প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১৪

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১৪
তানজিলা খাতুন তানু

আদৃতের কথা শুনে সকলেই ওর দিকে তাকাল। আদৃত সকলের তাকানো দেখে বলল..
– আজকে অতসী একটা বড়ো‌ এক্সিডেন্টের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
– কি বলছিল দাদাভাই এসব। (মিতু)
আদৃত সংক্ষেপে সবটা বলল সবাইকে। আদৃতের মায়ের বুকটা কেঁপে উঠল, অতসী কে আদর করে জড়িয়ে ধরলেন।
– একটু দেখে চলবি না। যদি কিছু হয়ে যেত।
আদৃতের মায়ের কথা শুনে অতসীর চোখ ভরে আসলো। চোখ দুটো পানিতে চিকচিক করতে দেখে আদৃতের মা বলল…

– আরে‌ কি হলো, তোর চোখে পানি কেন?
– কতদিন পর কেউ এইভাবে শাসন করল।
– পাগলি মেয়ে একটা। আমি তো তোর মায়ের মতোই, আজ থেকে তুই আমাকে মামনি বলবি ঠিক আছে।
– আচ্ছা।
আদৃত ওদের ভালোবাসা দেখে মুচকি হেসে বলল….

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– মা ওকে নিয়ে ভেতরে যাও। আর ওর জন্য কিছু খাবার ব্যবস্থা করো। ডাক্তার বলেছে অত্যাধিক চিন্তা, মানসিক চাপ আর অনেকক্ষন কিছু না খেয়ে থাকার জন্য অজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
মিতু অতসীর খাবার ব্যবস্থা করল। আদৃতের মা এমনিতেই অতসী কে পছন্দ করত, আজকে আরো আপন করে নিলেন। অতসী প্রথমে রাজি ছিল না এই বাড়িতে থাকার জন্য, আদৃতের মায়ের কথা আর আরুর জেদের বশে অতসী শেষে থাকতে রাজি হয়ে যায়।
অতসীর জন্য একটা ঘর খুলে দিলো। বাড়িতে অনেকগুলো রুম, বেশি কেউ থাকে না বলে রুমগুলো প্রায় সময়েই ফাঁকাই থাকে। অতসী রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। তখনি আদৃত দরজায় কড়া নাড়ল।

– আরে আপনি আসুন।
আদৃত ভেতরে আসলো না, দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বলল…
– রুমটাতে কেউ থাকত না বলে বেশি কিছু দিয়ে সাজানো নেয়। আপনি আপনার মতো করে সাজিয়ে নেবেন,আর কিছুর প্রয়োজন পড়লে বলবেন আমি এনে দেব। আর একটা কথা, মিতুকে নিয়ে গিয়ে আপনার দরকারি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে আসবেন আর ওই বাড়ির ভাড়াটা দিয়ে আসবেন।
একদমে কথাগুলো বলে আদৃত চলে যেতে যাবে, তখনি অতসী বলল…

– আমার একটা কথা ছিল।
– কি?
– আমি কিন্তু এই বাড়িতে এমনি এমনি থাকতে পারব না।
– মানে?
– ভাড়া নিতে হবে।
আদৃত অতসীর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
– কি বলছেন আপনি এইসব।
– ঠিক বলছি। যদি ভাড়া নেন তবেই আমি থাকব নাহলে নয়।
আদৃত ভালো ভাবেই বুঝল অতসী নাছোড়বান্দা, কিছুতেই এমনি এমনি এই বাড়িতে থাকতে রাজি হবে না। তাই বলল…

– আপনি মিষ্টিকে টিউশনি পড়ান তো।
– হুম।
– তারজন্য মাইনে নেন তো।
– হুম।
– এইবার থেকে মিষ্টিকে পড়ানোর জন্য আপনি কোনো মাইনে পাবেন না, তার বদলে এই বাড়িতে থাকবেন ঠিকাছে।
আদৃতের প্রস্তাব শুনে অতসী তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আদৃত অতসীর উত্তরের আশা না করেই বেড়িয়ে গেল, অতসী বিরবির করে বলল…

– লাভ হলো না লোকসান হলো।
আরু তো খুব খুশি, বলেই দিয়েছে অতসীর সাথে ঘুমাবে। অতসী ফ্রেশ হবে উশখুশ করেই চলেছে, কিন্তু কি পড়বে তার জন্য ফ্রেশ‌ হতে পাচ্ছে না।
– মিতু।
– হ্যাঁ বলো।
– আমি শাওয়ার নেব একটু।
– হ্যাঁ নাও।
– কিন্তু কি পড়ব। আমি তো কিছুই আনিনি। (মন খারাপ করে বলল)
– ওহ্ ।
মিতু চিন্তিত হয়ে গেল। অতসীর তুলনায় মিতুর শরীর স্বাস্থ্য একটু ভালো, অতসী ওর জামা গায়ে দিলে ফকফক করবে, আর একটা মানুষ ঢুকে যাবে।
মিতু চিন্তিত হয়ে মায়ের কাছে যায়।

– মা।
– হ্যাঁ বল।
– অতসী শাওয়ার নেবে বলছে কিন্তু কি পড়বে।
– তোর জামা দিয়ে দে।
– হ্যাঁ, আমার জামা ওর গায়ে হবে বলে তোমার মনে হয়।
উনি একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হলেন। একটু ভেবে বললেন….
– চল আমার সাথে।
– কোথায়?
– চল না।

আদৃতের মা মিতুকে টেনে নিয়ে সোজা আদৃতের ঘরে গেলেন। আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে দিলেন।
– মা!
– এইগুলো দিয়ে আয়, ব্লাউজটা মনে হয় অতসীর গায়ে হয়ে যাবে।
– কিন্তু মা, এইগুলো তো ভাবির। দাদাভাই যদি কিছু বলে।
– কিছু বলবে না। তুই দিয়ে আয়।
– আচ্ছা।
মিতুর মায়ের আদেশে অতসী কে গিয়ে শাড়িটা দিতেই অতসীর মুখ কুঁচকে গেল।
– আবার শাড়ি।
– কিছু করার নেই, এইটা ছাড়া তোমার মাপের আর কিছুই নাই।
– হুম।

অতসী হতাশ হয়ে শাড়িটা নিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেল। হসপিটালে ঘুরে এসেছে,গা কিরকম একটা করছে। অতসী শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলোকে মুছতে ছিল তখনি দরজায় টোকা পড়ল…
অতসী ঘুরে তাকাতেই আদৃত থমকে গেল, আধভেজা এলোমেলো চুল, চুলগুলো থেকে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে, আর পরনে ওর স্ত্রী রুহির শাড়ি। অতসী তাকিয়ে দেখল আদৃত কিরকম একটা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, আর হাতে অনেকগুলো প্যাকেট। অতসী নিজের শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলল…

– কিছু দরকার কি?
আদৃত অতসী কথাতে ধ্যান থেকে ফিরে এসে বলল…
– আপনার জন্য কিছু ড্রেস এনেছিলাম, রেখে গেলাম।
আদৃত প্যাকেটগুলো রেখে একপ্রকার পালিয়ে গেল। অতসী কিছুই না বুঝে ওর যাবার দিকে তাকিয়ে রইল।
আদৃত নিজের ঘরে ঢুকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল। অতসীকে ওই অবস্থাতে দেখে ওর মনের মাঝে অন্যরকমের একটা অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার কারন কি অতসীর গায়ে রুহির শাড়ি থাকা! নাকি অন্য কিছু।
আদৃতের কিরকম একটা পাগল পাগল লাগতে শুরু করে দিয়েছে। একটা অন্যরকম অনুভূতির‌ সৃষ্টি হচ্ছে। মিতু আদৃতকে খেতে ডাকতে এসে দেখল, আদৃত চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে বসে আছে।

– এই দাদাভাই। তুই ঠিক আছিস।
– হুম।
– মা খেতে ডাকছে চল।
– যাচ্ছি,তুই যা।
মিতু চলে যেতে যাবে, তখনি আদৃত ওকে পেছন ডাকল…
– মিতু শোন।
– হ্যাঁ বল।
– অতসী কে রুহির শাড়ি কে দিয়েছে?
– মা। কেন?
– না কিছু না, তুই যা।

মিতু চলে যেতে, আদৃত উঠে গিয়ে আলমারি খুলল। আলমারি ভর্তি রুহির শাড়ি, রুহির শাড়ি কিনতে বড্ড ভালোবাসত। আদৃত চাকরি পাবার পর, রুহির কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেনি। পছন্দ হলেই শাড়ি কিনে আনত। এইখানের বেশিরভাগ শাড়িই নতুন, রুহি অনেক শাড়িই একবারো পড়েনি। আদৃত শাড়িগুলো কাউকে দিতে দেয়নি, এমনকি মিতুকেও পড়তে দেয়নি। মিতু শাড়ির কথা বললে নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছে। আজকে রুহির শাড়ি অতসী কে পড়তে দেখেও কিছু বলল না কেন?

আদৃত খেতে গিয়ে দেখল, অতসী আরুকে খাইয়ে দিচ্ছে।‌ দুজনে পুরো মা-মেয়ে মনে হচ্ছে, আদৃত নিজের ভাবনাতে নিজেই অবাক হলো। খেতে বসেও ঠিক মতো খেতে পারল না,বারবার চোখ অতসীর দিকে চলে যাচ্ছে। শেষে আদৃত না খেয়েই উঠে চলে যায়।
– আরে কি হলো‌ খেয়ে যা।
– খিদে নেয়।
আদৃতের এইরকম ব্যবহারের কারনটা কেউ না বুঝলেও আদৃতের মা ঠিকই বুঝলেন। সকলের খাওয়া হয়ে যাবার পর, একটা প্লেটে খাবার নিয়ে ছেলের ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।

– আদৃত বাবা।
মায়ের গলা শুনে আদৃত তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। মায়ের হাতে খাবারে প্লেট দেখে আদৃতের মুখে হাসি ফুটে উঠল। কথাতেই বলে, মায়ের থেকে ভালো তার ছেলেমেয়েকে কেউ বোঝে না। সত্যিই তাই।
আদৃতের মা ভেতরে ঢুকে ছেলেকে পাশে বসিয়ে, খাইয়ে দিতে দিতে বললেন…

– জানিস বাবা। আমাদের জীবনের গতি একজনের হাতে ধরা আছে, আমাদের ভাগ্য আগে থেকেই ওনার কাছে লিখিত আছে। যেদিন তুই রুহিকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলিস, সেইদিন আমি কোনো আপত্তি না করেই মেনে নিয়েছিলাম। কারন তোদের ভাগ্য জোড়া ছিল আমার মানা না মানাতে কিছুই হবে না। রুহির আসা এবং চলে যাওয়াটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, তবে তার জন্য তুই নিজের জীবনটাকে থামিয়ে রাখবি এটা কিন্তু ঠিক নয়। বাবা অনুভূতি বলে কয়ে আসে না, যদি তোর জীবনে আবার কখনো অনুভূতি আসে তাহলে পিছিয়ে না গিয়ে সেটাকে অনুভব কর। দ্বিতীয়বারের মতো জীবনকে সুযোগ দিয়ে দ্যাখ না কি হয়।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১৩

কথার মাঝেই আদৃতের খাওয়া হয়ে যায়। আদৃতের মা ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে চলে যান। মায়ের কথাগুলোকে আদৃত ভাবতে থাকে, মা কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো‌ না আদৃতের।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১৫