প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১৩

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১৩
তানিশা সুলতানা

নারী সব ছেড়ে দিতে পারে, নারী সব সয্য করতে পারে কিন্তু নিজের স্বামীর পাশে অন্য কাউকে নারী কখনোই সয্য করতে পারে না।
গহনা নারীর দুর্বলতা, সন্তান নারীর নাড়ি ছেড়া ধন। একটা পর্যায়ে নারী গহনা সন্তান এসবও ছেড়ে দেয়। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গ ছাড়তে চায় না।
তেজী মহিলা মমতা। জমিদারের বউ। এক কালে জমিদার কন্যা ছিলেন তিনি। তার কথার বাইরে কখনোই কেউ যেতে পারে না। তার বাবা এবং স্বামীও কখনো তার কথা অমান্য করে নি৷
সন্তানদের গড়েছে নিজের মনের মতো করে। সেই মমতা আজকে স্তব্ধ। মুখে ভাষা নেই তার। চোখে দুটো চিকচিক করছে।

স্বামীর থেকে এমনটা সে কখনোই আশা করে নি।
মমতার মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হয় পূর্ণতার। মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
জমিদার সাহেবের চরিত্র খারাপ তবে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে নারাজ। আজকে ছল চাতুরী করে পূর্ণতাই বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। এই কাজে পূর্ণতাকে সহায়তা করেছে ইমন এবং ইশান। দুটো দেবরই দারুণ কাজের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাহেব এর কথা বলার মুখ নেই। তিনি মাথা নিচু করে আছেন। ঠোঁটের কোণে হাসি পলি বেগমরের (সদ্য যাকে বিয়ে করেছেন) তার বরাবরই লক্ষ্য ছিলো জমিদার বাড়ির বউ হওয়ার। মমতা বেগমকে তার মোটেও পছন্দ না। মাসের পর মাস পাপ কাজে লিপ্ত রেখেছেন পলিকে। কাজ করিয়ে টাকা দেয় নি অনেক সময়।
“আমার কামড়া কোন দিকে? ক্লান্ত আমি। একটু জিরবো।

পলি বলে ওঠে। মমতা বেগম পানি ভর্তি চোখে তাকায় পলির দিকে। তাতে দমে না পলি। জমিদারের হাত খানা শক্ত করে ধরে।
“চলুন
টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। জমিদার চোখের আড়াল হতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন মমতা। হাঁটু মুরে বসে পড়ে। তাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। ছেলের বউরা তাকে শ্রদ্ধা করেন ওপরে ওপরে।ভেতরে ভেতরে সকলেরই একটা চাপা রাগ রয়েছে শাশুড়ীর ওপর। শাশুড়ির ব্যাথায় তারা ব্যথিত নয়।
পূর্ণতা এগিয়ে যায়। হাঁটু মুরে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মমতা বেগমের।

“আপনার ছেলেরা যখন বিয়ে করে নতুন নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফেরে। তখন আপনার বউমারাও ঠিক এতোটা কষ্ট পায়। তাদের হৃদয়ও এভাবে জ্বলে।
মমতা বেগমের কান্না থেমে যায়। মাথা হতে পূর্ণতার হাত ঝাড়া মেরে ফেলে দেয়। অতঃপর হনহনিয়ে চলে যায়। পূর্ণতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সূদুরে দাঁড়ানো ইমন এবং ইশানকে বাহবা দেয় ইশারায়।

স্বইচ্ছায় কখনোই কোনো বাবা তার মেয়ে দিতে রাজি হয় না জমিদার পুত্রদের হাতে। দীর্ঘ দিন যাবত মমতা বেগমের নির্দেশনায় জমিদার পুত্ররা বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে বাবাদের কাছে যায়। কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এবং সেই সব মেয়েদের বিক্রি করে দেয় বিদেশীদের কাছে। মূলত এই ব্যবসায়ের জোরেই জমিদাররা প্রভাবশালী তাকমা লাভ করেছেন।

ইলেকশন গতকাল। বিপক্ষের দল গোটা এলাকায় মোটা অঙ্কের টাকা বিলিয়েছে। ভোট কিনেছে সকল সাধারণ গরীব জনগণের কাছ থেকে। খবরটা অভির অজানা নয় তবুও সে চুপ করে আছে। চুপ থাকার কারণও আছে অবশ্য। তবে সেই কারণটা আপাতত সে কাউকেই বুঝতে দিচ্ছে না।
শক্তপোক্ত অভিরাজ নাজুক প্রকৃতির। একটু চিন্তা করলে সে জ্বর বাঁধিয়ে বসে। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। রকিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে। জ্বরে গা পুরিয়ে যাচ্ছে।

শিউলি বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ছেলেটার একটু সেবা করতে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। দু মুঠো খাবার মুখে তুলে দিতে। কিন্তু অভিকে তিনি ভয় পায়। কোনো কারণ ছাড়াই। প্রয়োজন ব্যতিত কখনোই তার সাথে কোনো কথা বলে আজ ওবদি।

শিউলি বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দৌড়ে চলে যায় মিষ্টিকে ডাকতে। মিষ্টিই পারবে ছেলেটার মুখে খাবার দিতে।
শিউলি যেতেই অভি চোখ খুলে। লাল লাল চোখের দৃষ্টি মিলেছে মাথার ওপরে থাকা সাদা দেয়ালে।
শুকনো ওষ্ঠদ্বয় নেরে বিরবির করে বলে
“আমি যাদের ভালোবাসি তাদেরই হারিয়ে ফেলি। আপনাকে হারাতে চাই না মা। আপনাকে বাঁচতে হবে আমার মিষ্টি এবং পূর্ণতার জন্য।

মিষ্টি আর পূর্ণতা বই পড়ছিলো। সমবয়সী হওয়ার দারুণ দুজনের বই গুলো একই। একই ক্লাসে অধ্যায়নরত তারা। তাই সময় সুযোগ বুঝে দুজনই বই খাতা খুলে বলে। এই সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পড়ালেখা। সেটাই করতে পূর্ণ। অনেক পড়াশোনা করতে চায়।
শিউলি বেগম হতভম্ব হয়ে ঢুকে পড়ে মিষ্টির কামড়ায়। মাথার ঘোমটা নারিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে

“অভির ভীষণ জ্বর। তোমরা ওর কাছে যাও।
কলিজা কেঁপে ওঠে পূর্ণতার। মানুষটার জ্বর? সারাদিন পূর্ণতার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় নি পূর্ণতার। বই বন্ধ করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় পূর্ণতা। মাথার ঘোমটা ঠিক করে দৌড়ে যায়। মিষ্টি পেছন পেছন যেতে নিয়ে থেমে যায়। হেসে বলে
“ভাবি একটা চুমু দিয়েই জ্বর সারিয়ে দিবে।
হেসে ওঠে শিউলি। দুই হাতে জড়িয়ে ধরে মিষ্টিকে।
“ফাজিল

পূর্ণতার চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। অভি অবচেতন হয়ে পড়ে আছে ধবধবে সাদা বিছানায়। চোখ দুটো বন্ধ। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। শরীর উত্তাপ বেড়েই চলেছে। শার্টের বোতাম গুলো খোলা হওয়ার ফলো উন্মুক্ত বুকের লোভনীয় পশম গুলো বেরিয়ে আছে। শ্যামলা মুখখানা লালচে রং ধারণ করেছে। ওষ্ঠদ্বয় শুকিয়ে চামড়া উঠে যাচ্ছে।
এমন বিধস্ত অভিকে পূর্ণতা আগে কখনো দেখে নি৷

ছোট নরম হাত খানা গলিয়ে দেয়,অভির চুলে। আস্তে আস্তে মাথা টিপে দিতে থাকে। অন্য হাত দিয়ে কাঁথা টেনে বুক ঢেকে দেয়।
অতঃপর মাথা নিচু করে চুমু এঁকে দেয় ললাটে।
সাথে সাথে চোখ খুলে অভি। টকটকে লাল চোখের সাদা অংশ। পূর্ণতা ভয় পায় খানিকটা। চোখে কিছু হয়েছে কি?
“তোমার ছোঁয়ায় বিষ মেশানো আছে। আমাকে ছুঁয়ে দিও না।
বলেই পূর্ণতার হাত সরিয়ে দেয় মাথা থেকে। পূর্ণতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির দিকে। চোখে মুখে তার আতঙ্ক। কি বলছে এসব?

“ভালোই তো ছিলাম আমি, পিছুটান ছিলো না।
কেনো মায়ায় জড়ালে আমায়? মায়া কাটাতে পারছি না”
স্পষ্ট শুনতে পায় না অভির বলা লাইন গুলো। তবে বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে অভির। কিন্তু কি?

ভোট চলছে। বিশ্বস্ত কিছু মানুষ পাহাড়া দিচ্ছে ভোট কেন্দ্র। অভির শরীর আগের থেকে কিছুটা ভালো। আসন পেতে বসেছে খাবার খেতে। তার পাশে বসেছে জমিদার সাহেব। চোখে মুখে তার চিন্তার ছাপ। মমতা বেগম নিজ কক্ষে দরজা দিয়ে বসে আছে। তাকে মানাতে কেউ যায় নি। জমিদার সাহেবও না।
আজকে খাবার বেরে দিচ্ছে পলি। পলির ব্যাপারে অভি কিছু জানে না। সাহেব আশা করেছিলো কিছু জিজ্ঞেস করবে অভি। বলা বাহুল্য অভিকে ভয় পায় জমিদার।

ইফাদকে আজকে দেখা যাচ্ছে খাবার খেতে। পূর্ণতা সূদুরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার অভিতে নিবদ্ধ। গতকাল রাত থেকে অভির ব্যবহারের পরিবর্তন এসেছে বেশ। কে এড়িয়ে চলছে পূর্ণতাকে। এটা নিয়ে চিন্তিত নয় পূর্ণতা। প্রাণ প্রিয় স্বামীকে বেশ চিনে সে। কোথাও একটা আটকে আছে তার স্বামী। দিন শেষে এই পূর্ণতার নিকটই ফিরবে বেশ জানে অভি।

মনোয়ার মামুন এবং মনির তিন ভাই কোনো দিকে নজর দিচ্ছে না। তারা খাওয়াতে বড়ই ব্যস্ত।
ইমন এবং ইশান খেতে বসে নি। ইশানের দৃষ্টি নিতুর পানে। মেয়েটা মাথায় ঘোমটা টেনে রান্না ঘটে খাবার বেরে দিচ্ছে। আজকে ভোট গোনার পরেই মেয়েটাকে পাঠানো হবে অতিথি শালায়। সেখানে দরদাম চলবে। অতঃপর চলে যাবে মালিকের সাথে। আর কখনোই মিতুকে দেখা হবে না।
তাচ্ছিল্য হাসি ইশানের ঠোঁটের কোণে।
ইফতিকে দুদিন দেখা যাচ্ছে না। সে কোথায় আছে কেউ জানে না।
খেতে খেতে অভি বলে

“মিষ্টি এবং পূর্ণতাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আপনাকে দিলাম জমিদারের বড়পুত্র। আশা করি নিজের মেয়ে এবং পুত্রবধুকে সসম্মানে স্কুলে দিয়ে এবং নিয়ে আসতে পারবেন।
মুখে সবেই ভাত পুরেছে মনোয়ার। ছেলের কথা শুনে চিবতে ভুলে গিয়েছে। বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।
“এমনিতেই আপনার কোনো কাজ নেই। সারাদিন ঘুরে ফিরে বেড়ায়। তাই কাজটা আপনাকে দিলাম। এর জন্য বেতন দেওয়া হবে আপনাকে।

অপমানিত হয় মনোয়ার। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।
সাহেব শক্ত গলায় বলে
“অভি নিজের সীমার মধ্যে থাকো।
“দাদাভাই হালাল কোনো কাজই ছোট নয়। অসম্মানিত নয়। দুটো মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসা একটা কাজ। সৎ কাজ।
সাহেব ফের কিছু বলার সাহস করে না।
বলেন পলি বেগম।

“আমি শুনেছিলাম মিষ্টির বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তাহলে আবার স্কুলে কেনো যাবে?
অভি ওই মহিলার দিকে তাকায় না।
“আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি।
তখন মমতা পেছন থেকে বলে ওঠে
“বউকে স্কুলে দিলে আরেক বেডার লগে ভাইগা যাইবো। মিলিয়ে নিস আমার কথা।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১২

মমতাকে কেউ ডাকছে না বলে সে নিজেই বেরিয়ে এসেছে। তার বোঝা হয়ে গেছে কেউ এগোবো না তার দিকে।
পূর্ণতা এতোখন চুপচাপ থাকলেও এবার আর চুপ থাকবে পারে না। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে আসে এবং বলে
“ভাগতে তো পারিই। জমিদার সাহেব এর নাতী বউ বলে কথা। চরিত্র তো তার মতো হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়”

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১৪