প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৬

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৬
নিশাত জাহান নিশি

“আলবাত লাগবে। তোমার প্রতিটা বিষয় নিয়েই আমার কথা বলা লাগবে। কিছুদিন পর যখন আমার ঘাড়ে উঠবা তখন তো এমনিতেও আমার কাছে তোমার হাজারটা জবাবদিহি করতে হবে! তাই আগে থেকে প্র্যাক্টিস করে রাখা ভালো না?”
পূর্বের তুলনায় আরও অধিক কঠোর হয়ে উঠল চাঁদ! নাক-মুখ খিঁচে দাঁড়ালো। কৌতূহলী ভাব মিইয়ে তা তুখোর রাগে পরিণত হলো। অবিলম্বেই নাক ফুলিয়ে চাঁদ কর্কশ গলায় শুধালো,,

“পাগল হইছেন যে বাসায় জানে?”
নূর কদাচিৎ হাসল! নাক ঘঁষে চাঁদের অতি নিকটে দাঁড়ালো। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে ভাবলেশ গলায় বলল,,
“জানে বলেই তো পাগলামির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলাম! পাগল হয়ে তোমার মন ছোঁয়ার চেষ্টায় রইলাম!”
চাঁদ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। নূরের বেহায়াপনায় চরম বিরক্ত সে। রাগে গজগজ করে সে নূরকে রীতিমতো হুমকি ধামকি দিয়ে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি না আপনাকে ঠিক গলা টি’পে মে’রে ফেলব! এভাবে কা’মড়ে কুমড়ে আপনাকে ঠিক করা যাবেনা। জানে মে’রে এরপর আপনাকে ঠিক করতে হবে।”
নূর ফিক করে হেসে দিলো। চাঁদের রাগান্বিত মুখমণ্ডলে বিদ্রুপাত্নক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঠাট্টার স্বরে বলল,,

“জানে মা’রলে আমাকে ঠিক করবা কীভাবে হ্যাঁ? ম’রার পর মানুষকে আবার ঠিক করা যায় নাকি?”
চাঁদ তার নির্বুদ্ধিতার জন্য জিভ কাটল। মাথা নুইয়ে নূরের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। পিছু ঘুরে বাড়ির ভেতরের দিকে রওনা হলো। নিচু গলায় বলল,,

“হাত-পা ভে’ঙে এরপর আপনাকে ঠিক করতে হবে বুঝছেন? যখন দেখো তখনই আমার পেছনে লেগে থাকো। কেন ভাই? আপনার কী কোনো কাজকর্ম নেই না-কি?”
উচাটন নূর হয়ে চাঁদের পেছনে পেছনে হাঁটা ধরল। প্রসঙ্গ পাল্টে বেশ তৎপর গলায় বলল,,
“এই চাঁদ শোনো? আয়মনকে তোমার সরি বলা উচিৎ।”

চাঁদ থমকালো। চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটিয়ে তুলল। ভেতরের নিগূঢ় ব্যথায় মাথা নুইয়ে নিলো। ভগ্ন গলায় বলল,,
“প্রয়োজনে পা ধরে ক্ষমা চাইব! তবুও ভাইয়াকে আমি মানিয়ে ছাড়ব। কারণ, এই প্রথমবার আমি আমার ভাইয়াকে এতোটা হার্ট করেছি!”

চোখে জল নিয়ে চাঁদ এক ছুটে আয়মনদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালো। উতলা হয়ে ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপতে লাগল। অস্থিরতায় তার বুকটা ভীষণ কাঁপতে লাগল। কান্নায় গলা জড়িয়ে আসলো। চাঁদের পিছু পিছু নূরও ছুটে এলো। হন্ন হয়ে চাঁদের পাশাপাশি দাঁড়ালো। চাঁদ অসহায় দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“আচ্ছা? আয়মন ভাইয়া কিছু করে বসল না তো?”
নূর বিরক্তি প্রকাশ করল। নাক সিটকে বলল,,
“আরেহ্ ধ্যাত। কিছু করবে মানে? আয়মন কি ছোটো বাচ্চা? যে সামান্য বিষয় নিয়ে অবুঝের মতো কাজ করবে? তাছাড়া মাহিন তো আয়মনের সাথে আছেই। খামোখা দুঃশ্চিন্তা করছ তুমি।”

নূর এবার কলিং বেল চাপার বদলে দরজা ধাক্কাতে লাগল। আয়মনদের ফ্ল্যাট আজ পুরো ফাঁকা আজ। তার বাবা-মা এবং সাব্বির একজন নিকট আত্নীয়ের বার্থডে পার্টিতে গেছে। যে পার্টিটায় না গেলেই নয়। মুখ রক্ষা হবেনা। আয়মনকেও অনেক সেঁধেছিল যাওয়ার জন্য। তবে নূর এবং মাহিনকে পেয়ে আয়মন সাফ না করে দিলো। ফাঁকা বাড়ি দেখে চাঁদ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। খারাপ কিছুর আভাস পেতে লাগল। তিন থেকে চারবার দরজা ধাক্কানোর পর মাহিন দরজা খুলে বের হয়ে এলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নূর এবং চাঁদের দিকে তাকালো। চাঁদ উদগ্রীব হয়ে কিছু বলার পূর্বেই নূর মাহিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী রে? দরজা খুলতে এতো লেইট করলি কেন? দুইটায় মিলে ভেতরে কী করছিলি?”
“আরেহ্ আমি তো একটু ওয়াশরুমে ছিলাম। তাই লেইট হচ্ছিল দরজাটা খুলতে।”
পাশ থেকে চাঁদ ব্যতিব্যস্ত গলায় শুধালো,,
“আচ্ছা আয়মন ভাইয়া কই?”
মাহিন সরু দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। রূঢ় গলায় বলল,,

“কই আবার। রুমে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। একের পর এক সিগারেট গিলছে। কী দরকার ছিল বলো? ওরে এতোগুলো মানুষের সামনে এভাবে ইনসাল্ট করার? দোষ তো তোমার ফ্রেন্ডেরও ছিল তাইনা? তোমার ফ্রেন্ডকেও কিছু বলতে পারতা। তা না করে তুমি একতরফা আয়মনকেই দোষ দিলা?”
চাঁদ ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। রোষভরা গলায় বলল,,

“আমি ঐ ফ্রেন্ডসদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবনা! তাদের নাম্বারটাও ব্লক লিস্টে ফেলে দিব। তাছাড়া তিথী ও তো আপনার গাঁয়ে হাত তুলেছিল ভাইয়া। তাই তাদের দুজনকেই আমি ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আউট করে দিব।”
মাহিন পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। বাঁকা হেসে চাঁদের দিকে তাকালো। বেহায়া গলায় বলল,,
“আচ্ছা যাই করো আর না করো। তিথীর নাম্বারটা আমাকে একটু দিও তো! তার চড়টা শুধু আমার গালে লাগেনি! ডিরেক্ট মনে লেগেছে!”

চাঁদ এবং নূর ভড়কে উঠল! হতবাক দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। নিস্তব্ধতা ভেঙে নূর রুক্ষ গলায় শুধালো,,
“তোর জন্য আমি ঐ জংলী মেয়েটার সাথে ফাইট করে এলাম আর সেই তুই কিনা এখন ঐ মেয়েটার ফোন নাম্বার চাচ্ছিস? তোরা সবাই মিলে কী শুরু করলি হ্যাঁ? একজন তো এতক্ষণ তার ফ্রেন্ডের হয়ে সাফাই গাইল! নিজের ভাইকে সবার সামনে ইনসাল্ট করল, তাকে জঘন্যভাবে আঘাত করল। আর সেই তুই এখন ঐ উড়নচণ্ডী মেয়েটার হাতের চড় খেয়ে মেয়েটার ফোন নাম্বার চাচ্ছিস? হলোটা কী তোদের হ্যাঁ?”

মৃদু হেসে মাহিন মাথা চুলকালো। লজ্জামাখা গলায় বলল,,
“কুচ কুচ হোতা হে ভাই। তু নেহি সামঝেগি!”
আনমনা হয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো মাহিন। তিথীকে সর্বত্র ফিল করতে লাগল। উদাসচিত্তে সে সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ল। পেছনের গদিতে মাথা ঠেকিয়ে নেত্র যুগল বুজে অতি সূক্ষ্মভাবে তিথীকে অনুভব করতে লাগল!

সিক্ত প্রেমের রিক্ত অনুভূতিতে মশগুল হয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল! নূর এবং চাঁদ হতভম্ব হয়ে মাহিনের মজনুগিরি দেখছে। এ যেনো এক নতুন রূপে মাহিনকে আবিষ্কার করছে তারা! মাহিনের এই মিচকে হাসি আর একরত্তিও সহ্য করতে পারলনা নূর। রাগে গাঁ রি রি করে উঠল তার। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে মাহিনের পাশে বসল। মাহিনের শার্টের কলার টেনে ধরে তার মুখোমুখি বসালো! চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“তুই কিছুতেই ঐ মেয়েটার সাথে কোনোরকম সম্পর্কে জড়াবিনা মাহিন। আমি কিন্তু তোকে ওয়ার্ণ করছি।”
মাহিন গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। বিষয়টাকে আমলে না নিয়ে স্মিত হাসল। স্বাভাবিক গলায় বলল,,
“হঠাৎ করে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে আমি কী করতে পারি বল? তার চোখে-মুখে এতো বেশি মায়া কাজ করছিল যে তার মায়ায় আমাকে জড়াতেই হলো!”

নূর চোয়াল শক্ত করল। চোখ গরম করে মাহিনের দিকে তাকালো। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,
“মায়া-টায়া এসব ছাড় মাহিন। ঐ মেয়েকে আমি কিছুতেই ভাবি হিসেবে মেনে নিতে পারবনা। যে মেয়েটা তোর গালে অন্যায়ভাবে চড় মেরেছিল।”

“তুই মানবিনা তো ঘাড় মানবে! আমি যদি ঘাড়ত্যাড়া চাঁদকে ভাবি হিসেবে মেনে নিতে পারি তবে তুই কেন আমাকে চড় মারা মেয়েটাকে ভাবি হিসেবে মেনে নিতে পারবিনা?”

চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো! দুই ভাই ঝগড়ার মধ্যে গোপন কথাটা এভাবে ফাঁস করে দিবে তা সবার ভাবনার বাইরে ছিল। উৎসুক হয়ে চাঁদ মাহিন এবং নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাদের দুজনকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্যে মুখটা হা করল। অমনি নূর লোহিত দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিন তার ভুলের জন্য জিভ কাটল। মিনমিনে দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বাঁজখাই গলায় চাঁদ প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী বললেন মাহিন ভাই? আমি আপনার ভাবি? আপনার কোন ভাইয়ের বউ লাগি আমি?”
মাহিন থতমত খেলো। নূরের রাগমিশ্রিত ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তার কানে তীক্ষ্ণভাবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল! মাহিনের শার্টের কলারটা নূর আরও শক্তপোক্তভাবে চেপে ধরল! ভয়ঙ্কর কিছুর ইঙ্গিত দিতে লাগল। ভয়ে নেতিয়ে উঠল মাহিন! অবুঝ ভাব নিতে বাধ্য হলো। নির্বোধ গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কোন ভাবি? কার ভাবি? তুমি কার কথা বলছ চাঁদ?”
চাঁদ কোমরে হাত গুজল। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“নগদে পল্টি? আপনারা দুই ভাই-ই দেখছি সেইম? কোনো অমিল নেই আপনাদের মাঝে?”

নূর বেশ বুঝতে পারল চাঁদকে এভাবে দমানো যাবেনা। প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলবে মাহিনকে। আর মাহিনও চাঁদের চাপে পড়ে গুপ্ত সব কথা ফাঁস করে দিবে। তাৎক্ষণিক মাহিনের শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলো নূর। শানিত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। নীরস গলায় বলল,,

“তোমার এখানে কী হ্যাঁ? বড়দের মাঝখানে তুমি কী করছ? তোমাকে না একবার বলছি আয়মনকে সরি বলতে? তার রাগ ভাঙাতে? তা না করে তুমি আমাদের দুইভাইয়ের কথার মাঝখানে এসে টক্কর মারছ?”
অপমানিত বোধ করল চাঁদ। নূরের উপর সাংঘাতিক চটে বসল। রাগে ধেই ধেই করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। মনে মনে নূরকে হাজারটা গালি-গালাজ করতে লাগল। চাঁদের যাওয়ার পথে নূর ত্যাড়া দৃষ্টিতে তাকালো। শক্ত গলায় পেছন থেকে বলল,,

“এই একদম গালি-গালাজ করবানা! যদি এখন নাকেমুখে ওঠে না আমার? তো তোমার কিন্তু খবর আছে।”
চাঁদ থমকালো। জিভ কেটে আনমনে বলল,,
“এই লোকটা বুঝল কেমনে আমি তাকে গালি-গালাজ করছিলাম?”
বিস্ময়ে বশীভূত হয়ে চাঁদ পিছু ঘুরে তাকালো। কৌতূহল কাটাতে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী? আমি আপনাকে গালি-গালাজ করছিলাম?”
নূর বাঁকা হাসল। ব্যগ্র গলায় বলল,,
“কু’ত্তা তো মাস্ট বি বলছ!”
তাৎক্ষণিক চাঁদ নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হঠকারি গলায় বলল,,

“বাপরে! এ তো দেখছি অন্তর্যামি! না বললেও মনের কথা সব পড়ে নিতে পারে।”
দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। সোজা আয়মনের বেডরুমে প্রবেশ করল। উন্মুক্ত শরীরে আয়মন বিছানার উপর বসে ধুমছে সিগারেট ফুঁকছে! রাগে-দুঃখে-যন্ত্রনায় তার ভিতরটা সিগারেটের মতোই পুড়ছে।

আয়মনের এই বিমূর্ষ অবস্থা দেখে চাঁদের মনটা পুনরায় ব্যথীত হয়ে উঠল। মাথা নুইয়ে সে গভীর শোকে তলিয়ে পড়ল। ধীর পায়ে হেঁটে আয়মনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। চাঁদকে একনজর দেখামাত্রই আয়মন মুখটা ঘুরিয়ে নিলো! তীব্র রাগ প্রকাশ করল। চাঁদ চুপটি করে আয়মনের মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসল। আয়মনের বিমূঢ় মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে অস্থির শ্বাস ছাড়ল। মায়ামোহ গলায় বলল,,

“আমার দিকে তাকাবে না ভাইয়া?”
আয়মন নিরুত্তর। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে সে দুঃখ নিবারণ করতে ব্যস্ত। চাঁদকে যথেষ্ট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে সে। নাছোড়বান্দা চাঁদও জেদ ধরে বসে আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে আয়মনের পা চেপে ধরল সে! অপরাধী গলায় অনর্গল বলতে আরম্ভ করল,,

“সরি সরি সরি ভাইয়া। প্লিজ একটা বার আমার দিকে তাকাও প্লিজ। তোমার এই ছোটো বোনটাকে মাফ করে দাও প্লিজ। তুমি যতক্ষণ অবধি আমার দিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকাবা না ততক্ষণ অবধি আমি তোমার পা ছাড়বনা।”
আয়মন অধীর হয়ে উঠল। চাঁদের পাগলামো দেখে তার মন ক্রমশ বিগলিত হতে লাগল। চাঁদের দিকে মায়াময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্ষীণ গলায় বলল,

“পা টা ছাড় বলছি চাঁদ।”
“না ছাড়বনা। তুমি যতক্ষণ অবধি আমাকে ক্ষমা করবে না ততক্ষণ অবধি আমি তোমার পা ছাড়বনা।”
“ছেলেমানুষী করিস না চাঁদ। প্লিজ পা টা ছাড়।”
“না ছাড়বনা বললাম তো।”

“তাহলে ঐসময় সবার সামনে আমাকে এভাবে ইনসাল্ট করলি কেন হ্যাঁ?
“ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া! আর কখনো হবেনা।”
“তোর একটা ভুলের জন্য আজ সবার চোখে আমি কালার হয়ে গেলাম। তোর ফ্রেন্ডদের চোখেও ছোটো হয়ে গেলাম। আমাকে নিচে নামিয়ে তুই তাদের উপরে উঠিয়ে দিলি? খুব হার্ট হয়েছি আজ তোর ব্যবহারে। এই প্রথমবার আমি তোর প্রতি এতোটা নারাজ হয়েছি।”

“বোনের একটা ভুল ক্ষমা করা যায়না ভাইয়া? তুমি তো জানো তোমার এই বোনটার মাথায় একদমই বুদ্ধি-শুদ্ধি নেই। শুধু গাঁয়েই লকলক করে বড়ো হয়েছে সে। বুদ্ধিতে বড়ো হয়নি। তবে আমি কথা দিচ্ছি তাশফিয়া এবং তিথীর সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবনা। তারা দুজন-ই আমার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আউট।”

“থাক হয়েছে। কিচ্ছু করার দরকার নেই। তোদের সম্পর্কটা যেরকম আছে সেরকমই থাক। তবে মেয়ে দুটোকে আমি মার্ক করে রাখলাম। যদি পুনরায় আমার সামনে পড়েনা? তো তখন কিন্তু আমি তাদের ছাড়বনা। ফর দ্যা গড সেইক পরের বার আমাকে বেগড়া দিতে আসিসনা।”
“উঁহু৷ আমি আর কখনো তোমাদের মাঝখানে যাব না ভাইয়া। তুমি যেভাবে পারো শোধ নাও! তবে আমাকে এবার মাফ করে দাও।”

মলিন হাসল আয়মন। চাঁদকে তার পা থেকে উঠিয়ে নিলো। চাঁদের দু’বাহুতে ধরে তাকে নিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদকে একাত্নভাবে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। নরম স্বরে বলল,,
“যা হয়েছে সব ভুলে যা। আয়মন কখনো তার ছোট্টো চাঁদের সাথে এতক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেনা!”
চাঁদ মৃদু হাসল। আয়মনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। আন্তরিক গলায় বলল,,

“আমি জানতাম ভাইয়া। তুমি কখনো আমার সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবেনা।”
এরমধ্যেই নূরের আগমন ঘটল দুজনের মাঝখানে। রাগে বোম হয়ে নূর আয়মনের দিকে তেড়ে এলো। নিঠুর গলায় বলল,,
“এই আয়মন তুই মাহিনকে থামাবি কিনা বল? ঐ ঝগড়ুটে মেয়েটার প্রেমে পড়ছে ইডিয়টটা! যে মেয়েটা ওর গালে চড়ে মেরেছে।”

আয়মন রাগে চোয়াল শক্ত করল। চাঁদকে এক ঝটকায় তার বুকের পাঁজর থেকে সরিয়ে সোজা হাঁটা ধরল ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে। রাগমিশ্রিত মুখমণ্ডলে সে খড়তড় গলায় বলল,,
“শত্রুর সাথে প্রেম? ইম্পসিবল!”

মাহিনকে আজ হেস্তনেস্ত করবে বলে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগল আয়মন। চাঁদ উদ্বিগ্ন হয়ে আয়মনকে থামানোর জন্য তার পিছু পিছু হাঁটা ধরল। নূর হঠাৎ পেছন থেকে চাঁদের বাঁ হাতটা টেনে ধরল! প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল,,
“এই কই যাও তুমি?”

চাঁদ দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে সরু দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। অস্থির গলায় বলল,,
“আয়মন ভাইকে থামাতে।”
“এতো পাকামো করতে হবেনা তোমার। আমাকে এখন সময় দিবা তুমি! ঐ কাজটার থেকে এখন এই কাজটা বেশি ইম্পর্টেন্ট।”

চাঁদ বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। নূরের লাগামহীন কথাবার্তায় সে ঘোর তিক্ততা প্রকাশ করল। রূঢ় গলায় বলল,,
“ঢাকা থেকে আসার সময় কার মুখটা দেখে এসেছেন শুনি? এতো ফাও চিল্লাচ্ছেন কেন? আর এসব কী লাগামছাড়া কথাবার্তা বলছেন? বিহেভিয়ার এতো চেঞ্জ কেন?”
“আমার সবকিছুই তো তোমার কাছে লাগামছাড়া মনে হয় তাইনা? এতো অস্বস্তি কেন আমাকে নিয়ে? কী ক্ষতি করছি আমি তোমার হ্যাঁ?”

“কম ক্ষতি করেছেন আমার? দেখা হওয়ার পর থেকেই তো ক্ষতি করে আসছেন। আপত্তি সত্ত্বেও বার বার আমাকে বিরক্ত করছেন।”
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নূর চাঁদের হাতটা ছেড়ে দিলো। অসহ্যকর গলায় বলল,,
“যাও ভাগো। আর ভুলেও আমার সামনে আসবানা।”
ছাড়া পেয়ে চাঁদ স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। ভেংচি কেটে বলল,,

“আমার বয়ে গেছে আপনার মতো ইরেটেটিং একটা ছেলের সামনে পড়তে!”
এক দৌঁড়ে চাঁদ ড্রয়িংরুমে চলে এলো। হিংস্র বাঘের মতো গর্জে ওঠে নূরও চাঁদের পিছু পিছু হাঁটা ধরল। আয়মন এতক্ষণে মাহিনের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েছে! প্রেমে পড়া তার আজ বের করবে। প্রেমের ভূত আজ তার মাথা থেকে নামিয়ে-ই ছাড়বে! দুজনের ফাইটিং দেখে নূর তার আক্রোশ ভুলে গেল। চাঁদকে ছেড়ে মাহিনকে চেপে ধরল! তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদ তাদের তিনজনের পাগলামি দেখতে লাগল। আপাতত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা তার!

রাত প্রায় এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট ঘড়িতে। রাতের খাবার সম্পন্ন করে সবাই যে যার রুমে চলে গেলে ঘুমোতে। নূর এবং মাহিন নিচ তলায় চলে এলো আয়মনদের ফ্ল্যাটে। আয়মনের বেডরুমেই তারা একজোট হয়ে ঘুমুবে। তিনজন মারামারি করে বেশ ক্লান্ত! তবুও মাহিনের মুখ থেকে তিথী নামের শব্দটা তারা দূর করতে পারলনা!

প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্তে সে তিথী নামটাই কেবল জপ করছে। মনে হচ্ছে যেনো তিথী ছাড়া আর কোনো শব্দ-ই নেই এই জগতে। নূর এবং আয়মন অতিষ্ট হয়ে উঠল মাহিনের এই মজনুগিরিতে! তাই তারা এই পিনিক কাটাতে ইমরান হাসমির ওল্ড মুভিগুলো দেখে সেই পিনিক কাটানোর চিন্তা-ভাবনা করল! বন্ধুরা একসাথে হলেই একেকজন ডার্টি মাইন্ডেড হয়ে ওঠে!

চাঁদ এবং জায়মা তাদের পড়ার রুমে বসে একমনে পড়তে ব্যস্ত। দুইদিন পড়েই তাদের পরীক্ষা। রাত জেগে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের হাতে। যে করেই হোক সামনের পরীক্ষাটা তাদের ভালো করতে-ই হবে। দুজনের পুরো আকর্ষণ-ই এখন পড়ার মধ্যে। পুচি একটু আগে-ই চাঁদের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করে কেবলই চাঁদের কোলে ঘুমুলো। এরমধ্যে সোহানীও আবার ফ্ল্যাক্সে করে হট কফি দিয়ে গেছে তাদের দুজনের জন্য। ঘুম পেলে কিংবা বোর লাগলে তারা দুজনই যেনো কফিটা খেয়ে নিজেদের চাঙা করে তুলতে পারে।

রাতের খাবারের পর নীড়ের গরম গরম কফি খাওয়ার অভ্যেস আছে। তাই নীড়ের জন্যও সোহানী এক মগ গরম কফি নিয়ে তাদের বেডরুমে প্রবেশ করল। অমনি সোহানীর আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল নীড়ের দিকে। উন্মুক্ত শরীরে নীড় শুধুমাত্র নিচে একটা জিন্স প্যান্ট পড়ে বিছানার উপর বসে আছে! খুব মনযোগ দিয়ে সে ফোন টিপছে।

নাক-মুখ খাঁড়া হয়ে আছে তার। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছে সে! বিশেষ করে নাকের ডগা-টা তার অতিরিক্ত ফুলে আছে। মনে হচ্ছে যেনো যাকে সামনে পাবে তাকেই সে অ্যাটাক করবে। তাৎক্ষণিক সোহানী শুকনো ঢোঁক গিলল! কাঠ কাঠ গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“এই হনু’মাননটা আবার এভাবে ফুলে আছে কেন? আজ কি আমাকে আস্ত চি’বিয়ে খাওয়ার প্ল্যানিং করেছে?”
সোহানী মানে মানে করে জায়গা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পিছু ঘুরে সামনে পা বাড়াতেই নীড় শক্ত গলায় পেছন থেকে সোহানীকে ডাকল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এই কই যাও? জামাই কি আরও একটা আছে তোমার?”
সোহানী থতমত খেলো। বুকে থুঃথুঃ ছিটালো! অতিশয় বিপাকে পড়ে পিছু ফিরে তাকালো। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আপনি তো ফোনে ব্যস্ত ছিলেন, না? কীভাবে দেখলেন আমাকে?”

ফোনের স্ক্রীন থেকে চোখ উঠিয়ে নীড় ধারালো দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। খরখরে গলায় বলল,,
“তোমার মতো কি আমার মনযোগ শুধু একদিকেই থাকে? প্রতিটা দিকেই আমার সমান মনযোগ রাখতে হয়। এমনি এমনি এতো বড়ো পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছিনা বুঝলে?”
সোহানী উৎকন্ঠিত দৃষ্টিতে নীড়ের শানিত দৃষ্টিতে তাকালো! অধীর গলায় বলল,,

“আমি একটু পরে আসছি হ্যাঁ?”
তড়িৎ বেগে নীড় বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে হেঁটে সোহানীর দিকে এগিয়ে গেল। সোহানী ভয়ে কাঁপতে আরম্ভ লাগল। শঙ্কিত গলায় বলল,,

“আরে আরে কোথাও যাচ্ছি না তো আমি। আপনি এমন করছেন কেন?”
সোহানীর হাত থেকে কফির মগটা ছিনিয়ে নিলো নীড়। ডেস্কের উপর আওয়াজ করে মগটা রাখল। সোহানীকে উপেক্ষা করে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলো। পিছু ঘুরে তেজী গলায় সোহানীকে বলল,,

“যাও। এবার বের হয়ে দেখাও।”
নিরুত্তর সোহানী। এক দৌঁড়ে বিছানার উপর বসে পড়ল! নীড়ের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শঙ্কিত গলায় বলল,,
“কোথাও যাবনা আমি।”

ডেস্কের উপর থেকে কফির মগটা হাতে তুলে নিলো নীড়। বেশ ভাব নিয়ে মগটায় চুমুক দিলো। পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে ভীতসন্ত্রস্ত সোহানীর দিকে তাকালো। শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কফিটা কে বানাইছে?”
সোহানী ভীরু দৃষ্টিতে নীড়ের দিকে তাকালো। শুষ্ক গলায় বলল,,

“আআআমি।”
“আরও একটু চিনি লাগত! মিষ্টি কম হইছে।”
“আচ্ছা আমি চিনি নিয়ে আসছি।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৫

তড়িঘড়ি করে সোহানী জায়গা থেকে ওঠে গেল। সামনের দিকে পা বাড়াতেই নীড় তার বাম বাহু দ্বারা সোহানীর কোমর আঁকড়ে ধরল! রোমাঞ্চকর গলায় বলল,,
“কোথাও যেতে হবেনা তোমাকে। মিষ্টি আমার শরীর ছুঁয়ে আছে! এতোটুকুও বুঝো না তুমি?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৭