প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৮

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৮
নিশাত জাহান নিশি

চাঁদকে বাড়িতে এনে ডক্টর দেখানো হয়। মাথায় ব্যান্ডেজ এবং কিছু পেইনকিলার দেওয়া হয়। বিয়ের রীতি রক্ষার্থে নীড়ের শ্বশুড় বাড়িতে কেবল আয়মন, সাদমান এবং মাহিন যায়। নূর এবং নীড় বাড়িতে থেকে যায়। মেয়েরা আর কেউ যাওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করেনি। সবাই চাঁদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

রাত বারোটার পর বাড়িতে সাদামাটাভাবে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বিয়ের নিয়ম রক্ষার্থে এক প্রকার বাধ্য হয়ে-ই অনুষ্ঠানটি করা! থমথমে এবং শূণ্যতায় ভরা পরিবেশ বিরাজ করছিল সমগ্র স্টেজ জুড়ে৷ কারো মনে না ছিল খুশির রেশ, মুখে না ছিল হাসির রেখা!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চারিদিকের এতো জমকালো আলো, রোশনাই, ফুলেল সৌরভ, খাবারের বাহারি সুবাস সব যেনো মুহূর্তের মধ্যেই ফিকে পড়ে গেছে! কোনোকিছুতেই আনন্দ উচ্ছ্বাস খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। একটু আগের ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাটার জন্য সবাই ভেতর থেকে বেশ ভেঙে পড়েছে। পুচি এবং পুচির মায়ের জন্য সবাই শোক প্রকাশ করছে!

অধম নেশাখোরটার জন্য মনে মনে ক্ষোভের ঝড় তৈরী করছে! বিশেষ করে চাঁদের সাথে হওয়া দুর্ঘটনাটার জন্য বাড়ির সবার মধ্যে তুখার বিষণ্ণতা বিরাজ করছে! সামিয়া আহমেদ এখনো মেয়ের কথা ভেবে কাঁদছেন। চাঁদ যে এতো বড়ো বিপদ থেকে ফিরে এসেছে তার জন্য উনি আল্লাহ্’র কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন।

নীড় নিজেও এই বিষয়টাতে ভীষণ আপসেট। হলুদের অনুষ্ঠানটাও একরকম নীড়ের অমতেই পালন করা হয়! শুধু তাই নয় সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান জুড়ে চাঁদের অনুপস্থিতি সবাইকে ভীষণ মনম’রা করে তুলেছে। বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসব সব যেনো রসাতলে পরিণত হয়েছে!

প্রায় ঘন্টা খানিক আগে নীড় এবং নূর মিলে পুচি এবং পুচির মা’কে বাড়ির পেছনের দিকটায় দাফন করে এসেছে! অজান্তে তারাও পুচি এবং পুচির মায়ের জন্য ভীষণ আঘাত পেয়েছে! নিষ্পাপ দুটো বিড়ালছানার দিকে তাকিয়ে তারাও অবলীলায় চোখের জল ফেলেছে!

বোবা প্রাণীদের প্রতি এমনিতেও মায়া কাজ করে বেশি। তাদের প্রতি সবার-ই একটা ইমোশনের জায়গা কাজ করে। চাঁদ এখনো এই ব্যাপারে কিছু জানেনা! অসুস্থ শরীর নিয়ে জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় সে বিছানায় পড়ে আছে। কোনোরকম খাওয়া-দাওয়া কিংবা ঔষধ বিষুধ ছাড়াই!

মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এক পর্যায়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম থেকে ওঠে যখন জানতে পারবে পুচি এবং পুচির মা’কে দাফন করা হয়ে গেছে তখন চাঁদের প্রতিক্রিয়া ঠিক কী রকম হবে তা ভেবেই হয়রান সবাই!

নেশাখোর ছেলেটা এখন জেলহাজুতে বন্দি! তার উপর এটেম টু মার্ডারের চার্জ লেগেছে! নীড় এবং নূর মিলে তাকে নিয়ে থানায় গেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এসেছে। পুলিশ এসে ঘটনাচক্র ঘুরে গেছে৷ আহ’ত চাঁদকে দেখে আছে। চাঁদের উপর করা হা’মলার কারণও খতিয়ে গেছে!

চাঁদের জবানবন্দি নিয়েছে। খবরটা শায়লা বেগমের কানে অলরেডি পৌঁছে গেছে! উনি আসছেন দেবরকে জেলহাজুত থেকে ছাড়াতে! যদিও মনে মনে উনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন নেশাখোরটাকে পুলিশ ধরেছে বলে! তবে উনার স্বামীর চাপে পড়ে দেবরকে ছাড়াতে আসা! যাই হোক সংসারটা তো টিকিয়ে রাখতে হবে?

আজ নীড়ের বিয়ে! সকাল আটটা থেকেই বাড়িতে বিয়ের ধুম লেগে গেছে! কে কে নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি যাবে তা নিয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষের মধ্যে নানান স্পৃহা কাজ করছে! হলুদের অনুষ্ঠান যেনো তেনোভাবে উদযাপন করা হলেও বিয়ের অনুষ্ঠান তো আর যেনো তেনোভাবে উদযাপন করা যায় না। সবকিছুরই তো একটা সামঞ্জস্যতা আছে।

সর দিক মাথায় রেখেই এখন বাড়ির থমথমে পরিবেশ এখন বেশ রমরমা হয়ে উঠেছে! সবার মধ্যে আনন্দ, উচ্ছ্বাস এবং উদ্দীপনা কাজ করছে। তাছাড়া বাড়িতে আজ একজন নতুন বউ আসতে চলেছে। বউয়ের সাথে হয়তো আরও অনেক মেহমানও আসতে পারে। বাড়িটাকে তো অন্তত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে?

সেই দিক বিবেচনা করেই বাড়ির মেয়েরা সকাল থেকে বাড়িটাকে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সোহানী প্রায় সবকাজেই সবাইকে সাহায্য করছে। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে সবার মধ্য থেকে চাঁদ মিসিং! চাঁদের শূণ্যতা যেনো সবার মনে খুব দাগ কাটছে।

এইদিকে মাত্র ঘুম ভেঙে উঠেছে চাঁদ। গতকাল রাতের মতোই বিভৎস অবস্থা তার! লেপ্টানো সাজ, এলোমেলো শাড়ি, উসকো খুসকো চুল, মাথার অধিকাংশ অংশ জুড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সব মিলিয়ে সূচনীয় এক অবস্থা। একলা রুমে থাকার দরুন ঘুম ভেঙে ওঠার পর থেকেই চাঁদের কাল রাতের প্রতিটি ঘটনা খুব সূচালোভাবে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে সে হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

পুচি এবং পুচির মায়ের জন্য ফুপিয়ে কেঁদে চলছে! কিছুতেই তাদের দুজনকে মাথা থেকে সরাতে পারছেনা সে! পুচির নীল রঙের মায়াবী চোখজোড়া কেবল তার চোখের সামনে ভাসছে! পুচির ছোটো ছোটো থাবাগুলো সে তার পুরো শরীরে অনুভব করতে পারছে! আদর করে চাঁদের শরীর চাঁ’টার দৃশ্য সবই চাঁদ তীব্রভাবে উপলব্ধি করছে। এসব ভাবতে ভাবতে তার কান্নার রেশ যেনো আরও প্রবল হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে!

কাজের অত্যধিক চাপ থাকার দরুন চাঁদের কথা সবার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায়! সামিয়া আহমেদও সাবরিনা আবরারের সাথে বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই মুহূর্তে চাঁদের কথা কারোর মাথাতেই নেই! বিয়ে বাড়ির হাজারটা চাপ সামলে অন্য কারো কথা মাথায় থাকার কথাও না!

বরযাত্রীতে কে কে যাবে তার একটা লিস্ট হাতে নিয়ে নূর দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদের রুমের সামনে দিয়ে নিচতলার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। রাতে একদমই ঘুম হয়নি তার! থানায় এবং বাড়িতে দৌঁড়োদৌঁড়ি করে নাজেহাল অবস্থা! অদৃশ্য কিছু ভাবনা চিন্তায় সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে! অকারণেই চাঁদকে নিয়ে বড্ড ভেবেছে!

যে ভাবনাগুলো মূলত নূর ভাবতে চাইছেনা সেই ভাবনাগুলোই তার মাথায় বেশি করে ঘুরপাক খাচ্ছে! দীর্ঘ এক রজনী সে ছাদের উপর একা বসে সিগারেট ফুঁকুছে! যতসব আকাশকুসুম ভেবেছে। সকাল হতেই নির্ঘুম দু’চোখ নিয়ে বাড়ির বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘুমের রেশ এখন বেশ ভালোভাবেই ভর করেছে তার দু’চোখে!

তবে কাজের চাপে ঘুমানোর সময় বা সুযোগ কিছুই হয়ে উঠছে না তার। ক্লান্ত এবং ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে নূর যখন চাঁদের রুম ক্রস করে নিচতলার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখনই হঠাৎ চাঁদের ফুঁপানোর আওয়াজ তার কানে তীক্ষ্ণভাবে গেঁথে গেল! অমনি নূর থমকে দাঁড়ালো।

বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না চাঁদের কান্নার আওয়াজ-ই তার কানে ভেসে আসছে। অধীর মনে নূর গতিপথ ঘুরিয়ে চাঁদের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। ব্যাকুল চিত্তে চাঁদের রুমের ভেজানো দরজাটা খুলল। তখনি দেখতে পেল চাঁদ হাঁটু ভাজ করে ফুপিয়ে কাঁদছে!

নূর ভাবুক হয়ে উঠল! দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে চাঁদের পাশে বসল। গলা খাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আর ইউ ফাইন চাঁদ?”
নূরের গলার আওয়াজ ধরতে পেরে চাঁদ কান্নারত অবস্থাতেই মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো! নূর অধৈর্য্য হয়ে উঠল! উদ্বেগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা কী হয়েছে বলো? মাথায় পেইন হচ্ছে? না-কি অন্য কোনো কারণে আপসেট লাগছে?”
চাঁদ নাক টেনে কাঁদল। অস্পষ্ট গলায় বলল,,
“পুচির কথা খুব মনে পড়ছে নূর ভাইয়া! আর একটিবার যদি পুচিকে দেখতে পারতাম!”

কিছু মুহূর্ত মৌন রইল নূর। অতঃপর তব্ধ শ্বাস ছাড়ল। চাঁদকে বুঝানোর বৃথা চেষ্টা করে নমনীয় গলায় বলল,,
“যে চলে যাওয়ার সে তো চলে গেছে চাঁদ। তাকে নিয়ে অযথা ভেবে তুমি কেন তোমার শরীর খারাপ করছ বলো? মানছি পুচির জন্য তোমার একটা সফট কর্ণার কাজ করত, এখনও হয়তো কাজ করে তবে সময়ের সাথে সাথে তা মুছে যাবে আমি এশিওর করছি তোমাকে। এই একই জিনিস নিয়ে এভাবে পড়ে থাকলে চলবে বলো? মুভ অন করা লাগবেনা? নিজেকে তো ভালো রাখতে হবে তাই না?”

অশ্রুসিক্ত রক্তিম দু’চোখে চাঁদ মাথা তুলে নূরের দিকে তাকালো। নির্বাক গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“পেরেছেন আপনি বিচ্ছেদের এতোদিন পরেও রোজ আপুকে ভুলতে? মেয়েটা আপনাকে ঠকিয়েছে জেনেও পেরেছেন তাকে ভুলতে? এখনো কী মায়া কাজ করেনা তার প্রতি? ভালোবাসা কাজ করেনা তার প্রতি? এতোদিন হয়ে যাওয়ার পরেও কেন আপনি মুভ অন করতে পারছেননা বলুন? কেন নিজেকে ভালো রাখতে পারছেন না বলুন?”

নূরের শান্ত রূপ মুহূর্তের মধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠল! চোয়াল শক্ত করে সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো! চাঁদকে লক্ষ্য করে তটস্থ গলায় বলল,,
“আর ইউ ক্রেজি চাঁদ? মানুষের সাথে তুমি একটা প্রাণীর তুলনা করছ? কোথায় প্রাণী আর কোথায় মানুষ? ভেবেচিন্তে কথা বলছ তো? নাকি মাথায় যা আসছে তাই ইডিয়টের মতো বলছ?”

“আমার মাথা সম্পূর্ণ ঠিক আছে নূর ভাইয়া! আমি স্ব-জ্ঞানেই কথাগুলো বলছি। মায়া এবং ভালোবাসা শুধু যে মানব জাতির উপরই কাজ করে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। গোটা সৃষ্টির উপরই সমানভাবে মায়া এবং ভালোবাসা কাজ করে! তাছাড়া মানুষের চেয়ে একটি পোষা প্রাণী ঢেড় ভালো! তারা অন্তত মানুষকে ঠকায় না! মানুষের সাথে ছলনা করতে জানেনা।”
নূর রাগে ফোঁস করে উঠল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“জ্ঞান দেওয়া শেষ হয়েছে তোমার? এবার এখান থেকে ওঠবে প্লিজ? ফ্রেশ হবে? খাওয়া-দাওয়া করে মেডিসিন নিবে? মাঝে মধ্যে তোমাকে না? খুব ইরিটেড লাগে আমার বুঝছ? নিজেও বুঝি না কেন!”
রাগে গটগট করে নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিতেই চাঁদ শক্ত গলায় নূরকে ডাকল! তেজী গলায় বলল,,

“এতোই যেহেতু আমাকে ইরেটেড লাগে তাহলে আমার কাছে আসেন কেন হ্যাঁ? কে বলেছিল কাল আমাকে ওভাবে খুঁজতে যেতে? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারলেন না তখন?”
চোয়াল শক্ত করে নূর পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বাঁজখাই গলায় বলল,,

“খালামনি পাগল হয়ে যাচ্ছিল উনার এই ইডিয়ট মেয়েটার জন্য! কান্নাকাটি করে যাই যাই অবস্থা। এতোগুলো বছর পর খালামনিকে কাছে পাওয়া। সেই খালামনির নাজেহাল অবস্থা আমার একদম সহ্য হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই তোমাকে খুঁজতে যাওয়া! আমার কোনো ঠেকা পড়েনি হ্যাঁ? নিজ থেকে তোমাকে খুঁজতে যাওয়া। এসব ছাড়াও আমার অনেক কাজকর্ম আছে!”

“আপনার দয়া আমার লাগবেনা বুঝছেন? আপনি আমাকে খুঁজতে না গেলেও আমার আয়মন ভাইয়া আমাকে ঠিক খুঁজে বের করত! আপনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।”
তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে নূর তেড়ে এলো চাঁদের দিকে। কোনোদিকে তোয়াক্কা না করে চাঁদের ডান হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“আয়মন ভাইয়ার খুব তারিফ করা হয় না? আয়মন ভাইয়া এই, আয়মন ভাইয়া সেই। আয়মন এটা করেছে, আয়মন ভাইয়া ওটা করেছে। মুখে শুধু তারিফ আর তারিফ! শেষ পর্যন্ত কাল তোমাকে কে বাঁচাতে গেল হ্যাঁ? আমি না তোমার ঐ আয়মন ভাইয়া?”

চাঁদ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! চোখ জোড়া নূরের হিংস্র বাঘের ন্যায় ভয়াল হয়ে উঠল। আগুনের ফুলকির ন্যায় টগবগ করছে। অবিলম্বেই চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। কম্পিত গলায় বলল,,
“হাহাহাতটা ছাড়ুন।”

ঝট করে চাঁদের হাতটা ছেড়ে দিলো নূর। আঙুল তুলে চাঁদকে শাসিয়ে বলল,,
“আর যদি দেখিনা? গতকালের ঘটনার জন্য আবারও কান্নাকাটি করেছ বা আপসেট হয়ে আছো? তো আই টোল্ড ইউ চাঁদ, আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা!”

চাঁদ সরু দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। পুনরায় জেদ দেখিয়ে বলল,,
“করব! আমি একশবার কান্নাকাটি করব। পুচির জন্য আমি আবারও…..”
আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না নূর! চোখ গরম করে চাঁদের দিকে তাকালো। মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“শাট আপ। ইউ জাস্ট শাট আপ। মাথা মুথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার! এক্ষণি তুমি এখান থেকে উঠবে! ফ্রেশ হবে, শাড়ি পাল্টাবে, সেজেগুজে সকালের নাশতা কমপ্লিট করে এরপর মেডিসিন নিবে। কাম অন এন্ড হারি আপ।”

নূরের কথার উপর চাঁদ আর একটা কথা বলারও সাহস পেল না! আতঙ্কিত হয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো! মুখে আঙুল তাক করে দাঁড়িয়ে রইল। রাগ ঝাড়তে না পারলেও ত্যাড়া দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকাল! নূর আবারও ক্ষেপে গেল। মুখমণ্ডলে রাগান্বিত ছাপ ফুটিয়ে তুলল। রক্তিম চোখ দ্বারা বাথরুমের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,,

“যাও বলছি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ হ্যাঁ? ঘাড়ত্যাড়ামো করছ আমার সাথে? নূরের সাথে ঘাড়ত্যাড়ামো করছ?”
চাঁদ থতমত খেলো! বুকে এক গাঁধা থুঃথুঃ ছিটিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে গেল। ভয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ছাড়তে লাগল। ওয়াশরুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিনে গলায় বলল,,

“জল্লাদটা খামোখা আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। এখন দেখছি জল্লাদটা আমার আয়মন ভাইয়াকেও সহ্য করতে পারছেনা! হাউ স্ট্রেঞ্জ!”
নূর কয়েকদফা বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। সামনের চুলগুলো টেনে বিরক্তি প্রকাশ করল। পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করে বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“একে ঠিক এভাবে-ই টাইটে করতে হবে! মিষ্টি মিষ্টি কথায় একে ভুলেও টাইট করা যাবে না! ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে একটা।”
রুম থেকে প্রস্থান নিলো নূর। তক্ষণি হঠাৎ সাদমানের মুখোমুখি হয়ে গেল! সাদমান সন্দেহজনক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। কিয়ৎক্ষণ একই দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ এক ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কীরে তুই? চাঁদের রুমে কী করছিলি?”
নূর কপাল কুঁচকালো। কৌতূহলী গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“আমার কাজিনের রুম আমি কী করছিলাম মানে?”

“চাঁদের প্রতি এখন একটু বেশিই কেয়ারিং মনে হচ্ছে তোকে? আগে কিন্তু এই ভাবটা দেখিনি!”
“স্ট্রেঞ্জ! চাঁদের রুমে আসা নিয়ে তুই এখানে কেয়ারিংয়ের কী দেখলি হ্যাঁ?”
সাদমান দাঁতে দাঁত চাপল! হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে জেদ সামলে বলল,,

“অনেককিছুই দেখছি! যা আমার কাছে রীতিমতো অস্বাভাবিক লাগছে। আমি যা ভাবছি তা যেনো কখনো সত্যি না হয় নূর! তাহলে সবচেয়ে বড়ো আঘাতটা কিন্তু আমি পাব! কথাটা মাথায় রাখিস।”
সাদমান প্রস্থান নিলো! নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ মৌনতায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করল। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“হোয়াট রাবিশ। কী বলে গেল এসব সাদমান? কী এমন দেখছে সে? কী আন্দাজ করতে পারছে? চাঁদ এবং আমার মধ্যে কী আছে? কোন আঘাতের কথা বলে গেল সাদমান? আমি কী চাঁদকে সত্যিই কেয়ারিং করছি? নাকি সাদমানই একটু বেশি ভাবছে?”

মাথাভর্তি প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে নূর ধীর পায়ে হেঁটে নিচতলায় নেমে এলো। এই মুহূর্তে মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে তার! প্রথমত সারারাত ঘুমোয়নি, দ্বিতীয়ত সাদমানের এতোসব অভিযোগ! সব মিলিয়ে নূর ভীষণ ডিপ্রেশানে ভুগছে। এরমধ্যেই হঠাৎ জায়মার সাথে দেখা হয়ে গেল নূরের। কপাল ঘঁষে নূর জায়মার মুখোমুখি দাঁড়ালো। যন্ত্রণায় কাবু হয়ে ধীর গলায় বলল,,

“জায়মা একটু উপরে যাও তো। চাঁদ রুমে একা। আর হ্যাঁ যাওয়ার সময় কিছু খাবার নিয়ে যেও। মেডিসিনটাও ঠিকঠাকভাবে খাইয়ে দিও। খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াবে। যদি এতেও কাজ না হয় দেন আমাকে ডেকে দিবে!”
নূর প্রস্থান নিলো। জায়মা হঠকারি দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। বিস্মিত গলায় বলল,,
“নূর ভাইয়া ঠিক আছে তো?”

দুপুর প্রায় একটা বেজে ত্রিশ মিনিট ঘড়িতে। বরযাত্রী সেজেগুজে তৈরী! নতুন বর হতে শুরু করে বাড়ির প্রতিটি লোক রেডি হয়ে এখন গাড়িতে ওঠার পালা। পাড়ার কয়েকজন মুরুব্বিও আছে বাড়ির লোকজনদের সাথে। সাবরিনা আবরারের দু’একজন বান্ধবীও আছে বটে। পুচি এবং পুচির মায়ের কবরটা দেখে খুব কান্নাকাটি করে চাঁদ মাত্র রেডি হলো! বাড়ির সবার চাপে পড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে রেডি হতে হয়েছে। তার একফোঁটাও মত ছিল না বিয়েতে যাওয়ার! একে তো শারীরিকভাবে সে ভীষণ দুর্বল। দ্বিতীয়ত মানসিকভাবেও খুব ক্ষুন্ন।

লাল শাড়ি পড়ে বাড়ির মেয়েরা তৈরী নীড়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য। বাড়ির ছেলেরা লাল পাঞ্জাবি পড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বাড়ি থেকে বের হলেই এক এক করে সবাইকে গাড়িতে তুলে নিবে। এখন প্রায় সবার মধ্যেই বেশ আনন্দ-উল্লাস কাজ করছে। শুধু নূর ছাড়া! সাদমান সকাল থেকেই নূরের সাথে কথা বলছেনা। নূর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেও বার বার তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে! নূরের ছায়াটিও সাদমান সহ্য করতে পারছেনা! যার কারণে নূর ভেতরে ভেতরে প্রবল দুঃশ্চিতায় ভুগছে। সবার থেকে বেশ দূরে দূরে থাকছে!

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নীড় লাল শেরোয়ানী পড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় এলো! মনে হাজারো আনন্দের রেশ নিয়ে ফুলে সজ্জিত গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক এমন সময় নীড়ের ফোন বেজে উঠল! তাড়াহুড়ো করে নীড় হাতে থাকা ফোনটি চোখের সামনে ধরল। স্ক্রীনে ‘তুলি’ নামটি জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। হাসিমুখে নীড় ফোনটি রিসিভ করল। প্রফুল্ল গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৭

“হ্যাঁ তুলি বল?”
ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলার স্বর ভেসে এলো। নীড়ের ফ্রেন্ড অর্থাৎ তমা উত্তেজিত গলায় নীড়কে বলল,,
“অনু পালিয়ে গেছে নীড়! গতকাল রাতেই তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে! খবরটা এইমাত্র আমার কানে এলো। তাই আগে থেকেই তোকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখলাম।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৯