প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৫

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৫
তানজিলা খাতুন তানু

মিহানের মা কথাটিকে কোনোরকমে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন,
– অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
মিহানের বাবা কথা না বাড়িয়ে ঘুমাতে চলে গেলেন। উনি ভালো করেই জানেন,তার স্ত্রী তাকে কিছুই বলবে না তাই জোর করে লাভ নেই। স্বামী ঘুমাতে চলে যেতেই উনি নিজের ভাবনাতে বিভোর হয়ে গেলেন,

মিহান ওনার নিজের সন্তান নয়। মিহানের মা মা/রা যাবার পর, ওনার সাথে মিহানের বাবার বিয়ে হয়। সকলের সামনে উনি মিহানকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও পেছনে একদমই ভালোবাসতেন না। মিহানের মায়ের অর্থাৎ সৎ মায়ের আগের পক্ষের একটা ছেলে ছিল তবে মিহানের বাবার সাথে বিয়ের সময়ে উনি ওনার সন্তানকে নিয়ে আসতে পারেননি। নিজের ছেলের থেকে দূরে থাকার সমস্ত ক্ষো’ভটা মিহানের উপরে গিয়ে পড়ে। মিহান বড়ো হবার সাথে সাথে উনি মিহান কে বদ অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে ফেলতে ছিলেন। সবকিছু নিজের গতিতেই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই মিহানের লাইফে অতসী আসে আর মিহান নিজেকে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
মিহানের এই কাজে ওর সৎ মা প্রচন্ড রেগে যায়। একদিন মিহান কে নিজের কাছে ডেকে পাঠান।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– মা আমাকে ডাকছিলে?
– হ্যাঁ। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– কি বলো।
মিহান ছোট বেলা থেকেই ওর সৎ মাকেই নিজের মা হিসাবে জানত। আর মাকে খুব ভালোবাসে,কখনোই মায়ের কথার অবাধ্য হয়নি।
– তুই কি কারোর সাথে রিলেশন করছিস?
মায়ের প্রশ্নে মিহান কিছুটা খুশি হয়।‌ওহ তো এটাই চাইছিল, কিন্তু মাকে বলে উঠার সাহস পাচ্ছিল না।

– হ্যাঁ মা।
– কাকে নিশ্চয় জিনিয়াকে তাই না।
জিনিয়ার নামটা শুনে মিহান চমকে উঠল।
– জিনিয়া মানে?
– কেন। তোর সাথে তো জিনিয়ার বিয়ের কথা অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, তুই জানতিস না।
মিহান একের পর এক চমক পাচ্ছে।

– মা আমি জিনিকে নয় জিনির বন্ধু অতসী কে ভালোবাসি।
– কিন্তু বাবা। তোর আর জিনিয়ার বিয়ে তো‌ ঠিক করা আছে। আর তোদের বিয়েটা না হলে তোর মামা প্রচন্ড রেগে যাবে আর তোর বাপির কোম্পানিতে অনেক বড়ো লস করে দেবে। তুই প্লিজ অতসীকে ভুলে যা।
– কিন্তু মা আমি অতসীকে খুব ভালোবাসি। আমি কিভাবে ওকে ভুলব।
– আমি তো তোর মা। আমি তো কখনোই তোর থেকে কিছু চাইনি আজকে এটা চাইছি এটাও দিবি না।

মিহানকে নানারকমের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে অতসীর থেকে মিহানের মনটা ঘুরিয়ে দিতে শুরু করলেন। আবার অন্যদিকে, জিনিয়ার কাছে অতসী আর মিহানের সম্পর্কের কথাটা বলে জিনিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলল।
সবকিছুই ওনার প্ল্যান মতোই চলছিল, কিছু হঠাৎ করেই মিহান আবারো অতসীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়তে লাগল। তখনি মিহানের সৎ মা নিজের আসল রূপ দেখালেন…
মিহানকে আবারো ডেকে পাঠালেন উনি।

– মিহান তুমি আবারো অতসীর সাথে যোগাযোগ করছ, এইসব কি শুরু করেছ তুমি।
– মা আমি অতসী কে খুব ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।
– আমি কিন্তু আমার কথার খেলাপ করা পছন্দ করিনা।
– মানে?
– তুম যদি আবারো অতসীর সাথে সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করো তাহলে আমি কিন্তু অতসীর ক্ষ/তি করব।
– কি বলছো এইসব মা।
– হ্যাঁ ঠিক বলছি। ভালোই ভালোই বলছি নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে মিহান।
– মা তুমি এইসব কথা বলছ কেন?

– বেশি কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। আমার অবাধ্য হবার চেষ্টা করো না, তুমি অবাধ্য হবে তার জন্য আমি এতদিন তোমাকে মানুষ করিনি।
– মা আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না।
– তুমি আমার নিজের সন্তান নয়।
– কি?
– হ্যাঁ। তোমার মা মা/রা যাবার পর তোমার বাবা তোমাকে দেখাশোনার জন্য আমাকে নিয়ে আসে। আমি তোমাকে মানুষ করার জন্য আমি আমার নিজের সন্তানকে বির্সজন দিয়েছি। আর আজকে তুমি আমার কথার অবাধ্য হচ্ছো। তুমি না যদি আমার কথা শোনো তাহলে আমি এই সংসার থেকে থেকে চলে যাবো।

মিহান আর সহ্য করতে পারছে না। আর মাকে বড্ড ভালোবাসে, সে চলে যাবে এটা মেনে নিতে পারবে না। মিহান কোনো উপায় না পেয়ে জিনিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
মিহানের মা এইসব টাই করেছে জিনিয়ার বাবার সম্পত্তির জন্য। জিনিয়া ওর মা বাবার একমাত্র সন্তান, ওর বাবার পরে সবকিছুর মালিক জিনিয়া হবে। আর জিনিয়ার মাঝে মিহানের মা সবকিছুর রাজ করবে।
পরেরদিন,
অতসী কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার সময়ে দেখল রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। অতসী দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে গেলে রুদ্র বলল,

– বোন।
– এইখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না আমি।
– প্লিজ আমার সাথে চল। তোকে বাড়ি ফিরতে হবে না, তুই আমার সাথে চল আমি তোকে কিছু কথা বলতে চাই।
অতসীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে, রুদ্র আবারো বলল,
– প্লিজ বোন চল।
রুদ্রের আকুতি ভরা কন্ঠ অতসী ফেরাতে পারল না। বাবার উপরে যতই রাগ, অভিমান, অভিযোগ থাকুক না কেন দাদাভাইকে তো প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে। রাগ দেখিয়ে, অভিমান করে এতদিন চোখের আড়ালে থেকেছে তবে আড়াল থেকেও রুদ্রের খবর রেখেছে প্রতিনিয়ত।

– আচ্ছা চলো।
রুদ্র খুশি হয়ে অতসী কে নিজের বাইকে চাপিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। আগে ছোটবেলাতে রুদ্রের বাইক চড়ে সারা এলাকা ঘুরে বেড়াত অতসী, আজ কতদিন পর আবারো রুদ্রের বাইকে উঠছে ভাবতেই দুচোখে ভর্তি পানি এসে গেল অতসীর।
আয়নায় অতসীর চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে দেখে মৃদু হাসল রুদ্র। ছোট থেকে বড্ড আদরে মানুষ করেছে অতসীকে অথচ সেই আদরের দুলালীই গত ৫বছর ধরে কতটাই না সেক্রিফাইস করে যাচ্ছে।
রুদ্র অতসী কে নিয়ে একটা কফি শপেতে আসলো। কফি শপটা ওদেরই তাই ওরা আসতেই ম্যানেজার একটা ফাঁকা প্লেস ওদের জন্য দিয়ে দিলো। এখনকার আপ্যায়ন দেখে অতসীর বুঝতে অসুবিধা হলো না, কফি শপটা কার। তবুও রুদ্রকে জিজ্ঞেস করল,

– এটা কার।
রুদ্র কিছু বলল না। অতসী আবারো জিজ্ঞেস করল,
– নতুন হয়েছে।
– হুম।
একজন ওয়েটার কফি দিয়ে যেতেই অতসী নিজের নিরবতা ভেঙে বলল,
– কি জন্য আনলে বলো।
– হয়তো কথাগুলো বললে তুই ভাববি আমি মিথ্যা বলছি, অথবা বানিয়ে বলছি। কিন্তু কথাগুলো একদম সত্যি।
অতসী রুদ্রের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রুদ্র কি বলতে চাইছে সেটা বুঝতে পারছে না।
– কি কথা।
– সেই রাতে তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর। আমরা রাতে কোনো কিছুই জানতে পারিনি। কিন্তু পরেরদিন সকালে মা তোকে খুঁজতে গিয়ে যখন পাই না, আর তার বদলে একটা চিঠি থাকতে দেখে। তখন মা কান্নাকাটি করতে শুরু করে।
ফ্ল্যাশব্যাক…

– কি হয়েছে তুমি এইভাবে কান্নাকাটি করছ কেন?
– তোমার জেদের কারনে আমি আমার ছোট মেয়েটাকেও হারিয়ে ফেললাম। আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করব না।
স্ত্রীয়ের কান্না দেখে আকরাম খাঁন কিছুই বুঝতে পারেন না। উপরিউক্ত প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হয়ে পড়েন।
– কি হয়েছে সেটা কি বলবে তুমি। নাকি আমি বেড়িয়ে যাবো।
কাঁদতে কাঁদতেই অতসীর মা স্বামীর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন। আকরাম খাঁন প্রচন্ড পরিমানে বিরক্ত হয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন,

বাবা/মা,
প্রিয় বলেই সম্বোধন করলাম না। কারন আপনাদের নিজ স্বার্থ আমার প্রিয়স্থান থেকে আপনাদের সরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। বাবা আপনি যখন আমাদের ফিরিয়ে আনতে গেলেন, আমি সত্যি ভেবেছিলাম সবকিছু হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ভাবনাটাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত করে দিয়ে আপনি শুধুমাত্র আমাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি যে কারোর প্রয়োজনে প্রিয়জন হতে চাই না, প্রিয়জনে প্রয়োজন হতে চাই। তাই আপনার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলাম। আমি একাই একার খরচ চালিয়ে নিতে পারব আশা করি। ভালো থাকবেন আর মাকে দেখে রাখবেন।

ইতি,
অতসী।
পুরানো কথাগুলো মনে করে রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতসী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।
– সেই ঘটনার পর মা বাবাকে দোষ দিতে থাকে। নিজের জেদের কারনে দুই মেয়েই ঘরছাড়া হয়ে যাবার শোকটা উনি সহ্য করতে না পেরে হার্ট এ্যা/টাক করেন।
– কি?
– হ্যাঁ। গত ৬মাস হসপিটালে বেডে শুয়ে মৃ/ত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁ/চে ফিরে এসেছেন। শুধুমাত্র তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে। সুস্থ হবার পর তোকে তন্নতন্ন করে সব জায়গাতেই খুঁজে বেড়িয়েছে, কিন্তু যে মানুষ নিজে থেকে লুকিয়ে থাকে তাহলে কি তাকে খুঁজে পাওয়া যায়!

– আমার বাবা মনে হয় ওনার আর একটা মেয়ের কথা ভুলেই গেছেন।
– জানি না রে। রুহির কথা উঠলেই বাবা কিরকম একটা গম্ভীর হয়ে যান। তবে আমার কি মনে হয় জানিস যদি কখনো তোরা দুইবোন বাবার সামনে‌ গিয়ে দাঁড়াস তাহলে দেখবি বাবা কখনোই তোদের থেকে মুখ ফেরাতে পারবে না।
– কে জানে। আর যে মানুষটা বেঁ/চেই নেয় সে কিভাবে কারোর‌ সামনে গিয়ে দাঁড়াবে!
কথাটা বলেই তাচ্ছিল্যের হাসল অতসী। রুদ্র কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
– মানে?

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৪

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে সকলে বলবেন। গল্পটা ধীরে ধীরে শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের সকলের গঠনমূলক মন্তব্য চাই😌

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৬