প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩
Writer Mahfuza Akter

“ডক্টর সৌহার্দ্য রায়হান আমি! আজই দেশে ফিরলাম। আমার কথা মনে আছে আপনার, চাচা?”
দূরে দাঁড়িয়ে থেকেও তরী স্পষ্ট শুনতে পেল কথাটা। মাথাটা ভনভন করে উঠলো মুহুর্তেই। এটা সৌহার্দ্য? মানে মধুর ভাই! হ্যাঁ, সৌহার্দ্য-ই তো ইউকে চলে গিয়েছিল আট বছর আগে। তার মানে তো এটা সৌহার্দ্য-ই! সামনেই গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাসি মুখে কথা বলছে এক বয়স্ক লোকের সাথে। তরী অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দৃশ্যমান পাশের দিকে। অর্ণব তরীর ফ্যালফ্যাল চাহনির সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

“কী দেখছিস ঐদিকে?”
তরী প্রকৃতস্থ হলো। সৌহার্দ্যের সাদা গাড়িটা অনেক দূরে চলে গেছে ইতোমধ্যে। তরী চমকে তাকিয়ে বললো,
“আরেহ্! ঐটা তো মধুর ভাই! চলো, তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।”
অর্ণব অবাক চোখে তাকালো। মধুর ভাইকে সে চেনে না। কখনো দেখেছে বলে মনেও পড়ছে না। তাই তরীর এমন আচরণের মানে বুঝতে পারলো না। তরী ঝড়ের গতিতে পা চালিয়ে এগোচ্ছে। অর্ণবও ওর পিছু পিছু দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তরী প্রথমে নিজের বাড়িতে এলো। একটু ফ্রেশ হয়ে তারপর আহমেদ ভবনে যাবে। অর্ণব আর ভেতরে আসেনি। গেইটের সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। তরী গেইট দিয়ে প্রবেশ ভেতরে এসেই অবাক চোখে তাকালো। উঠোনের একপাশে চেয়ারে বসে মধু আফনাদ হকের সাথে গল্প করছে। তরী বিস্মিত চোখে তাকিয়েই বললো,
“তুই এখানে কী করছিস?”
মধু ফিরে তাকালো। তরীকে দেখে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বললো,

“এসে পড়েছিস? এতো দেরি হলো কেন? কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমি! চল, আমার সাথে আমাদের বাসায় চল!”
“কিন্তু কেন?”
“আরে, সৌহার্দ্য ভাইয়া এতো বছর পর দেশে ফিরেছে! চল তাড়াতাড়ি।”
তরীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মধু ওকে টেনে নিয়ে চলে গেল। মধুর কারণে তরী কলেজ ড্রেস পরিবর্তন করারও সুযোগ পেল না। আফনাদ হক হাসলেন ওদের কান্ড দেখে। সৌহার্দ্যের সাথে তিনিও দেখা করতে যাবেন কিছুক্ষণ পর।

অরুণী বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে সকাল থেকে। রাতে দু’ঘন্টা বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছে। সকালের এলার্ম তার কানে পৌঁছায়নি। উঠতে দু’ঘন্টা দেরি হয়ে গেছে। সেটা নিয়েই তার মেজাজ এখন প্রচন্ড খারাপ। বেশ কয়েকটা থিওরি মুখস্থ করা বাকি। এইটুকু সময়ে শেষ করার জন্য বেশ মনযোগী হয়ে পড়াশোনা করছে।

রুমমেট তন্নী এসে একমগ গরম কফি দিয়ে গেছে। অরুণী বই হাতে নিয়ে কফি খেতে খেতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মনটাও আজ তেমন ভালো নেই। সৌহার্দ্যের সাথে কথা হয় না তিন-চারদিন যাবৎ। সৌহার্দ্যের নাম্বারেও কল যাচ্ছে না। অনলাইনেও যোগাযোগ করতে পারছে না। এই প্রথম এরকম হচ্ছে। অরুণী বিষয়টা নিয়ে বেশ চিন্তিত। সৌহার্দ্য কি কোনোদিন ওর অনুভূতি বুঝবে না? সে যে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে সৌহার্দ্যকে!

সে হোস্টেলের তিনতলার একটা রুমে থাকে। চোখ সরে সামনের দিকে যেতেই মনযোগ চলে গেল অরুণীর। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সামনের রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে। অরুণী প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা রোজ রোজ তাকে ফলো করে। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তাকালেই কৌশলে নজর ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু অরুণী বেশ ভালো করে বুঝতে পারে ছেলেটার মতলব।

বিরক্তি নিয়ে ঘরে চলে এলো অরুণী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, বিকেলের ক্লাসের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো অরুণী। কিন্তু রাস্তায় সেই ছেলেটাকে না দেখতে পেয়ে অবাক হলো সে। এতোক্ষণ তো এখানেই ছিল! এখন কোথায় গেল?

রিকশা নিয়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না অরুণীর। ক্লাসে সময় মতোই এসেছে সে। ক্লাস শেষে ল্যাবের দিকে যাওয়ার সময় দেখলো সেই ছেলেটা করিডোরে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এবার আর চোখ সরায়নি অরুণীর ওপর থেকে। অরুণী ফুঁসে উঠে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল। মুখোমুখি দাঁড়াতেই ছেলেটা অমায়িক হাসলো।
“আমাকে ফলো করো কেন তুমি?” অরুণীর কন্ঠে রাগ স্পষ্ট।
“তুমি কীভাবে বুঝলে?”

হঠাৎ ‘তুমি’ সম্বোধনে চমকে উঠলো অরুণী। বললো,
“অপরিচিত কাউকে তুমি করে বলছো কেন? মিনিমাম ম্যানার্স শেখোনি?”
“আপনি তুমি করে বলছেন, তাই আমিও বললাম!” বলেই মিট মিট করে হাসলো ছেলেটা।
অরুণী হকচকিয়ে গেল। কী চালাক ছেলে রে বাবা! আমতা আমতা করে বললো,

“নাম কী?”
“মুগ্ধ।”
“কোন ইয়ার?”
“থার্ড ইয়ার।”
অরুণী প্রচন্ড অবাক হয়ে বললো,
“আমি কোন ইয়ারে, জানো?”
“জানি তো! ফোর্থ ইয়ারে। মানে ফাইনাল ইয়ারে।”

অরুণী আকাশ থেকে পড়লো। তার থেকে জুনিয়র এই ছেলে তার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছে? তাকে আরো অবাক করে দিয়ে মুগ্ধ বললো,
“এমনিতে এক বছরের জুনিয়র হলেও বয়সে আপনি আমার চেয়ে এগারো মাস আট দিনের বড়।”
অরুণী রাগী কন্ঠে বললো,
“তোমাকে যেন আমি আমার আশে পাশে না দেখি।”
অরুণী হনহন করে ল্যাবের দিকে চলে গেল। মুগ্ধ নিঃশব্দে হাসতে লাগলো ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। মনে মনে বললো,
“সিনিয়র আপু! মন দিয়ে ফেলেছি তো আপনাকে! এখন আশেপাশে না এসে কোথায় যাই বলুন তো?”

টানা আট বছর পর সৌহার্দ্যকে দেখে সুজাতা, মালিহা আর আফনা বেগম কেঁদেই দিয়েছেন। আটটা বছর কম সময়? একদমই না! এই লম্বা সময়ে সৌহার্দ্যের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে অনেক। তারা তো প্রথম দেখার সাথে সাথে চিনতেই পারেনি। কিন্তু চিনতে পেরে আর নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারছেন না। সৌহার্দ্য হেসে তিনজনকেই জড়িয়ে ধরলো। নিজের প্রশস্ত বুকে তিনজনকে আগলে নিয়ে সৌহার্দ্য বললো,

“তোমাদের কান্নাকাটি দেখার জন্য এসেছি আমি? সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এলাম, আর তোমরা এভাবে কান্না করা শুরু করে দিলে?”
সুজাতা সৌহার্দ্যের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন। কেঁদে মুখ লাল করে ফেলেছেন তিনি। মালিহা দ্রুত গতিতে রায়হান সাহেবের ঘরে ছুট লাগালেন।

আফনা বেগম সৌহার্দ্যের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালেন। নাতি তার অসাধারণ দেখতে হয়েছে। কালো শার্ট কালো প্যান্টের সাথে ইন করে ওপরে এপ্রোন পরেছে সৌহার্দ্য। উচ্চতা বেশ, মুখের দিকে তাকাতে গলা উঁচিয়ে দেখতে হয়। সুঠাম দেহে সুপুরুষ লাগছে বটে। আফনা বেগম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন,
“নাতি আমার বিদেশে গিয়া সাদা ধবধবে হইয়া গেছে! মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! আবার বড় ডাক্তারও হইয়া আইছে!”
সৌহার্দ্য হেসে দাদীর কপালে চুমু দিলো। বললো,

“তোমার ডাক্তার নাতি এখন থেকে তোমার সাথেই থাকবে। কাছের হসপিটালে দেখা করে এসেছি। ওখানে বসবো আপাতত।”
আফনা বেগম তো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। সৌহার্দ্যের প্রশস্ত বুকে হাত বুলিয়ে দিলেন খুশি মনে। রায়হান সাহেব এসেছেন। সৌহার্দ্যকে দেখে তার মুখ থমথমে। ছেলেটা তার বড্ড অবাধ্য, একগুঁয়ে, জেদি। এই যে, রায়হান সাহেবের হাজার বারণ না শুনে বিদেশে পড়তে চলে গেল সৌহার্দ্য। রায়হান সাহেব তাই ছেলের প্রতি নিজের ভালেবাসা তেমন প্রকাশ করেন না।

বাবার দিকে সৌহার্দ্য-ই এগিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন আছো, বাবা?”
রায়হান সাহেব নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই ছেলের পিঠে হাত রাখলেন। ছেলে তার বেশ লম্বা হয়েছে! ঝুঁকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রায়হান সাহেব ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন গম্ভীর মুখেই। সৌহার্দ্য হাসলো।
“ভাইয়া, দেখো কে এসেছে?”

পেছন থেকে মধুর হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠ শুনে হেসে পেছনে তাকালো সৌহার্দ্য। তরীর দিকে চোখ পড়তেই মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল তার। এটা তো রাস্তায় থাকা সেই মেয়েটা! একটা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। এখানে মধুর পাশে দাঁড়িয়ে কী করছে?

তরী ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নির্ঘাত ওকে চিনে ফেলেছে। তরী আশে পাশে তাকাতে লাগলো। সৌহার্দ্যের মুখ মুহুর্তেই থমথমে হয়ে গেল,
“এই মেয়ে তোর পাশে কেন? আমি তো তোকে বলেছিলাম, চাঁদকে সাথে নিয়ে আসতে! একে কেন নিয়ে এসেছিস?”
তরী চমকে উঠলো। সৌহার্দ্য ওকে ‘চাঁদ’ বললো? সৌহার্দ্যের এখনো মনে আছে? অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তরী সৌহার্দ্যের দিকে। মধু সৌহার্দ্যের কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২

“আরেহ্! এটাই তো আমাদের চাঁদ! চিনতে পারছো না? ভালো মতো দেখো!”
সৌহার্দ্য বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তরীর দিকে। তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস! সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে, এটাই চাঁদ! অস্ফুটস্বরে সৌহার্দ্য বললো,
“তোর কোথাও ভুল হচ্ছে, মধু। এটা আমার চাঁদ হতেই পারে না!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪