প্রিয়কাহন পর্ব ৭

প্রিয়কাহন পর্ব ৭
লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহূর্তগুলো ছিলো প্রিয়তার সবচেয়ে সুন্দর জীবন। তবে সেই সুন্দর জীবনে অভীর অনুমতিবিহীন আগমনে জীবনে হাতছানি দিলো তুমুল তোলপাড়। প্রিয়তাদের সেমিস্টার শেষ। জীবন অতিবাহিত হচ্ছিলো বসন্তের দিনগুলোর মতো।সেই বসন্তের দিনগুলো পাড়ি দিয়ে নতুনভাবে ক্যাম্পাসে আসা মাত্রই হতভম্ব হলো সে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। হলের পুলু মামা থেকে শুরু করে মোড়ের দোকানের রমিজ কাকা, ক্যাম্পাসের দারোয়ান মিয়া দাদা এমনকি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদার্পন করা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীগুলোও। কেউ কেউ তো তুমুল আগ্রহে এগিয়ে এসে সালাম জানালো । প্রিয়তা তাদের প্রতিউত্তর দিলো যন্ত্রমানবীর মতো।

রুদ্রিক অদ্রিও হতভম্ব। প্রিয়তার মতো মেয়েকে সবাই এত গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা যেন ওদের বিশ্বাসের বাইরে। প্রিয়তা অসামাজিক ধরনের মেয়ে। কথা কম বলে, বললেও গুছিয়ে বলতে পারে না। এই শিক্ষাজীবনে খুব কম মানুষই আছে যারা ‘তাহমিনা প্রিয়তা’ কে এক নামে চিনবে। তবে এখন সবাই মুখে আপু আপু বলে যেভাবে ফ্যানা তুলছে সেটা দেখে দুজনের মাথা রীতিমতো চক্কর দিয়ে উঠলো। রুদ্রিক এগোলো প্রিয়তার কাছে। তুমুল উৎসাহে বললো,
‘ তুই কি ডিপার্টমেন্টে ধর্মের ভাই পাতিয়েছিস প্রিয়তা?’
প্রিয়তা বাক্যহীন। কথা হয়ে গিয়েছে অগোছালো। সে নিজেও বুঝতে পারলো না এর কারন কি। তুমুল বিরহে সে প্রতিউত্তর দিলো,
‘ আমি ধর্মের ভাই পাতাতে যাবো কেন বল্ তো?’
হাজার খুঁজেও এর উত্তর পেলো না রুদ্রিক। অদ্রি আচার খাচ্ছিলো। ভাইয়ের থামামাত্রই সে বলে উঠলো,
‘ কাহিনী আস্তে আস্তে বের হয়ে যাবে বস্। ওয়েট কর্। আপাতত ঠান্ডা মাথায় ক্লাস করে আসি। তারপর কোনো একটা জুনিয়র চেংলা পেংলা কে ধরলেই সব খবর বের হয়ে যাবে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অদ্রির কথায় মনে মনে একটু হলেও শান্তনা পেলো প্রিয়তা। তারপর তিনজন চলে গেলো ক্লাসের দিকে। তবে অন্তরের ছিমছাম চিন্তা ভাবনা হিমবাহের ঝড়ের মতো উড়ে গেলো যখন দেখলো তাদেরই ব্যাচমেট প্রিয়তাকে তোষামোদ করে চলছে। তাদের ব্যাচের একটা ছেলে আছে।নাম রাকিব। ইউনিভার্সিটির চরম রকমের প্লেবয়। এমন কোনো মেয়ে নেই যার পিছে সে ঘুরে নেই। অদ্রির সাথেও রিলেশন ছিলো। সেটা টিকেছে ঘন্টাখানেক মতো। অদ্রির মতো বাচ্চাহাতির খরচ বইতে বইতে রাকিব জর্জরিত কন্ঠে বললো,
‘ মাফ করো বইন, তুমি আজথেকে আমার বাতাসে উড়ে আসা বইন। কোনো প্রেমিকা ট্রেমিকা না। আমি এমনিতেও বাপের টাকায় খাই দাই ঘুমাই, তোমার মতো বাচ্চা হাতিরে পাললে জীবন বরবাদ হয়ে যাইবো।’
অদ্রি ভয়ংকরভাবে রেগে গিয়েছিলো সেবার। তারপর থেকেই সব সম্পর্ক শেষ। মাঝপথে সে প্রিয়তাকে লাইন মারার চেষ্টা করে । আর আজ সেই ছেলে যখন প্রিয়তাকে তুমুল শ্রদ্ধার সহিত আপা আপা বলে মুখের ফ্যানা তুলে ফেললো বিচলিত হলো প্রিয়তার মন। বললো,

‘ তুমি আমায় আপা বলছো কেন রাকিব?’
‘ তো বলবো না? আমি কি জানতাম যে তুমি অভী ভাইয়ের ফিওন্সে? জানলে আমি কেন, কেউই তোমার পিছে ঘুরতো না।’
স্নায়ু অকেজো হয়ে গেলো প্রিয়তার। দৃষ্টি বিভ্রম হলো। অবাক প্রসন্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি কিভাবে জানলে?’
‘ শুধু আমি না। সবাই জানে এ ব্যাপারে। নবীন বরণের সেই ঘটনার পর অন্তু ভাইয়াই সবাইকে বলে বেড়িয়েছে এ কথা। রমিজ কাকা তো ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে ফেলেছে। আমাদের চবি স্টুডেন্টদের যে সোশ্যাল গ্রুপ আছে সেখানেও তোমায় আর অভী ভাইকে নিয়ে মাতামাতি। তোমাদের মধ্যে যে প্রেমের সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা ভাবতেও পারিনি আমি।’
সবার চোখে মুখে একই অভিব্যাক্তি। সবার এক মতামত, নুরুল স্যারের বড় ছেলে হওয়ায় অভীর সাথে প্রিয়তার প্রেমের সূত্রপাত হয় আর তারপরই সেই সূত্রে আসে বিয়ে। এটা সত্য যে অভী প্রিয়তা পূর্বপরিচিত কিন্তু তাদের মধ্যে প্রেম তো দূরের কথা, ভালোমতো দুদন্ডও কথাও হয়নি। অভীর গম্ভীর চুপচাপ বৈশিষ্ট্য কিশোরী বয়সেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো প্রিয়তাকে।
ক্লাস শেষ করলো কোনোমতে। যেই স্যার ক্লাস করিয়েছিলো সেই স্যারের সাথে ব্যাক্তিগত কোনো পরিচয় ছিলোনা প্রিয়তার। কিন্তু ক্লাস শেষে সে যখন প্রশ্ন করলো,

‘ এখন কেমন আছো প্রিয়তা? ব্যাথা কমেছে?’
প্রিয়তার মুখ বোয়াল মাছের মতো হা হয়ে গেলো। আজ হয়তো অবাক হওয়ার দিন। একের পর এক এমন ঘটনা উপনীত হয়েছে যে প্রকৃতি চাইছে তাকে অবাকমিশ্রিত রমনী বানাতে। ঢোক গিললো প্রিয়তা। এই স্যার মহাশয় তাকে চিনলেও হয়তো নাম এত ভালোভাবে জানতো না। অথচ আজ উনি সহ সকলের কাছে প্রিয়তার নাম, ডিপার্টমেন্টসহ একাডেমিক সিরিয়াল যেন নখদর্পনে। প্রিয়তা আবেশি হয়ে বললো,
‘ জ….জ্বি স্যার কমেছে।’
‘ এত দুর্বল হলে চলে প্রিয়তা? বেশি করে দুধ ডিম এসব খাবে। কাল যেভাবে পড়ে মাথা ফাটালে আমি তো শুনেই আৎকে উঠেছিলাম। ভাগ্যিস অভী সামলে নিয়েছিলো ব্যাপারটা। কেয়ারিং বন্ধু পেয়েছো বলতে হবে।’
প্রিয়তা ভাব পাল্টালো না। সিনিয়র ভাইকে ‘কেয়ারিং বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে স্যার যে কি বোঝাতে চেয়েছে তা স্পষ্টই বুঝতে পেলো প্রিয়তা। কয়েকজন মানবমানবী ওকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। কেউ ফট করে বহিঃপ্রকাশ করে বলছে,
‘ প্রিয়তা দেখি ছুপা রুস্তম বের হলো মাইরি, এমন অন্যাবেলা ডলের মতোমুখ করে থাকা মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ঠিকই অভী ভাইকে পটিয়ে নিলো। ভাবা যায়?’
রেগেমেগে ক্লাস থেকে বের হলো প্রিয়তা। অদ্রি বললো,

‘ কি হলো তোর?’
‘ কি হলোনা এটা বল? দেখছিস সবাই কিসব বলছে?’
‘ চিল ইয়ার! ভুলসব বলছে নাকি ওরা। ওই হাংকি পাংকি স্যার আই মিন হাকিম স্যারের কানে পর্যন্ত যখন গেছে তার মানে তুই আমাদের ডিপার্টমেন্ট ভাইরাল করে ফেলেছিস। এখন কদিন অভী ভাইয়ার পাওয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়া বইন। যেই কুত্তিগুলা আমাদের র ্র্গিং করতো তারাও পর্যন্ত তোকে সালাম করবে।’
‘ চল আমার সাথে।’
‘ কোথায়?’
‘ বরকত হলের দিকে যাবো?’
‘ ওদিক কি কাজ?’
‘ অভী ভাইয়া ওই সাইডেই আছে আমি সিউর। কথা বলবো উনার সাথে।’
‘ চল তাহলে।’

কড়া রোদে ফেটে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আশেপাশে হাজারো নর নারীর ভীড়। রিক্সা টুংটাং আওয়াজ চালাচ্ছে। বাতাসের দুলে ওঠা পাতার ফাঁক ফোকরে পড়ছে জালের মতো রোদ। প্রিয়তা ঘামে তেতে উঠলো। জামা লেপ্টে রইলো গায়ে। রুদ্রিক এখানে নেই। সে বঙ্গবন্ধু ঊদ্যানের প্রান্তে গিয়েছে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে। অদ্রি এতক্ষণ এখানেই ছিলো। বরফ গোলা খাবে বলে কই যে গেলো আর খবরবার্তা নেই। প্রিয়তা হলের দিকে গেলো। এখানে সিনিয়র স্টুডেন্টদের ভীড়ে অস্বস্তি হলো বেশ। অভীকে খুঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। হঠাৎ সাদা গেন্জি পড়া এক চটপটে ছেলে হাজির হলো প্রিয়তার কাছে। আঙুল উচিয়ে বললো,
‘ তুমি কি সেই ইউনিটের তাহমিনা প্রিয়তা?’
তরুনটি কিভাবে প্রিয়তার নাম জানলো তা বুঝতে বেগ পেতে হলো বেশ। তবুও মেকি হাসি দিয়ে বললো,

‘ জ্বী।’
‘ তাহলে তুমি তো আমাদের ভাবি। অভী ফার্স্ট ফ্লোরেই আছে। হাতের বামদিকে সিড়ির কোণেই ওদের আড্ডাখানা। গেলেই পেয়ে যাবে।’
প্রিয়তা কথা বাড়ালো না আর। চুপচাপ ভবনের ভেতরে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ চিরুনি অভিযান চালানোর পর পেয়েও গেলো অভীকে। দেখে শরীরের চটচটে ঘাম নিমিষেই যেন শীতলে রূপ নিলো। অভী বসে আছে মোটা রেলিংয়ে। হাতে একটা বিশালাকার বই। কলম কামড়াচ্ছে আনমনে। তার বন্ধুমহল আশপাশে তাকেই ঘিরে ধরেছে। কথায় কথায় সে আলতোভাবে হেসে উঠছে বারবার। হঠাৎ অন্তুর সাথে চোখাচোখি হলো প্রিয়তার। খেয়াল করলো অন্তু অভীকে ইশারায় বললো সেদিকে দেখতে। প্রিয়তা নড়বড়ে হয়ে উঠলো। চোখাচোখি হলো অভীর সাথে। অভীর পাশাপাশি বাকি বন্ধুরাও সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো।
এবার সে পড়লো মহাফ্যাসাদে। অস্বস্তি শিরায় শিরায় যেন বয়ে বেড়াচ্ছে। অভী বই বন্ধ করলো। পা চালালো তার দিকে। প্রিয়তা পাথর হয়ে দাঁড়ালো। অপেক্ষায় রইলো কখন অভী বরাবর দাঁড়াবে। তবে অবাক করে দিয়ে অভী একবারও তাকালোনা প্রিয়তার দিকে।নিঃশব্দে এড়িয়ে চলে গেলো অন্যদিকে।
অপমানে রি রি করে উঠলো প্রিয়তার শরীর। গাল হয়ে উঠলো লাল। রাগে ক্ষোভে ব্যাগের একাংশ চেপে ধরলো। মানতে পারলোনা এই এড়ানোটা। বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ আপনি খারাপ অভী। বুদ্ধদেবের বাবলির মতোই আপনি ভীষণ খারাপ, অহংকারি আর একগুঁয়ে একটি লোক।’
প্রিয়তা নিঃশব্দে হল থেকে বেরোলো। দাঁড়ালো লনের সামনে। অদ্রি ছায়াতলে বরফ গোলা খাচ্ছে। দেখামাত্রই সে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ কথা হয়েছে?’
‘ না।’
‘ দেখা পাসনি?’
‘ পেয়েছি।’
‘ তাহলে কি হলো?’
অদ্রির সাথে কথা বলার প্রিয়তার বিন্দুমাত্র মনমানসিকতা নেই। অভী আসলেই দাপুটে মানুষ। এতটা দাপট কি প্রিয়তার সামনে না দেখালে হতো না? তখনই হ্যাংলা পাতলা গড়নের এক ছেলের ডাক পড়লো,
‘ আপা…..ও আপা শুনুন।’
প্রিয়তা চমকালো। তাকালো ছেলেটার দিকে। ঋজু কন্ঠে ছেলেটা বললো,
‘ আপনাকে অভী ভাইয়া ডাকছে আপা।’
আগুন জ্বললো প্রিয়তার চোখে। ভরাট কন্ঠে বললো,
‘ তাকে বলে দাও আমি যাবো না।’
‘ কেনো আপা?’
‘ আমি যাবো কেনো সেটা বলো?’

হ্যাংলা পাতলা ছেলেটি উত্তর খুঁজে পেলো না। অগত্যাই চলে গেলো সে। ঠিক পাঁচমিনিট পর অভী একটা মেসেজ দিয়ে বললো,
‘ বোর্ডরুমে আসো প্রিয়তা।’
প্রিয়তা সিন করলো। কিন্তু রিপ্লাই দিলো না। চুপচাপ ফুটপাতের আখের রস গোগ্রাসে হরণ করলো। অতঃপর আবার টেক্সট এলো,
‘ তুমি কি চাও আমি এমন কোনো কান্ড করি যাতে তুমি আবার জ্ঞান হারাও?’
স্পষ্ট হুমকি। প্রিয়তা এড়িয়ে পারলো না। অদ্রিকে বললো,
‘ তুই এখানে থাক অদি। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
বোর্ড রুম ডিপার্টমেন্টের শেষ মাথায়। এটাকে পরিত্যাক্ত বোর্ড রুম বলা চলে। পেছনের লনে বনলতাদের জংলী আবাস। সন্ধ্যায় মশাদের ভয়ংকর আড্ডাখানা চলে। প্রিয়তা দুতিনেক রুম পেরিয়ে শেষ মাথায় গেলো। আশপাশের গাছের আড়ালে যাদের দেখা যাচ্ছে প্রণয়ী নর নারী। উঁকি মারা অভদ্রতা তাই সেদিকে এগোলো না। বাঁয়ে পা চালিয়ে ঢুকে গেলো রুমে। সেখানে পরিত্যাক্ত টানাপাখা ঝুলছে। টেবিল, গুটিকতক চেয়ার, আর পুরোনো বইয়ে ঠাসা শেলফ। মানবের অস্তিত্ব নেই। প্রিয়তা ডাক দিলো। বারি খেলো তারই আওয়াজ। আচমকা দরজার খিল লাগানোর শব্দে তটস্থ হলো সে। পেছনে ফিরে আবিষ্কার করলো অভীকে।
প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। ধরতে পারলো না অভীর কার্যকলাপ। জেগে উঠলো ভয়। কোণঠাসা কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ আমায় ডেকেছেন কেন অভী?’
অভী কিছুবললো না। শুধু নিঃশব্দে হেসে দরজা বন্ধ করে দিলো।

প্রিয়কাহন পর্ব ৬

নোটবার্তাঃ এই গল্পটি আমি প্রথম লিখেছিলাম ২০১৯ এ ডায়রির পাতায়। ফেসবুক তখন আমার থেকে বহু দূরে। স্কূলে ক্লাসের ফাঁকে বেশ কিছু অংশ লিখতাম। ভাবিনি এতবছর পর সেগুলো পোস্ট করা হবে। আনাড়ি ছিলাম। বানান ছাড়া আর কোনো কিছুই সংযোজন পরিমার্জন করিনি। এমনকি তথ্যও না। ভুল কিছু থাকলে থাকতেও পারে। তাই এটা শুধু একটা গল্প হিসেবেই ধরে নিবেন। আসসালামু আলাইকুম।

প্রিয়কাহন পর্ব ৮

1 COMMENT

Comments are closed.