প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৬

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৬
ইলমা বেহরোজ

নির্জনের রুম সামনে এসে আঞ্জুমান ভাবনায় ডুবেন।ছেলের অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকবেন নাকি অনুমতি ছাড়া।অনুমতি ছাড়া ঢুকলে কি সাংঘাতিক কাজ কর্ম দেখতে হয়।সেদিন ঢুকে দেখেন নির্জন ভিডিও কলে রোহিকে উড়ন্ত চুমু দিচ্ছে!আঞ্জুমান দরজায় টোকা দিয়েই ডাকেন,
— “নির্জন, আব্বু আছোস?”
একটু থেমে আবার ডাকে,
— “নির্জন?”
গলার স্বর দ্বিগুণ করেন,
— “নির্জন?”

নির্জন ভিডিও কলে ব্যস্ত ছিলো রোহির সঙ্গে।মায়ের কন্ঠ কানে আসেনি।তৃতীয় ডাকটা কানে আসে।মা জোরে চেঁচিয়ে ডাকছেন।তাড়াতাড়ি কল কাটে নির্জন।এরপর দরজা খুলে টান টান করে জোরপূর্বক হাসে।আঞ্জুমান ছেলের হাসির স্টাইল দেখে কপালের ভুরু হালকা কুঞ্চিত করে বললেন,
— “হাঁদারামের মতোন হাসবিনা আমার সামনে।হাঁদারাম আছিস হাঁদারাম থাক!প্রকাশ করার কি দরকার?”
নির্জন বাধ্য ছেলের মতো হাসি বন্ধ করে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়ায়।আঞ্জুমান বলেন,
— “এখন স্ট্যাচু হইছোস কেন?ঢং করবিনা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নির্জন তখনো স্ট্যাচু!ইচ্ছে করে এমন করছে মা কে রাগানোর জন্য।সোজা হয়ে থাকবে কথা বলবেনা, হাসবেনা।আঞ্জুমান ছেলের দিকে সরু চোখে তাকান।নির্জনো হুবুহু কপি করে তাকায়।আঞ্জুমান চোখ দিয়ে ভয় দেখান।নির্জনও তাই করে।আঞ্জুমান নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেন,জিহ্বা বের করেন।নির্জন মায়ের পাগলামি দেখে জোরে হেসে উঠে।সাথে হাসেন আঞ্জুমান।নির্জনের পিঠ চাপড়ে বলেন,
— “সুখবর আছে।”
নির্জন আগ্রহ নিয়ে তাকায়।আঞ্জুমান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলেন,

— “রোহিরে কল দিয়ে বল আমরা আগামী বৃহস্পতিবার বিয়ে পাকা করতে ওদের বাড়ি যাচ্ছি।আংটি পরিয়ে আসবি সেদিনই।বয়স তো কম না,আঠাশ হলো।”
নির্জন সেকেন্ড দুয়েক হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।এরপর মা’কে কোলে তুলে নেয় খুশিতে।আঞ্জুমান চিৎকার করে উঠেন,
— “পড়ে যাবো,পড়ে যাবো।নামা!”
নির্জন মা কে নামিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “থ্যাংকিউ সো মাচ আম্মু।সারপ্রাইজ ছিল আমার জন্য।”
আঞ্জুমান ছেলের এতো আনন্দ দেখে বুক ভরে শ্বাস নেন।এরপর ছেলের কপালে চুমু এঁকে বলেন,
— “তোদের খুশিই আমাদের খুশিরে বাবা।”

আঞ্জুমান নিঝুমের রুমে এসে দেখেন রুমে নেই নিঝুম।তিনি ব্যালকনিতে আসেন।নিঝুমকে পান।মগ্ন হয়ে লিখছে।তিনি ডাকেন,
— “নিঝুম? আব্বা।”
নিঝুম ঘুরে তাকায়।মা’কে দেখে হাসলো।বললো,
— “আম্মু।বসো।”
আঞ্জুমান বসতে গিয়ে দেখতে পান সেন্টার টেবিলে আরেকটা কফির মগ।তিতলির জন্য ছিল হয়তো।বুঝেও সাবধানে প্রশ্ন করেন,
— “কেউ এসেছিল?কফির মগ দেখছি।”
— “তিতলি এসেছিল।”
— “গল্প করতে আসছিলো?”
নিঝুম ডায়রি বন্ধ করে মায়ের সোজাসুজি বসে বললো,

— “সেদিন আসছিল বুঝছো।আমার এতো বই দেখে খুশি হয় খুব।তাই আমি বলেছি এক্সাম শেষে বই নিয়ে পড়তে।আজ বই নিতে আসে।বার বার বড়দের উপন্যাস নিচ্ছিলো পড়তে।আমি মানা করেছি।কিন্তু ও বড়দের উপন্যাসই পড়বে।কথা শুনলো না পড়তে বসলো।আমি জানতাম প্রেমের উপন্যাস ও কারোর সামনে পড়তে পারবেনা।লজ্জা পাবে।মেয়েটা খুব লাজুক।তবুও পড়েছে কিন্তু শেষে কি হলো জানো?ঠিকই লজ্জা পেয়েছে।আমি তাকাতেই উঠে ভোঁ দৌড়।”
নিঝুম হেসে উঠলো।কিন্তু শব্দ নেই নিঃশব্দ সেই হাসি।আঞ্জুমান মুগ্ধ নয়নে ছেলেকে দেখেন।আর অবাক হন খুব।নিঝুম সাধারণত বেশি কথা বলে না।বিস্তারিত কিছু বলে না। আঞ্জমান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

— “মেয়েটা খুব সরল আর ভালো।”
— “সেটা ঠিক তবে মেয়েটা বয়স কম আবেগ বেশি!আর ঘাড়ত্যাড়া।”
আঞ্জুমান মুখ ফসকে জিজ্ঞাসা করেন,
— “তিতলিকে কেমন লাগে তোর?”
নিঝুম শান্ত চোখে মায়ের চোখের দিকে তাকায়।এরপর প্রশ্ন এড়িয়ে বলে,
— “আব্বু বাসায় ফিরেছে?”
আঞ্জুমান ছোট করে উত্তর দেন,
— “হুম।”
নিঝুম আবার ডায়রি খুলে।আঞ্জুমান ভেবেছিলেন নিঝুমের হয়তো দূর্বলতা আছে তিতলির প্রতি।কিন্তু নিঝুমের কথায় বুঝে যান ছেলের কোনো আগ্রহ নেই তিতলির উপর।তবে,উনার বেশ মনে ধরেছে তিতলিকে হুট করেই।মিনিট কয়েক আগেও যা ভাবেন নি তাই এখন ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আঞ্জুমান বলেন,

— “আচ্ছা আসি আব্বা!’
— “আচ্ছা।”
নিঝুম পিছন থেকে আবার ডেকে উঠলো,
— “শুনো আম্মু?”
মিসেস আঞ্জুমান ঘুরে দাঁড়ান।নিঝুম বলে,
— “ডিনার করতে নিচে যাবনা।পাঠিয়ে দিও প্লীজ।”
— “আচ্ছা আব্বা।”

দরজার ওপাশে কেউ এসে দাঁড়ায়।টোকা দেয়।কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
— “তিতলি?”
তিতলি মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলে।অবাক হয়ে বললো,
— “নির্জন ভাইয়া আপনি?”
নির্জন আরো বেশি অবাক হয়।তিতলি তাকে আর নিঝুমকে গুলিয়ে ফেলেনি দেখে।নির্জন হেসে বলে,
— “চিনে গেছো দেখি।”
তিতলি মাথা নামিয়ে ভাবে,
— “আমি আমার ডাক্তারকে কখনো কারো সাথে গুলিয়ে ফেলবোনা ভাইয়া।”
নির্জন বলে,
— “রুমে ঢুকবো?’
তিতলি সামনে থেকে সরে গিয়ে বলে,
— “জ্বি ভাইয়া!’
নির্জন রুমে ঢুকে বললো,
— ” তুমি জানো তুমি আমার জন্য লাকি গার্ল।”
তিতলি অবাক হয়ে তাকায়।নির্জন বলে,

— “আসছো পাঁচদিন।এর মধ্যে আমার বিয়ে পাকা হয়ে যাচ্ছে।”
— “এ ক্রেডিট তো আমার না।আল্লাহ চাইছেন বলেই হয়েছে।”
নির্জন এক হাতে সামনের চুল ঠিক করে এরপর বলে,
— “সেটা ঠিক।তবে, তুমি আসার পর আমার এতদিনের অপেক্ষা শেষ হয়েছে।তাই তোমাকে ট্রিট দেব।বলো কি চাও?”
তিতলি লজ্জা পেয়ে বললো,
— “আপনাদের বাড়িতে এক-দু মাসের জন্য থাকতে দিয়েছেন এটাই অনেক।”
নির্জন দু’হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
— ” আব্বু দিয়েছে আমি না।আমার কাছে আলাদা করে কিছু চাও।”
— “একদিন চেয়ে নেব ভাইয়া।আজ মনে পড়ছেনা।”
— “আচ্ছা।কিন্তু আমি মরার আগে চেয়ো কিন্তু।”
তিতলি জোরে হেসে বললো,
— “হ্যাঁ ভাইয়া চাইবো।”
— “আচ্ছা আসি।”
— “জ্বি ভাইয়া আসুন!”

এরপরদিন দুপুর এগারোটায় তিতলি ছাদে আসে।বাগান দেখছিল ঘুরে ঘুরে।মৌনতা, মোহনা দুজন ভার্সিটিতে।নিঝুম নির্জন হস্পিটাল।বাড়ি প্রায় খালি।সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় আচমকা পা ফসকে পানিতে পড়ে তিতলি।পানি থেকে মুখ তুলে তিতলি হতবাক।মুহুর্তে কি হয়ে গেলো।নিজে নিজে হেসে ফেললো।স্বচ্ছ নীল পানি।পায়ের তালু অব্দি দেখা যাচ্ছে।বেশ লাগছে তার।আরেকটা ডুব দেয়।সাঁতার কাটতে থাকে।সেই মুহূর্তে নিঝুমের পা পড়ে ছাদে।সাদা শার্ট গায়ে, চোখে চশমা।নিঝুমের চোখ যায় সুইমিংপুলে।একটা মেয়ে নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটছে।স্বচ্চ নীল জলে ধবধবে ফর্সা এক কন্যা।জলে ভাসছে কালো লম্বা চুল।নিঝুম চিত্রশিল্পী হলে তখনি এই দৃশ্য এঁকে নিতো।সে এক পা এক পা করে সুইমিংপুলের পাশে এসে দাঁড়ায়।তিতলি থমকে যায়।কারো পায়ের শব্দ শুনেছে যেমন।ঘুরে তাকায়।নিঝুমকে দেখে কেঁপে উঠলো। সাথে সাথে ডুব দেয়।বেশ কয়েক সেকেন্ড পর ভেসে উঠে।নিঝুম তখনো দাঁড়িয়ে।ঠোঁটে হাসি।তিতলি আবার ডুব দেয়।যখন শ্বাস বন্ধের উপক্রম তখন ভেসে উঠে।তখনো নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে।তিতলি আবার ডুব নিতে গেলে সাথে সাথে নিঝুম বলে,

— “এই আর ডুব দিওনা।একটা কথা ছিল তোমার সাথে।উঠে আসো।”
তিতলির ভেজা গায়ে উপরে উঠতে লজ্জা করছিল ভীষণ। তাই মাথা নাড়িয়ে না করে।নিঝুম বুঝতে পেরে বললো,
— “আচ্ছা শুনো।আজ বের হতে পারব না।বিকেলে আমাকে একটা অপারেশন করতে হবে।ইট’স আর্জেন্ট।আগামীকাল বের হবো আমরা।”
তিতলি নিঝুমের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “এইটা বলতে এসেছেন?”
নিঝুম রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় আর বলে,

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৫

— “না।ফোন নিতে মনে নেই।নিতে এসেছি।আরো দরকারি কাজ আছে।”
নিঝুম রুমে চলে যায়।তিতলি থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।ভেবেছিল আজ একসাথে পাশাপাশি থাকা হবে।অথচ হলোনা।নিঝুম ফোন নিয়ে বেরিয়ে আসে।সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে আবার উপরে উঠে আসে।রুমে যায়।একটা বড় তোয়ালে তিতলির হাতে দিয়ে নেমে যায়।তিতলি এতে ভীষণ রকম খুশি হয়….ভীষণ।নিঝুমের দেওয়া তোয়ালে অঙ্গে জড়িয়ে খুশিতে চোখ খিঁচে হাসে।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৭