প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৮

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৮
তানজিলা খাতুন তানু

অতীত…
আদৃত সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কিছু নম্বরের জন্য গর্ভমেন্ট কলেজে চান্স পেল না। বাধ্য হয়েই আদৃতের বাবা ওকে একটা প্রাইভেট কলেজে ভর্তি করালেন। প্রাইভেট কলেজ মানেই অনেক খরচ, আদৃতের বাবা একজন প্রাইভেট কোম্পানির সামান্য কর্মচারী। চাকরি থেকে যা টাকা আসে, তাতে পরিবার ভালো ভাবেই চলে যায় কিন্তু আদৃতের কলেজের খরচা চালাতে পরিবারকে একটু হলেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবুও আদৃতকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওর পরিবার ওর পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন।

তিনটে বছর,
পরিবারের উপর দিয়ে অনেক কষ্ট বয়ে যেতে থাকে। তবে সবকিছুই আদৃতের আড়ালে। আদৃতের বাবা মা ওকে এইসব বিষয়ে কিছুই জানায় নি। একমাত্র ছেলের স্বপ্ন পূরণ করতে, নিজেরা সবকিছুই সহ্য করতে থাকে। সবকিছু নিজের গতিতেই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই আদৃতের বাবা ব্রেন স্ট্রো*ক করে মা*রা যান। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাবাকে হারিয়ে আদৃত নিজের জীবনের গতি হারিয়ে ফেলে। মাকে ডেকে বলে…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– মা আমি আর পড়াশোনা করতে চাই না। একটা কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই।
আদৃতের মা ছেলের এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। যে ছেলের পড়াশোনার জন্য এতদিন এত কষ্ট করলেন, আর এখন আদৃত পড়াশোনা ছেড়ে দেবে এটা কিছুতেই হতে পারে না।
– না বাবা এটা করিস না। তোর বাপির ইচ্ছা ছিল,তুই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বি। তার শেষ ইচ্ছাটা এইভাবে নষ্ট করিস না।
– কিন্তু মা। আমার পড়াশোনার অনেক খরচ, সংসার খরচ কিভাবে কি চলবে।
– আমি একটু কষ্ট করে ঠিক চালিয়ে নেব,তুই চিন্তা করিস না।
– কিন্তু কিভাবে মা?

– আমি হাতের সেলাইয়ের কাজ জানি, পড়াশোনাও জানি,যা হোক একটা না হয় করে নেব।
মায়ের জেদের কাছে হার মেনে পুনরায় পড়াশোনা করতে রাজি হয়ে যায় আদৃত। আদৃতের মা একটা কে.জি স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে জয়েন করেন। পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ, আবার টিউশনি পড়াতে শুরু করেন। কে.জি স্কুলের টিচারদের মাইনে খুব কম,তাতে আদৃতের পরিবারের চলবে না,তাই বাধ্য হয়েই ওর মাকে টিউশনি পড়াতে হতো।
অন্যদিকে…

আদৃত পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি পড়াতে শুরু করে। পড়াশোনা, টিউশনি সব মিলিয়ে দূর্বিষহ জীবনে একজন মন ভালো করার মানুষ আসে। আদৃত না চাইতেও তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
– কি হয়েছে আদৃত এইভাবে মন খারাপ করে আছো কেন?
– রুহি তুমি তো সবটাই জানো। বাবা চলে যাবার পর, আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে ঠিক কি কি যাচ্ছে। তুমি আমার সাথে থাকলে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না।
– এইভাবে বলো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– কিন্তু তোমার পরিবার আমার মতো একটা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে কিছুতেই দেবে না।
– আমি মানিয়ে নেব। এত চিন্তা করো না।
– হুম।

আদৃতকে চিন্তা করতে বারন করলেও রুহি নিজেই মনে মনে সবকিছু নিয়ে চিন্তিত ছিল। রুহি বাবা আদৃতদের কলেজের ৩০% শেয়ার হোল্ডার। পাশাপাশি আরো অনেক কলেজেই শেয়ার আছে। আদরের দুলালী, উল্টো দিকে আদৃত বেকার, আর না আছে বাবার সেরকম কিছু। রুহির পরিবার আদৌও এই সম্পর্ক মেনে নেবে কিনা,তাই নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ওহ।
দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো একটা বছর। আদৃতের পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলেও চাকরি পাইনি এখনো। অন্যদিকে, রুহির পরিবার ওকে বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করছে লাগল। পরিবারের জেদের কাছে হেরে গিয়ে শেষমেশ আদৃতের কথা বলে দেয়।

– আমি একজনকে ভালোবাসি।
রুহির কথাটা ওর পরিবারের সকলের কাছে বজ্রাঘাতের মতো লাগল।
– কি বলছিস তুই মা। তুই কাকে ভালোবাসিস। (রুহির মা)
– আমি আদৃত বলে একজনকে খুব ভালোবাসি মা। ওকে ছাড়া আমি বাঁ*চব না।
– ছেলে কি করে? (গম্ভীর কন্ঠে বলল)
– ইঞ্জিনিয়ার।
– কোথায় চাকরি করে? কত টাকা ইনকাম। (রুহির দাদা জিজ্ঞেস করলো)
– এখনো কোথাও চাকরি করে না।
– তারমানে তুমি একজন বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছ? (রুহির বাবা)
– বাবা,একটু অপেক্ষা করো। ও খুব তাড়াতাড়িই চাকরি পেয়ে যাবে।
– আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। রুদ্র তুমি মত তাড়াতাড়ি একটা ছেলে দ্যাখো,, এই সপ্তাহের ভেতরেই রুহির বিয়ে হবে।

– বাবা! (রুহি)
– রুদ্রর মা রুহি না বাড়ির বাইরে যায়। সেইদিকে খেয়াল রেখো।
রুহির মা মাথা নাড়লেন। রুহির বাবা আর দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রুহি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
– মা প্লিজ আমার সাথে এইরকম করো না। আমি আদৃতকে ছাড়া বাঁ*চব না।
– মারে আমার কিছু করার নেই। যা হচ্ছে মেনে নে।

কান্নায় ভেংগে পড়ল রুহি। ওর ফোন নিয়ে নিয়েছে, বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রুহি কিছুতেই আদৃতের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। আদৃতের অবস্থা খুবই খারাপ। রুহির সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না, ফ্যামিলি প্রবলেম আর তার উপরে রুহির হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যাওয়া আদৃতকে বড্ড চিন্তিত হয়ে উঠেছে।
রুহির জন্য পাত্র ঠিক হয়ে যায়। এবং খুব তাড়াতাড়ি রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করার সিদ্ধান্ত নেয় ওর পরিবার। রুহি কিছুতেই রাজি হয় না, কান্নাকাটি করতে থাকে।

– মা প্লিজ।‌ আমার সাথে এইটা করো না। প্লিজ মা।
রুহি ওর মায়ের পা ধরে কাঁদতে থাকে।‌ রুহির মা নিজের মেয়ের কান্না দেখে সহ্য করতে পারে না।
– মা, প্লিজ‌ এইরকম করো না। আমি অন্য কারোর‌ সাথে সুখে থাকব না।
– রুহি মা এইরকম করিস না। মেনে নে।
– প্লিজ মা প্লিজ।

হাত জোড় করে কেঁদে উঠল রুহি। কাঁদতে কাঁদতে সব সাজগোজ নষ্ট হয়ে গেছে। রুহির মা কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। মেয়ের কষ্টটা দেখতে পারল না,শেষে বলে উঠল..
– তুই পালিয়ে যা আদৃতের সাথে।
– মা সত্যি বলছো।
– হুমম। অনেক দূরে চলে যা তুই।
রুহির মা ওর হাতে ওর ফোনটা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলো। রুহি মাকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির বাইরে চলে গেল। বাইরে বেড়িয়ে এসে বলল…

– আদৃত।
– এতদিন কোথায় ছিলে? কি হলো তুমি ঠিক আছো তো।
– হুমম। তুমি তাড়াতাড়ি কাজি অফিসের সামনে আসো।
– কিন্তু কেন?
– এত প্রশ্ন করার কিছু নেয়। তাড়াতাড়ি আসো, নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
– আচ্ছা।
আদৃত রুহির কথা শুনে, বাড়িতে কাউকে কিছু না‌ বলে। বাড়ির বারিয়ে বেড়িয়ে সোজা কাজি অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

এইদিকে…
রুহির বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার কথা কথাটা গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে গেল। রুহির বাবা প্রচন্ড রকমের রেগে বলে উঠলেন…
– তোমার এতো বড়ো সাহস তুমি। আমার কথা অমান্য করে এই বাড়ি থেকে রুহিকে পালাতে সাহায্য করেছ।
– আমার মেয়ে আদৃতকে ভালোবাসে। আমি কিছুতেই ওদের আলাদা করতে দেব না।
– কাজটা ভালো করলে না। তোমাকে এর ফল ভোগ করতেই হবে।
– আমি আমার মেয়েদের জন্য সবকিছু সহ্য করতে রাজি আছি।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৭

রুহির বাবা রেগে বেড়িয়ে গেলেন। রুহির মা প্রার্থনা করে বললেন…
– দোয়া করি মা। তোরা খুব সুখে থাকিস। তোর বাবার জেদের কবলে পড়ে তোর জীবনটা না নষ্ট হয়ে যায়।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৯