প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৩

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৩
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

সকালের সূর্য উঠার আগেই মেইন রোডে একটা এক্সি’ডে’ন্ট ঘটে গেল। অল্প বয়সী একটা তরুণী মাঝ রাস্তায় বসে কাঁদছে,তাকে ঘিরে রাস্তায় চলাচলরত কৌতুহলী মানুষের ভিড় জমে আছে।ভিড় ঠেলে ফাইরুজের কাছে এলো আবির মাহমুদ।

‘ কি হয়েছে মামণি? তুমি এক্সিডেন্ট করলে কিভাবে ?'(আবির মাহমুদ)
ফাইরুজ কিছু বলছে না। চুপচাপ আশপাশে তাকিয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করলো। এখানে সে কিভাবে এসেছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না,হুট করে চোখ খুলে দেখে মাঝ রাস্তায় গাড়ি চলছে আর ওর হাত দুটো বাঁধা। সামনে দিয়ে একটা বাইক আসছিল তার সাথেই এক্সি’ডে’ন্ট করলো টাল সামলাতে না পেরে। এখন হাত খোলা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দু হাতে চোখ মুছে বাবা কে জড়িয়ে ধরলো ফাইরুজ। কালকে পূর্বের থেকে এতো বড় একটা ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলানো মুশকিল ছিল তার, সেজন্য বন্ধুদের নিয়ে ক্লাবে গিয়ে ড্রিংক করেছে প্রচুর।মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছে, আবির মাহমুদ ওকে নিয়ে গাড়িতে তুললেন। নিজের গাড়ির ড্রাইভার কে ফাইরুজের গাড়ি আনতে বলে ফাইরুজ কে নিয়ে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলেন। পিছনে লোকজন চেঁচামেচি শুরু করেছে এক্সি’ডে’ন্ট এর জন্য, সেদিকে কর্ণপাত করলেন না তিনি।

সকাল ছয়টায় ঘুম ভাঙল পূর্বের।আড়মোড়া ভেঙে বেডে উঠে বসল তখনই খেয়াল করলো স্নিগ্ধা রুমে নেই। মূহুর্তের মধ্যেই ঘুম উধাও হয়ে গেছে ওর। এতো সকালে কোথায় গেল স্নিগ্ধা , বাগানে যায়নি তো আবার? পাতলা একটা ব্লেজার জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে পূর্ব তাড়াতাড়ি বাগানের দিকে গেল।

বাগানের মালি রুমি গাছে পানি দিচ্ছে ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কোন মেয়ে বাগানে এসেছে কিনা।রুমি না সূচক মাথা নাড়ল। পূর্ব আশপাশে দেখতে দেখতে গেটের বাইরেই এসে দাড়ালো, ইতিমধ্যেই পুরো বাড়িতে খুঁজে শেষ করে দিয়েছে কিন্তু কোথাও স্নিগ্ধার টিকি টাও খুঁজে পায়নি।

হঠাৎ করেই কিছুটা দূরে রাস্তায় ওর চোখ গেল, ওখানে একটা ক্লিপ পড়ে আছে। পূর্ব এগিয়ে গেল ওদিকে।ক্লিপ টা হাতে তুলে নিয়েই বুঝতে পারলো এটা স্নিগ্ধার ক্লিপ,রাতেও ওর চুলে এটা লাগানো ছিল ও খেয়াল করেছিল। স্নিগ্ধা এখানে কেন এসেছে এতো সকালে, কোথাও আবার ওর কিছু হয়ে যায় নি তো?

‘ তূর্য, এই তূর্য! গাড়িটা বের কর কুইক !’
বাড়ির ভেতরে প্রায় দৌড়ে এলো পূর্ব। রুমে ঢুকে নিজের ফোনটা নিতে নিতে তূর্য কে ডেকে গাড়ি বের করতে বললো। কেন জানি ওর মন বলছে স্নিগ্ধার কোন বিপদ হয়েছে, এতো সকালে গেইট খুলেনি দারোয়ান। নিশ্চয়ই ও রাতের কোনো এক সময় গেটের বাইরে গেছে, কিন্তু দারোয়ান ওকে যেতে দিল কেন , পূর্বের তো নিষেধ আছে রাত বারোটার পর এই বাড়িতে কারোর আসা যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ।এসব ভাবতে ভাবতেই তূর্য চলে এলো।

‘ দোস্ত কি হয়েছে, এভাবে চেঁচামেচি করছিস কেন!আর এতো সকালে গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবি?'(তূর্য)
‘ স্নিগ্ধা কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খুব সম্ভবত ও বাসা থেকে কোথাও বেরিয়ে গেছে আমাদের না বলেই, গেটের বাইরের রাস্তায় ওর চুলের ক্লিপ পড়ে ছিল আমি গিয়ে দেখলাম।'(পূর্ব)

‘ কি বলছিস তুই? তাসনিয়া ভাবী আর না বলে বাসা থেকে চলে যাওয়া ! পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেলেও সম্ভব নয় এটা।'(তূর্য)
‘ তাহলে কোথায় ও? গেটের বাইরে ওর ক্লিপ পড়ে ছিল এটা আমি নিজে দেখেছি আর তুলেও নিয়ে এসেছি, এই দেখ!'(পূর্ব)

_____ ‘ ওটা আপনার হ্যালুসিনেশন হয়েছিল স্যার, আপনি ক্লিপ টা রুমের বাইরে পেয়েছেন গেটের বাইরে না।’
হঠাৎ এমন আওয়াজ শুনে পূর্ব যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলো।ওয়াশ রুমের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল পূর্ব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আমি ওয়াশ রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তূর্য আমাকে দেখে হাসি মুখে বললো,,,

‘ কি আর বলবো ভাবী বলেন, আমার বন্ধু আপনাকে চোখে হারাচ্ছে বারবার তাই তো ঘুম থেকে উঠে আপনাকে চোখের সামনে না পেয়ে উল্টো পাল্টা ব’কা শুরু করেছে।হ্যা রে পূর্ব, তুই ভাবী কে ওয়াশ রুমে খুঁজেছি লি তো নাকি!!(তূর্য)
আর কিছু না বলে তূর্য হো হো করে হাসা শুরু করে দিল।

পূর্ব অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো, কিছু বললো না। তূর্য ওর কাঁধে হাত রেখে ইশারায় কিছু একটা বলে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তূর্য রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পূর্ব গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে।চোখ মুখের বিস্ময় ভাব এখনও কাটেনি উনার, হাতের মধ্যে লেগে থাকা পানি ছিটা দিলাম উনার মুখে।

‘ কি হয়েছে স্যার, এভাবে দেখছেন কেন আমাকে?'(শান্ত কন্ঠে বললাম আমি)
‘ কি কিছু না।আজ তোমার অফিসে যাওয়ার দরকার নেই স্নিগ্ধা, আমি আমি আসছি এখন।'(পূর্ব)
পূর্ব আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।যাওয়ার সময় দরজায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো শান্ত চোখে,সে চাহনিতে কোনো মায়া ছিল না ছিল একরাশ অবিশ্বাস। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোন নিয়ে চলে গেল।

ফাঁকা রাস্তায় কোন কারণ ছাড়া একা একাই গাড়ি ড্রাইভ করছে পূর্ব। কিছুক্ষণ আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার হিসাব কিছুতেই মিলাতে পারলো না সে। পূর্ব নিজে ওয়াশ রুমে চেক করেছে প্রথমে, সেখানে স্নিগ্ধা আছে কিনা দেখার জন্য কিন্তু ওখানে ও ছিল না। রুমের, বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজে দেখেছে কোথাও পায়নি তাকে।

তাহলে হুট করে স্নিগ্ধা ওয়াশ রুম থেকে বের হলো কি করে,এটা কি করে সম্ভব?হ্যালুসিনেশন???? না,এটা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।ক্লিপ টা ও গেটের বাইরেই পেয়েছে এটা ও হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর,আর ও যে গেটের বাইরে গেছে এটার সাক্ষী বাগানের মালি রুমি আর দারোয়ান খালেক চাচা। এসব কি হচ্ছে তার সাথে আজ? ভেবে কোন কুল কিনারা করতে পারলো না পূর্ব। চিন্তায় মাথা কাজ করছে না অযথাই ড্রাইভ করতে লাগলো ফাঁকা রাস্তায়।

রুমে বসে বসে হালকা সাজলাম আমি। এমনিতে তো সাজা হয়না কখনও,আর এখন পূর্ব স্যার ও বাসায় নেই খুব সম্ভবত।স্যার আসার আগেই একটু সাজলে মন্দ হয় না।বিয়ের জন্য যখন আমাকে সাজানো হয়েছিল তখন মেয়েগুলো হাসাহাসি করছিল আর বলছিল ‘ভাবী আমাদের ভাই কে হাতের মুঠোয় রাখতে হলে তাকে খুশি রেখো।

ভাইয়ের ভালোবাসা পেতে চাও তো ভাই কেও ভালোবেসো একটু।’ আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসলাম আমি।স্যারের মতো গম্ভীর মানুষ কে ভালোবাসতে হবে ভাবতেই কেমন লাগছে, তিনি কি আমাকে ভালোবাসবেন ?চাপে পড়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এখন উনার কাছে ভালোবাসা আশা করাটা মুর্খামী এক প্রকার আর কিছুই না।তার পরেও নিজের মনের শান্তির জন্য সাজা আর কি! তখনই দরজায় নক করার শব্দ হলো,,,

‘ ও ভাবী,ভাবী গো তুমি কি করো?’
তাকিয়ে দেখি কেয়া এসেছে।লাল টুকটুকে একটা গাউন পড়েছে,চুল গুলো ছেড়ে দেওয়ায় খুব সুন্দর লাগছে তাকে। উঠে গেলাম ওর কাছে। হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কেয়া, ওর নাকটা টেনে দিয়ে বললাম,,

‘ এই তো চুল বাধছিলাম। ভালো করেছো তুমি এসে,একা একা ভালো লাগছিল না আমার।স্যার ও অফিসে যেতে মানা করেছেন আজ।এসো গল্প করি দুজনেই,,'(আমি)
‘ সেকি ভাবী? এখনও পর্যন্ত তুমি ব্রেক‌ ফাস্ট করোনি,মামী তো আমাকে তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছে।আগে খাবে চলো, এরপর সব গল্প হবে।আর ভাইয়া কোথায়, ভাইয়া কেও ডেকেছে খাওয়ার জন্য।'(কেয়া)

‘ জানি না।উনি হুট করে কোথায় যে বেরিয়ে গেলেন।'(আমি)
‘ ওহ্। তুমি এসো।'(কেয়া)
হাতের চিরুনি টা রেখে কেয়ার সাথে চলে এলাম। খাবার টেবিলে বেশ মানুষ আজকে।সিয়া, তূর্য, শশুর বাবা, শাশুড়ি মা,দাদী সহ আরো নতুন কয়েকটি মুখ দেখে কেয়ার দিকে তাকালাম।কেয়া পরিচয় করিয়ে দিল,

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১২

‘ ভাবী,উনি হচ্ছেন তোমার ছোট ফুপি শাশুড়ি আর আমার একমাত্র মা।আর এনারা দুজন তোমার চাচা শশুর আর চাচী শাশুড়ি, ওরা দুজন হচ্ছে তোমার দুই মাত্র দেবর আর নন্দিনী মিফতাহ চৌধুরী আর রায়ান চৌধুরী।’
আমি‌ সবার পরিচয় শুনে ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। চাচী শাশুড়ির দিকে তাকালাম, উনি মুখ কালো করে ফিরিয়ে নিলেন নিজের মুখটা। আমার মনে হলো কেন জানি উনি আমাকে ঠিক পছন্দ করেন নি,,,,

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৪