তোকে। নয়তো এতোক্ষনে তুই দুনিয়ার ওপারে থাকতি।
রায়হান;; মানে কি এইসবের?
আব্রাহাম;; শুধু জন্ম দিলেই যেমন বাবা-মা হয়ে যায় না ঠিক তেমনই মানুষের পেটে থেকে জন্মালেও সবসময় মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়া যায় না। মানুষের পেট থেকে অমানুষ হয়ে বের হয়েছিস তুই।

রায়হান;; যা ইচ্ছে বল।
আব্রাহাম;; তোর মা এসেছিলো আমার কাছে।
রায়হান;; কিহ, কেনো এসেছিলো?
আব্রাহাম;; তোর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে আর কি।
রায়হান;; কি বলতে চাস তুই?

আব্রাহাম;; তুই লন্ডনে আছিস। এতোক্ষনে আমি তোর সামনে থাকতাম। আর তুই থাকতি লাশ হয়ে। কিন্তু তোর মা এসে আমার কাছে যা বললো তাতে তোকে মারার জন্য আমার মন আর সাই দিলো না। ভাগ্য ভালো তুই মা এতো ভালো পেয়েছিস। সময় থাকতে মানুষের কদর করতে শিখ, সময় ফুরিয়ে গেলে আফসোস করেও লাভ নেই। ভালো থাক।
আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়। আর ওইদিকে রায়হান কি করবে ভেবে পায় না। রাগ হচ্ছে তার।

প্রথমত আব্রাহাম এতো জলদি তার ঠিকানা পেয়েও গেছে আর কি দরকার ছিলো রুকশানার আব্রাহামের কাছে গিয়ে এগুলো বলার। রায়হান রাগে তার হাতে থাকা ফোন টা ছুড়ে মারে। আব্রাহাম তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আব্রাহাম ভিক্ষে দিয়েছে তাকে, ভিক্ষে। আব্রাহাম তার জীবন তাকে ভিক্ষে দিয়েছে। এটা ভাবতেই যেনো রায়হানের মাথায় আগুন ধরে উঠছে। রায়হান রাগে রুমে শুধু পায়চারি করে যাচ্ছে তখনই হাই হিলের টগবগ শব্দ তুলে প্রীতি রুমে আসে। রায়হানের মুখ খানা দেখে বুঝলো যে বেশ রেগে আছে…..

প্রীতি;; রায়হান, সবকিছু ঠিক আছে তো?
রায়হান;; কিচ্ছু ঠিক নেই।
রায়হান রাগে চিল্লিয়ে ওঠে পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ব্যাস টা ভেঙে ফেলে। প্রীতি ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
রায়হান;; আমার মা ওই আব্রাহামের কাছে গিয়ে নাকি বলেছে যে আব্রাহাম যেনো আমাকে না মারে। তার মানে কি আমি কি আব্রাহাম কে দেখে ভয় পাই নাকি। ওই আব্রাহাম আমার সামনে আসলেই বা কি। আমি কম না। মা কেনো যে আব্রাহামের কাছে গেলো। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।

প্রীতি;; আচ্ছা ঠিকআছে আগে তুমি শান্ত হও। ব্যাপার হাতের বাইরে যায় নি এখনো। তুমি ঠান্ডা করো মাথা। আর এভাবে হাল ছেড়ে দিলে হয় না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। শান্ত হও।
রায়হান প্রীতির হাত খপ করে ধরে ফেলে নিজের দিকে নিয়ে আসে।
রায়হান;; আমার আইরাতকে চাই (দাত কটমট করে)

প্রীতি;; ওকে, ওকে ফাইন। সব হবে। আগে তুমি চুপ করো। রাগের মাথায় নেওয়া সব ডিসিশন খারাপই হয়। ঠান্ডা হও। আর এখন যে আব্রাহাম লন্ডন আসবে না তাতে আমাদেরই ভালো হয়েছে।
রায়হান প্রীতি কে ছেড়ে দেয়। প্রীতি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে রায়হানের পাশে এসে দাঁড়ায়।
প্রীতি;; আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে। এন্ড আই এম সিওর যে এটা কাজ করবে।

আব্রাহাম-আইরাত সেদিকে ভালোই আছে। আইরাত আগে থেকে তার চাচা-চাচি মৃত্যুর শোকে টা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আব্রাহাম তাকে সবসময় হাসি খুশি রাখে। আগে ছিলো তিনজন এখন চারজন। রনিত আছে। আসলেই বাড়িতে একটা ছোট বাচ্চা থাকলে বাড়ির চেহারাই পালটে যায়। খুনশুটিতে দিন কাটছে। আব্রাহাম অফিসে যায় আবার আসে। মাঝে মাঝে আইরাতের জিদের ফলে তাকে অফিস কামাই দিতে হয়।

আগে চকোলেট আনতে হতো একজনের জন্য এখন দুইজনের জন্য আনতে হয়। রনিতকে আব্রাহাম নিজের জান দেখে। মাঝে মাঝে এই দুই ভাই-বোনের কান্ড দেখে তো আব্রাহাম বলেই উঠে যে “”এই দুই পাগলের জন্য আমি নিজেও পাগল হয়ে যাবো””। তখন আর আব্রাহাম কে পায় কে। আইরাত আর রনিত মিলে ফাইট শুরু করে দেয়। আজ আব্রাহামের দাদার মৃত্যুবার্ষিকী। তাই ইলা আর আইরাত মিলে জমিয়ে রান্না করছে।

আজ কোন স্টাফ রানবে না। আইরাত আর ইলা সকাল থেকেই সব শুরু করে দিয়েছে। আব্রাহাম যদিও না করেছিলো কিন্তু ইলা আর আইরাতের সাথে পায় নি। অনেক সময় ইলা রান্নাঘরে ছিলো তাই আইরাত ইলা কে হলরুমে এসির নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। তার ঘন্টা খানিক পর আইরাত ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। রনিত ওপরে আব্রাহামের কাছে। আইরাত ভাবলো গরমের দিন যেহেতু তাই সবার জন্য ঠান্ডা জুস নিয়ে যাক। ইলাকে জুস দিয়ে আইরাত দুটো গ্লাস নিয়ে ওপরে রুমে যায়। তবে রুমে গিয়ে রুমের দরজা খুলতেই আইরাতের মুখ হা।

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪৩+৪৪+৪৫

তার মাথা ঘোরাচ্ছে। পুরো রুম বালিশের ভেতরের তুলা দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চারিদিকে খালি তুলা আর তুলা। কিছু কিছু উড়েও যাচ্ছে। আর বিছানার ওপর তাকিয়ে দেখে আব্রাহাম আর রনিত পিলো ফাইট করছে। দুইজনের হাতে দুটো বালিশ। আর তার ভেতরের তুলা নেই বললেই চলে। সব তুলা বাইরে বের হয়ে গেছে। আব্রাহাম-রনিত এতোক্ষন বালিশ নিয়েই এগুলো করছিলো আইরাতকে হঠাৎ এভাবে দেখে দুজনেই চুপ হয়ে যায়। আইরাত চোখ গুলো ছোট ছোট করে তাদের দুইজনের দিকে তাকায়। আইরাতের এমন চেহারা দেখে আব্রাহাম রনিত দুজনেই শুকনো ঢোক গিলে।
আইরাত এগিয়ে গিয়ে কোন রকম করে টি-টেবিলের ওপর জুসের গ্লাস দুটো রাখে। আইরাত তাকিয়ে দেখে আব্রাহাম আর রনিত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই আছে। এটা দেখে আইরাতের মাথা খারাপ হয়ে যায়।

আইরাত;; এইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই!! এগুলো কি? সারাদিন রান্নাঘরে এতো কাজ করার পর এখন এগুলো। ঘেমে নেয়ে শেষ হয়ে গেছি আমি। এখন এই রুম কে পরিষ্কার করবে। রুম নাকি কোন গরুর গোয়াল। কি একটা অবস্থা করেছে। এগুলো কে করবে এখন। আর কিছু ছিলো না খেলার জন্য। বাইরে বাগানে গিয়ে খেলেতে। দুইজনেই এগুলো কি করেছো। (অনেক চিল্লিয়ে)

আইরাতের চিল্লানোর ফলে আব্রাহাম আর রনিত দুইজনেই কানে আঙুল দিয়ে রেখেছে। আইরাত আরেকবার চিল্লিয়ে উঠলে আব্রাহাম আর রনিত দুজনেই দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। কি আর করার আইরাত সব পরিষ্কার করে। তার যেনো নাকের পানি আর চোখের পানি এক। পুরো জঙ্গলি হয়ে গেছে। আইরাত ইনিয়ে-বিনিয়ে নিচে নেমে আসে। ইলা আইরাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আব্রাহাম-রনিত আইরাতকে দেখে হিহিহি করে হেসে দেয়। তারপর দুইজনেই হাই ফাইভ করে। আইরাতকে চেনা যাচ্ছে না। মাথায় এতো গুলো তুলা, মুখ টা কালো হয়ে গেছে। আব্রাহাম আর রনিত কে হাসতে দেখে আইরাত দেয় আরেক ধমক।

কি আর করার ইলা এদের কান্ড দেখে হাসছে। বিকেলের দিকে পুরো এলাকার যত গরিব-অসহায় মানুষ ছিলো তাদের সবাইকে ডেকে খাওয়ানো হয়েছে আব্রাহামের দাদার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে। এভাবেই দিন গেলো হাসি-খুশিতে। তবে কেনো জানি তাদের এই খুশিতে কালো ছায়া পরে গেছে। নজর লেগে গেছে কারো।

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৪৯+৫০+৫১