প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৮

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৮
ইলমা বেহরোজ

তিতলির এহেন কান্ডে নিঝুম হতভম্ব হয়ে যায়।বুকের বাঁ পাশে শিরশির অনুভব হয়।হৃৎপিন্ড লাফাচ্ছে দ্রুতগতিতে।নিশা যখন ছেড়ে চলে গিয়েছিল এমন করেই লাফিয়েছিলো হৃৎপিন্ড।তবে সেটা ছিল কষ্ট,অপমানের!এখনেরটা তাহলে কি?কি নাম দেওয়া যায় এই অনুভূতির?নিঝুম আপন মনে ভাবে,তিতলি কি ভয় পেয়েছে?এমন করে কেঁদে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো কেনো? নাকি কোনো অতীত আছে।যেটা মনে পড়ে যাওয়াতে এতোটা আবেগী হয়ে পড়েছে।আর…আর কাঁদার জন্য আমার বুকটা বেছে নিয়েছে?

তিতলির কান্না থামে।অনুভূতি,ইচ্ছে,আকাঙ্ক্ষা কমে গিয়ে বুকে একরাশ ভয় ভীর করে।এইটা সে কি করলো?ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে আসে।কি ভুল করলো সে।কালই বাবাকে ডাকাবে।আর বলবে কলঙ্কের কথা।বাবা তখন ঘৃণা চোখে তাকাবেন?ভয়ার্ত তিতলি ছিটকে সরে যায়।ওড়নাটা টেনে ধরে।মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।আতঙ্কে তার দেহের পাঁজরে পাঁজরে কাঁপন।ভাবে, এখনি হয়তো থাপ্পড় মারবে নিঝুম।সত্যি সত্যি এগিয়ে আসে নিঝুম।তিতলি চোখ তুলে তাকায়।নিঝুম ভয়ংকর রেগে আছে।চোখগুলো লাল!তিতলিকে কষে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তুলে।তিতলি চোখ বন্ধ করে, চোখ খিঁচে কেঁপে উঠে।কিন্তু কোনো থাপ্পড় পড়েনি গালে! ধীরে ধীরে চোখ খুলে।দেখে,নিঝুম জায়গায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টি তাকেই দেখছে।তিতলির ভাবনার ভুল!
সে আরেকবার নিঝুমকে দেখে।পরমুহূর্তেই ভয়ে কাঁপতে থাকে।নিঝুমকে সে ভালবাসলেও ভয় পায় খুব।মাথা ভার হয়ে আসে।জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে ফ্লোরে পড়ার আগে নিঝুম বাহুডোরে নিয়ে আসে।নিঝুম হতবাক,হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হতে পড়ে।উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকলো,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “তিতলি? এই তিতলি? তিতলি? ”
তিতলির কোনো সাড়া নেই।বাধ্য হয়ে কোলে তুলে নেয়।শুইয়ে দেয় নিজের বিছানায়।মেয়েলি ব্যাপারে বরাবর দূরে থাকার চেষ্টা করে নিঝুম।আর ওর কাঁধেই এসে পড়ে মেয়েরা।বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।বিপদ যখন আসে চারিদিক থেকে একসাথে আসে।ফোন নিয়ে মাকে কল করে।তৃতীয় রিংয়ের সময় আঞ্জুমান ধরেন।নিঝুম সাধারণত কিছু দরকার পড়লে মা’কে রুম থেকে কল করে তাই আঞ্জুমান শুরুতেই প্রশ্ন করেন,
— “কি আব্বা? রুমে আসবো? কিছু দরকার?”
নিঝুম শান্তভাবে বললো,

— “আম্মু,তিতলি সেন্সলেস হয়ে পড়ছে।একটু আসো তো।”
আঞ্জুমান আতঙ্কল শুদ্ধ ভাষা ভুলে আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠেন,
— “কি কস বাপ!আল্লাহ কি হইলো মাইয়াডার।আইতাছি আমি!’
মিসেস আঞ্জুমান সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চিল্লিয়ে আর্তনাদ করতে থাকেন,
— “আল্লাহ!শাহেদ ভাইজান মাইয়াডারে ভরসা করে আমার হাতে দিলো।কি হইছে।কিছু হইলে আমি কেমনে মুখ দেখাবো।আল্লাহ!”
মৌনতা, মোহনা মায়ের গলার স্বর শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।নির্জন ফোনে কথা বলছিলো রোহির সাথে।চেঁচামেচি শুনে বললো,

— ”রোহি!ওয়েট।আমি আসছি।এসে কল ব্যাক করব।’
তিন ভাই-বোন রুম থেকে বের হয়ে দেখে আঞ্জুমান ছাদের দিকে যাচ্ছেন।মায়ের মুখ বিমর্ষ!ভাইয়ের কিছু হলো না তো? ওরা ছুটে পিছু পিছু।আঞ্জুমান দরজার সামনে থেকেই বলতে থাকেন,
— “ও আব্বা, আব্বা! কি হইছে ওর।’
মায়ের গলা করুণ!তিনি রুমে এসে দৌড়ে বিছানায় আসেন। তিতলির কাছে।পিছন পিছন মৌনতা,মোহনা, নির্জন এসেও ঢুকে।নিঝুম হতবাক,বাকরুদ্ধ!মা এদেরও নিয়ে এসেছে!এলাকা আসেনি এতেই সবুর।

— “ভাইয়া, কি হইছে তোমার?’
মোহনা উৎকণ্ঠিত!
নিঝুম থমথমে গলায় বললো,
— “কিছু হয়নি আমার।তিতলি অজ্ঞান হয়ে গেছে।দেখতে পাচ্ছিস না?তাই মা কে ডাকছি।আর দেখ, তোদেরও নিয়ে আসলো।”
নির্জন নিঝুমের দিকে তাকায়।পরখ করে দেখে প্রশ্ন করে,
— “কিন্তু তিতলি এই রুমে কেনো? আর অজ্ঞানই হলো কেনো?”
— “আর বলিস না!মা খাবার পাঠিয়েছিলো ওরে দিয়ে।আমি ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেছি এসে দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজছে।ডাকলাম আর ও তাকালো।কাঁপছিলো, কেমন করছিলো, তারপর……..”
নিঝুম থেমে যায়।অস্থির চোখে এদিক, ওদিক তাকায়। তিতলি যে জড়িয়ে ধরেছে এটা বলতে সংকোচ বোধ হচ্ছে।কন্ঠ স্বাভাবিক করে বললো,

— “তারপর লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে।ধরে নিয়ে আসলাম।আর মা’কে কল দিলাম।”
নির্জনের চোখ সরু।কপাল কুঁচকে রেখেছে।নিঝুম কিছু একটা বলেনি মনে হচ্ছে।আঞ্জুমান কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন,
— “ও আব্বা।মেয়েটা বাঁচবো?”
— “কি বলো আম্মু।পানি ছিটিয়ে দিলেই উঠে যাবে।”
আঞ্জুমান মোহনার দিকে তাকিয়ে কড়া স্বরে বলেন,
— “মোহনা পানি দেয় ওর মুখে।”
নিঝুম চশমা ঠিক করতে করতে বললো,
— “না লাগবেনা।ভয় পেয়ে এমন হয়েছে। এখন জাগালে ভয়ই পাবে।থাক,এমনিতেই উঠবে।”
— “তুই নিশ্চিত হয়ে কেমনে বলছিস?”
নিঝুম কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,

— “মা।রাত বাড়ছে।ভেজাল করোনা।”
আঞ্জুমান নিঝুমের সাথে না পেরে বাকি ছেলে-মেয়েদের বকেন,
— “হাঁদারামের দল তোরা কেন আসছস?যাত্রা হইতাছে এখানে? যা রুমে যা।”
তিনজনই বেরিয়ে যায়।নির্জন ঠান্ডা মাথায় বেরিয়ে গেলেও দুই মেয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে যায়।
— “এখন কি করব?”
মিসেস আঞ্জুমানের অভিমানি স্বর।মায়ের বাচ্চামি দেখে নিঝুম হাসলো।তারপর বললো,
— “তুমি যা চাও আম্মু?”
— “তিতলিরে জাগিয়ে দেয়।”

নিঝুম গ্লাস থেকে পানি ছিটিয়ে দেয় তিতলির চোখে,মুখে।কিন্তু তিতলির সাড়া নেই।আঞ্জুমান আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে থাকেন।নিঝুমের এই ব্যাপারটা ভালো লাগেনা।মা সবসময় ছোট-খাটো ব্যাপারেও কাঁদবে ফ্যাসফ্যাস করে।নিঝুম আবার পানি ছিটায়। তিতলি চোখ খুলে।কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে অবস্থা বুঝতে।আঞ্জুমানকে দেখে দ্রুত উঠে বসে।আঞ্জুমানের ঠোঁটে ফুটে হাসি।নিঝুম গ্লাসটা রেখে মা’কে বললো,
— “এবার ওর রুমে নিয়ে ওর জামা-কাপড় চেঞ্জ করে দাও।ঠান্ডা লেগে জ্বর উঠবে।কেমন আছো এখন তিতলি? কি দেখে ভয় পেয়েছিলে?কিছু দেখেছিলে গাছে?”
তিতলি আতংকিত ছিল কি বলবে।কিন্তু নিঝুমই ক্লু দিয়ে দিল!আমতা আমতা করে সে বললো,

— “বড় গাছটায় কালো কি যেন ছিল!”
নিঝুম বিছানা থেকে উঠে সোফায় বসে এরপর বলে,
— “তিতলি সেসব কিছু নেই এখানে।এটা তোমার মনের ভুল।যাও রুমে যাও।”
তিতলি বিছানা থেকে নামতে গেলে,আঞ্জুমান নির্বিকার হয়ে বললো,
— “আব্বা? মেয়েটা একা ঘরে ভয় পাবেতো।এমনি ভয় পাইছে।আবার একা পাঠাইতে চাইছো।আর মেয়েটা দূর্বল যাবে কেমনে?হাঁটতে পারব না।হাঁটতে গিয়ে আবার সেন্সলেস হয়ে গেলে।থাকুক এখানে।”
তিতলি প্রতিবাদ করে বলে,
— “না আন্টি,ভয় পাবোনা।”
— “তুই চুপ থাক মেয়ে!ভীতু মেয়ে।আবার কথা বলে।আর আন্টি কি?”
তিতলি অপরাধী স্বরে বলে,
— “সরি ফুফি আম্মা।”

নিঝুম চিন্তিত হয়ে কিছু ভাবে।অপশন তার কাছে দুটো তিতলিকে কোলে করে নিচে নিয়ে যাওয়া নয়তো এখানে থাকতে দেওয়া।নয়তো মা ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে। নিঝুম একটা বই নেয় হাতে।এরপর শান্ত ভাবে বলে,
— “আচ্ছা আম্মু তুমিও এখানে থাকো তিতলির সাথে।”
— “তুই কই থাকবি?”
— “বই পড়ে রাত কাটিয়ে দেব।”

আঞ্জুমান নিচে গিয়ে আলতাফ চৌধুরিকে বলে তিতলির কাপড় নিয়ে আসেন।তিতলিকে কাপড় দিয়ে তিনি শুয়ে পড়েন।অন্যের মেয়ে তো তাই বড্ড ভয় হয় কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়।তিতলি একবার ব্যালকনিতে তাকায়।লাইট জ্বলছে।ওয়াশরুমে এসে নিঝুমের ব্যবহৃত তোয়ালে নিতে বেশ খানিকক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।এরপর ফ্রেশ হয়ে রুমে আসে।ভাবে,রুমে থাকাটা কি ঠিক হচ্ছে? যতই আঞ্জুমান ফুফি থাকুক।নিঝুম বিরক্ত হচ্ছে না? আবার লোভও হচ্ছে নিঝুমের রুমে থাকার।তিতলি কম্বল গায়ে দিয়ে আঞ্জুমানের পাশে শুয়ে পড়ে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। তাই ঠান্ডা পড়েছে খুব।নিঝুম যে বিছানায় ঘুমায় যে বালিশে ঘুমায় সে বিছানায় আর বালিশে এখন তিতলি।ভাবতেই তিতলির বাঁ পাঁজরে কাঁপনের ঢেউ উথলে উথলে উঠছে।সবকিছুতে নিঝুমের ছোঁয়া আছে। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে।সারারাত নিঝুম না ঘুমাক,বিরক্ত হোক,পারলে চুলোয় যাক।তিতলির কিছু যায় আসেনা।আজ আর এই বিছানা থেকে উঠছেনা।কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত তখন তিনটে কি চারটে, নিঝুমের ঘুম পায় খুব।কারেন্টও আসে তখন।কিন্তু বৃষ্টি কমেনি বরং বেড়েছে।বল সোফায় ঘুমানোর সুবিধাও নেই।তিতলির রুমটা তো খালি।নিঝুম তিতলির রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।পর্দা সরিয়ে রুমে আসে।রুমে আলো জ্বলছে।এতে মা আর তিতলির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে।নিঝুম অনেকটা জোরে হেঁটে লাইটের সুইচের কাছে যায়।এবং বন্ধ করে দেয়।সাথে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়।রুম থেকে বেরোবার কালে ইচ্ছে হয় একবার বিছানায় তাকাতে।কিন্তু ঘুমন্ত পর নারীকে দেখার স্বভাব তার ধাঁচে নেই।তাই আর দাঁড়ায় না।ছাদ থেকে নেমে চলে আসে তিতলির রুমে।ফজরে ঘুম ভাঙ্গে তিতলির।আঞ্জুমানের সাথে নামায পড়ে।ব্যালকনিতে এসে দেখে নিঝুম নেই।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৭

বাইরে এসেও দেখে নিঝুম নেই।চিন্তিত মুখ নিয়ে নিজ রুমে এসে চমকে যায়।নিঝুম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।তিতলি নিঝুমের পাশে রাখা চশমাটা সাবধানে হাতে নেয়।এরপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চোখে পরে।নিঝুমের মতো ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়ায়।হুবহু নিঝুমের কথা বলার ভঙ্গি আয়ত্তে নিয়ে বলে,

— “তিতলি এটা করবে না।এটা ভালো না।ওটা ভালোনা।বড়দের বই একদম পড়বে না।”
নিঝুমের ঘুম ভেঙে যায়।বিছানায় হাতড়ে খুঁজে চশমা।ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখে তিতলি তার চশমা পরে তার মতো করে কথা বলছে।নিঝুম কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকায়। এরপর হেসে ফেললো।তিতলি আয়নায় দেখে নিঝুম তাকিয়ে আছে।চোখ খিঁচে জিভ কাটে। চশমা চেয়ারের উপর রেখে এক দৌড়ে নিচ তলায়।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৯