হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৮

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

সকাল থেকে বিশালভাবে তোড়জোড় চলছে।আজ আরাবী আর জায়ানের গাঁয়ে হলুদ।দুজনের গাঁয়ে হলুদ একসাথেই হবে এটা জায়ানের আদেশ।এর জন্যে একটা কমিউনিটি সেন্টার বুক করা হয়েছে।জায়ানের পাগলামিতে সে-কি হাসাহাসি ওর পরিবারের।কিন্তু এতে অবশ্য জায়ানের কোন ভাবাবেগ দেখা যায়নি।

সে সর্বদার মতো নির্বিকার। নূর এসব আরাবীকে জানাতে সেও হেসেছে।তাকে ঘিরে যে লোকটার কতোশতো পাগলামি।আরাবী এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় রাখা জায়ানদের বাড়ি থেকে হলুদের যাবতীয় সব কিছু দিয়ে গিয়েছে। সবকিছু কেমন যেন লাগছে।মনের মাঝে অন্যরকম একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কালকের পর থেকে জায়ান নামন ব্যাক্তিটার সাথে ওর অস্তিত্ব আজীবনের জন্যে জুড়ে যাবে। হলুদের লেহেঙ্গাটায় হাত ছোয়ালো আরাবী। ভীষণ সুন্দর লেহেঙ্গাটা।ওর বিয়ের যাবতীয় সবকিছু না-কি জায়ান নিজে পছন্দ করে কিনেছে। কারো পছন্দের মত নেইনি।হাসলো আরাবী জায়ানের কথা ভেবে।গালদুটো লজ্জায় গরম হয়ে উঠলো। এতে শ্যামবর্ণের আরাবীকে লজ্জাবতী অবস্থায় কি-যে সুন্দর লাগে।এইজন্যেই বুঝি জায়ান বারে বারে আরাবীকে লজ্জা দেয়।আরাবীর ঠোঁটের কোণে মুঁচকি হাসি।

আরাবী যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত।তখন আলিফা এসে তারা দিলো আরাবীকে।
-‘ কিরে? তৈরি হবি নাহ? সময় বেশি নেই তো।’
ভড়কে গেলো আরাবী।তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকালো।আসলেই সময় বেশি নেই।জলদি কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছাতে হবে। আরাবী দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসলো। আলিফা এইবার আরাবীকে মেক-আপ করে দিতে লাগলো।আলিফা একজন মেক-আপ আর্টিস্ট।তবে ওর কোন পার্লার নেই।মাত্র কয়েকমাস হলো মেক-আপ কোর্স করেছে।ভীষণ সুন্দর করে সাঁজায় মেয়েটা। এটা অবশ্য শখের বসে শিখা।আরাবী বলে উঠলো,

-‘ কতো করে বললাম একটা পার্লার দে।কি সুন্দর সাঁজিয়ে দিস তুই।’
আলিফা হেঁসে বলে,
-‘ এইটা তো এমনি শখের বসে শিখেছি।আচ্ছা দেখি ভবিষ্যতে ইচ্ছে হলে খুলবো নেহ। এখন চুপচাপ থাক।নড়িস নাহ মেক-আপ নষ্ট হয়ে যাবে। পরে জায়ান ভাইয়া আমাকে দোষ দিবে।’

আরাবী হেসে দিলো।আলিফার কথার ধরনে হেঁসে দিলো।আলিফা আরাবীকে সুন্দর করে সাজানো শেষ করলো। আরাবীকে সসম্পূর্ণ রূপে সাজিয়ে আলিফা মুগ্ধ হয়ে বলে,
-‘ ইস,কিযে সুন্দর লাগছে না তোকে।ভাইয়া দেখলে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে।’
আরাবী হাসলো।বললো,

-‘ তুই কি কম সুন্দর নাকি।আমাকে সুন্দর বলছিস।তাহলে তো তুই সাজলে তোকে পুরো হুরপরি লাগবে।তাড়াতাড়ি সেজেগুজে নেহ।’
আলিফাও তৈরি হতে চলে গেলো।আলিফা পরেছে সারারা ড্রেস।ওকেও কোন অংশে সুন্দর লাগছে না।
ওরা তৈরি হতেই দরজায় টোকা পরলো।শোনা গেলো ফাহিমের কণ্ঠস্বর,
-‘ কিরে হলো তোদের?বের হবো আমরা।’

আরাবী গিয়ে দরজা খুলে দিলো।ফাহিম বোনকে দেখে মুগ্ধ হলো।আরাবীর গায়ের রঙ শ্যামলা বলে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।তবে তারা তো আর জানে না শ্যামবর্ণের এই মেয়েটাকে ঠিক কতোটা মায়াবতী লাগে।ফাহিম বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
-‘ মাশা-আল্লাহ। খুব সুন্দর লাগছে তোকে।’
আরাবী মিষ্টি হাসলো।পাশ থেকে আলিফা এসে বলে,

-‘ আমাকে কেমন লাগছে ফাহিম ভাইয়া?’
ফাহিম হেসে বলে,
-‘ তোকেও খুব সুন্দর লাগছে,মাশা-আল্লাহ! ‘
আলিফা খুশি হয়ে গেলো।আরাবী আর আলিফাকে নিয়ে বসার ঘরে আসলো ফাহিম।আরাবী সোজা হেটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।জিহাদ সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আরাবীর চুলে চুমু দিয়ে বলেন,

-‘ একদম আমার মায়ের মতো সুন্দর লাগছে।একদম একটা মিষ্টিপরি লাগছে।’
আরাবীর চোখ ভরে আসলো।আর মাত্র একটাদিন আছে এই মানুষগুলো কাছে।এইসব ভাবলেই আরাবীর বুক ভার হয়ে আসে।বুকের মাঝে আপনজনদের ছেড়ে চলে যাবার হা’হাকারের ঝড় উঠে। আরাবীর কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা দেখে আলিফা জোড়পূর্বক হেসে বলে,

-‘ আরে কি করছিস। কান্নাকাটি করে আমার এতো কষ্ট করে দেওয়া মেক-আপ নষ্ট করিস নাহ।ফ্রিতে সাজিয়ে দিয়েছি।কেঁদেকেটে তা নষ্ট করলে টাকা দিতে হবে বলে দিলাম।’
জিহাদ সাহেব হেসে দিলেন।আরাবীকে বুক থেকে তুলে নিলেন।মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
-‘ কোন কান্নাকাটি করা যাবে নাহ।তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন এগুলো।মন ভরে উপভোগ করবে।দিনশেষে এইগুলোই সুন্দর কিছু স্মৃতি হয়ে থাকবে।’

আরাবী চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মুছে নিলো।তারপর লিপি বেগমের কাছে গেলো।মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।লিপি বেগম অবাক হলেন।তবে কিছু বললেন নাহ।তিনিও আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে দিলেন।আরাবী যেন এটুকুতেই খুশিতে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছে।
এদিকে ফাহিম হাতের ঘড়িতে সময় দেখে সবাইকে তাড়া দিতে লাগল,
-‘ আর দাঁড়িয়ে থেকো নাহ।জলদি চলো।নাহলে লেট হয়ে যাবে।চলো চলো।নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে সেই কখন থেকে।’

গাড়ি এসে পৌঁছালো সুসজ্জিত ঝলমলে একটা বিল্ডিংয়ের সামনে।সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।ফাহিম এসে আরাবীকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করছে। আরাবী কমিউনিটি সেন্টারের গেটের সামনে একটা বিশাল বোর্ড দার করানো দেখলো। সেখানে লিখা ” আজ জায়ান,আরাবীর হলুদ ছোঁয়া “।

কমিউনিটি সেন্টারের ভীতরে প্রবেশ করলো সবাই।প্রায় সংখ্যক মেহমান এসে পরেছে।জায়ান’রা এখনো আসেনি।তাদের একটু দেরি হবে।ফাহিম আলিফাকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলে আরাবীকে নিয়ে এখানে অপেক্ষা করতে।জায়ান ওরা আসলেই যেন বের হয়। আলিফা আরাবীকে নিয়ে সেই রুমে চলে গেলো।

বিছানায় বসে হাঁসফা’স করছে আরাবী। সেই-যে সকাল থেকে বুকটা ধ্বুকপুক করা শুরু করেছে তো করেছেই।থামাথামির নাম গন্ধ নেই।হাত-পা ঘেমে যাচ্ছে বার বার।এখানে আসা অব্দি কতো গ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছে আরাবী।তাও যেন বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।আলিফাটা সেই-যে ওয়াশরুমে গিয়েছে আসার নামগন্ধ নেই।হঠাৎ বাহির থেকে শোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসলো।আরাবী বুঝলো জায়ান’রা এসে পরেছে।

বুকের মাঝে এইবার কাম’ড়ে ধরলো যেন।ইস, কিরকম সুখময় যেন এই যন্ত্র’না।আরাবী শক্ত হয়ে বসে রইলো। আরাবীর ভাবনার মাঝেই হঠাৎ আরাবীর ফোন বেঁজে উঠলো।আরাবী ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে ‘ জায়ান’ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে কল আসছে।কলিজাটা ছ্যাৎ করে উঠলো।

এই লোক এখানে এসেও কেন কল করছে ওকে?এখন আরাবী কথা বলবে কিভাবে? ওর গলা দিয়ে তো কথাই বের হবে না। যেই অবস্থা ওর।আকাশসম চিন্তার মাঝেই প্রথমবার কলটা ধরতে পারলো না আরাবী।দ্বিতীয়বার ফোন বেঁজে উঠতেই আরাবী কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে করলো।কাঁপা গলায় নিজেই আগেই সালাম দিলো।ওপাশ থেকে জায়ান সালামের জবাব নিয়ে নরম গলায় বলে,

-‘ ফিলিং নার্ভাস?’
আরাবী সময় নিয়ে উত্তর দিলো,
-‘ হু।’
-‘ আমিও নার্ভাস।’
অবাক হলো আরাবী।জায়ান ছেলে হয়েও নার্ভাস হচ্ছে?এমন একটা কথায় আরাবী হাসবে নাকি জায়ানকে শান্তনা দিবে ভেবে পেলো না। ওপাশ হতে জায়ানের শান্ত কণ্ঠ,

-‘ ছেলে হয়েও আমি কেন নার্ভাস জিজ্ঞেস করবে নাহ?’
আরাবী মিনমিন করে বলল,
-‘ কেন?’
-‘ তোমার জন্যে!’
অবাক আরাবী।
-‘ আমার জন্যে?’
-‘ হ্যাঁ।’
-‘ আমি কি করেছি?’

-‘ বলো একটু পর আমার সাথে কি কি করবে! এইযে তুমি এখন সুন্দরভাবে সেজেছো।নিশ্চয়ই তোমাকে একেবারে হলুদপরি লাগছে।এখন তোমাকে এই রূপে দেখবো একটু পর আমি।তখন আমার কি হবে ভাবতে পারছো তুমি?আমি পাগ’ল না হয়ে যাই।মাথা টাথা খারাপ হয়ে যাবে আমার।পরে সবার সামনে কন্ট্রোললেস হয়ে গেলে তোমাকে চুমু টুমু না খেয়ে বসি।পরে তুমিই আর কালকে বাস’র রাতে আমার কাছেই আর আসবে না।তখন আমি কি করবো বলো তো। কতোটা নার্ভাস আমি জানো তুমি এসব ভেবে? চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

আরাবী হা হয়ে গিয়েছে।ও আরো কতো কি ভাবলো।কিন্তু জায়ান ওর সবকিছু উল্টেপাল্টে দিয়ে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছে।খামোখা কি আর আরাবী লোকটাকে ‘ অস’ভ্য’ উপাধি দিয়েছে। ওর ভাবনার মাঝে ফোনের ওপাশ হতে জায়ানের অস্থির কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,

-‘ আরাবী কথা বলছো না কেন? আমার কষ্টটা অনুভব করো।আমি কতোটা চিন্তিত। কোথায় আমাকে প্রেম প্রেম কথা বলে শান্তনা দিবে তা না করে চুপ করে আছো।জানো আমি কাল রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি।জেগে জেগে তোমায় নিয়ে কতো কি করেছি।তোমাকে কতো যে আদর করেছি।

ইস,কালকের দিনটা আসছে না কেন?এতো দেরি কেন লাগছে।এইসব হলুদের ফাংশান কে আবিষ্কার করেছে? তাকে গু’লি করে মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কোন হলুদ টলুদের অনুষ্ঠান না করে ডিরেক্ট বিয়ে করে নিবে এতেই না আমার মতো অস্থির মানুষ শান্ত হবে।এসব অপেক্ষা ভালো লাগে না।আমি তো অনেক বেশি অস্থির।কাল না জানি কবুল বলেই ডিরেক্ট বাসর ঘরে নিয়ে ঢুকে চুমু টুমু খেয়ে….. ‘

জায়ানের এইসব ভয়ংকর কথাবার্তা সহ্য করতে না পেরে আরাবী চেঁচিয়ে উঠলো,
-‘ বন্ধ করুন আপনার এসব অস’ভ্য কথাবার্তা।’
-‘ তুমি তো আমার কথা শুনলেই… ‘

জায়ানের কথা পুরোটা শোনার আগেই আরাবী ফোন কেটে দিলো। লজ্জায় পুরো শরীর গরম হয়ে গিয়েছে আরাবীর। সারা শরীর লজ্জায় ভয়া’বহভাবে কাঁপছে।এমনিতে তো অন্যকারো সামনে বো’ম মারলেও সহজে কথা বের হয় না।আর ওর কাছে আসলেই যেন তার টকিং মেশিন অবিরাম চলতে শুরু করে।কোন বাধানিষেধ নেই।এমন এক নির্লজ্জ লোকের সাথে আরাবী থাকবে কিভাবে?এমন ভ’য়ং’ক’র কথাবার্তা যে কেউ এমন অনায়াসে বলতে পারে কাশ্মিনকালেই ভাবেনি।আর সেটা যে ওর কপালেই এসে জুটবে।আরাবী বিরবির করলো,

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৭

-‘ অস’ভ্য ঠোঁটকা’টা লোক।লাগাম নেই লোকটার।একদম নেই।’
আরাবী দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো।ভীষণ গরম হয়ে আছে সারা মুখশ্রীর আরাবীর।লজ্জায় চোখ ভিজে উঠেছে আরাবীর।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৯