প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৫
Writer Mahfuza Akter

তরী নিজের ফোস্কা পড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য এই নির্মম অত্যাচার করলো কীভাবে? পাতলা চামড়া লাল হয়ে গেছে। জ্বলছে প্রচুর! তরীর চোখের কোণ ভিজে উঠছে। কান্না পাচ্ছে, কিন্তু কাঁদতে পারছে না। নিজের এই অক্ষমতায় তরী প্রচন্ড বিরক্ত। মেয়েরা একটু কিছু হলেই কেঁদে-কেঁটে বুক ভাসিয়ে ফেলে। আর সে? কান্নার সময় কাঁদতে পারে না। বড়জোড় চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানিতে গাল ভিজবে। অর্ণব হয়তো এজন্যই বলেছিলো,

“তোর মন বড্ড কঠিন রে, তরী!”
তরী হতাশ হলো। ঘড়িতে রাত দশটা বাজে। সৌহার্দ্য তখন হাত ছাড়তেই তরী ছুটে নিজের বাড়ি চলে এসেছিল। হাতে ঠান্ডা পানি ঢেলে কিছুটা শান্তি পেলেও জ্বালাপোড়া এখনো কমেনি। বাঁ হাত লুকিয়ে রাখতে সারাদিন ঘরেই পড়ে ছিল। নিচ থেকে হৈচৈ এর শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই এখন খেতে ডাকবে ওকে! ওড়না দিয়ে হাতটা ভালোভাবে ঢেকে দরজার দিকে এগিয়ে গেল তরী। দরজা খুলতেই লাফিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল সে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরুণী পড়ার টেবিলে বসে আছে। বই মেলে রাখলেও পড়ায় মনযোগ নেই তার। সৌহার্দ্য এখনো কোনো যোগাযোগ করলো না। ফোনে বারবার তাকাচ্ছে অরুণী। কিন্তু কোনো কল আসছে না। অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো তার। সৌহার্দ্য তাকে কখনোই বুঝলো না। এই যে, তার মনপ্রাণ জুড়ে সৌহার্দ্যের জন্য হাজারো অনুভূতি, সেটা কি সত্যিই সৌহার্দ্য বুঝতে পারে না? এতো বছরে একবারও সৌহার্দ্যকে দেখতে পারলো না। সৌহার্দ্য কখনোই নিজের ছবি অরুণীকে পাঠায়নি। অরুণী ছবি পাঠালে উল্টো ধমক দিতো,

“আমাকে ছবি পাঠাবি না, অরুণী! তোর বরকে দেখানোর জন্য জমিয়ে রাখ!”
সৌহার্দ্য এমন কেন? ভাবলেই অরুণীর কান্না পায়। হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনে চমকে ওঠে অরুণী। চোখে মুখে হাসির ঝলক ছড়িয়ে ফোনটা হাতে নেয়। আনন্দচিত্তে কল রিসিভ করে কানে গুঁজে বসে,
“সৌহার্দ্য! তোমার সাথে কতদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করছি! কোথায় ছিলে তুমি?”
অভিমানগুলো গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো অরুণীর। চোখে পানি জমে টইটম্বুর। ওপাশ থেকে গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠ শোনা গেল,

“মুগ্ধ।”
অরুণী হতভম্ব হয়ে গেল। চোখের পানি মুছে ফোনের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলালো। আননৌন বাংলাদেশী নাম্বার! এটা তো সৌহার্দ্যের নাম্বার নয়! অরুণী অবাক কন্ঠে বললো,
“সরি! কে বলছেন?”
“সিনিয়র আপু, আমি মুগ্ধ বলছি।” মুগ্ধর হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠ শোনা গেল।
সম্বোধন শুনে অরুণীর চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। চিনতে আর বাকি নেই ওর! এই ছেলেকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। নয়তো পিছু ছাড়বে না। অরুণী রাগী গলায় বললো,

“নাম্বারও যোগাড় করে ফেলেছো?”
“অনেক আগেই করেছি। কিন্তু কল দেওয়ার সাহস ছিল না।”
“এই দুঃসাহস আর দ্বিতীয়বার দেখিও না।”
বলেই অরুণী কল কেটে দিলো। এমনিতেই সৌহার্দ্যের চিন্তায় জীবন অচল হয়ে যাচ্ছে! তার ওপর এসব উটকো ঝামেলায় অতিষ্ঠ অরুণী ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।

অন্যদিকে মুগ্ধ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন। অরুণী কাঁদছিল, সেটা সে গলা শুনেই বুঝেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘সৌহার্দ্য’টা কে? নিশ্চয়ই অরুণী তাকে ভালোবাসে। অরুণীর কন্ঠের আকুতি, আবেগ ও অভিমান মুগ্ধ বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো সে। এই উদ্ভট প্রেম তার জীবনে কেন এলো? এর পরিণতি কী? অরুণী কি কোনোদিন মুগ্ধকে ভালোবাসতে পারবে?

“ধাক্কা দেওয়ার আগেই দরজা খুলে দিলে! আমি আসবো বুঝতে পেরেছিলে বুঝি? আই লাইক ইট!”
তরী বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সাদা-কালো চেক শার্ট আর জিন্স পরে এসেছে। ঠোঁটে অদ্ভুত রহস্যমিশ্রিত হাসি! সেই হাসি দেখে তরীর গলা শুকিয়ে গেল। এই ছেলে এখানে কী করছে? কেন এসেছে? কীভাবে এসেছে?

সৌহার্দ্য তরীকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে এতক্ষণে। বিছানায় আরাম করে বসেছে। ঘরের চারপাশে নজর বুলিয়ে সন্তুষ্ট হলো সৌহার্দ্য। তবে মুখে সেটা প্রকাশ না করে বললো,
“দরজা খুলে এভাবে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে কেউ? এসো, আমার সামনে এসে দাঁড়াও!”
তরী সৌহার্দ্যের দিকে এগোলো না। হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। তাই সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
“আ….. আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

সৌহার্দ্য মুখ কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তরীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। তরী চমকে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সৌহার্দ্য ওর বাহু চেপে ধরলো,
“নড়তে হবে না। চুপচাপ দাঁড়াও এখানে।”

তরী মাথা উঠিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। চোখের সামনে সৌহার্দ্যের প্রশস্ত বুক। সেটা ঠেলে সরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সাহসও নেই তার। দৃষ্টি সৌহার্দ্যের লোমশ সাদা হাতে গিয়ে ঠেকলো। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করে রেখেছে। পকেট থেকে হাতটা বের করতেই চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেল তার। সৌহার্দ্যের হাতের অবস্থা তার থেকেও খারাপ। ফোস্কা পড়ে চামড়া ফুলে উঠেছে। তরী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো।
“দেখি, তোমার হাতটা দেখাও!”

তরীর হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষা করলো না সৌহার্দ্য। নিজেই তরীর হাতটা চোখের সামনে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো। তরী খেয়াল করলো, সৌহার্দ্যের হাতে একটা ক্রিমের টিউব। সৌহার্দ্য ক্রিম হাতে নিয়ে তরীর হাতে লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,

“আফনাদ আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম মূলত। নিচে ওনার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো। যাওয়ার আগে ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই।”
তরী সরু দৃষ্টিতে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। তাকে এতো জবাবদিহি কেন করছে? কিন্তু মুখে কিছু বললো না। এর থেকে যত দূরে দূরে থাকা যায়, ততই ভালো। হঠাৎ সৌহার্দ্য ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,
“ছেলেটা কে?”

তরী চমকে সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য চোখ দিয়ে ইশারা করতেই বললো,
“কোন ছেলে?”
“তোমার অজানা নয়।” সৌহার্দ্যের শান্ত গলা।
তরী মুখ ছোট করে বললো, “অর্ণব ভাই।”
“ভাই?” সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
“আমার বড় খালামনির ছেলে উনি।”
“পছন্দ করো তুমি ওকে?”

তরী হকচকিয়ে তাকালো। এমন প্রশ্ন সে মোটেও আশা করেনি। ‘পছন্দ করো’ মানে? তরী তো কখনো অর্ণবকে সেই দৃষ্টিতে দেখেইনি! তবে অর্ণব তাকে পছন্দ করে, এটা তরী জানে। বুঝেও।
তরীর এমন নীরবতায় সৌহার্দ্য কেশে বললো,
“কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি তোমায়!”
তরী আমতা আমতা করে বললো,
“আমি কেন ওনাকে পছন্দ করতে যাবো!”

“কিন্তু তোমার ঐ অর্ণব ভাই তো করে!
তরী আনমনে বললো,
“জানি।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
“তুমি জানো?”
তরী সপ্রতিভ চোখে তাকালো। সৌহার্দ্য প্রশ্নসূচক চাহনিতে হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
“হা….. হাত ছাড়ুন! নিচে যাবো। সবাই কী ভাববে এতোক্ষণ এভাবে কথা বললো?”
সৌহার্দ্য হাত ছেড়ে দিলো। বললো,

“কেউ কিছু ভাববে না। এমনিতেও কাল থেকে তুমি আমার আন্ডারে থাকছো পার্মানেন্টনি।”
তরী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো, “মানে?”
সৌহার্দ্য অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো,
“মানে হচ্ছে কাল থেকে তুমি আমার কাছে পড়াশোনা করবে। আফনাদ আঙ্কেলের সাথে কথা হয়েছে আমার। ওনার ইচ্ছে, তুমি ডক্টর হও। তাই মেডিক্যাল এডমিশনের জন্য তোমাকে প্রস্তুত করার দায়িত্বটা আমার কাঁধেই ইন্টেনশনালি নিলাম!”
তরী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই লোকের কাছে কীভাবে পড়বে সে? আজকে কফি ঢেলে দিয়েছে। কাল তো গায়ে আ*গুন লাগিয়ে দিবে। তখন?

তরী ভাবনায় মশগুল। সৌহার্দ্য ক্রিমটা তরীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“রাতারাতি হাতের পেইন সেরে যাবে। তবুও কাল সকালে একবার লাগিয়ে নিও।”
সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তরী বলে উঠলো,
“আপনার হাতটাও তো পুড়ে গেছে!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪

সৌহার্দ্য ঠোঁটে নিষ্প্রাণ হাসি ছড়িয়ে বললো,
“শুধু হাত পুড়ে যাওয়াটা-ই দেখলে?”
সৌহার্দ্য উত্তরের আশা না করেই চলে গেল। তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই প্রশ্নের মানে কী?

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৬