প্রিয়কাহন পর্ব ৮

প্রিয়কাহন পর্ব ৮
লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

এভাবে অভীর দরজা লাগানোতে সচকিত হলো প্রিয়তা। এখন এই ঘরটিতে ওদের দুজনের ছাড়া আর কারও কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রিয়তার ভয় হলো, সন্দেহ জাগলো অভীর কার্যকলাপের জন্য৷ তবুও বুকে সাহস নিয়ে শেষমেষ বললো,
‘ দরজা লাগালেন কেন আপনি?’
‘ কিছু কাজ দরজা খুলে করা যায় না তাই।’
অভীর নির্বিকার প্রতিউত্তর। প্রিয়তার মুখ হা হয়ে গেলো। বোলতার মতো ভনভন করতে লাগলো মাথা৷ অভীকে এতদিন সে জানতো ভদ্রবেশী ছেলে হিসেবে, আর আজ সেই ছেলের চট করে আমূল পরিবর্তন প্রিয়তার মাথার উপর দিয়ে যেন সাঁ সাঁ করে উড়ে যেতে থাকলো। অভী এগোলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা পেছালো। এক পা, দু’ পা তিন পা – কিন্তু অভী থামলো না। শেষমেশ সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘ পেছাচ্ছো কেন তুমি?’
‘ আপনি নিরাপদ দুরত্ব নিয়ে দাঁড়ালেই আমি পেছাবো না ‘
‘ ফাইন।’
দাঁড়িয়ে পড়লো অভী। প্রিয়তা হাফ ছাড়লো। বোর্ড রুমের দক্ষিণা জানালা দিয়ে দিঘীর দৃশ্যপট অপূর্ব লাগছে। নাকে ভেসে আসছে আমপাতার সুবাস। পরিত্যাক্ত কোণঠাসা এই ঘরটিতে ভরদুপুরের আলো পড়াতে যেন প্রাচীনকালের কোনো গল্পের দৃশ্যপট মনে হচ্ছে। অভী সচকিত হলো। হাত পকেটে গুঁজে নিখাদ স্বরে বললো,
‘ আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসার কারন?’
প্রিয়তা উত্তর খুঁজে পেলো না। সে যে ঠিক কি কারনে বরকত হলে এসেছে সে নিজেও জানে না। শুধু জানে যে তখন প্রিয়তার রাগ উঠেছিলো৷ হ্যাঁ এটা সত্য যে অভী তার হবু বর কিন্তু এই জিনিসটা নিজেদের মধ্যে থাকলেই কি ভালো হতো না? এমন না যে তারা ভুল জানে বা অভীর সাথে তার এই তথ্যটাও ভুঁয়া খবর তবুও কেন যেন সব কিছুর নষ্টের মূল এই ছেলেটাকেই মনে হচ্ছে।
প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ধাতস্থ করলো। বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ আপনি এসব ইচ্ছে করেই করেছেন তাই না?’
‘ কিসব?’
‘ এই যে আমাদের বিয়ের খবরটা?’
বিরক্ত হলো অভী। বলে উঠলো,
‘ আরে আমি এসব ইচ্ছে করে কেন করতে যাবো?
‘ কারন আপনার ইগোতে লেগেছে যে আমি আপনাকে রিজেক্ট করতে চাচ্ছি, লাগাটাই স্বাভাবিক। আপনি ব্রাইট স্টুডেন্ট, এসএসসি – এইচএসসিতে চট্টগ্রাম বোর্ডে ফার্স্ট, চবি ভর্তি পরীক্ষায়ও হাইয়েস্ট রেজাল্ট, ভালো সিজিপিএ নিয়ে অনার্স কমপ্লিট, কদিন পর মাস্টার্স শেষ করে একটা ভালো জবে ঢুকবেন আর আমার মতো মেয়ে কিনা আপনাকে রিজেক্ট করছে সেটা আপনার সহ্য হচ্ছে না।’
অভীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। থমথমে কন্ঠে বললো,

‘ তুমি নিজেও কিন্তু ব্রাইট স্টুডেন্ট প্রিয়তা। ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল, চবি তে ঢুকা কখনোই এতটা সহজ না বাট তুমি পেরেছো। তারপরও বাচ্চাদের মতো এমন লেইম এক্সকিউজ দিচ্ছো কেন তুমি?’
‘ আপনার জন্যই এসব বলছি। এখন আপনি যেভাবে পারবেন বিষয়টা থামাবেন!’
অভী হাসলো কিঞ্চিত। জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি বলে থামাবো?’
‘ বলবেন প্রিয়তা একটা গাধি মেয়ে, যেখানে সেখানে হুটহাট করে অজ্ঞান হয়ে যায়। কথাবার্তা বাচ্চাদের মতো। বাবার জন্যই আপনি চুপ আছেন নতুবা আপনার মোটেও আমায় পছন্দ না।’
‘ কিন্তু আমি মিথ্যা কেন বলবো?’
সচকিত হলো প্রিয়তা। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকালো অভীর দিকে। বললো,
‘ আপনি তো আমায় পছন্দ করেন না। তাই না?’
প্রিয়তা ভড়কে গেছে। চট করে নির্বিকার ছেলেটার আমূল পরিবর্তন ভাবিয়ে তুলেছে। অভী কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। ঝুঁকে এসে স্ফীত কন্ঠে বললো,

‘ কে বলেছে তুমি আমার পছন্দ না?’
বিস্ফোরিত হলো প্রিয়তার চোখ। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো অভীর প্রচ্ছন্ন মুখের দিকে। ভয় হচ্ছে। মতিগতি ঠিক মনে হচ্ছে না এর। মিথ্যে বলার কথা বললো মানে? তাহলে এতদিন কি প্রিয়তার ধারনা ভুল ছিলো? গম্ভীর ছেলেটা যে কি না সব মেয়েদের এড়িয়ে চলতো সে তাইলে আসলেই পছন্দ করতো প্রিয়তাকে? আর এজন্যই তবে নুরুল স্যার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন? তাকে অবাক করে দিয়ে অভী অকপটে বললো,
‘ ঝামেলা আমি ক্রিয়েট করিনি প্রিয়তা৷ তোমার বোন অদ্রি করেছে, কপাল ভালো ও একটি মেয়ে। নাইলে সপাট করে চড় মেরে পাটির দাঁত ফেলে দিতাম৷ আমি মোটেও চাইনি যে আমাদের পারিবারিক এ ব্যাপরটি এখানে আসুক৷ জানো যেদিন আমি তোমায় দেখতে গিয়েছিলাম, আমি তখন থেকেই শিউর ছিলাম যে এটা জানাজানি হলে একটা হৈ হুল্লোড় হবে৷ এটাই স্বাভাবিক। আজ তুমি অন্য কোনো বাইরের ছেলেকে বিয়ে করলে এমন কিছুই হতো না, কিন্তু আমরা যেহেতু দুজনেই চবির স্টুডেন্ট, একটু তো মসলাদার ঘটনা হবেই!’

প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। শরীর হয়ে গেলো অসাড়। অভীকে রহস্যময় মানব মনে হচ্ছে, চোখের সামনে সবকিছুই লাগছে ধোঁয়াশা। এই ছেলে রীতিমতো হ্যালুসিনেট করছে ওকে। প্রিয়তা হঠাৎ করে বললো,
‘ আমায় এখানে ডেকেছিলেন কেন আপনি অভী?’
অভী অদ্ভুত হাসি দিলো। বিনাবাক্যে এগিয়ে গেলো প্রিয়তার কাছাকাছি। প্রিয়তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো৷ আতঙ্কে বললো,
‘ একি আপনি কাছে…
‘ সাট আপ প্রিয়তা! কাছে এসে ভয়াবহ কিছু করবো না। আবার অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যেও না খবরদার। নাহলে আবারও তোমার মতো বস্তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। ‘
প্রিয়তার নাক ফুলে ফেপে উঠলো। রি রি কন্ঠে বললো,
‘ খবরদার কাছে….’

প্রিয়তার বাঁধা মানলো না অভী। অনুমতিবিহীনভাবে নিজের দু’হাত আবদ্ধ করে দিলো প্রিয়তার চুলে। দক্ষতার সাথে চুলে খোপা বেঁধে দিলো। ছন্নছাড়া হয়ে অভীকে পরখ করলো প্রিয়তা৷ বুকে দুরুক দুরুক শব্দ হচ্ছে , ঠোঁটজোড়া নিঃশ্বাসের উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছে অস্বাভাবিকভাবে। অভী চুল ভালোমতো বেঁধে দিয়ে বললো,
‘ নাও পার্ফেক্ট!’
‘ কি করলেন এটা আপনি?’
অভী প্রিয়তার এমন ব্যাবহারে বিভ্রান্ত হলো না। অকপটে বললো,
‘ এজন্যই এখানে এনেছি তোমায় প্রিয়তা। তোমায় তখন দেখামাত্রই এই ইচ্ছেটা জেগে উঠেছিলো। আর এই ভয়ংকর ইচ্ছেটা আমি মোটেও চাইনি বন্ধুবান্ধবদের সামনে পূরন করতে। কাল থেকে এমনিতেও ওরা কম জ্বালায়নি। এমনকি সন্ধ্যার দিকে বাসায় এসেও শিউর হয়ে গিয়েছে বাবার কাছে। আর তুমি কি ভাবো তোমার চুল বেঁধে দেওয়ার মতো কাজ আমি ওদের সামনে করবো? তাই এখানে আসতে বলেছি।’
প্রিয়তা কথা খুঁজে পেলো না। হয়ে গেলো বাক্যহীন।।অভী পুনরুপি বললো,
‘ ঘেমে মুখের কি হালচাল বানিয়েছো খেয়াল আছে? তার ওপর পরেছো পাতলা বেগুনি জামা। খুব শখ সিনিয়র ভাইয়াদের তোমার মর্মান্তিক রূপ দেখানোর?’
প্রিয়তার চোখ ছোট হয়ে এলো। অপমানটা ছ্যাত করে বুকে লেগেছে। বিড়বিড়িয়ে বললো,
‘ আপনার মতো সিনিয়র ভাইয়াদের নিজের রূপ দেখানোর মোটেও ইচ্ছে নেই। নিজেকে কি ভাবেন আপনি? বিল গেটস যে সবার সামনে আমায় তুমুলভাবে এড়িয়ে আড়ালে আবডালে কাছাকাছি আসার চেষ্টা করবেন?’
ভ্রুকুটি করলো অভী। বললো,

‘ তুমি এটাকে কাছাকাছি আসা বলছো?’
‘ একশবার বলছি।’
হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো অভী৷ কঠোর দৃষ্টি নিরূপন করলো। প্রিয়তা হঠাৎ বোকা বনে গেলো। পুরো ঝগড়ার মুড বানিয়ে নিয়েছিলো এখন তবে এই ছেলে চুপ হয়ে গেলো কেনো? প্রিয়তা মনে মনে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
‘ কথা বলেন অভী ভাইয়া। আপনি কথা না বললে ঝগড়া করতে পারবো না।’
বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা কাটালো অভী৷ বললো,
‘ তুমি কি বুঝো যে কাছাকাছি আসার মানেটা কি?’
অভীর কন্ঠ ভরাট, অদ্ভুত এক গাম্ভীর্যতা টের পেলো প্রিয়তা। বিনা সময় ব্যায়েই তাই সে প্রতিউত্তর দিলো,
‘ অবশ্যই বুঝি।’
অভী নিঃশ্বাস ফেললো। অতপর বলে উঠলো,
‘ ফাইন! এট এনি চান্স তুমি যদি আমায় বিয়ে করতে রাজি হও, তারপরই আমি দেখিয়ে দিবো প্রোপারলি কাছাকাছি আসা কিভাবে হয়।’

বলেই ঘটাঘট পদচারণে এই ঘর ত্যাগ করলো অভী। প্রিয়তা নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে রইলো। সারা পরিবেশে বিকট স্থবিরতা। প্রিয়তার কানে অভীর কথাগুলো বেজে চলছে শব্দতরঙ্গের ন্যায়।
চুপচাপ এখান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। অদূরেই আছে অভী তার বন্ধুদের সাথে। প্রিয়তা ঠিকই দেখলো তবে অভী একবারও ফিরে তাকালো না। কে বলবে এই শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র ছেলেটা কিছুক্ষণ আগে তার হবু বউকে এক ভয়ংকর কথা বলে এসেছে?
অদ্রির বরফ গোলা প্রায় শেষ পর্যায়ে। লেমন ফ্লেভারের হওয়াতে ওর ঠোঁট সবুজ হয়ে গিয়েছে। অদ্রি প্রিয়তাকে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘ তুই এমন ব্লাশ করছিস কেন জানু? গাল দেখি টমেটো হয়ে গিয়েছে। আর ইউ ফাইন? আবার কোনো কান্ড করবি না তো?’
প্রিয়তা আমোদী হয়ে গেলো। টের পেলো লজ্জা তাকে আবিষ্ট করেছে। এই লজ্জা তাকে ছেড়ে যাবে না। গালে টুইটুম্বুর হয়ে তা ফুটে থাকবে।

গর্জন উঠেছে আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে নেমে পড়বে বৃষ্টি। প্রিয়তা এসময় এসেছে প্যারীদাস রোডের একটি দোতল বাসায়। মিথি নামের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়েকে ইংরেজি পড়ায় সপ্তাহে তিনদিন। মেয়েটা চরম ফাঁকিবাজ। পড়ালেখা ছাড়া দুনিয়ার যত কারবার তার কাছে আছে।
মিথিরা দুই ভাইবোন। বড় ভাই প্রাণো এইচএসসি পরীক্ষার্থী। বাবা নেই ওদের। বাড়ি ভাড়া নিয়ে কোনোমতে ওদের মা’ই সামলায়। আজকে মিথির মা নাস্তা দিয়ে বললো,
‘ শুনলাম তোমার নাকি নুরুল স্যারের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রিয়তা, আমাদের বলোনি যে?’
প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। মেকি হেসে বললো,
‘ ফাইনাল হয়নি আন্টি।’
‘ আরে ফাইনাল না হলে হয়ে যাবে। তোমার মতো লক্ষী মেয়েকে সবাই ঘরে নিতে চাইবে। আজ আমার ছেলে যদি তোমার চেয়ে বয়সে বড় হতো তবে আমিও তোমায় পুত্রবধূ বানাতাম।’
প্রিয়তা কথা বললো না। মিথির মা এবার বললেন,

‘ মিথির কি অবস্থা পড়ালেখার?’
‘ আন্টি আমি পড়া দিয়ে গেলে তো ও বাসায় মোটেও পড়ে না! ‘
‘ হায় রে, এই মেয়ে আমার সর্বনাশ করবে। পড়ালেখায় একটুও মন নেই তার। তুমি একটু খেয়াল রেখো কেমন? ‘
‘ ঠিক আছে।’
প্রিয়তা আজ ওকে ভালোমতো পড়াতে পারলো না৷ দুটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। হুট করে মিথি বললো,
‘ আচ্ছা আপু মেয়েদের কোন শাড়ি পড়লে ছেলেরা মুগ্ধ হবে?’
প্রিয়তা বড় বড় চোখ করে তাকালো মিথির দিকে। বললো,
‘ তুমি কাকে মুগ্ধ করতে চাও?’
লজ্জার ভান করলো মিথি। অতঃপর বললো,
‘ একজন ছেলে গতকাল আমায় প্রপোজ করেছে আপু। সে বলেছে আমায় নাকি সাদা শাড়ি পড়তে দেখে সে মুগ্ধ হয়েছে।’
প্রিয়তা বিস্ময়ে হা হয়ে রইলো। বললো,

‘ কে সেই হতভাগা?’
‘ আমার সাথেই পড়ে।’
প্রিয়তা শক্ত হওয়ার ভান করলো। বললো,
‘ এসব করার বয়স তোমার হয়নি মিথি। ভালোমতো পড়াশোনা করো।’
মিথি মুখ ভেংচালো। বললো,
‘ তুমি ভীষণ ইয়ে টাইপের। কোনো রস নেই।’

প্রিয়কাহন পর্ব ৭

প্রিয়তার ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে উড়াধুরা মারতে। কিন্তু মারলেও কিছু হবে না। মিথি চরম উড়নচণ্ডী মেয়ে। এই বয়সেই পাড়ার বহু ছেলেকে নাটাই বানিয়েছে। মাঝে মাঝে ওকে দেখে আফসোস হয় প্রিয়তার। তাদের সময় সে ছেলেদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না আর এরা কি সব করে বেড়ায়। হুট করে মিথি বলে উঠলো,
‘ আচ্ছা তুমি কি অভী ভাইয়াকে কখনও চু’মু খেয়ছো আপু?’

প্রিয়কাহন পর্ব ৯