প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৩

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৩
তানজিলা খাতুন তানু

অতসী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,
– রাস্তাতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কোথায় যাবো কি করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রাত বেড়ে চলেছে, মানুষের আনাগোনাও কমে গেছে, দূরে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। ভয়েতে হাত পা কাঁপছে,তবুও হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছি, তবে কোথায় যাচ্ছি সেইদিকে আমার খেয়াল নেয় আর না কোনো রাস্তা জানি। দীর্ঘ ৫বছর এই এলাকায় না থাকার কারণে কোনো কিছুই আমার ঠিক মতো চেনা ছিল না।

দূরে দেখলাম একটা আলো জ্বলছে, ভয়ও লাগছে আবার সাহসও পাচ্ছি কিছুটা,যদি কোনো মানুষ আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তো।
কিছু হেঁটে এগিয়ে আসার পর বুঝলাম আলোটা একটা শ্মশানের। আর কিছু লোক শ্মশানের পাশে বসে মদ খাচ্ছে। ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠল, যথারীতি ওইখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি করে পা চালিয়ে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ডাক পড়ল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আরে মামনি একা একা এত রাতে কোথায় যাচ্ছো।
বুঝলাম শয়তানগুলোর নজরে পড়েছি, তাই পেছন ফিরে না তাকিয়েই জোরে হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমার পেছনে ওরাও আসছে। অপেক্ষা না করে নিজের হাতের ব্যাগটাকে শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়াতে শুরু করালাম। কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছি সেইদিকে আমার খেয়াল নেয়, আমার শুধু একটাই চিন্তা জী/বন থাকতে কখনোই ওই নরপশুদের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেব না। যেভাবেই হোক ওদের হাত থেকে আমাকে পালাতেই হবে।

দৌড়াতে দৌড়াতে বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে পৌছালাম। যাত্রীদের বসার সিটে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম তখনি একটা বাস আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কি করব, না করবে অনেক ভেবেই বাসে উঠে পড়লাম। বাসটা মোটামুটি ভর্তিই ছিল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। অন্ধকারে আমার পাশে কে আছে সেটা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। তবে যতটুকু আন্দাজ এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন।
বাস জার্নি করার অভ্যাস না থাকাতে কিছুক্ষণ পর থেকেই শরীর খারাপ হয়ে আসতে লাগল। আমাকে উশখুশ করতে দেখে ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন,

– মা তোমার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে।
কথা বলার মতো শক্তি ছিল না। তবুও অনেক কষ্টে মাথা নাড়ালাম। লোকটি সেটা দেখতে পেল নাকি জানি না, তবে তিনি বলেন উঠলেন
– তুমি এইদিকে এসে বসো। ভালো লাগবে।
ওনার কথাতে আমি জায়গা অদলবদল করে বসলাম।‌ জানালার পাশে বসার পর সত্যি ভালো লাগছিল কিছুটা। জানলার পাশে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেইদিকে আমার খেয়াল ছিল না। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম গোটা বাস ফাঁকা, শুধুমাত্র একটা ভদ্রলোক বসে আছেন। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে তিনি বললেন,

– তোমার ঘুম ভেঙে গেছে মা।
চেনা কন্ঠস্বর শুনে আমি লোকটার দিকে দৃষ্টি দিলাম। লোকটিকে চেনা চেনা লাগলেও বুঝে উঠতে পারলাম না।‌আমাকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটি বললেন,
– আসলে সবাই চলে নেমে গেছে, তুমি কোথায় যাবে মা।
– কোথায় যাবো আমি!
আমি নিজের মনে মনেই প্রশ্নটা করলাম। আমি তো জানি না আমি কোথায় যাবো।

– এটা কোথায় কাকাবাবু।
– এটা কলকাতা শহর।
– কলকাতা?
– হুমম। তুমি কোথায় যাবে।
– আমি জানি না।
– জানি না মানে? এত রাতে একা বাসে উঠলে, শরীরটাও ভালো না। এখন বলছো কোথায় যাবে জানো না।
– হুমম।
– যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলব।
– কি কথা।
– আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে।
– আপনার বাড়ি?

– তুমি আমার মেয়ের বয়সীই আমি এই শহরে তোমাকে একাকে রেখে যেতে পারব না। দয়া করো চলো আমার সাথে।
নিজের মনটাকে শক্ত করে লোকটির সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলাম আমি। আমি জানি না কি হবে,তবে লোকটিকে ভরসা করাই যায়। আমার সম্মতি পেয়ে লোকটিকে খুশি মনে আমাকে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
বাড়িটা বেশ বড়ো আর সুন্দর ছিল। আমাকে নিয়ে লোকটি তার ঘরে আসতেই তার স্ত্রী বলল,
– এটা কাকে নিয়ে এসেছ তুমি।
লোকটি কাচুমাচু হয়ে উত্তর দিলো,

– নতুন ভাড়াটিয়া।
বুঝলাম বাড়ির কর্ত্রী তার স্ত্রী। এই বাড়িতে তার কথা ছাড়া আর কারোর কথা চলে না, লোকটি ভীত হয়েই আমাকে তার ভাড়াটিয়া বলেই পরিচয় দিয়েছে। লোকটি আমাকে একটা ঘরে থাকতে দিয়ে বলল,
– আজকে থেকে তুমি এইখানেই থাকবে। আর ভাড়ার বিষয়টা সিরিয়াস নিয়ো না। তোমার কাকিমা একটু বদমেজাজি স্বভাবের কিছু মনে করো না।
সেইদিন মুচকি হাসি দিয়ে থাকতে শুরু করেছিলাম। তবে মনে ঠিক করেছিলাম থাকলে বাড়িতে ভাড়া দিয়েই থাকব।
কাকাবাবু আমাকে অনেক ভাবেই সাহায্য করতে লাগলেন। তবে সবটাই তার স্ত্রীয়ের চোখের আড়ালে।

– কাকাবাবু আমার একটা সাহায্য করবেন।
– কি সাহায্য মা।
– একটা টিউশনি খুঁজে দেবেন।
– আচ্ছা দেখছি।
কাকাবাবুর সাহায্য নিয়ে টিউশনি জোগাড় করে নিজের খরচ চালাতে শুরু করলাম। আর সবকিছুর মধ্যে কখন যে মেডিকেলে ভর্তির ডেট চলে গেল সেটা বুঝতেই পারলাম না। ভেবেছিলাম পড়াশোনা করব না চাকরি করব। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাসে কে চাকরি দেবে আমাকে। চাকরিও পেলাম না। টিউশনি পড়িয়ে নিজের জীবন চালাতে লাগলাম। আমার ডিগ্রির প্রচন্ড প্রয়োজন ছিল, বেড়িয়ে আসার আগে বাবাকে বলেছিলাম নিজের পরিচয়ে কিছু করে দেখাব। পড়াশোনা ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারব না। তাই ডিগ্রি নেবার জন্য অর্নাসে ভর্তি হলাম আর চলতে শুরু করল জীবনটা নিজের গতিতে।

ডাক্তার হবার স্বপ্নটা নিমিষেই হারিয়ে গেল। যেদিন জানতে পারলাম আমার আর ডাক্তারি পড়া হবে না তখন প্রচন্ড কেঁদেছিলাম।‌সেই কষ্টটা আজও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। তবে আমি কাকাবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ, তার কারনেই আমি আজকে এখনো পর্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক আছে। সেইদিন আমাকে আশ্রয় না দিলে আমার কি হতো কে জানে।
কথাগুলো বলতে বলতে অতসীর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
– জানেন অর্থ ছাড়া কেউ কারোর আপন হয় না। কিছু অর্থের জন্য আমার ডাক্তারি পড়া হয়ে উঠল না। আমার ডাক্তার হওয়া হলো না।
– খুব কষ্ট হয় তাই না।
– হুমম।

– কিন্তু অতসী পুরানো কথাগুলো ভেবে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না। পুরানো কথাগুলো তোমাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেবে না তাই এইগুলো বাদ দাও, বর্তমান নিয়ে ভাবো।
– হুম সেটাকেই ভাবতে চাই।
– হুমম।
কিছুক্ষন নিশ্চুপ। তারপরে অতসী বলে উঠল,
– আমার একটা প্রস্তাব আছে।
– কি প্রস্তাব।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩২

– আমি আরুর দায়িত্ব নিতে চাই।
– হ্যাঁ নাও আমাদের কোনো অসুবিধা নেয়।
– ওইভাবে নয়।
– তাহলে।
– আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
– কি?

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৪