প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১১

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১১
তানিশা সুলতানা

অতিরিক্ত রক্তপাতে ভয়াবহ অবস্থা মিতুর। অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে সে। ঘটনাটা সকাল হতে কেউ জানে না। মনির সাত সকালে বেরিয়েছে। কেউ খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি মিতুর। অবশ্য নেওয়ার কথাও না। মনিরের অন্য স্ত্রী রিমা সে বাবার বাড়ি চলে গেছে। স্বামীকে অন্য কারো পাশে সে মানতে পারছিলো না।

অভির ধমকে পূর্ণতা ভুলবশত নিজের কামড়ায় না ঢুকে, মিতুর কামড়ায় ঢুকে পড়ে ছিলো । আর তখনই তার নজর পড়ে সাদা বিছানায় রক্তের চিহ্ন। সেই সাথে এলোমেলো পড়ে থাকা মিতুকে। বুক কেঁপে ওঠে পূর্ণতার। দৌড়ে এগিয়ে যায় মিতুর কাছে। শুকনো মুখখানা দেখে নেয় ভালো করে। কাপড় ঠিক করে দেয় মিতুর। অতঃপর সকলকে ডাকতে কামড়া হতে বেরিয়ে যায়।
মনে মনে ঘৃণা জন্মায় মনিরের প্রতি। কাপুরুষ বলে গালিও দেয় কয়েকবার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অভি সবেই নিজ কামড়ায় ঢুকেছে। এবার একটু জিরবে সে। খানিকক্ষণ পরে আবারও বের হতে হবে তার। পাশের এলাকার প্রভাবশালী ইফতিয়ারের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে হবে।
ভোটে বিজয়ী অভিই হবে। তবুও একবার ইফতির মুখোমুখি হতে চায় সে। মনে মনে ইফতি গভীর কোনো ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। যা চতুর অভি বেশ বুঝতে পারছে।

ধবধবে সাদা পালঙ্কে সবেই একটুখানি বসেছে অভি। তখনই দৌড়ে কামড়ায় ঢুকে পূর্ণতা। চোখে মুখে তার আতঙ্ক।
অভি বিচলিত হয়। তবু আদুরে ভঙ্গিমায় দুই হাতে আগলে নেয় না মেয়েটিকে। মুখের গম্ভীরতাও কমায় না।
পূর্ণতা হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে মাথা নিচু করে বলে,
“ছোট চাচা কাল যাকে বিয়ে করে এনেছে। সে অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে বিছানায়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। তার চিকিৎসার প্রয়োজন।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অভি। জবাব দেয় না। তারাহুরো করে উঠেও যায় না। পূর্ণতা আহত নয়নে তাকিয়ে থাকে অভির মুখ পানে।

” বাঁচাবেন না তাকে?
চোখের কোণে আবারও পানি জমেছে পূর্ণতার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছোট বোনের নিথর দেহ খানা। রক্তাক্ত পা জোড়া।
পুরুষ মানুষ শুধুমাত্র নারীর দেহের পাগল?
দেহ ছাড়া তারা কিছুই বোঝে না?
নারীরা শুধুমাত্র ভোগের বস্তু?

বিরবির করে বলে পূর্ণতা। অভি শুনতে পায়। তাকায় গোলগাল মায়াবী মুখপানে। ডান হাত এগিয়ে গালে হাত রাখে। বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মুছে দেয় চোখের পানি। জলভরা গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভি বলে।
“নারীরা মায়ের জাত। তারা সম্মানের বস্তু। সমাজে নারী ছাড়া পুরুষ অচল।
অভির গলা জড়িয়ে ধরে পূর্ণতা। ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে।

” তাহলে এতো অসম্মান কেনো করা হয় নারীকে? আপনি প্রতিবাদ কেনো করেন না?
এই প্রশ্নের জবাব অভির কাছে নেই। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পূর্ণতাকে। পূর্ণতার ছোট্ট বুকে মাথা রাখে। বুকের হাহাকার শুনতে পায় অভি।
“আমি এসব সহ্য করতে পারছি না। আমি সুন্দর সমাজ চাই। সুস্থ ভাবে বাঁচতে চাই। আপনার সাথে সুখে সংসার করতে চাই।

অভি চোখ বন্ধ করে ফেলে। বিরবির করে বলে
” এ জীবনে তো সম্ভব নয় পূর্ণ। পরের জনমে আমরা জন্ম নিবো একে অপরের পরিপূরক হয়ে। সুন্দর একটা পরিবার হবে আমাদের। এই জীবনটা নাহয় আফসোস নিয়েই কাটালাম। পরের জীবন সুখ নিয়ে কাটাবো।
মুখে বলে
“ইনশাআল্লাহ
একদিন সুখী হবো আমরা।
নিরবতায় কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ। অতঃপর অভি বলে

” একটু পরে আমাকে বেরুতে হবে। আপাতত শান্তিতে ঘুমাতে চাচ্ছি।
পূর্ণতা ছেড়ে দেয় অভিকে।
“ঘুমান তাহলে আমি যাই মেয়েটার কাছে।
অভি কোমর ছাড়ে না।
সময় নিয়ে চুমু খায় পূর্ণতার গালে।
” মেয়েটার কাছে ইফতি ইমন ওরা আছে। চিন্তা করো না।
ভ্রু কুচকে ফেলে পূর্ণতা।
“আপনি জানলেন কি করে?

গম্ভীর মুখখানায় হাসির ঝলকের দেখা মেলে। লোকটা হাসলে কি ভালো দেখায় তাকে। পূর্ণতা মনে মনে কয়েকবার শুকরিয়া আদায় করে নেয়।
অভি পূর্ণতাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। পূর্ণতার ছোট্ট বুকে মাথা রাখে। দাঁড়ি ঘসে দেয় বুকে। শিওরে ওঠে পূর্ণতা। দুই হাতে মুঠো করে ধরে অভির শার্ট। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে৷
“এতো কাঁপা-কাঁপি করবে না জান৷

গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার আশা জাগে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হয়।
অসহায় শোনালো বোধহয় অভির কন্ঠস্বর। পূর্ণতা শুকনো ঢোক গিলে বলে
“ছুঁয়ে দিচ্ছেন না কেনো?
অভি চোখ বন্ধ করে।
“বড় হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি তোমায়। তুমি তো আমারই। এতো তাড়াহুড়ো নেই আমার।
মুগ্ধ হয় পূর্ণতা। এই মানুষটার শরীরে কি জমিদার বাড়ির রক্ত বইছে না?

পূর্ণতার পেছনেই ছিলো ইফতি। সে শুনে নিয়েছিলো পূর্ণতার কথা। তখনি বেরিয়ে পড়েছিলো ডাক্তারের খোঁজে। পূর্ণতার চোখের পানি সহ্য হয় না ইফতির। মনে চায় নিজের জীবন দিয়ে পূর্ণতাকে আগলে রাখতে। সুখের রাজ্যে নিয়ে যেতে। কিন্তু অনুমতি কিংবা অধিকার কোনোটাই নেই তার। থাকলে কাউকে পরোয়া করতো না সে।
বাজারে একটা ডাক্তারের চেম্বার আছে। সেখান থেকেই ডাক্তারকে নিয়ে এসেছে ইফতি। সাথে নিয়ে গিয়েছিলো ইমনকে। ইমন হাজারবার জিজ্ঞেস করেছে ডাক্তার কার জন্য? ইফতি জবাব দেয়নি। বাজার থেকে যখন ইমন ইফতি আসছিলো তখন ইমন বলে ওঠে

“মেঝো ভাই।
পূর্ণ ভাবির জন্য কিছু মজার খাবার নিয়ে যাই?
ইফতি মুচকি হাসে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ইমন খুশিতে গদগদ হয়ে অনেক কিছু কিনে নেয়। পূর্ণতাকে তার ভালো লাগে। একটু বেশিই ভালো লাগে। দাদিকে তার পছন্দ না। বাবা চাচাদের ব্যবহারও পছন্দ না। সারাজীবন দেখে আসছে মায়ের নিচু মাথা। এখন ইমন নিশ্চিন্ত। পূর্ণতা সকলের স্বভাব বদলে দিবে। পাপের রাজ্যে সুখ এনে দিবে।

ডাক্তার মিতুকে দেখছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইফতি, ইমন এবং ইশান। ইশানের চোখের কোণে পানি জমেছে। বাবাকে খু ন করতে ইচ্ছে করছে। ভেতর থেকে ‘ছিহহ’ শব্দটা বেরিয়ে আসল।
মিষ্টি মিতুর পাশে বসে আছে। তারও চোখের কোণে পানি।
পূর্ণতাই শুধু এখানে নেই। ইফতি বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। পূর্ণতা আসবে কি? দেখবে কি ইফতি বাঁচাচ্ছে মিতুকে? বুঝবে কি জমিদার বাড়ির বাকি পুরুষদের মতো ইফতি নয়?
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, যখন দেখলো পূর্ণতা আসছে না। তখন ইফতি মিতুর কক্ষ হতে বের হয়ে আসে। এগিয়ে যায় পূর্ণতার কামড়ার দিকে।

জানালায় উঁকি দেয়। দেখতে পায় অভির বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে পূর্ণতা। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে ওঠে ইফতির। সরে যায় জানালা হতে। মনে মনে কিছু কথা সাজায়। একখানা চিঠি লিখবে সে পূর্ণতাকে। আবেগ মিশ্রিত চিঠি। সেই চিঠিখানা পড়ে পূর্ণতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বে। কয়েক মুহুর্তের জন্য ভাবতে থাকবে আগন্তুক ইফতিকে নিয়ে। তাতেই শান্ত হবে ইফতির খাঁখাঁ করা বিচলিত হৃদয়।

“প্রিয় পূর্ণতা,
ইচ্ছে ছিলো একদিন খুব প্রিয় হবো তোমার। বুকের বাঁ পাশে ঠাঁই হবে আমার। হৃদপিণ্ডে আমি নামক এক অসুখ বাসা বাঁধবে। নিয়ম করে আঁকড়ে ধরার আশা জাগবে।
ইতি,
তোমার অপ্রিয় একজন।

ইফতিয়ার চৌধুরীর মুখোমুখি বসে আছে অভিরাজ। অভি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ইফতিকে। ছেলেটা দারুণ সুদর্শন এবং মার্জিত। প্রথম নজরেই যে কোনো রমনীর হৃদয় কাড়তে সক্ষম হবে।
এর আগে এমন সুদর্শন ছেলে দেখেছে কি না মনে পড়ছে না অভির।
বয়সও বেশি নয়। এই ২৪-২৫ হবে।

পোশাক আশাক এবং চালচলনে প্রভাবশালীর চিহ্ন।
দুজনের মাঝখানে রয়েছে একখানা কাঠের টেবিল। তার ওপরে দুধ চা। অভি চায়ের কাপ তুলে তাতে চুমুক বসিয়েছে। চা তার বরাবরই পছন্দ।
ইফতি ধীরে সুস্থে নিজের চায়ের কাপ তুলে নেয়। ফুঁ দিয়ে সময় নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় তাতে।
অতঃপর বলে

” ভোটে বিজয়ী হবেন আপনি। এটা আপনিও জানেন আমিও জানি।
ঠোঁট বাঁকায় অভি। মেরুদণ্ড সোজা করে বসে।
ইফতি নিজেও হাসে। গোলাপি অধরের হাসিটা দারুণ। অভির ভালো লাগে।
“বিয়ে করেছেন শুনলাম।
পরির মতো বউ।

অভিকে মোটেও বিচলিত দেখালো না। সে দুই হাত টেবিলে রেখে ইফতির দিকে এক ঝুঁকে বলে
” অপহরণ, ধর্ষণ, ব্লা ব্লা ব্লা হুমকি বেশ পুরনো। যুগ পাল্টাচ্ছে। নতুন কিছু বলো।
ইফতি শব্দ করে হেসে ওঠে। বাঁ হাতে সিল্কি চুল গুলো পেছনে ঠেলে বলে
“আমি ভালোবাসি পূর্ণতাকে। দুই বছর আগে থেকে। ভালোবেসে জয় করে জমিদার বাড়ি হতে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসার হুমকি নয় চ্যালেঞ্জ করলাম।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১০

অভি কপাল চুলকায়
“দুনিয়ায় অহরহ মেয়ে থাকতে আমার ছোট্ট বউয়ের দিকে সকলের নজর কেনো ভাই?
কয় জনের চোখ তু লে নেবো আমি? আর এতো চোখ ফেলবো কোথায়?

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১২