প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৩০

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৩০
তানিশা সুলতানা

বহুদিন পরে পূর্ণতা বাবার বাড়িতে এসেছে। একটা রাত বাবা মায়ের সাথে কাটাবে। দুই হাত ভর্তি ফলমূল এবং বাবামায়ের জন্য কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছে। অভির সাথে মার্কেটে গিয়ে পছন্দ করে কিনেছে সব।
নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী ব্যক্তি মনে হচ্ছে পূর্ণতার। মা বাবার জন্য কিছু করতে পারলে এতোটাই বুঝি সুখ লাগে?

তবে পুরোপুরি সুখী সে নয়। বরের টাকায় বাবাকে কিছু দিচ্ছে। যেদিন নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা মায়ের জন্য কিছু করবে সেইদিনই পুরোপুরি সুখী হবে।
বাড়িতে নতুন ঘর উঠেছে টিনের। ভাঙা চৌকিটা আর নেই। কমদামি একখানা খাট পেতেছে ঘরের মেঝেতে। কাপড় চোপড় আর তোষকের তলে রাখতে হয় না একখানা আলমারিও হয়েছে ঘরটাতে। রান্নার জন্য মাটির চুলোর পাশাপাশি গ্যাসের চুলোও আছে এখন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কেরোসিন দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার নিবারণ করতে হয় না আলোর জন্য কারেন্ট আছে। জমিদার বাড়ির মতোই রাতে অন্ধকারে চকচক করছে তাদের ঘরখানা। আলুসিদ্ধ ভাত খেতে হয় না। বাজারে যে কাপড়ের দোকান দেওয়া হয়েছে সেখানে প্রচুর বেচাকেনা হয়। সালাম ভালোভালো খাবার আনে। মাস মাংস চাল ডাল সবই রয়েছে ঘরে।
পূর্ণতা মুগ্ধ হয় স্বামীর ব্যবহারে। বাবা মায়ের অভাব ঘুচানোর জন্য গর্বে বুক ফুলে ওঠে। নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়।

“পৃথিবীর সব থেকে শুদ্ধ পুরুষটি আমার আহহহা কি দারুণ ভাগ্য আমার। আল্লাহ আমার শুদ্ধ পুরুষটিকে আমার আয়ু দিয়েও বাঁচিয়ে রাখুন দীর্ঘ দিন।
মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে পূর্ণতা। তার পাশে বসে পাপন কমলা খাচ্ছে আর বই পড়ছে। সালামের ইচ্ছে ছিলো ছেলেমেয়েদের ডাক্তার ইন্জিনিয়ার বানাবে। কিন্তু অর্থের অভাবে নিজের স্বপ্ন মুখ ফুটে বলে নি কখনো। তবে এবার ছেলের পিঠ চাপকে বলেছে

“বাজান মন দিয়া পড়াশোনা কর। যত টেহা লাগে লাগুক। তোরে আমি ডাক্তার বানামু”
অভিও শশুরের স্বপ্ন পূরণে উঠেপড়ে লেগেছে। ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে পাপনকে। প্রাইভেট টিচার রেখে দিয়েছে বেশ কয়েকটা। যাতে কোনো রকমের অসুবিধা না হয় পাপনের।
পূর্ণতার ঠোঁটের কোণের হাসি দেখে সালমা বেগম পূর্ণতার গালে হাত দিয়ে বলে

“শোন পুর্ণ মাঝেমধ্যে নিজের সুখের জন্য স্বার্থপর হতে হয়। সুখ বড় কঠিন জিনিস মা। আল্লাহ তোরে সুখ দিছে। নিজের সুখটা ধরে রাখ।
দূরে কোথাও চলে যা জামাইকে নিয়ে। পাপের রাজ্যে থাকিস না মা।
পূর্ণতা মায়ের হাতে চুমু খায়। মাথা ঘুরিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়
“সেই পাপের রাজ্যের অংশীদার যে আমি মা। যেখানেই যাই পাপ যে পিছু ছাড়বে না।
বিরবির করে বলে পূর্ণতা।

“কিছু বলছিস না যে পূর্ণ?
একটু থেমে আবারও বলে
ওই দিন তোর দেবররা যদি আমাকে না বাঁচাতো। তাহলে আজকে আর আমি তোদের সামনে থাকতাম না।
বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসে সেলিনা বেগমের।
“ভয় পেয়ো না মা। আমার দেবররা তোমার এবং আমার পাশে আছে। ইমন আর ইশান আমার দেবর না মা। ওরা আমার ভাই। ওরা আছে বলেই আমি বেঁচে আছি। ওদের মাঝ সমুদ্রে ছেড়ে আমি কি করে পালাবো মা?

ওদের একটা সুন্দর জীবন দিবো আমি। পাপের রাজ্য ধ্বংস করবো। তারপরই খ্যান্ত হবো। তুমি শুধু দোয়া করিও।
জবাব দেয় না সেলিনা। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। মেয়ের মতো এতোটা সাহসী সে নয়। ছলচাতুরী বোঝে না। দু মুখো পান্তা খেয়ে দিন পার করতে পারলেই হলো তার। একটা সন্তান হারিয়েছে। আরেকটা সন্তান হারালে সে বাঁচবে কি করে?
মেয়ের জন্য ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন সারাক্ষণ। এই বুঝি কোনো বিপদে পড়লো। মায়ের মন তো।

গতকাল ইফতিয়ার চৌধুরীর ২৭ তম জন্মদিন। আজকেই গোটা পাড়া দাওয়াত দেওয়া শেষ করেছেন ইসমাইল চৌধুরী। পাঁচটা গরু মেরে ছেলের জন্মদিন উদযাপন করবেন তিনি৷ প্রতিবছরই এমনটা করে থাকেন। চৌধুরী বাড়িটা সাজানো হচ্ছে নতুন রূপে। কালো গোলাপের বাগানটাও পরিচর্যা করা হচ্ছে।

ইফতিয়ার নিজ কক্ষের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কালো গোলাপের বাগান দেখছে। লাল নীল বাতিতে জ্বলজ্বল করছে বাগান খানা। ইফতিয়ারের মনে হয় বাগানের মাঝখানে পূর্ণতা বসে আছে। পরণে তার টুকটুকে লাল রংয়ের শাড়ি। গা ভর্তি গহনা আর লম্বা চুল গুলো বিছিয়ে আছে গোলাপ গাছের ওপর। কানের পাশে এক খানা কালো গোলাপ গুঁজতে ভোলে নি।

কি দারুণ হাসছে মেয়েটা। আর ইফতিয়ার মুগ্ধ নয়নে দেখছে।
এই যে হুটহাট পূর্ণতাকে অনুভব করা এটা কি প্রীড়া দায়ক নয়? মন পোরে। হৃদয় বিচলিত হয়। না পাওয়া আক্ষেপটা কুড়ে কুড়ে খায়। বিশাল পৃথিবীতে নিজেকে শূন্য মনে হয়। ক্ষমতাবান বাবার সন্তান হয়েও সাধারণ একটা মেয়েকে নিজের করতে পারলো না। কি হবে এই ক্ষমতা, অভিজাত্য, ধন সম্পদ দিয়ে?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ইফতিয়ার। বিরবির করে বলে ওঠে

“ছুঁয়ে দেখার সাধ্য নেই
অনুভবেই রাখি তারে
দুরত্ব যতই হোক
আমি সারাজীবন ভালোবাসবো তাকে”
পকেটে থাকা মুঠোফোন স্ব শব্দে বেজে ওঠে। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘরে। মস্তিষ্ক পূর্ণতার বিচরণ থেকে বেরিয়ে ফোনে ঢুকে যায়।

পকেট থেকে ফোন খানা বের করে। ফোনের স্কিনে “Misty” নামখানা ভেসে ওঠে। কথা বলার ইচ্ছে না থাকলেও কল রিসিভ করে। মেয়েটার সাথে একটু কথা বললে যদি পূর্ণতা নামটাকে কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলে থাকতে পারে।
“আসসালামু আলাইকুম চৌধুরী সাহেব।
মিষ্টির কন্ঠে চঞ্চলতা স্পষ্ট।
ইফতিয়ার গম্ভীর গলায় সালাম ফেরায়।

“ ওয়ালাইকুম আসসালামু
“আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে চৌধুরী সাহেব। একটু দেখ করবেন?
অনুরোধ করে বলে মিষ্টি। ভীষণ ভয়ে আছে সে। এখুনি ইফতিয়ার তাকে মানা করে দিবে। এটা ঠিকই জানে মিষ্টি। তবুও আবদার করে বসলো। আসলে মন তো মানে না।
ইফতিয়ার ফোঁস করে শ্বাস টানে
“মিষ্টি

আমি তোমাকে কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবো না বিশ্বাস করো। কোনোদিনও তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে তোমার কথা ভাবতে পারবো না। কখনোই তোমাকে ছুঁয়ে দিতে পারবো না।
আমার হৃদয় পূর্ণতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। আমি তোমার মাঝেও পূর্ণতাকে খুঁজতে থাকি। আমি ভীষণ স্বার্থপর। পূর্ণতাকে একটু দেখার লোভে তোমাকে ব্যবহার করছি।
থমকায় মিষ্টি। এসব সে জানে তবুও ইফতিয়ারের মুখ থেকে সরাসরি শুনতে একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। মন রাখার জন্যও কি একটু মিথ্যে অভিনয় করতে পারে না? সে কি বোঝে না মিষ্টির হৃদয়ে র ক্ত ক্ষ র ণ হয়?
ইফতিয়ার আবারও বলে

“ইদানীং তুমি একটু বেশিই অধিকার দেখাচ্ছো। আমার কাছে তোমার চাওয়া পাওয়া বাড়ছে। আমি তোমায় আশকারা দিতে চাই না। মিথ্যে স্বপ্নও দেখাবো না।
আমার জীবনে পূর্ণতা ছাড়া কখনো কেউ ছিলো না আর ইন ফিউচার কেউ থাকবেও না।
মৃত্যুর পরেও আমি পূর্ণতাকে ভুলবো না। পরপারে অপেক্ষা করবো পূর্ণতার। সেখানে আমাদের সংসার হবে। পূর্ণতা আমার হবে।

হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয় মিষ্টি। মৃদু হেসে বলে
“আমি সারাজীবন আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকবো। যা বলবেন তাই শুনবো। আর কখনো আবদার করবো না। ভালোবাসা চাই না আমি। আপনার ভালো সময়ের সঙ্গীও হতে চাই না।
শুধু খারাপ সময়ে আপনার পাশে রাখবেন আমায়। দিন শেষে একবার “কেমন আছো মিষ্টি” বলবেন তাতেই চলবে আমার।

আপনাকে দুচোখ ভরে দেখতে পেলেই আমি সন্তুষ্ট। আর কিচ্ছু চাই না।
“ভালোবাসা ছাড়া বাকি জীবন কাটাতে পারবে? আফসোস হবে না?
“হবে না। আর যদি হয় ও
আপনার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দিয়েন। সব আফসোস মিটে যাবে।
পরপারে আমি আপনার পিছু নিবো আপনি পূর্ণতার পিছু নিবেন আর পূর্ণতা অভিরাজের পিছু নিবে। কি দারুণ ভাগ্য আমাদের।

অভিরাজে শশুর বাড়িতে আজকেই প্রথম রাত্রীযাপন। সেলিনা বেগম নানান পদের রান্না করেছে মেয়ে এবং মেয়ের জামাইয়ের জন্য। সালাম নতুন বিছানা চাদর এনেছে। দোকান থেকে বোতলের পানি কিনে এনেছে যাতে জামাইয়ের কোনো অসুবিধা না হয়। এখন দুই জামাই শশুর মিলে গল্প গুজব করছেন। হাসাহাসি করছে। বাবা মায়ের খুশি দেখে পূর্ণতার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়।

মোবাইল ফোন সম্পর্কে পূর্ণতার ধারণা খুবই কম। অভির বড় বড় দুটো মোবাইল ফোন আছে। পূর্ণতা কখনো ছুঁয়েও দেখে নি। আজকে একা একা বসে আছে বিধায় ফোন দেখতে ইচ্ছে করে। চট করে বিছানার মাঝখানে থাকা একটা ফোন হাতে তুলে নেয়। অভিকে কয়েকবার ব্যবহার করতে দেখেছে। একবার কিছু দেখলে সহজে ভোলে না পূর্ণতা।
অভি যেভাবে ফোন চালু করেছিলো পূর্ণতাও ঠিক সেই ভাবেই চালু করে। আর তখনই দেখতে পায় এক অবিশ্বাস্য বিষয়। হাত ফসকে ফোনটা মাটিতে পড়ে যায়। আঁখি পল্লব টলমল করে ওঠে মুহুর্তেই। শ্বাস আটকে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। হাত পা মৃদু কাঁপছে।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৯

পাতলা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় নেরে পূর্ণতা বলে ওঠে
“আমার মুগ্ধ পুরুষটি আমাকে ঠকাতে পারে না। আমার এমপি সাহেব পবিত্র। আমার অহংকার। সে পাপী নয়।
ইয়া আল্লাহ হয়ত আমার দেখা ভুল প্রমাণ করুন নয়ত আমার প্রাণ নিয়ে নিন। মরার আগেই অমৃত যন্ত্রণা দিয়েন না আমায়।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৩১