প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তরীর মুখের ওপর নিবদ্ধ। মুখটা থমথমে করে বসে আছে সে। সৌহার্দ্যের মুখোমুখি-ই তরী আর মধু বসেছে। বৈঠকঘরে তারা তিনজন ব্যতীত আর কেউ নেই। ভয়ে সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে না তরী। যতবারই তাকাচ্ছে, ততবারই চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে। এভাবে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন সৌহার্দ্য? প্রশ্নটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তরীর।
মধুর মুখ এখন অনর্গল চলছে। মেয়েটা এতো বকবক করতে পারে! একনাগাড়ে সে কথা বলেই চলেছে,

“ভাইয়া, কুঞ্জনগরে এসে রাস্তায় পরিচিত কাউকে দেখোনি?”
“হুম!” সৌহার্দ্য তরীর দিকে তাকিয়ে-ই ছোট করে উত্তর দিলো।
“কাকে দেখেছো?” মধুর গলা বেশ উৎসুক শোনালো।
“মতিন চাচা।”
“কথা বলোনি? তোমায় দেখে চিনতে পেরেছে?”
“হুম, পরিচয় দিয়েছি।”
“আর কাউকে দেখোনি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে দেখেছি। রাস্তায় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ছিল।”
তরী চমকে উঠলো। তড়িৎ গতিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য এখনো চোখ সরায়নি তরীর ওপর থেকে। চোখে মুখে চাপা ক্ষোভ! কন্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট বুঝতে পারছে তরী। হকচকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো মুহূর্তেই।
মধু হতবাক হয়ে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করে বললো,

“মানে? কাকে দেখেছো তুমি?”
তরী প্রচন্ড বিরক্ত হলো মধুর ওপর। মেয়েটা কি ঘাস খায়? নাকি চোখের তেরোটা বেজেছে? তার ভাই যে তারই চোখের সামনে বসে তারই পাশের জনের দিকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এটা কি মধু দেখছে না? একবারও কি চোখে পড়েনি মধুর? এই মেয়েকে ঠাটিয়ে দু’টো চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে তরীর। একবার আলাদাভাবে পেয়ে নেক! সব রাগ মধুর ওপর ঝাড়বে সে।

সৌহার্দ্য মধুর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। মধু আবার জানতে চাইলো,
“কী হলো? ব… ”
“মধু রে! কোমরে একটু তেল মালিশ করে দিয়ে যা আমার!”
দাদীর কর্কশ ডাকে আর নিজের কথা শেষ করতে পারলো না মধু। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে,
“যাই, বুড়ির একটু সেবা করে আসি। মা আর ছোটমা তো রান্নাঘরে! আমাকেই তাই ডাকছে।”

তরীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মধু চলে গেল। তরী ওকে আটকাতে চেয়েও পারলো না। সৌহার্দ্যের গম্ভীর চোখের সামনে তরী অসহায় হয়ে পড়লো। সে কি উঠে চলে যাবে? সিদ্ধান্তহীনতায় হাসফাস করায় ব্যস্ত তরীকে অবাক করে দিয়ে সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়ালো। পা ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে বললো,

“আমার ঘরে একমগ গরম গরম কফি নিয়ে এসো। এন্ড কফিটা অভিয়েসলি ধোঁয়া ছড়ানো গরম হতে হবে। ফাস্ট!”
তরী বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। এই অসময়ে কেউ কফি খায়? খেতেই পারে! বিদেশি হাওয়ায় এতোগুলো বছর কাটিয়ে এসেছে! এসবে অভ্যস্ত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিরূপায় ভঙ্গিতে তরী দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। মনে মনে মধুকে গালাগালি করতে ভুললো না। আজ মধুর জন্যই এভাবে বিপাকে ফেঁসে গেছে সে!

রান্নাঘর সুজাতা আর মালিহা কোমরে আঁচল বেঁধে কাজ করছেন। এতো বছর পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। তাদের কাছে এটা চাট্টিখানি কথা নয়। আজ সৌহার্দ্যের পছন্দের সকল আইটেম রান্না করবেন তারা। তাদের রান্নার আয়োজন দেখে তরীর চোখ কপালে। এতো কিছু রান্না করে কী হবে? আহমেদ ভবনের খাবার ঘরের টেবিলটা বিশাল হলেও তাতে তো এতো কিছুর জায়গা হবে না। আর সৌহার্দ্য এতো খাবার কীভাবে খাবে? ঠোঁট উল্টে বিরক্ত প্রকাশ করলো তরী। এগিয়ে গিয়ে বললো,

“ঐ বিদেশি ডাক্তার একমগ কফি খেতে চেয়েছে।”
মালিহা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “কে? সৌহার্দ্য?”
তরী মাথা নাড়ালো। সুজাতা হেসে বললেন,
“তুই দাঁড়া! এখনি বানিয়ে দিচ্ছি।”
তরী সুযোগ পেল চলে যাওয়ার। তাই তাড়া দেখিয়ে বললো,

“না! আমি দাঁড়াতে পারবো না। বাসায় গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আসতে হবে। আমার আরও অনেক কাজও আছে।”
“না, মা! এভাবে যাস না। দেখছিস-ই তো দু’হাতে সব গোছাতে হাঁপিয়ে উঠছি আমি আর মালিহা। আজ কাজের মেয়েগুলোও নেই! তুই সৌহার্দ্যকে কফিটা দিয়ে আয়।”
সুজাতা এমন ভাবে বলায় তরী আর তার কথা ফেলতে পারলো না। নিরূপায় হয়ে কফির মগটা নিয়ে সৌহার্দ্যের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

অর্ণব চিন্তিত ভঙ্গিতে হাতের কাগজগুলোর দিকে চোখ বুলাচ্ছে। পড়াশোনা শেষ করেছে সে কয়েকমাস আগেই। কিছু বিদেশের একটা ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপে সেকেন্ড মাস্টার্স করার ইচ্ছে তার অনেক দিনের। সেই সুবাদেই এপ্লিকেশন করে পরীক্ষা দিয়েছিল অর্ণব। আজকে রেজাল্ট হাতে এসেছে তার। কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সিলেক্টেড হয়েছে সে। এখন শুধু ভিসা প্রসেসিং এর কাজ বাকি।

অর্ণব এই সংবাদে খুশি হবে, নাকি অখুশি হবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তার আপাতত তরীর থেকে দূরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। এতো দিন বেশ ভালো করে তরীর সংস্পর্শে ছিল অর্ণব। তরীর সান্নিধ্য তাকে প্রচন্ড আনন্দ দেয়। মেয়েটা তার কাছে আস্ত একটা ভালোবাসা! তাকে নিজের করে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবে না অর্ণব।
আসমা বেগম সোফায় আরাম করে বসে টিভি দেখছেন। হঠাৎ অর্ণবকে বিমর্ষ ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে বললেন,

“কী হয়েছে আমার বাবার? মুখ এমন কালো করে রেখেছো কেন?”
অর্ণব পা থামালো। আসমা বেগমের কাছে এসে বসে তার কোলে মাথা রাখলো। আসমা বেগম কিছু না বুঝতে পেরে টিভি অফ করে দিলেন। আদুরে কন্ঠে বললেন,
“কী হইছে, বাপ?”
“মা, তরীর পরীক্ষা তো আজকে শেষ হলো!”
“তাই?”

“হুম, এবার তুমি খালামনির সাথে কথা বলো না? আমি তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই!”
আসমা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। ছেলের কথায় তিনি মোহনাকে আগেই বলে রেখেছেন। অর্ণব তরীর জন্য পাগল হয়ে আছে। মোহনা তেমন আপত্তিও করেনি। কিন্তু সমস্যাটা অর্ণবের বাবা রাশেদ সাহেবকে নিয়ে। তিনি মোহনাকে তেমন পছন্দ করেন না। কিন্তু তরীর ব্যাপারে তার কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। আসমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“এতো তাড়ার কী আছে? তোর তো বিদেশে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে!”
“সেসব পড়ে ভাবা যাবে। তুমি আগে তরীকে এ বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করো।”
“ঠিক আছে। দেখছি আমি।”
অর্ণব মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। স্কলারশিপের কাগজটা লুকিয়ে রাখলো আলমারিতে। এই ব্যাপারে কাউকে কিছু জানানো যাবে না। রাশেদ সাহেব জানতে পারলে বিয়েটা এই মুহুর্তে হতেই দিবেন না। তাই সবটা গোপন থাকাই ভালো মনে করলো অর্ণব।

তরী সৌহার্দ্যের দরজায় কড়া নাড়লো। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে তার। তরী স্পষ্ট অনুভব করছে, তার হৃদযন্ত্র নিজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজের হৃদকম্পনের শব্দ শুনতে পেলেও তরী ভেতর থেকে সৌহার্দ্যের কোনো সাড়াশব্দ পেল না।
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিলো তরী।

সৌহার্দ্য বিছানার এক প্রান্তে বসে আছে। মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত ভেজা তার। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পানি ঢেলেছে কি মাথায়? কিন্তু কেন? প্রশ্নটা নিজের ভেতরই চেপে রাখলো তরী। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য এখনো চোখ তুলে তাকায়নি। মাথা ঝুঁকিয়ে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে রেখেছে। ছেলেটা কি তরীকে এখনো দেখেনি? হয়তো! যাক, তাহলে তো আর ভয় নেই! তরী খুশি মনে তাড়াতাড়ি সৌহার্দ্যের বিছানার পাশের টেবিলে কফির মগটা রাখলো।

হঠাৎ তরীকে অবাক করে দিয়ে সৌহার্দ্য ওর হাত চেপে ধরলো। সৌহার্দ্যের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে তরী চমকে তাকালো। সৌহার্দ্য চোখ তুলে তরীর দিকে তাকিয়েছে। তার চোখ দুটোর সাদা অংশ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তরী ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়িয়েছে, বাঁ হাতে তরীর ডান হাত চেপে রেখেছে। তরী ঢোক গিলে বললো,
“হা… হাত ছাড়ুন!”

“অন্য কেউ ধরলে তো এভাবপ ছাড়তে বলো না!” সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে। কন্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট।
তরী হতভম্ব হয়ে গেল এমন কথায়। সৌহার্দ্যের এমন আচরণের মানে খুজে পাচ্ছে না সে। সৌহার্দ্য এতক্ষণে কফির মগ ডান হাতে নিয়েছে। হাত চেপে ধরেই কি কফি খাবে? সৌহার্দ্য থমথমে গলায় কফির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কফিটা অনেক গরম! ধোঁয়া উড়ছে। হাত দিয়ে মগটা ছোঁয়া যাচ্ছে না। ঠিক এরকম কফি-ই চেয়েছিলাম। থ্যাংক ইউ ফর দিস হট এন্ড আমেইজিং কফি।”

সাথে সাথেই তরীর করুণ আর্তনাদ শোনা গেল। গরম কফিটা তরীর হাতের ওপর ঢেলে দিয়েছে সৌহার্দ্য। তরীর চোখে পানি চলে এসেছে। ব্যথায় চোখ কুঁচকে নিজের হাতের দিকে তাকালো সে। হাতের সাদা চামড়া লাল হয়ে গেছে। জ্বলছে প্রচুর।
“ব্যথা করছে? আমারও করছিলো!”
সৌহার্দ্য হাতে চাপ প্রয়োগ করে পুনরায় বললো,

“চাঁদ কারো স্পর্শের জিনিস নয়। আকাশের চাঁদের গায়ের কলঙ্ক মেনে নিলেও, আমার চাঁদের গায়ে বিন্দুমাত্র স্পর্শ মেনে নেবো না আমি।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩

সৌহার্দ্য তরীর হাত ছেড়ে দিয়েছে। তরী ব্যথিত চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তেই খেয়াল করলো, সৌহার্দ্যের ফর্সা হাতটাও ভিজে লাল হয়ে আছে। তরীর অবাক চোখে তাকালো। তরীর হাতে গরম কফি ফেলার সময় তো সৌহার্দ্য ওর হাত ধরেই ছিল! তার মানে তরীর সাথে সাথে নিজের হাতেও এই গরম কফি ফেলেছে সৌহার্দ্য! তরী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। লোকটা কি পাগল?

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৫