প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪১

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪১
নিশাত জাহান নিশি

“তোর নানী চ্যাচালো!”
মাহিন তাজ্জব বনে গেল। চোখে-মুখে অপার বিস্ময়তার ছাপ ফুটিয়ে তুলল। ভ্রুযুগল খড়তড়ভাবে কুঁচকে আয়মনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সন্দেহজনক গলায় শুধালো,,
“আমার নানী চ্যাচালো কই থাইকা হ্যাঁ? নানী তো সেই পাঁচবছর আগেই মারা গেছে। তোর সাথে কি নানীর জ্বীন-ভূত আছড় হইল না-কি? ভাবসাব আমার কিন্তু বেশ অলৌকিক ঠেকছে!”

হাত-পা ঝেড়েঝুড়ে আয়মনের অবস্থা প্রায় বিভীষিকাময়! ভেতরে মাহিনের ঘ্যানর ঘ্যানর, সন্দেহজনক দৃষ্টি, তিথীকে ঘিরে নানান প্রেমপলাপ। আর বাইরে তার চিরশত্রুরা তাকে ভয় পাওয়ার বদলে উল্টো তাকে দেখে মজা নিচ্ছে, মনে মনে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে, তাকে নিয়ে নানান কটুক্তিও করছে, তার বেঁচে যাওয়া ইজ্জতের দফারফা করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যা কল্পনায় আয়মনের চোখে অতি তিক্তভাবে ভেসে ওঠছে! মোট কথা সব মিলিয়ে আয়মনের গাঁ রি রি করছে৷ মাথাটা প্রবল ধরে আসছে। এখনি কোনো একটা চরম প্রতিশোধ নিতে না পারলে তার শান্তি হবেনা। গাঁয়ের জ্বালা গাঁয়েই রয়ে যাবে।

মাহিনকে উপেক্ষা করে আয়মন দ্রুত পা ফেলে তার বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো। মাহিন নির্বোধ দৃষ্টিতে আয়মনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। পেছন থেকে আয়মনকে ডেকে বলল,,
“এই কই যাস তুই? কী হইছে তোর বল তো? পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিস কেন?”
আয়মন এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালোনা। এমনকি পিছু ফিরেও তাকালোনা। তার লক্ষ্যে সে স্থির হয়ে রইল। শাণিত গলায় প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

“একটু সময় দে ভা’তার! তোর জন্য এক কাপ তিথী আনতে যাব! তিথীকে গুলে চায়ের সাথে মিক্স করে খাওয়াব! খুব শখ না তিথীকে খা’ওয়ার? সেই শখ মিটিয়ে দিব!”

মাহিন এবার চটে গেল! তিথীকে নিয়ে কটুক্তি তার গাঁয়ে বেশ জ্বালা ধরালো। সকাল সকাল তিথীকে নিয়ে এহেন অহেতুক বিদ্রুপ তার সহ্য হলো না! তাই সে গলায় কঠোরতা এনে তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে বলল,,
“তোর মাথা গেছে শা”লা। সকাল সকাল লাড়া চাড়া শুরু হইছে! এতো লাড়লে বিয়ে করছ না কেন? বিয়ের বয়স তো কম হইলনা। এখনই কীসব খাওয়াদাওয়া নিয়া পড়ছস! সকাল সকাল গোসল করার অভ্যেসটা ছাড় এবার! ঘুমের মধ্যে খাওয়াদাওয়া বন্ধ কর!”

মাহিনের কোনো কথাই আয়মন কানে তুললনা। এখন তার একটাই লক্ষ্য চিরশত্রু নিধন করা! শর্টস পাল্টে সে এখন প্যান্ট-শার্ট পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মনে মনে তাদের দুজনকে শাস্তি দেওয়ার পন্থা খুঁজতে লাগল! কেন তারা দুজন আজ জেচে এই বাড়িতে এলো তার কারণ জানার জন্য সে ছটফট করতে লাগল। তাড়াহুড়োর কাজ সবসময় দেরি হয় বলেও একটা কথা আছে। যা এখন আয়মনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে!

এতে তার রাগ আরও দ্বিগুন বেড়ে উঠছে। আয়মনের যাওয়ার পথ থেকে মাহিন তার ধারালো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাথাটা ঝেড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এক্ষণি তাকে গরম এক কাপ চা অথবা কফি কিছু একটা খেতে হবে। নতুবা মাথায় চেপে বসা প্রচণ্ড ব্যথা তাকে অস্থির করে তুলবে। শরীরটাও ভালো হবেনা।

আর মন-মর্জিও ঠিক হবেনা। ধীর পা ফেলে মাহিন ফ্ল্যাটের মেইন ডোর খুলতেই হঠাৎ দু’কদম পিছিয়ে গেল! দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড়িয়ে তাশফিয়া এবং তিথী ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে গেল! তারা দুজনই দরজায় আড়ি পাতছিল! যার কারণে দরজা খোলার সাথে সাথেই দুজন দরজা থেকে সরে এসে আপনাআপনি ফ্ল্যাটের ভেতরে চলে এলো।

মাহিন দিনের আকাশে চাঁদ দেখার মতো অবাক হলো! হতভম্ব দৃষ্টিতে তাশফিয়া এবং তিথীর দিকে অস্থির দৃষ্টি বুলাতে লাগল। তাশফিয়া এবং তিথী লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। দুজনই আড়চোখে আড়ষ্ট দৃষ্টিতে দুজনকে দেখতে লাগল। হাত-পা কচলে জড়তা প্রকাশ করতে লাগল। মনে মনে নিজেদের হাজারটা বকা দিতে লাগল। কীভাবে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়িয়ে যাবে তার পথ খুঁজতে লাগল।

মাহিন পুনরায় তার মাথা ঝাড়লো। চোখ কচলে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের দুজনের দিকে তাকালো। আবারও তার চোখকে অবিশ্বাস করল! এসব কী দেখছে সে? সত্যি সত্যিই কী তিথী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? তার প্রথম প্রেম তার সামনে এতটা অভাবনীয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে?

আর সে কিনা এভাবে অপ্রস্তুতভাবে নিজেকে তার কাছে জাহির করছে? সামান্য টাউজার আর টি-শার্ট পড়ে? চোখে-মুখে অবসন্নতা নিয়ে? এতোটা উচ্ছৃঙ্খল সে কীভাবে হলো? ইমপ্রেশন তার সব গেল। তিথীকে পটানো আর সম্ভব হলো না বলে! আর এক মুহূর্ত ব্যয় করলনা মাহিন। মুখ লুকিয়ে উল্টা পথে হাঁটা ধরল। বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“শিট। হাউ আনস্মার্ট আই এম! কাপড়-চোপড়ের নাই ঠিক। মুখ-চোখের নাই ঠিক। এই লুকে আমি তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম? যদি রিলেশান হওয়ার আগেই ব্রেকআপ হয়ে যায় তখন আমার কী হবে বাপ?”

হায়-হুতাশ করতে করতে মাহিন আয়মনের বেডরুমের দিকে অগ্রসর হলো৷ নিজেকে হ্যান্ডসাম লুকে তিথীর কাছে প্রেজেন্ট করার লক্ষ্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। অমনি তিথী এবং তাশফিয়া হঠকারী দৃষ্টিতে চোখ তুলে মাহিনের যাওয়ার পথে তাকালো। হুট করেই তিথী অপরাধী গলায় পেছন থেকে মাহিনকে ডেকে বলল,,

“ভাইয়া সরি প্লিজ। ঐদিনের বেয়াদবির জন্য সত্যিই আমি খুব লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। আপনি প্লিজ এভাবে আমাকে হতাশ করে চলে যাবেননা ভাইয়া। আমার প্রতি কোনো রাগ, অভিমান বা ঘৃণা পুষিয়ে রাখবেননা।”
মাহিন থমকালো। ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। পিছু না ফিরেই তিথীকে উদ্দেশ্য করে ইতস্তত গলায় বলল,,

“পরে এই বিষয় নিয়ে আমি কথা বলছি। আপনারা প্লিজ বসুন। দশমিনিট সময় দিন আমায়। আমি এক্ষুণি আসছি।”
দ্রুত পা ফেলে মাহিন প্রস্থান নিলো। নিজের ইমেজ রক্ষার্থে ছুটে চলল। তিথী এবং তাশফিয়া দুজন দুজনের দিকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকালো। দুজনই ঠোঁট উল্টিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মৌনতা ভেঙে তাশফিয়া হাফছাড়া গলায় তিথীকে বলল,,
“কী আর করার? চল আমরা বসি গিয়ে। মা ও আমাদের সাথে এলো না! হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল।”
তিথী অস্থির শ্বাস ছাড়ল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“শোন না? ঐ আয়মন ছেলেটাকে আমার মোটেও সুবিধার লাগছেনা! আমাদের দেখেই কেমন ভয়াল হয়ে উঠেছিল। রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ছেলেটা যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে বসে তখন?”

ইতোমধ্যেই আয়মন ফায়ার লুক নিয়ে হনহন করে ড্রয়িংরুমে ছুটে এলো! ডিপ ব্লু রঙের শার্টের হাতজোড়া ফোল্ড করতে করতে সে রুদ্রময় রূপ ধারণ করে তাশফিয়া এবং তিথীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তৎক্ষনাৎ ভয়ে দুজন আঁতকে উঠল! বুকে থুঃথুঃ ছিটিয়ে দুজন হাত ধরাধরি করে অসম্ভব কাঁপতে লাগল। তাদের ভয় দেখে আয়মন বেশ ভাব নিলো। দুজনের দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“এবার চিল্লাইয়া দেখাও! আমাকে নিয়া হাসি-ঠাট্টা কইরা দেখাও।”
তাশফিয়া শুকনো ঢোক গিলে আয়মনের দিকে তাকালো। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সে একটা ভয়ঙ্কর বুদ্ধি মাথায় আনল! থমথমে গলায় আয়মনকে বলল,,

“এবার তো আপনাকে পুরো আগুন লাগছে ভাইয়া! ফিল্মের হিরোদের মতো ডেশিং লাগছে! পুরা কিলার লুক। আমি চোখ বুজে বলতে পারি ভাইয়া, যেকোনো মেয়ে আপনাকে এই লুকে দেখলে আপনার প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেই হবে!”
আয়মন ফুসলে গেল! ক্রোধ ভুলে খানিক চোখে পড়ার মতো লজ্জায় ভুগল! মেয়েদের মতো ব্লাস করতে লাগল। গলা ঝেড়ে শার্টের কলারটা টেনে ঠিক করতে লাগল। তিথী আড়চোখে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। তাশফিয়া বাঁকা হেসে ইশারায় তিথীকে বলল,,

“ব্যাটা পটে গেছে!”
তিথী মুখ চেপে হাসতে লাগল। মনে মনে তাশফিয়াকে বাহবা দিতে লাগল। হাসি বন্ধ করে তাশফিয়া ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। আয়মনকে আরও একটু গলানোর চেষ্টা করল। ঝেড়ে কেশে পুনরায় নাজুক স্বরে বলল,,
“সত্যিই বলছি ভাইয়া আপনাকে আজ একটু বেশিই সুদর্শণ লাগছে! সিরিয়াসলি কথাটা বলার সময় আমার গাঁয়ের লোমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠছিল! মানে ছেলেরা কি এতোটাও সুদর্শন হয়? ওহ্ মাই গুডনেস! আই কান্ট বিলিভ ইট।”

আয়মন বেশ ভাবুক হয়ে উঠল। ভূতের মুখে রাম নাম শুনে তার সন্দেহ যেনো দ্বিগুন বেড়ে গেল। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা তাশফিয়া তার সাথে ছলনা করছে! তাকে লক্ষচ্যুত করার জন্য খামোখা তারিফ করছে। মাথায় পুনরায় রাগ চেপে বসল আয়মনের। হিংস্র দৃষ্টিতে সে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। তটস্থ গলায় বলল,,

“নাটক করো হ্যাঁ? নাটক? কী ভাবছ তুমি? আমি কিছু বুঝি না? বাচ্চাদের মতো পিটার খাই আমি? নাক টিপলে দুধ বের হয় আমার? তুমি যে কথাগুলা বলছ না? এসব কথা আমি খাইও না! আয়মনকে শান্ত করা কী এতোই সহজ?”
তাশফিয়া এবং তিথী পুনরায় ভয় পেয়ে গেল! দুজনই মনে মনে আল্লাহ্’র নাম জপ করতে লাগল।

এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য দিশা খুঁজতে লাগল। তিথী চাইলেও এই মুহূর্তে রাগ দেখাতে পারছেনা! কারণ, অসুস্থ জেসমিন হক বারবার করে তাকে বারণ করে দিয়েছেন কারো সাথেই যেনো সে খারাপ আচরণ না করে, অহেতুক রেগে না যায়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলে আসে। সেই কথার রেশ ধরেই তিথী দাঁতে দাঁত চেপে সব অপমান সহ্য করে নিচ্ছে। কোনো দিশা খুঁজে না পেয়ে তাশফিয়া এবার ভয়ার্ত গলায় হঠাৎ আয়মনকে বলল,,

“দেখুন ভাইয়া আমি একটু চাঁদ এবং জায়মার সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ একবার সুযোগ করে দিন আমায় তাদের সাথে দেখা করার। কথা দিচ্ছি তাদের সাথে দেখা করেই আমরা আমাদের মধ্যে হওয়া ভুল বুঝাবুঝিটা প্যাচ আপ করে নিব।”
“একসেকেণ্ড একসেকেণ্ড। প্যাচ আপ করা মানে কী বুঝাইলা হ্যাঁ? শুধু কী সরি বলার জন্যই বাঘের গর্তে এসে ঢুকলা? প্যাচ আপ করা কী এতোই সহজ নাকি?”

তাশফিয়া মাথা নুইয়ে নিলো। ভাবনাচিন্তা ভুলে বিষণ্ন মনে নিচু স্বরে বলল,,
“প্রয়োজনে আমরা আপনাদের পা ধরে ক্ষমা চাইব ভাইয়া! মা বলেছেন ক্ষমা চাইতে কোনো লজ্জা নেই।”
আয়মন হু হা শব্দে হেসে দিলো! তাশফিয়ার নিচু হওয়াকে সে হেয়ালিপনা বলে ভেবে নিলো। বুকে হাত রেখে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,

“সিরিয়াসলি? তোমরা আমাদের পা ধরে ক্ষমা চাইবা? এখন এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে ভাই? টোটালি আনবিলিভঅ্যাবল! কেমনে পারো এতো নাটক করতে হ্যাঁ?”
তিথী এবার মুখ খুলল। দৃষ্টি উঁচিয়ে আয়মনের দিকে তাকালো। নম্রতা বজায় রেখে জোরপূর্বক হেসে বলল,,

“আপনি আমাদের ইমোশন নিয়ে হাসি-তামাশা করছেন ভাইয়া? আমরা কি এতোটাই খারাপ যে আমাদের কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা?”

ইতোমধ্যেই তাদের মাঝখানে মাহিনের উপস্থিতি ঘটল! কালো এবং সাদার কম্বিনেশনে আয়মনের একটা চেক শার্ট পড়ে সে নিজেকে মারাত্মক হ্যান্ডসাম লুকে তিথীর সামনে জাহির করল! তিথী আকস্মিক ড্যাব ড্যাব চোখে মাহিনের দিকে তাকালো! এই মার ডালা লুকে মাহিনকে দেখে সে তব্ধিত হয়ে গেল! শার্টের কলারটা সমতল করে মাহিন উপস্থিত তিনজনের দিকে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এলো। তৎপর গলায় বলল,,

“কে কার কথা বিশ্বাস করছেনা হ্যাঁ? কী হচ্ছে এখানে?”
আয়মনের দৃষ্টি সূচালো হয়ে উঠল। মাহিনের গাঁয়ে তার পছন্দের শার্টটা দেখে তার রাগ ওঠে গেল! মাহিনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সে খরখরে গলায় মাহিনের কানে মুখ ঠেকিয়ে বলল,,
“কী রে ভা’তার? নানীকে ইমপ্রেস করার জন্য আমার পছন্দের শার্টটাকেই টার্গেট করলি? দুনিয়ায় আর কোনো শার্ট পাইলি না?”

মাহিন দাঁতে দাঁত চাপল! শাণিত গলায় বিড়বিড় করে বলল,,
“চুপ কর শা’লার ব্যাটা! কখন থেকে কী নানী নানী করছিস? সি ইজ মাই লাভ! মাই প্রেজেন্ট, মাই ফিউচার, মাই ইস্ট, মাই ওয়েস্ট এন্ড অল অফ মাই ওর্য়াল্ড!”

“ভাই থাম থাম। হাসি পেয়ে যাচ্ছে আমার। নূরের মতো তোরও ছ্যাকা খাওয়ার পিনিক ওঠছে বুঝলি? তাই চোখে-মুখে এখন সরিষার ফুল দেখছিস! নেশা কেটে গেলে লাভ শাভও কেটে যাবে।”

ওয়াশরুম থেকে “ইয়ে” সেরে নূর মাত্র চোখে-মুখে চরম তিক্ততা এবং আড়ষ্টতা নিয়ে কুজো ভঙ্গিতে দরজার বাইরে বের হয়ে এলো! ধীর পা ফেলে সে নিজেদের রুমে না ঢুকে নীড়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। বড়ো সড়ো বিপদের মুখোমুখি পড়েছে সে। যে বিপদ থেকে আপাতত নীড় ছাড়া অন্য কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারবেনা!

পথিমধ্যেই হঠাৎ চাঁদের মুখোমুখি পড়ে গেল নূর! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অন্তপ্রাণ চেষ্টা করল। তবে শেষ অবধি তা সম্ভব হলোনা। তাকে পুনরায় প্যান্টের চেইন ধরেই কুজো ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হলো! মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“সাইক্লোনটার এখনই আসার সময় হলো? মান-ইজ্জত আর রইলনা আমার! গেল গেল সব বিসর্জন গেল! প্রেম-ভালোবাসার আগেই সব ইমেজ গোল্লায় গেল!”

চাঁদ কোমরে হাত গুজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নূরকে দেখতে লাগল। মাঝে মাঝে ভ্রু যুগল উঁচিয়ে নূরের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিও নিক্ষেপ করতে লাগল। ফেলুদা’র মতো সন্দেহজনক দৃষ্টি তার। যেনো আটঘাট বেঁধেই সে গোয়ান্দাগিরিতে নেমে পড়েছে! ব্যাপারটায় নূর বেশ হাইপার হলো! চাঁদের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“কী দেখো হ্যাঁ? সামনে থেকে সরো।”
চাঁদ ঘাড়ত্যাড়ামো করল। একচুলও জায়গা থেকে নড়ল না! উল্টো বুকের পাঁজরে দু’হাত বেঁধে ট্যাড়াব্যাকা দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। উদ্বেগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ওখানে হাত দিয়ে কী ঢাকছেন হ্যাঁ? কী আছে ঐ জায়গায়? দেখি দেখি?”
নূর থতমত খেলো। যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো। চাঁদ তার ইজ্জত নিয়েই ছিনিমিনি খেলা ধরল! চাঁদের থেকে অস্থির দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নূর। এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেলে মিনমিনে গলায় বলল,,

“দেখ! কোথায় দৃষ্টি পড়েছে এই মেয়েই। আমিই দিন কী দিন মেয়েটাকে খারাপ করে তুলছি! আদর-সোহাগ করতে করতে লজ্জা কাটিয়ে তুলছি!”
রাগী ভাব নিলো নূর। ভালো কথায় চিঁড়ে ভিজবেনা বেশ বুঝতে পারল সে। তৎক্ষণাৎ চাঁদকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নূর তার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো! আবারও কুজো ভঙ্গিতে নীড়ের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। যেতে যেতে রুক্ষ গলায় বলল,,

“দাঁড়াও আগে বিপদটা সেরে আসি। এরপর আমি তোমার ক্লাস নিব! বেশি পাকা হয়ে গেছ না? ঐখানে কী হইছে এটা পরে দেখাব!”
চাঁদ বেকুব দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মুখটা ফুলিয়ে আশ্চর্যজনক গলায় বলল,,
“যাহ্ বাবা। এর আবার কী হলো? কী লুকালো আমার থেকে? কী এমন বেফাঁস কথা বলে ফেললাম আমি? আমি কী এখন তাকে ফলো করব?”

যে ভাবা সেই কাজ। পা টিপেটিপে হেঁটে চাঁদ পাতি চোরদের মতো নূরকে ফলো করতে লাগল! আজ নূরের কারসাজি সে ধরবেই ধরবে। প্যান্টের চেইন সামলে নূর এক দৌঁড়ে দরজায় কোনো নক-টক ছাড়াই নীড়ের রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল! অমনি নিজের বিবেচকহীনতার জন্য তাকে লজ্জার সম্মুখীন হতে হলো!

যা নূর ক্ষণিকের জন্যও ভাবেনি! নীড় এবং সোহানী দুজন দুজনকে ছেড়ে দুই থেকে তিন ফুট দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো! কফি খাওয়ার বাহানা করে নীড় সুযোগ বুঝে সোহানীকে রাগানোর পায়তারা খুঁজছিল। সোহানীকে বারবার শাড়ি ঠিক করতে বেগড়া দিচ্ছিল! এই রোমাঞ্চকর মুহূর্তেই হঠাৎ তাদের নূরের আগমন ঘটল। যা তাদের তিনজনকেই লজ্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো।

উশখুশ করে নূর গলা ঝাড়লো। তৎক্ষনাৎ পিছনের দিকে মুখটা ফিরিয়ে নিলো। লজ্জায় চোখ টিপে বন্ধ করে নিলো। ইতস্তত গলায় সোহানীকে বলল,,
“ভাবী তুমি একটু বাইরে যাবা? ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কাজ আছে!”

সোহানী অপ্রস্তুত হয়ে নূরের দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে সে সম্মতি জানালো। নীড়ের মাথা-মুথা হুট করে গরম হয়ে গেল! এই প্রাইভেট টাইমিংয়ে নূরের আগমন তাকে বেশ ঘাটালো! কী আর করার। পরিস্থিতি তো মানতেই হবে। ছোটো ভাইকে তো আর ধাক্কা দিয়েও রুম থেকে বের করে দেওয়া যাবেনা। সোহানী একবার আড়চোখে নীড়ের গম্ভীরতায় ভরা মুখমুণ্ডলের দিকে তাকালো। অতঃপর সে শাড়ির কুচিটা সামলে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীড় মাথা চুলকে সোহানীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে বলল,,

“এই কাছেই থাইকো। কাজে টাজে লেগে পইড়ো না আবার।”
সোহানী লজ্জা রাঙা মুখে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীড়ের আহ্লাদিপনা দেখে তার খুব হাসি পেল। চোখে চোখে বউকে হারাচ্ছে একদম। যা সোহানী প্রথম থেকেই চাইছিল! নূর মনে মনে বেশ বিব্রতবোধ করল। ধমকের স্বরে নিজেকে বলল,,
“ওহ্ শিট! ভাইয়া-ভাবির প্রাইভেট টাইমেই আমাকে আসতে হলো? মহা আহা’ম্মক তো আমি।”

সোহানী দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে বের হতেই নীড় পিছু ঘুরে রুক্ষ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে রূঢ় গলায় শুধালো,,
“এই কী সমস্যা তোর হ্যাঁ? বিয়ার পরেও আমাকে শান্তি দিবিনা নাকি?”
নূর মুখটা কাচুমাচু করে নীড়ের দিকে এগিয়ে এলো। প্যান্টের চেইনে হাত রেখে বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে নিলো। অসহায় গলায় বলল,,

“চেইনটা লেগে গেছে ভাইয়া! আই থিংক আমার ওয়েট কিছুটা বেড়েছে। তাই কাল থেকেই এই প্যান্টটা আমার কোমরে কেমন চিপা চিপা লাগছে! চেইন খুলতে লাগাতেও অসুবিধা হচ্ছে।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪০

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চাঁদ অট্ট হেসে উঠল! মুখ টিপে ধরে দম ফাঁটা হাসিতে মরে যাচ্ছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাত-পা ঝেড়ে হাসতে লাগল সে। পাশ থেকে সোহানী চাঁদের মাথায় জোরে এক গাড্ডা মারল! দাঁতে দাঁত চেপে মন্থর গলায় বলল,,
“বেশরমের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আঁড়ি পাতছিল কেন হ্যাঁ? দিন দিন তো বড্ড বে” য়াদব হয়ে উঠছিস তুই। কিছু বলছি না দেখে খুব সাহস পেয়ে গেছ না?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪২