প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১০

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১০
Writer Mahfuza Akter

রাতগুলো নির্ঘুম কাটছে। চারদেয়ালের বন্দিদশায় দমবন্ধ লাগছে। আবার ঘরের চৌকাঠ পেরোলেই বাইরের হাওয়া বি*ষা*ক্ত মনে হচ্ছে। সূর্যোদয় হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ছাদের কিনারায় দাঁড়াতেই শো শো শব্দ কানে লাগছে। ভোরের শীতল বাতাস গায়ে এসে বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বারবার কপালে পড়ছে। সৌহার্দ্যের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। সে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। চোখ দু’টো নিষ্প্রাণ! অদূরে থাকা পুকুর পাড় ছাদের কিনারা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানেই তরী আর অর্ণবের খুনসুটি প্রেম ও তরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতেই পারছে না সৌহার্দ্য।

“আমাকে পুড়িয়ে হলেও তুমি ভালো থেকো!”
কথা উদাস গলায় বলে ফেললো সৌহার্দ্য। হঠাৎ নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো মুখে। হেসেই দৃষ্টি সরিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালো সৌহার্দ্য। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটের মাথায় লম্বা ছাই জমে গেছে। জ্বালানোর পরও একটা টান দিতে পারেনি সৌহার্দ্য। তরীর আর অর্ণবকে একসাথে দেখলে তার পৃথিবী থমকে যায় প্রতিবার। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আর মাত্র দু’টো দিন বাকি! তরীর বিয়েটা হয়তো হয়েই যাবে! ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্য সিদ্ধান্ত নিলো, কাল সে ঢাকা চলে যাবে যাবে। লাইসেন্স কয়েকদিন আগেই পেয়েছে সে। বেশ কয়েকটা হসপিটাল থেকে অফারও এসেছে। এখনই সব ঠিকঠাক করে ফেলবে সে। সিগারেটটা ফেলে একপলক তরীর দিকে তাকালো সৌহার্দ্য। অর্ণবের হাতের মুঠোয় তরীর হাত আবদ্ধ। চোখ দুটো আবারও জ্ব*ল*ছে সৌহার্দ্যের! দ্রুত গতিতে ছাদ থেকে নেমে গেল সে।

বাস স্টপেজে নাক-মুখ কুঁচকে দাড়িয়ে আছে অরুণী।রোজ রোজ রিকশা ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করে ঠিক পোষাচ্ছে না। তাই মাঝে মাঝে বাসে চলাফেরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। কিন্তু সব বাস-ই মানুষজনে ভর্তি হয়ে আসছে। অরুণী ভীষণ বিরক্ত হলো!

“আপনার কুঁচকে যাওয়া নাকটা এই মুগ্ধ মারাত্মক মুগ্ধ করে! ঘায়েল হয়ে যাই আমি।”
উদ্ভট কথাটা শুনে অরুণী অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। বিস্ফোরিত চোখে পাশে তাকিয়ে দেখলো, মুগ্ধ হাসিহাসি মুখ করে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অরুণী হতভম্ব হয়ে বললো,
“তুমি? তুমি এখানে কী করছো?”

মুগ্ধ অরুণীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“কেন? কী ভেবেছিলেন? বাবাকে আমার নামে কমপ্লেইন করলেই আমি আপনার পিছু ছেড়ে দিবো! আমার জন্য এতো সহজ না ব্যাপারটা! বাজেভাবে ফেঁসে গেছি আমি।”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে বললো,

“কোথায় ফেঁসেছো?”
মুগ্ধ মোহনীয় চোখে তাকিয়ে বললো,
“আপনাতে!”
অরুণী থমকানোর ভঙ্গিতে মূর্তিবৎ চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মুগ্ধর গভীর চোখ দু’টো থেকে দৃষ্টি সরানো বেশ কঠিন মনে হচ্ছে অরুণীর। এমন সম্মোহন কারো চোখে দেখেনি সে কখনো! এই ছেলের চোখ দু’টোতে কি ডুবে যাবে সে? ভেবেই চমকে উঠলো অরুণী। তড়িৎ গতিতে চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,

“ফ্লার্ট করছো আমার সাথে?”
“আপনার কাছে ফ্লার্ট মনে হলে হতেই পারে। আমি শুধু সারাজীবন আপনার মাঝেই ফেঁসে থাকতে চাই!”
অরুণী বিব্রত হয়ে বললো,
“ভুলে যেও না, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়। আমার দৃষ্টিতে তুমি একটা বাচ্চা ছেলে।”
মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো,

“আমি আপনার চেয়ে বয়সে বড় হলে আপনি আমাকে মেনে নিতেন।”
অরুণী মুগ্ধর দিকে তাকালো। কাটকাট গলায় বললো, “না!”
“কারণ?”
“আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি!”
মুগ্ধ কথাটা শুনে অদ্ভুত ভাবে হাসলো। অরুণী অবাক হলো মুগ্ধর হাসি দেখে! সে হাসার মতো কী বললো? মুগ্ধ হেসেই বললো,

“আপনি যাকে ভালোবাসেন, সেও যদি কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসে, তাহলে আমি আপনার সামনে আর কোনোদিন আসবো না।”
বলেই মুগ্ধ চলে গেল। অরুণী ওর যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য কি তাকে ভালোবাসবে কোনোদিন? সৌহার্দ্যের আচরণে অরুণীর প্রতি কোনো দূর্বলতা কখনো দেখেনি সে! এই যে, এতোদিন পর দেশে ফিরে ওকে জানালো না পর্যন্ত! অরুণীর মন সৌহার্দ্যকে দেখার জন্য আকুলিবিকুলি করছে। কিন্তু উপায় নেই! পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে গ্রামে যেতে পারবে না সে। ইশ! এই পরীক্ষাকে কি সব অসময়েই হাজির হতে হয়? অসহ্যকর! বিরক্তিতে নাক কুঁচকে ফেললো অরুণী।
.
দুপুর খাবারের পর তরী আড়ালে মোহনার ফোনটা ওড়নায় পেঁচিয়ে নিয়ে ঘরে চলে এসেছে। মোহনা হয়তো টের পায়নি! ঘরে প্রবেশ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দরজা চাপিয়ে দিলো তরী। মোহনা ঘুমাতে চলে গেছে এখন। বিকেলের আগে ঘুম থেকে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। তরী নিশ্চিন্তে চেয়ার টেনে জানালার দিকে মুখ করে বসলো।

ফোনটা ওড়নার ভাজ থেকে বের করে হাতে নিলো। আফনাদের নাম্বার মুখস্ত-ই আছে তরীর। দ্রুত আঙুল চালিয়ে নাম্বার তুললো। কল দেওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে একবার সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। নাহ, কেউ নেই! চোখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তরী।

বুকটা ঢিপঢিপ করছে। মোহনা বা অর্ণব যত যা-ই বলুক! বিয়ের মতো একটা বড় ব্যাপারে তার বাবা বিন্দুমাত্র কিছু জানতে পারবে না, এটা মেনে নিতে পারছে না তরী। সবার থেকে লুকালেও নিজের বাবার থেকে কীভাবে লুকাবে সে? তরী নিজেও চায়, তার বিয়েটা হোক! কিন্তু আফনাদ হক জানলে অসুবিধা হওয়ার তো কথা না! অর্ণব ভালো ছেলে। আফনাদে কোনো আপত্তি থাকবেই না। তরীর বয়স কম ভেবে অমত করলেও তরী মানিয়ে নেবে। এসব ভেবেই আফনাদ হককে বিয়ের খবরটা জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তরী। যদিও মোহনা বা অর্ণব কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলেনি সে! তারা কখনো জানাতে দিবে না আফনাদকে। রিং হচ্ছে…. দু’বার রিং হতেই আফনাদ হক কল রিসিভ করলেন,

“হ্যাঁ! কেমন আছো, মোহনা?”
“বাবা! বাবা, আমি তরী!” তরী উৎসুক গলায় বললো।
আফনাদ হেসে বললেন,
“আরে! আমার মায়ের আজকে হঠাৎ ছেলের কথা মনে পড়েছে! কী ব্যাপার, হুম?”
“বাবা, তুমি ভালো আছো?”
“আছি রে, মা! তুই বল! তোর পড়াশোনা কেমন চলছে? সৌহার্দ্য পড়াচ্ছে তো ঠিকঠাক মতো!”
তরী মাথা হেলিয়ে বললো,

“হ্যাঁ! বাবা, তুমি কবে আসবে?”
“এই মাসে তো আসতে পারছি না, মা!” আফনাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
তরী উত্তেজিত গলায় বললো,

“বাবা, আসলে তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। আমার মনে হয় তোমাকে জানানো উচিত। অর্ণব ভাই….. ”
কথা শেষ হওয়ার আগেই তরীর হাত থেকে কেউ ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। আকস্মিক এমন হওয়ায় তরী আঁতকে উঠে পেছন ঘুরে তাকালো। মোহনা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে তরীর দিকে। তরীর গলা শুকিয়ে গেল। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো মোহনার দিকে। মোহনা ফোনটা কানে লাগালো। ওপাশ থেকে আফনাদ বারবার জিজ্ঞেস করছেন,
“হ্যাঁ, বল! কী হলো? কথা বলছিস না কেন? হ্যালো! তরী!”

মোহনা থনথমে গলায় বললো,
“তোমার মেয়ের কয়েকটা বই লাগবে। শহর থেকে আনাতে হবে। বইয়ের নাম তোমাকে পাঠিয়ে দিবো। তুমি পার্সেলে পাঠিয়ে দিও।”
আফনাদ হক চিন্তিত গলায় বললেন,
“ওহ! আচ্ছা, আমি পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু তরী অর্ণবকে নিয়ে কিছু বলতে চাইছিল। ওকে ফোনটা দাও।”
মোহনা রাগী চোখে তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“বইগুলো অর্ণবই ওকে কিনতে বলেছে। সেটাই বলছিলো তোমাকে। এখন ওকে পড়াশোনা করতে দাও। ফোন রাখলাম!”
মোহনা ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কল কাটলো। তরীর ভীত দৃষ্টি দেখে ফুঁসে উঠে তরীর দিকে এগিয়ে এলো। চুলের গোড়া মুঠোয় আঁকড়ে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,
“তোর বাবাকে কেন বলছিলি এসব?”
তরী ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বললো,
“মা! বাবাকে না জানিয়ে আমি বিয়েটা কীভাবে করবো?”

মোহনা চুলের মুঠো চেপে ধরেই সশব্দে তরীর গালে তিনটে চড় মারলো। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
“হারা**, আমার মুখে মুখে কথা বলিস! আমার অবাধ্য হোস! আমি বারণ করা সত্ত্বেও ওনাকে ফোন দিয়েছিস লুকিয়ে লুকিয়ে? এই সাহস দ্বিতীয় বার দেখালে তোকে আস্ত রাখবো না আমি বলে দিলাম!”

বলেই তরীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মোহনা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। তরী বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তার চোখ বেয়ে একফোঁটা পানি-ই পড়লো শুধু। কিন্তু সেটা মুছলো না। বিয়েটা লুকিয়ে হলেও হয়ে যাক! এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে হলেও বিয়েটা তরী করবে। আফনাদকে না জানিয়ে হলেও করবে। ভারাক্রান্ত কন্ঠে বিরবির করলো তরী,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও, বাবা। তোমার মেয়েটা বড্ড স্বার্থপর! নিজের স্বার্থের জন্য তোমাকে ঠকাচ্ছে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৯

বিকেলের দিকে তরী সৌহার্দ্যের কাছে পড়তে গেল। গালে পাঁচ আঙুলের লালচে ছাপ ওড়না দিয়ে ভালোমতো আড়াল করার চেষ্টা করছে তরী। আহমেদ ভবনে প্রবেশ করতেই বসার ঘরের দিকে অবাক চোখে তাকালো তরী। আরমান আহমেদ এসেছেন। আফনা বেগম থমথমে মুখে পাশে বসে আছেন। তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে আরমান আহমেদের দিকে। এই লোকটা এখানে কেন এসেছে? আর কত ধ্বংস চান তিনি?

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১১