পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩০

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩০
মম সাহা

ধূলো পড়া ঘরে যেন লুকিয়ে আছে মোহনার অমানুষ হওয়ার চিহ্ন। হাজের খানেক রহস্যের জাল বুনানো আছে এই ঘরখানায়। মায়া হৈমন্ত নিস্তব্ধ হয়ে সেই রহস্য, লুকিয়ে রাখা হিংস্রতা দেখে তব্দা খেয়ে আছে। তাদের বলার ভাষা নেই। বাক্যও ফুরিয়েছে। দু’জন কেবল দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। ডায়েরীর মলিন পাতায় ঘেটে যাওয়া লিখাটাতে মোহনার আফসোস ছাড়া পাপকার্যের কথা লিখা।

হৈমন্তের ফোন পেয়েই মায়া ছুটে এসেছিলো বাড়িতে। হৈমন্ত তখন বিপ্রতীপদের বাড়ির ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। মায়া ঘরে ঢুকতেই দেখে হৈমন্ত একটা ডায়েরী বার বার নেড়েচেড়ে দেখছে। মায়া তার সামনে দাঁড়াতেই ডায়েরীটা মেলে ধরে হৈমন্ত। মায়া কতক্ষণ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখে। ডায়েরীর শক্ত মলাটের উপর লাল রাঙা কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ‘বীভৎস বিধ্বস্ততা’।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মায়া ডায়েরীটা উলোটপালোট করে দেখলো কতক্ষণ। ডায়েরীটার এমন অদ্ভুত নামকরণ দেখে সামান্য চমকায়ও সে। কিন্তু ডায়েরীটা খুলে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলো মায়া। ডায়েরীটার প্রথম থেকে মাঝামাঝি অংশ ছেঁড়া। লাস্টের কত পৃষ্ঠা নেই। কেবল গুটি কয়েক পৃষ্ঠাই আছে ডায়েরীটার। মায়া মাঝামাঝি একটা পৃষ্ঠায় কিছু লেখা দেখতে পায়। তারিখটা বেশ পুরানো। আরও পঁয়ত্রিশ বছর আগের। এত পুরানো তারিখ দেখে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায় তার। তারিখের থেকে চোখ নামিয়ে আনে পৃষ্ঠার মাঝামাঝি দোয়াত দিয়ে লিখা স্থূল শব্দ যুগলে। দোয়াতের কালি ঘেঁটে গিয়ে কালসিটে হয়ে গেছে। তবুও লিখাটা স্পষ্ট হয়ে জানান দিচ্ছে মোহনার কৃতকর্ম। গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,

❝জীবনের দ্বিতীয় খু*ন করেছি আজ। প্রথম খু*নটা করার সময়ই টার্গেট করেছিলাম দ্বিতীয় খু*নটা তাকেই করবো। প্রথম বারের মতন আমার হাত কাঁপে নি আজ, হৃৎপিণ্ডও ছলাৎ করে উঠে নি খু*ন করার সময়। বেশ সাবলীল ভাবে খু*নটা করেছি। সবার ভাষ্যমতে খু*ন হওয়া ব্যাক্তিটা আমার ভাইয়ের বউ। খু*ন করে পিস পিস করে কেটেছি। মাটির ঘর লাল বর্ন ধারণ করেছিল। তারপর ভাসিয়ে দিয়েছি বাড়ির পিছে পুকুরটাতে। কেউ জানবে না সে কোথায়। কি তৃপ্তি!❞
মায়ার হাত থেকে ছিটকে ডায়েরীটা পরে যায়। চোখের সামনে যেন দেখলো সে নিদারুণ বীভৎসতা। এত ভয়ঙ্কর তার শ্বাশুড়ি! এতদিন যাবত তার আচরণের কারণে তাকে নিকৃষ্ট মনে হয়েছিলো কিন্তু আজ,আজ যেন তাকে আখ্যায়িত করার ভাষা মায়ার জানা নেই। শব্দ ভান্ডার খুঁজেও পাওয়া গেলো না মোহনার জন্য উপযুক্ত শব্দ। মানুষ এতটা খারাপ কীভাবে হয়?

হৈমন্ত ডায়েরীটা উঠালো। হৈমন্তের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই কারণ সে হয়তো আগেই পড়ে ফেলেছে। মায়ার শরীর অনবরত কাঁপছে আর ঘামছে। এমন নিষ্ঠুর মেয়ে মানুষ হতে পারে কখনো? হৈমন্ত মায়ার আঁচল টেনে মায়ার মুখের ঘামটুকু মুছে দেয় যত্নে। বাহুতে হাত রেখে ভরসা দেয়। চোখ দিয়ে ইশারা করে পরের পৃষ্ঠা গুলো পড়তে।
মায়া আবার পৃষ্ঠা উল্টায়। মাঝের পৃষ্ঠা গুলো ছেঁড়া। এক,দুই,তিন করে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে ঠিক ষষ্ঠ নাম্বার পৃষ্ঠার মাঝা মাঝি আরেকটা লেখা চোখে পড়লো মায়ার। মায়া নিজেকে শক্ত করলো এই ভেবে যে, হয়তো আরও বীভৎস কিছু আছে ডায়েরীটার মাঝে। এই লিখাটা লেখা হয়েছে আগের লেখাটার ঠিক দুইমাস পর।

❝এই নিয়ে তৃতীয় খু*নটা করেই ফেললাম। মানুষ জানবে না, আমার ভাই আমার হাতে খু*ন হয়েছে। আহারে বেচারা, খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছি তোকে তাই না রে? মানুষ তোর লাশটা দেখলে আফসোসের সাথে বলবে আহারে কৃষ্ণকমল লোকটা কত ভালোই না ছিলো। ফাঁ*সি দিয়ে মরলো কেনো! নিশ্চয় বউটা পরপুরুষের সাথে গিয়েছে বলে এ কাজ করলো লোকটা। আহারে! আহারে! ওরা তোর ঝুল*ন্ত লাশ আর গলার মোটা দাঁগ দেখবে ভিতরের ভয়াবহতা কেউ জানবে না।❞
মায়া আরেকদফা চমকে গেলো। নিজের ভাইকেও এ মহিলা খু*ন করেছে? এ মানুষ নাকি পিচাশ? মায়া ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পর পর আরও পৃষ্ঠা উল্টায়। এ মহিলা আর কোনো খু*ন করেছে কিনা জানার জন্য। কিন্তু না,আর কোনো খু*নের কাহিনী নেই। মায়া স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এ মহিলাকে রীতিমতো তার ভয় করছে এখন। এ মহিলা যে স্বাভাবিক না বুঝায় যাচ্ছে। মারাত্মক রকমের মানসিক সমস্যার রোগী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাভাবিক মানুষ কখনো এমন করতে পারবে না নিশ্চয়।

মায়া ডায়েরীটা বন্ধ করতে নিলেই থামিয়ে দেয় হৈমন্ত। ধীর কণ্ঠে বলে,
“আরও কিছু আছে লিখা। শেষ পৃষ্ঠায় দেখ।”
মায়া অবাক হয়। আরও কিছু লিখা আছে মানে? এ মহিলা কী আরও খু*ন করেছে? কাকে করেছে?
মায়া বিদ্যুতের গতিতে আবার ডায়েরীটা খুলে। শেষ পৃষ্ঠায় চোখ যেতেই চক্ষু চড়কগাছ। ডায়েরীটা পুরোনো। সেখানে লিখা প্রতিটা ঘটনাকাল,সময়ও পুরোনো। কিন্তু এ লিখাটা পুরোনো না। কয়েকদিনের মাঝেই লিখেছে। তারিখটা প্রায় মাস খানেক আগের। কালো বলপেন দিয়ে হয়তো লিখেছে। লিখাটা,

❝আমার মৃত্যু ক্ষুধা অনেক বছর আগেই মিটে গিয়েছিলো। কিন্তু কে জানতো এত বছর পর আবারও তা জেগে উঠবে? আমি আবার রক্ত মাখাবো হাতে! খুব শীগ্রই পড়তে যাচ্ছে আরেকটা লা*শ। সময়ের অপেক্ষা কেবল।❞
মায়া একবার লিখাটা আরেকবার হৈমন্তের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। তার চোখ ব্যাপ্ত করছে কত রকমের কথা। হৈমন্ত মায়ার অবস্থা বুঝলো। ধীর গতিতে মায়ার হাতে নিজের হাতে রাখলো। আশ্বাসের স্বরে বললো,
“ভয় পাস না। আমি আছি তো। এই মহিলাকে আর কারো মৃত্যুর কারণ হতে দেওয়া যাবে না। তিন তিনটা খু*ন করেছে সে। নিজের ভাই আর বৌদিকে খু*ন করেছে। কিন্তু আরেকজনটা কে সেটা বের করতে হবে আমাদের। আর তাছাড়া সে পরবর্তী কাকে নিশানা করেছে সেটাও খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। আমরা পারবো।”

“শেষ টার্গেট আমি না তো?”
হৈমন্ত কেঁপে উঠলো মায়ার প্রশ্নে। সত্যিই তো,সে তো এটা ভেবে দেখে নি। শেষ টার্গেট তো মায়াও হতে পারে। কারণ ইদানীং মায়া এ মহিলাকে জ্বালাচ্ছে,ক্ষ্যাপাচ্ছে। নিজের ভয়টা নিজের মনেই রাখলো হৈমন্ত। ভরসার স্বরে বললো,
“আরে না,তুই হবি কেনো? আর তুই হলেও বা কী? আমি আছি না তোর সাথে? আমি তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াবো। ভাবিস না। আবার দর্শিনী দিদিও হতে পারে। সাবধানে থাকতে হবে।”
হৈমন্ত যতই আশ্বাস দেক,মায়ার মনে খুঁতখুঁত রয়েই গেলো। যতটুকু মনে হয়েছে মোহনা ভয়ঙ্কর মহিলা। শেষ টার্গেট খুব সম্ভবত মায়াই হবে। মায়ার নিজেকে সাবধানে রাখতে হবে। তার বোনের জন্য হলেও তাকে বাঁচতে হবে।

দারুণ কারুকাজ সজ্জিত সোফার মাঝে গোল হয়ে বসে আছে মৃত্যুঞ্জয়দের বিশাল পরিবার। মধ্যমণি হলো দর্শিনী। সবার কৌতূহল দৃষ্টি দর্শিনীর মুখের উপর।
দর্শিনীর মনে সামান্য ভয় আর লজ্জা মিলে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। সে যখন প্রবেশ করলো বাড়িতে, যে ভদ্রমহিলা তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলো, সে মহিলা তার পাশে বসে আছে হাসি হাসি মুখে। তার আশেপাশে অনেক মানুষ। সাত আট বছরের একটা ফর্সা ধবধবে ছেলেও আছে। এটা যে পুরো বিদেশি দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
দর্শিনী কৌতূহলী দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,

“মৃত্যুঞ্জয় কোথায়?”
পাশের মহিলাটি মুচকি হাসলো। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ও তো নিজের ঘরে আছে। তুমি ভালো আছো তো,মা?”
দর্শিনী অবাক হলো এই অপরিচিত মহিলার আচরণে। এত সুন্দর ব্যবহার!
দর্শিনী হাসি মুখে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ আন্টি,ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”
“আমি ভালো আছি মা। তোমাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিলো,আজ পূরণ হলো। তুমি ভারী মিষ্টি। প্রেগন্যান্সির কারণে বোধহয় আরও বেশি মিষ্টি লাগছে।”

দর্শিনী কিঞ্চিৎ অবাক হলো মহিলার কথায়। কিন্তু অবাক ভাবটা নিজের ভিতরেই রাখলো। তাছাড়া ভদ্রমহিলা দারুণ বাংলা জানেন। বিদেশী কোনো ছাপ নেই শরীরে।
দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই তার সামনের সোফায় বসা ফর্সা বাচ্চা ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“হু ইজ সি, জেম্মা?”
দর্শিনীর পাশে বসা মহিলাটা মুচকি হাসলো। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে বললো,
“সি ইজ এ্যা ফেইরি। তোমার না ফেইরি পছন্দ?”

বাচ্চাটা মাথা ঝাঁকালো। যার অর্থ তার ফেইরি পছন্দ। অতঃপর সে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বললো,
“আ’ম ধ্রুব। আমি বেঙ্গলিও পারি। জেম্মা শিখিয়েছে। তোমাকে আমার দারুণ লেগেছে ডার্লিং।”
দর্শিনী চোখ বড় বড় তাকিয়ে থাকে ছেলেটার কথায়। কী পাঁকা ছেলে! তবে ভীষণ আদুরে আর মিষ্টিও। বাংলাটা একটু অশুদ্ধ বলে কিন্তু দারুণ লাগে।
ভদ্রমহিলা এবার দর্শিনীকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ভদ্রমহিলা হলো মৃত্যুঞ্জয়ের মা। পিচ্চিটা মৃত্যুঞ্জয়ের কাকাতো ভাই৷ মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা কাকারা দুই ভাই আর তাদের এক বোন আছে। সে বাংলাদেশই থাকে। এছাড়া মৃত্যুঞ্জয়দের পরিবারের সবাই বিদেশী। মৃত্যুঞ্জয়ের কাকী সেই দেশেরই মহিলা। সবাই বেশ ভালো ও মিশুক। দর্শিনীর এক নিমিষেই পুরো পরিবারটাকে দারুণ লেগে যায়।

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২৯

সবার সাথে পরিচয়ে ব্যস্ত থাকা কালীন ড্রয়িং রুমে হাজির হয় লম্বাচওড়া এক ভদ্রলোক। দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি দিয়েই চিৎকার দিয়ে বলে,
“এই মেয়েটা! এই মেয়েটা এখানে কী করছে? এ বাড়িতে ওর কী?”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩১