প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৬
Writer Mahfuza Akter
সৌহার্দ্যের কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা খুব বেশিক্ষণ করতে পারেনি তরী। আফনাদ হক তার চিন্তায় দাড়ি বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, কাল থেকেই সৌহার্দ্যের কাছে পড়াশোনা শুরু করতে। মেডিক্যাল এডমিশন টেস্ট আর পাঁচটা সাধারণ পরীক্ষার মতো না। এতে ভালো গাইডলাইনের দরকার, যেটা সৌহার্দ্যের চেয়ে ভালো কেউ দিতে পারবে বলে আফনাদের মনে হয় না।
তরী নিজেও সৌহার্দ্যের মেধা সম্পর্কে জ্ঞাত। মানুষটার স্মরণশক্তি মাত্রাতিরিক্ত তীক্ষ্ণ না হলে তাকে অর্ণবের পাশে এক দেখায়-ই চিনে ফেলতে পারতো সেদিন? ভেবেই তরী অবাক হয়। তার ওপর কুঞ্জনগর গ্রামে ভর্তি প্রস্তুতিমূলক কোনো কোচিং সেন্টারও নেই। গ্রাম থেকে শহরও বেশ দূরে। তাই আফনাদ হকের কথার বিপরীতে কোনো যুক্তি না পেয়ে নিতান্ত বাধ্য হয়েই রাজি হয়ে যায় তরী।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
টানা দুই দিন বাড়ির বাইরে পা রাখেনি তরী। মালিহার সাথে দেখা না হলেও মধুর মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছে তরী যে, সে দু’দিন পর আসবে। মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে এক বুক সাহস নিয়ে তৃতীয় দিন দুপুরের পর সৌহার্দ্যের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো তরী। দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখলো, সৌহার্দ্য হাতে বই নিয়ে মনযোগী ভঙ্গিতে ঘরময় পায়চারি করছে। তরীকে অবাক করে দিয়ে সৌহার্দ্যের বই মনযোগ রেখেই হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“ব্যাড ম্যানার্স! এভাবে উঁকি না দিয়ে দরজায় নক করতে হয়।”
তরী চমকে উঠলো। তার দিকে না তাকিয়েও সৌহার্দ্য কীভাবে বুঝে গেল? হতভম্ব তরীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সৌহার্দ্য বললো,
“ভেতরে আসবে না? ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
তরী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। কিন্তু সৌহার্দ্যের থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্য চেয়ার টেনে দিতেই বললো,
“অলরেডি সাত মিনিট লেইট করেছো তুমি। কাল থেকে ঠিক দুপুর তিনটায় আসবে এন্ড এসেই ডিরেক্ট ঘরে ঢুকে যাবে। এসব উঁকি-ঝুঁকি দিবে না আর!”
তরী মাথা দুলালো। তরীর আঁটসাঁট ভঙ্গি দেখে সৌহার্দ্য বেশ হাসি পাচ্ছে। তবুও মুখে গাম্ভীর্যের রেশ বজায় রেখেই বললো,
“বসো এখানে।”
সৌহার্দ্য চেয়ারের দিকে ইশারা করলো। তরী আর কালক্ষেপ না করেই বসে পড়লো। হাত-পা কাঁপছে তার। বসাটা জরুরি। সৌহার্দ্য তরীর অবস্থা হয়তো বুঝতে পারলো। তাই তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সৌহার্দ্য চলে যেতেই তরী লম্বা শ্বাস ফেললো। এতোক্ষণে যেন বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নামলো। কৌতূহলী চোখ সারা ঘরে বুলালো সে। আগে এই ঘরে একটা পালঙ্কের খাট, পড়ার টেবিল ও বিশাল আলমারি ছিল। আজ সৌহার্দ্যের ঘরটা আর আগের মতো নেই। ঘরে যুক্ত হয়েছে নতুন একটা বুকশেলফ, যেখানে শুধু মেডিক্যাল সায়েন্সের বইপত্র। পাশাপাশি একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা কম্পিউটার টেবিল ও নতুন এসি সেট করা হয়েছে ঘরে।
তরীর ভাবনার মাঝেই সৌহার্দ্য এসে তরীর পাশের চেয়ারটায় বসলো। তরী হকচকিয়ে নড়েচড়ে বসলো। সৌহার্দ্য সেটা খেয়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“লিসেন, চাঁদ! আমি কোনো বাঘ বা সিংহ নই। সো, একটু নরমাল হওয়ার চেষ্টা করা উচিত তোমার।”
তরী অবাক চোখে তাকালো। সৌহার্দ্য তাকে ‘চাঁদ’ বললো? এই নামে তো তাকে শুধু মালিহা-ই ডাকে। তরীকে এভাবে তাকাতে দেখে সৌহার্দ্য ভ্রু নাচালো। তরী সপ্রতিভ হয়ে মাথা নাড়ালো। আর সময় নষ্ট না করে সৌহার্দ্য পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা শুরু করে দিলো। সাপ্তাহিক পড়াশোনার একটা রুটিন বানিয়ে দিলো। সৌহার্দ্যের পড়ানোর ধরণ দেখে তরী হা হয়ে গেল। এই ছেলে মারাত্মক মানুষ! এইভাবেও কেউ পড়াতে পারে? সৌহার্দ্য এতো বিস্তারিত ভাবে টপিকগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে, তরী নিজের অজান্তেই পড়াশোনায় ডুবে গেল। আলোচনার মাঝে তরী প্রশ্ন করলো,
“ভাইয়া, এই প্রশ্নটা দিয়ে কী বুঝিয়েছে?”
এতোক্ষণে পড়ানোর সকল উদ্যম নিমেষেই হারিয়ে গেল সৌহার্দ্যের। ভ্রু কুঁচকে তাকালো তরীর দিকে। সেটা খেয়াল করে তরী ঢোক গিললো,
“আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
“আমি তোমার ভাই হই?” সৌহার্দ্যের কপালে গভীর ভাজ পড়েছে।
তরী অবুঝের মতো তাকিয়ে থেকে বললো,
“হ্যাঁ। মধুর ভাই তো আমার ভাইয়ের মতোই!”
সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তরী এমন চাহনি দেখে হাসফাস করতে লাগলো। এতোক্ষণ তো সব ঠিকই ছিল! কী সুন্দর পড়াচ্ছিলো! এখন আবার কী হলো? হঠাৎ সৌহার্দ্য থমথমে গলায় বললো,
“আমায় ভাইয়া বলবে না।”
“তাহলে কী বলে ডাকবো?” – প্রশ্নটা মনে এলেও ভয়ে আর সেটা প্রকাশ করতে পারলো না তরী। নীরবে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
টানা দুই ঘন্টা পড়ানোর পর সৌহার্দ্য তরীকে বললো,
“আমার ডিউটির সময় হয়ে গেছে। হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হবো এখন আমি। আমার জন্য একমগ কফি নিয়ে এসো তো! ফাস্ট!”
কফির কথা শুনে তরীর গলা শুকিয়ে গেল। সেদিনের মতো যদি আবার হাতে ঢেলে দেয়! আঁটকে আসা গলায় বললো,
“আমি আনবো?”
“এখানে তুমি ছাড়া তো অন্য কেউ নেই যে, তাকে আনতে বলবো! ভয় পেতে হবে না। আজ কফিটা আমার পেটে ঢালবো, তোমার হাতে না।”
তরী মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। সৌহার্দ্য শার্ট-প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুম থেকে একেবারে রেডি হয়ে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ফোনের রিংটোন কানে ভেসে এলো। অনলাইনে আজকেই ফোনটা কানেক্ট করেছে সে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, অরুণী হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছে। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এখানে আসার পর আর যোগাযোগ-ই করেনি সে অরুণীর সাথে।
ভুলেই বসেছিল মেয়েটার কথা। তাই নিজের নাম্বার থেকেই সরাসরি কল করলো অরুণীকে।
এদিকে অরুণী হোস্টেল থেকে বের হবে ক্লাসের উদ্দেশ্যে, এমনসময় কল এলো ফোন। স্ক্রিনে আননৌন বাংলাদেশী নাম্বার দেখে বিরক্ত হলো সে। নিশ্চয়ই ঐ ছেলেটা! ছেলেটাকে নিতান্তই বাচ্চা মনে হয় অরুণীর। আজ আবার কল দিয়েছে ভেবে চটে গেল সে। সাত-পাঁচ না ভেবে ফোন কানে গুঁজে কর্কশ গলায় বললো,
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। আমি তোমার থেকে বয়সে বড়, এটা জানার পরও রেস্পেক্ট করা তো দূরের কথা! তুমি আমার পেছনে ঘুরঘুর করছো! তোমায় যদি আমি এই কলেজ থেকে বিদায় না করিয়েছি, তাহলে দেখে নিও!”
অরুণী এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো। সৌহার্দ্য এসব শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বললো,
“অরুণী, কাকে কী বলছিস এসব?”
অরুণী সৌহার্দ্যের গলা শুনে অবাক হলো। ফোনের স্ক্রিনে পুনরায় চোখ বুলালো। কন্ঠে অবিশ্বাস মিশিয়ে বললো,
“সৌহার্দ্য! তুমি?”
এতোক্ষণে তরী চলে এসেছে কফি নিয়ে। সৌহার্দ্য ফোনে কথা বলছে দেখে আর ভেতরে প্রবেশ না করে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো। সৌহার্দ্য কানে ফোন রেখে চুল সেট করতে করতে বললো,
“চিনতে পেরেছিস তাহলে!”
অরুণী উত্তেজনায় দিন-দুনিয়া ভুলে গেল,
“সৌহার্দ্য, তুমি কোথায় ছিলে? এতো দিন তোমার কোনো খোঁজ নেই! কত চেষ্টা করেছি তোমার সাথে যোগাযোগ করার!”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,
“তোকে না বলেছি, আমার নাম এভাবে ডাকবি না! কিসের সৌহার্দ্য? বড়ো না আমি তোর? ভাই বলে ডাকতে পারিস না? এতো বছরে বলে বলেও তোর মুখ থেকে ভাইয়া ডাকটা আর বের করতে পারলাম না!”
তরী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। একটু আগে না তাকে বকা দিলো ভাই ডাকায়? অরুণী সৌহার্দ্যের কথা শুনলো কি শুনলো না, কে জানে? সে নিজেই নিজের মতো প্রশ্ন করলো,
“নাম্বারটা তো বাংলাদেশের! তাহলে কি তুমি এখন বিডিতে?”
“তিনদিন আগে এসেছি।”
অরুণী ভীষণ কষ্ট পেল। বললো,
“আর আমাকে তিনদিন পর জানাচ্ছো?”
“মনে ছিল না জানাতে।” সৌহার্দ্যের সাবলীল উত্তর।
অরুণী কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সৌহার্দ্য বললো,
“আচ্ছা, আমার ডিউটি আছে। আ’ম গেটিং লেইট। তোর সাথে পরে কথা হবে। ওকে? বায়!”
সৌহার্দ্য ফোন রেখে তাড়াহুড়ো করে পেছন ঘুরতেই তরীকে দেখতে পেল। কফির মগ হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সৌহার্দ্য হতাশ হয়ে বললো,
“পারমিশন দিয়েছি না ডিরেক্ট ঘরে প্রবেশ করে ফেলার? এখন আবার দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
তরী ইতস্তত করে বললো,
“আপনি ফোনে কথা বলছিলেন! তাই আর বিরক্ত করিনি।”
তরীর দিকে এগিয়ে এসে সৌহার্দ্য বললো,
“এখন থেকে করবে।”
“কী করবো?”
“বিরক্ত।”
তরী অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের সুন্দর মুখশ্রীর দিকে। তরীর হাতের কফির দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য আবার বললো,
“সুগার চেক করেছো কফির।”
তরী মাথা নাড়ালো, “না, কিন্তু ঠিকঠাক-ই আছে।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“চেক না করেই বলছো পারফেক্ট আছে? নাহ্, নিজে এক চুমুক খেয়ে টেস্ট করে দেখো।”
তরী বিমূঢ় দৃষ্টি মেলে বললো,
“আ…. আমি?”
“জ্বী, আপনি। ফাস্ট! হাতে বেশি সময় নেই আমার।”
তরী ইতস্তত করে কফির মগে একটা চুমুক দিতেই সৌহার্দ্য ওর হাত থেকে টেনে মগটা নিয়ে নিলো। কফিতে একের পর এক চুমুক বসাতে বসাতে স্টেথোস্কোপ, এপ্রোন, ওয়ালেট হাতে নিলো। ঘরে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
“সেদিন কলেজ ড্রেসে একেবারে বাচ্চা মনে হচ্ছিল তোমায়! আজ একটু বড় বড় লাগছে। আসছি। থ্যাংকস ফর দিস সুইট কফি।”
তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। এই ছেলের কথাবার্তা, আচার-আচরণের অর্থ সে বুঝে উঠতে পারে না। তবে এমনিতে যেমনই হোক, পড়াশোনায় সৌহার্দ্যের চেয়ে ভালো গাইডার তরী কখনো দেখেনি। পড়ার টেবিলে মানুষটা আসলেই অসাধারণ।
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৫
[আগামী পর্ব থেকে গল্পটা মেইন ট্র্যাকে চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। সবার রেসপন্স প্রত্যাশা করছি।
Sundor hoyasa golpota onk…..porar part ar jonno wait kortasi…tara taridiban🤗❤🖤💛💙💜
Sundor hoyasa golpota onk…..porar part ar jonno wait kortasi…tara taridiban🤗❤🖤💛💙💜
Golpo ta darun