সায়েবা আসক্তি পর্ব ২০

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২০
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

সাহেরা বেগম সায়েবার সাথে কথা বলছেন না।এ বাড়িতে আসার পর থেকে এক কথায় গুম হয়ে আছে।সায়েবা অবশ্য কয়েকবার মায়ের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শোয়েব মা আর বোনের নিরব যুদ্ধ একমনে দেখে চলেছে।যদি ও খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না সে।মা যদি একবার জানতে পারে বিসিএস ক্যাডারের খবর ফারহানের কাছে সে পাচার করেছে তাহলে তার পিঠ বাচাবে কে সে চিন্তায় কয়েক রাত ধরে ঘুম হচ্ছে না। তার মা তো তার পিঠের ছাল তুলে নিবে!শোয়েব ভয়ে ভয়ে একবার সাহেরা বেগমের দিকে তাকালো। তিনি গম্ভীর মুখে নিজের কাজ করছেন।শোয়েবের মুখটা কাদো কাদো হয়ে গেলো। মনে মনে বললো, বোন আর দুলাভাইয়ের মিল করাতে গিয়ে না জানি ফোটার আগেই আমার জীবনের কলি ঝরে যায়! এখনো কোন মেয়ে ও পটাতে পারি নাই,বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হওয়া ও বাকি!মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ও বুঝি হলো না! এগুলো হয়তো আমার না হওয়া গার্লফ্রেন্ড গুলোর অভিশাপ!

— আর কতক্ষন এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে?একটু পরে তো চলেই যাবো। এখন তো একটু কথা বলো!
সায়েবার অসহায় গলায় বলা কথা গুলো শুনে সাহেরা বেগমের কোন ভাবাবেগ হলো না। সে নিজের মনে কাজ করতে করতে বললো,
— বড় হয়েছো,বিয়ে ও হয়ে গেছে।বাবার বাড়ি আসবে যাবে।নিজের মতো করে থাকবে।আমাকে আর দরকার পরবে কেন?
সায়েবা মলিন চোখে মায়ের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই অভিমানের বরফ কবে গলবে আল্লাহ জানেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিবের গালে বরফ ধরে বসে আছে ফারহানা বেগম। ফায়জার হাতে ভালোই উত্তম মধ্যম খেয়েছে সে।ফারহানা বেগম কয়েক দফা ঝেড়েছে সবাই কে।একেক জন ডাক্তার, বিজনেসম্যান হয়েও বাচ্চাদের মতো ঝগড়া মারামারি করছে।এই দিন দেখার জন্যই বেচে আছে সে।ভাগ্য ভালো সায়েবা বাসায় নেই।নাহলে কি এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরতে হতো!
— তোমাদের আমার আর কিছুই বলার নেই।তোমাদের থেকে পাচ বছরের বাচ্চা ও ভালো মেনার্স জানে।আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমাদের কান্ডজ্ঞান দেখে!
ফায়জা এখনো রেগে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে। সুযোগ পেলে আরো কয়েক ঘা লাগিয়ে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আদিব সবার চোখের আড়ালে ঠোঁট উঁচু করে চুমু দেখাতেই ফায়জা আবার তেড়ে গেলো আদিবের দিকে। ফারহানা বেগম ধমকে তাকে ওখানেই থামিয়ে দিলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
— আরেকবার ওর গায়ে হাত তুললে কালকের মধ্যে দুটোর বিয়ে দিয়ে দিবো। তখন যত পারো চুলোচুলি করো।এখন থেমে যাও।
ফরহাদ ও বোনের হাতে কয়েক ঘা সোফায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে। ফরহাদের পায়ের দিকে ফায়জা বসে রাগে ফুসছে।ফরহাদ পা ফায়জার কোলে তুলে দিয়ে বললো,

— অনেক মেরেছিস বোনু।এবার একটু সেবাযত্ন কর।খুব ব্যাথা করছে।পা টা একটু টিপে দে।
ফায়জা রেগে তাকাতেই ফরহাদের মলিন মুখ দেখে চুপ করে গেলো। যত কিছু হয়ে যাক না কেন,ভাইদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না সে।ফারহানের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব ক্লান্ত। কালকে সারাদিন ফারহানের বিয়ের জন্য খাটা খাটনি করে আবার ক
সকাল সকাল অফিসে চলে যেতে হয়েছে।এখন আবার ফুপ্পির জন্য দৌড়ে চলে আসতে হলো। ক্লান্তিতে অবস হয়ে আসছে শরীর। ফায়জা কোন কথা না বলে পা টিপতে শুরু করলো। আদিবের যেন এটা একদম সহ্য হলো না, সে ফারহানা বেগমের কাছে অভিযোগের সুরে বললো,
— দেখলে মনি?মার তো দুজনেই খেয়েছি।দাদাভাই কে তো নামে মাত্র মেরেছে।আর আমাকে!আমাকে সরকারি মাল মনে করে ধুপি ঘাটের কাপড়ের মতো করে ধুয়েছে।এখন ভাইয়ের সেবা করা হচ্ছে। আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?যদিও আমার পা টিপে দিতে হবে না, হালকা করে একটা চুমু খেলেই হবে।
ফারহানা বেগম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেলেন।এই ছেলেটা সব সময় ফায়জার পেছনে লাগে।এ জন্য মার ও কম খায় না। তবুও একই কাজ করে।

আদিবের কথা শুনে ফায়জা আর ফরহাদ একসাথে বালিশ ছুড়ে মারলো ওর দিকে।
— অসভ্য ছেলে বের হও বাসা থেকে। না হলে বাক যে হাড়গুলো ভালো আছে সে গুলো ও ভেঙে দেবো।
ফায়জার ধমকি জানালা দিয়ে ছুরে মেরে আদিব ওখানের বসে রইলো। ফায়জার দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হেসে গান ধরলো,
— তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী তুমি গলার মালা।এই যে দেখো তোমার জন্য আনছি আর্সি কোলা।
— অসহ্য।
ফরহাদ চোখ বুজে পরে রইলো। এখন এদের ঝগড়া দেখার সময় নেই।তার একটু ঘূমানো দরকার।

রাত নয় টার দিকে ফায়জা আর আদিব সায়েবাদের বাসায় উপস্থিত হলো। সায়েবা তখন টেবিলে খাবার গোছাচ্ছিলো।আদিব আর ফায়জা কে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো। ফায়জা কে হালকা জরিয়ে ধরে কুশল বিনিময় করে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলো। আদিব কে যদিও বলা লাগে নি। আদিব নিজ দায়িত্বে বসে গেছে।ফায়জার পড়নে কালো বোরকার মতো একটা লম্বা ফ্রক।সাথে হাটু পর্যন্ত লম্বা হিজাব।চেহারা ও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। আদিব যদিও সায়েবার দিকে তাকাচ্ছে না। তবুও সায়েবা নিজেকে আরেকটু ভালো করে ঢেকে নিলো।ফারহানের কড়া হুকুম,বেপর্দায় চলা যাবে না।

আর এখন থেকে এমন লম্বা গ্রাউন পরেই থাকতে হবে। বাইরে গেলে ঢিলা ঢালা বোরকা সাথে হাত মোজা পা মোজা ও পড়তে হবে। সে তার বউ কে কাউকে দেখতে দিবে না। কেউ তার বউয়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাবে এটা তার সহ্য হবে না। তার বউকে শুধু সে একা দেখবে।মন ভরে দেখবে।মন ভরে গেলে আবার প্রথম থেকে দেখবে।দেখতেই থাকবে।সায়েবা খুব হেসেছিল ফারহানের কথা শুনে। তার সমস্ত আবদার খুশিমনে মেনে নিয়েছে।
আদিব নিজের খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো শোয়েব কে নিয়ে।তারপর সাহেরা বেগম, ফায়জা আর সায়েবা একসাথে খেতে বসলো। ফায়জা সাহেরা বেগম কে অবশ্য সরি বলেছে। সাহেরা বেগম হাসিমুখে সরি এক্সেপ্ট করেছে।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ফায়জা যাওয়ার জন্য তাড়া দিলো সায়েবা কে।যাওয়ার কথা শুনে সায়েবার মুখ কালো হয়ে গেলো। তার একদম যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতেই হবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পরলো ওদের সাথে। কাল আবার সকাল সকাল চলে আসা যাবে।যাওয়ার আগে শোয়েব কে কতক্ষণ জরিয়ে ধরে রাখলো।সাহেরা বেগমের চোখ ও ছলছল করে উঠলো। মেয়ের উপর যতই রাগ করে থাকুক না কেন, মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে শুনেই কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। সায়েবা মা কে ও কিছুক্ষণ জরিয়ে ধরে বিদায় নিলো মায়ের কাছ থেকে।

ফারহানদের বাসায় এসে সবার সাথে হালকা কথা বলে রুমে চলে এলো সায়েবা।ফারহানা বেগম তার ননদের হয়ে ক্ষমা চেয়েছে সায়েবার কাছে।সায়েবা তাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে এসেছে এতে তাদের কোন দোষ নেই।
রুমে আসতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো সায়েবার।চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস টেনে ফারহানের গায়ের গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করলো। কাবার্ড থেকে ফারহানের একটা শার্ট নিয়ে কিছুক্ষণ জরিয়ে ধরে রাখলো। এখন ফারহানের শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে। শার্ট টা জরিয়ে ধরেই শুয়ে পরলো সে।চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনাপানি বেরিয়ে ভিজিয়ে দিলো শার্ট টা। ফারহান প্রেয়সীর চোখের পানি দেখে মন খারাপ করার বদলে তৃপ্তির হাসি হাসলো। চোখ বন্ধ করে সেও তার ধুলোর রানী কে অনুভব করার চেষ্টা করলো। চোখ খুলে সায়েবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাকে কল করলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই ফারহানের নেশালো গলা শুনে কেপে উঠল সায়েবা।

— মিস মি??
সায়েবা এবার শব্দ করে কান্না করে দিলো। কান্নারত গলায় বললো,
— অনেক।
ফারহান প্রত্যেক ফোটা চোখের পানি গুনে নিলো। সায়েবার কান্নার দমকে লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বললো,
— আমিও।
সায়েবা কোন রকম কান্না থামিয়ে হেচকি তুলতে তুলতে বললো,
— খেয়েছেন?
— হুম।
— কখন উঠলেন?
— অনেকক্ষণ। তুমি খেয়েছো?
— হুম।
— মা কি খুব বেশি রেগে?
— হুম।
— ঠিক হয়ে যাবে।চিন্তা করো না।
— আচ্ছা।
ফারহান চুপ করে সায়েবার দিকে রইলো। সায়েবা ও চুপ করে ফারহানের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলো।
— সায়েবা,,,
— হুম।
— একবার ভালোবাসি বলবে?
সায়েবা চমকে গেলো। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর নিজেকে শান্ত করে বললো,
— একবার নয়,অগুনিত বার বলবো। তবে যেদিন আমার সামনে হাজির হবেন সেদিন।
ফারহান মুচকি হাসলো। দুষ্টু গলায় বললো,
— সেদিন শুধু ভালোবাসি বললেই হবে না। এভাবে জরিয়ে ধরে ও রাখতে হবে।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ১৯

আদিব ছাদে সিগারেট জ্বালাতেই ফায়জার ফোনে কথা বলতে বলতে আগমন।আদিব কে সিগারেট জালাতে দেখে অবাক হয়ে বললো,
— তুমি সিগারেট জ্বালাচ্ছো???
আদিব ফায়জার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,
— নাহ নিজেকে।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২১