সায়েবা আসক্তি পর্ব ২১

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২১
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে ফায়জা।পাত্রের মা জহুরি নজরে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুটিয়ে খুটিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে।মহিলার মধ্যে একটা দারোগা দারোগা ভাব আছে।ড্রয়িং রুম জুড়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ। পাত্র নিজেও একজন ডাক্তার। কর্মক্ষেত্রেই তাদের পরিচয়। ফায়জা কে দেখেই মনে ধরে যায় তার।তাই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
— তা ক’বছর যাবত আপনারা এখানে আছেন?
ছেলের মায়ের প্রশ্নে হচকচিয়ে গেলো সবাই।ফারহানা বেগম হাসি হাসি মুখ করে বললো,
— বাড়ি হওয়ার পর থেকেই আমরা এখানে। আসলে এখান থেকে আমাদের হসপিটাল আর অফিস দুটোই সামনে হয়।তাই এখানে সিফট হওয়া।
পাত্রের মা মুখ কুচকে বললেন,
— আমাদের তো নিজের বাড়ি ঢাকায়।তা আপনারা বাড়ি করার ব্যাপারে কিছু চিন্তা করেন নি? না মানে, কতদিন আর ভাড়া বাসায় থাকবেন?

ড্রয়িং রুমে পিনপতন নীরবতা। সবাই বজ্র চোখে তাকিয়ে আছে পাত্রের মায়ের দিকে। পাত্র নিজেও অপ্রস্তুত চোখ তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। ঠিক সেই মুহুর্তে আদিবের আগমন। ফায়জা কে এভাবে সেজেগুজে বসে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেছে সে।তবুও কিছু না বলে শান্ত ভাবে গিয়ে বসে পরলো ফরহাদের পাসে।
সবার দিকে নজর বুলিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করলো জাবের (পাত্র)। মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— কি বলছো মা।এই পুরো বাড়ি টাই ওনাদের।প্লিজ তুমি নিজের মুখ একটু বন্ধ রাখো।
ছেলের কথা শুনে চোখ চকচক করে উঠলো তার।এতো বড় বাড়ি! তার মানে টাকা পয়সা ভালোই আছে।এতক্ষণের থমথমে ভাব কেটে গিয়ে মুহুর্তেই আহ্লাদে গদগদ হয়ে গেলো সে।ফায়জার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আহা কি সুন্দর মেয়ে।দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মাশআল্লাহ। আমার তো।মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে।
ফায়জা তার মায়ের দিকে করুন চোখে তাকালো। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। পড়াশোনার জন্য এতো বছর পরিবার ছেড়ে দূরে ছিল। যখন দেশে আসলো তখন ফারহানটা চলে গেলো। এখন যখন ফারহান আসার সময় হয়েছে তখন তার আম্মু তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ফায়জার দিকে। তার দৃষ্টি ফায়জা থেকে নড়ছে না।আদিব অনেকদিন আগেই বাবার ব্যাবসা জয়েন করেছে।তাই এদিকে খুব একটা আসা হয়ে উঠে না।কিছুক্ষণ আগে সায়েবা থেকে জানতে পেরেছে ফায়জা কে আজ দেখতে আসছে।তাই সমস্ত কাজ রেখে এখানে ছুটে এসেছে।সানোয়ার সাহেব ও নিজের স্ত্রীর এমন ব্যবহারে বিরক্ত।মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য এতো তাড়া কিসের সে বোঝে না। ফরহাদ এখানে নেই।সে অফিস থেকে আসেনি।মায়ের উপর নিরব রাগ ঝাড়ছে সে।
সায়েবা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। আদিবের রক্তলাল চোখ দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে উঠছে।ফারহানের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ফারহান ইদানীং খুব একটা সময় দিতে পারছে না তাকে।পড়াশোনায় খুব ব্যাস্ত সে।তার ফাইনাল এক্সাম চলছে। দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে গেছে। চোখের পলকেই যেন সময় চলে যায়।
দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তার মাধ্যমে ঠিক হয় তারা আজ ই ফায়জা কে আংটি পাড়িয়ে যাবে।দুই মাস পরে ফারহান আসলে অনুষ্ঠান করে তুলে দিবে।আদিব এখনো ফায়জার দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়জার দৃষ্টি নিচের দিকে। ফায়জা ছলছল চোখে সানোয়ার সাহেবের দিকে তাকাতেই তার চোখ পরলো আদিবের দিকে। আদিবের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো। সানোয়ার সাহেব মেয়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।
অবশেষে জাবেদ ফায়জার অনামিকায় রিং পরিয়ে দিলো।আদিব নিজের চোখ সরিয়ে নিলো ফায়জার থেকে। ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে হাটা দিলো ছাদের দিকে।

ফরহাদ আর ফারহান দুজনেই মায়ের উপর রেগে আছে। মায়ের এই হুটহাট সিদ্ধান্ত তারা মেনে নিতে পারছে না। ছেলের সম্পর্কে ভালো করে খোজ খবর না নিয়েই এনগেজমেন্ট করে ফেলা হটকারিতা ছাড়া কিছুই নয়।
— তুমি এটা কিভাবে করতে পারলে আম্মু?অন্তত পক্ষে আমার জন্য অপেক্ষা তো করতে পারতে?
— রাগ করো না আব্বু।এখন শুধু এনগেজমেন্ট হয়েছে।তুমি আসলেই বিয়ে হবে। এতো দিনে ওরা নিজেদের মধ্যে সময় কাটাক।চিনুক জানুক। আর জাবের ভালো ছেলে। আমি অনেকদিন ধরে চিনি।আম্মুর উপর একটু ভরসা করে দেখো আব্বু।
রাগে ফারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ফারহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
— তুমি তাকে প্রোফেশনালি চেনো আম্মু।ব্যাক্তিগত ভাবে কতটা চেনো?একটা মানুষ কেমন তা তার বাইরের দিক দেখে কখনোই বোঝা যায় না। আর তার একার ভালো দিয়ে কি হবে আম্মু?তার পরিবার কেমন তা ও জানতে হবে। আমার বোন কোন ফেলনা নয়।হাজারের মধ্যে একজন খুজে আনবো তার জন্য। ছেলের সাথে সাথে ছেলের পরিবার ও গুরুত্বপূর্ণ আম্মু।আমার বোন তাদের সাথেই থাকবে।তুমি এ বিষয় নিয়ে আর এগোবে না আম্মু।আমি দেশে এসেই যা করার করবো।

ফারহান রাগ করে কল কেটে দিলো।মায়ের উপর রাগ হচ্ছে খুব।এদিকে ফারহানা বেগম ভাবনায় পড়ে গেলেন।ফারহানের কথা ভুল নয়।এভাবে তাড়াহুড়ো করা উচিত হয়নি।ফায়জার মত না নিয়ে তো একদমই নয়।
ফায়জা সেই যে দরজা বন্ধ করেছে এখনো খোলেনি।ফরহাদ মায়ের উপর চোটপাট করে গিয়ে কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিয়েছে।কিন্তু ফায়জা দরজা খোলে নি। সায়েবা শুধু অসহায় চোখে সব কিছু দেখে যাচ্ছে। বাড়ির পরিবেশ গরম। কিছু বলতেও ভয় হচ্ছে। এদিকে রাত ও কম হলো না। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে একবার ডেকে এসেছে।কিন্তু কেউই খেতে আসেনি। ফায়জা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সানোয়ার সাহেব আর ফারহানা বেগমের জন্য খাবার নিয়ে গেলো। সানোয়ার সাহেবের প্রেসারের মেডিসেন নিতে হবে। খাবার খাইয়ে তাকে মেডিসিন দিয়ে ফারহানা বেগমের কাছে গেলো সায়েবা।বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছে সে। সায়েবা আস্তে করে মা বলে ডাকতেই চোখ খুললো সে।সায়েবার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,
— খাবার নিয়ে যাও সায়েবা।আমি আর আজ খাবো না।ফায়জার দিকে একটু খেয়াল রেখো। রেগে আছে খুব।
— চিন্তা করবেন না আম্মু।সব ঠিক হয়ে যাবে।
— তোমার ও মনে হয় আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই না?
সায়েবা তপ্ত শ্বাস ফেললো। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,

— বাবা মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না আম্মু।আপনার দিক থেকে আপনি সঠিক। তবে সময় নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে নিলে ভালো হতো। এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সবাই মন খারাপ করেছে।আমার কথায় রাগ করবেন না আম্মু।আপনার আপুর সাথে কথা বলা উচিত ছিল। তার মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার অনুমতি ব্যতীত এএনগেজমেন্ট করা বোধহয় ঠিক হলো না। ইসলামে এটা সম্পুর্ন নিষেধ। কুমারী মেয়ের অনুমতি আর বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের মতামত ছাড়া তাদের বিয়ে দেয়া নিষেধ।এতে বান্দর হক নষ্ট হয়।
— আমি রাগ করি নি আম্মু।আমার ভুল হয়েছে।তবে বিয়ে হয়ে যায় নি। আমি এবার ভালো করে খোঁজ নিয়ে তারপর বিয়ে নিয়ে এগোবো।আর ফায়জার মতামত নিয়েই হবে সব কিছু। ওর যদি মত না থাকে তাহলে বিয়ে হবে না।
সায়েবা সন্তুষ্টির হাসি হাসলো। সানোয়ার সাহেব ও খুশি হলেন।এতক্ষণ সে ওদের সব কথা শুনছিলেন।স্ত্রীর উপর এতক্ষণ রেগে থাকলেও এখন আর রাগ টা নেই।সে খুশিমনে শুতে চলে গেলো।

সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ছাদেই আছে আদিব।নিচে নামতে ইচ্ছে করছে না। চোখ গুলো রক্তবর্ন ধারণ করেছে।
পায়ের শব্দ পেয়েও পিছনে ফিরলো না সে।
— এতো রাতে এখানে কি করছো?
ফায়জার উপস্থিতি টের পেয়েও কিছু বললো না আদিব।
— কি হলো? কথা বলছো না কেন?
— ইচ্ছে করছে না।
— নিচে যাও আদিব।অনেক রাত হয়েছে।
— আমাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে আপু।
আদিবের মুখে আপু ডাক শুনে চমকে উঠলো ফায়জা। যেন হৃতপিন্ডের ভিতর কেউ হাজারো সুচ ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফায়জা ছলছল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। আদিব একবার ও তার দিকে তাকায় নি। যে ছেলেকে মারধর করে ও আপু বলানো যায় নি সে আজ নিজ ইচ্ছায় আপু বলছে!কয়েক বার ঢোক গিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো ফায়জা।ভাঙা গলায় বললো,

— হটাৎ আপু ডাকলে যে?
আদিব আকাশের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
— অনেক আগে থেকেই বলা উচিত ছিল। আমার ই ভুল।আপনাকে আপু না ডাকা টাও ভুল।ঠিক আপনাকে ভালোবাসার মতো।
ফায়জা ফ্রিজ হয়ে গেলো। কাপা কাপা গলায় বললো,
— আদিব!কি বলছো এসব?,আমি তোমার বড়,,,
আদিব ঝড়ের গতিতে ঘুরে ক্ষ্যাপা বাঘের মতো চেপে ধরলো ফায়জা কে। রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বললো,

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২০

— মজা করছো আমার সাথে?তুমি জানতে না আমি ভালোবাসি তোমাকে?বলো জানতে না?একটা মেয়ে দূর থেকে ছেলেদের দৃষ্টি দেখেই সব বুঝে ফেলে।আর আমি তো তোমার এতো কাছে ছিলাম সব সময়। সারাক্ষণ তোমার সাথে ছায়ার মতো থেকেছি।তোমাকে ঘিরে হাজার পাগলামি করেছি।এই অবহেলা আমি তোমার তিন বছরের ছোট বলে?আরে একবার আমাকে একটা সুযোগ তো দিয়ে দেখতে!জান দিয়ে হলেও সবাই কে রাজি করাতাম।তুমি আজ আমাকে খুন করেছো।নিরবে আমার হৃদয়ে আঘাত করে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলেছো।ড্রয়িং রুমের প্রতিটি সেকেন্ডে আমার নিশ্বাসের সাথে বিষাক্ত যন্ত্রণা দিয়েছো তুমি।আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না সোনা।খুব পস্তাবে তুমি।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২২

2 COMMENTS

Comments are closed.