প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪২

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪২
নিশাত জাহান নিশি

“বেশরমের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আঁড়ি পাতছিলি কেন হ্যাঁ? দিন দিন তো বড্ড বে”য়াদব হয়ে উঠছিস তুই। কিছু বলছি না দেখে খুব সাহস পেয়ে গেছিস না?”

অতিরিক্ত চাপা হাসির প্রভাবে চাঁদের চোখের কোটর জুড়ে জল চিকচিক করে উঠল। ফুলকো গাল দুটো টমেটোর মতো লাল টগবগে রূপ ধারণ করল। দমটা যেনো তার বন্ধ হয়ে আসছিল! সোহানীর দিকে এক পলক হাসোজ্জল দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাঁদ বিদ্রুপাত্নক গলায় বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“দেখলে আপু? তোমার দেবর এখনও প্যান্টের চেইন-ই লাগাতে শিখলনা! কতোটা বাচ্চা প্রকৃতির এই ছেলে!”
সোহানী এবার নিজেও ফিক করে হেসে দিলো! দস্তুর মতো চাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। নূরের দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নীড়! নূরের কাচুমাচু ভাব দেখে কপাল চাপড়ালো সে। শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“মানে এখনও চেইনের প্যান্টটা কীভাবে কায়দা করে লাগাতে হয় এটাও শিখলিনা? অথচ দুইদিন পরে বিয়ে দিলে তিন/চার বাচ্চার বাপ হয়ে যাবি!”
নূর ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল! মাথা নুইয়ে জিভ কাটল। লজ্জামাখা গলায় বলল,,

“কম বললে ভাইয়া! তোমার শা’লীকে তো আমি ফুটবল টিমের জননী বানিয়ে ছাড়ব-ই ছাড়ব! শুধু একবার বিয়েটা হতে দাও! সব ভাইদের তুলনায় আমি চ্যাম্পিয়ান হয়ে দেখাব!”
নীড় ভ্রু কুচকালো। সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কিছু বললি?”
নূর থতমত খেলো। মাথা উঁচিয়ে নির্বোধ দৃষ্টিতে নীড়ের দিকে তাকালো। অস্ফুটে গলায় বলল,,
“কিকিছু না তো।”

নীড় বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল! শার্টের হাতা ফোল্ড করে নূরের প্যান্টের চেইনের দিকে এগিয়ে এলো। নিরুপায় হয়ে প্যান্টের চেইনটা সে নিচ থেকে উপরে তোলার প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে পড়ল। নূরের বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল! তবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে তাকে অবশ্যই এখন অস্বস্তিকর কাজটাই করতে দিতে হবে।

চাঁদ আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়ালো না। দৌঁড়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে সে সোজা নিচতলায় নেমে এলো। কারণ ফ্ল্যাটের ভেতরে সে মন খুলে একফোঁটাও হাসতে পারছে না। হঠাৎ কারো চোখেন সামনে পড়লেই তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলবে। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর সে মুখ ফুটে বলতে পারবেনা! লজ্জায় মরণ হয়ে যাবে। কুজো হয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ কোমরে দু’হাত গুজল। প্রাণ খুলে হু হা শব্দে হেসে উঠল। অস্ফুটে গলায় বলল,,

“খোদা এ কোন মহা এলিয়েনের পাল্লায় পড়লাম আমি? এতো বড়ো ছেলে নাকি এখনো প্যান্টের চেইনটাও খুলে লাগাতে পারেনা? এ আমি কী দেখলাম মাবুদ? কী শুনলাম এসব?”

ইতোমধ্যেই নিচতলার ফ্ল্যাট থেকে হাঁক ডাকের শব্দ ভেসে এলো চাঁদের কর্ণকুহরে! হকচকিয়ে উঠল চাঁদ। হাসি থামিয়ে উদ্বেগী হয়ে উঠল।ফ্ল্যাটের ভেতরে কী চলছে তা জানতে উৎসুক হয়ে উঠল। চক্ষুজোড়া কৌতূহল এবং বিস্ময় নিয়ে চাঁদ ফ্ল্যাটের দরজায় কান পাতল। অমনি তার কর্ণতলে মিহিভাবে ভেসে এলো তাশফিয়ার নরম কণ্ঠস্বর! থমথমে গলায় সে আয়মনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“প্লিজ ভাইয়া যা হয়েছে সব ভুলে যান এবার। রেষারেষিটা এখানেই সমাপ্ত করুন প্লিজ। আমি তো আপনার ছোটো বোনের মতো তাইনা? ছোটো বোনের একটা অন্যায় কী মাফ করা যায়না?”

আয়মন রাগে ফোঁস করে উঠল! কেন জানিনা “বোনের মতো” কথাটা শুনতেই রাগে তার গাঁ টা গরম হয়ে এলো! শরীরে প্রবল তিক্ততা কাজ করতে লাগল। তাশফিয়াকে ধরে কেলাতে মন চাইল। দু’চারটা চড় দিয়ে বলতে ইচ্ছে করল,,
“তুমি আমার কোন জা’তের বোন লাগো হ্যাঁ? ছেলে মানুষ দেখলেই শুধু ভাই বানাতে মন চায়?”
চোয়াল শক্ত করল আয়মন। পেছনের চুলগুলো টেনে ভয়ঙ্কর শ্বাস ছাড়ল! খরখরে গলায় তাশফিয়াকে বলল,,

“চাঁদ ছাড়া আমার আর কোনো ছোটো বোন টোন নেই ওকে? ফারদার এই কথাটা যদি বলছ না? তো আই ওয়ানা কি”ল ইউ ওকে? একদম জানে মেরে ফেলব। যখন যাকে দেখো তাকেই ভাই বানিয়ে দাও। অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব।”
তাশফিয়া শুকনো ঢোঁক গিলল। আয়মনের অত্যধিক রাগমিশ্রিত মুখমণ্ডল থেকে ভয়াল দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঝট করে মাথাটা নুইয়ে নিলো! বিড়বিড় করে বলল,,

“এরে তো তেল মারতে মারতে তেলের দাম আরও বাড়িয়ে দিলাম! এখন তো কিছুতেই সেই দাম কমানো যাবেনা। নম্রতাও এই লোকের জেদের কাছে হার মেনে গেল। তবে যে মা বলল নম্রতার উপরে আর কোনো অস্ত্র নেই!”

মাহিন অন্তপ্রাণ চেষ্টা করছে তিথীকে একটুখানি পটানোর! পানি খাওয়ানোর বাহানা দিয়ে তাকে রান্নাঘর অবধি নিয়ে এসেছে সে! প্রাইভেটলি কিছু কথা বলার জন্য। তিথীর মনের হালচাল বুঝার জন্য। তাদের সম্পর্কটাকে আরও একটু সহজ করার জন্য। তিথীর সাথে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। এতে করে তিথী খুব সহজে-ই মাহিনের সাথে মিশে যেতে চাইবে। তিথীকে নিজের করে তুলতেও তার সুবিধা হবে।

পানিভর্তি গ্লাসটা মাহিন তিথীর দিকে এগিয়ে দিলো। স্মিত হেসে তিথীর দিকে তাকালো। গলায় দারুন ভঙ্গিমা এনে বলল,,
“এই নিন ম্যাম। আপনার পানি।”
তিথী জোরপূর্বক হাসল। মাহিনের হাত থেকে গ্লাসটা তুলে নিলো। জড়তাগ্রস্ত হয়ে মাথা নুইয়ে পানির গ্লাসে চুমুক দিতেই মাহিন বুকের পাঁজরে দুহাত গুজল। ব্যগ্র হেসে রসাত্নক গলায় বলল,,
“হায়! কতো ভাগ্য এই গ্লাসটার। আপনার মতো সুন্দরীর ঠোঁটের স্পর্শ পেল!”

তৎক্ষনাৎ তিথীর নাকে-মুখে উঠল৷ কাশতে কাশতে সে দলামোচড়া হয়ে গেল। চোখ তুলে মাহিনের দিকে একবার তাকালো। হঠকারি দৃষ্টিতে মাহিনকে কিয়ৎক্ষণ প্রদর্শন করল! মাহিন বাঁকা হাসল। মগ্ন স্বরে বলল,,
“সুন্দুরীদের নাকেমুখে উঠলেও কতো সুন্দর দেখায়!”
তিথীর সারা শরীরময় রাগে রি রি করে উঠল! পানির গ্লাসটা সে সশব্দে রান্নাঘরের তাকে রাখল। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে?”
“রিয়েলি? ফ্লার্ট কেউ এভাবে করে? আগে তো জানতাম না! আপনার থেকে নতুন কিছু শিখলাম। এবার থেকে সত্যিই ফ্লার্ট করা যাবে।”

তিথীর মাথায় সাংঘাতিক রাগ চেপে বসল! মাহিনের বিহেভিয়র তার কাছে ফ্লার্ট টাইপ মনে হলো! আর এসব ফালতু ফ্লার্টিং টার্টিং তার একদম-ই পছন্দ নয়। এসব বাজে দিক থেকে সে নিজেকে যথেষ্ট বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। অতি দ্রুত স্থান থেকে প্রস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এমনকি এই বাড়ি থেকেও! মাহিনকে চোখের গরম দেখিয়ে সে তড়িঘড়ি করে পিছনে ঘুরতেই মাহিন পেছন থেকে ব্যতিব্যস্ত গলায় তিথীকে ডাকল! হেয়ালি স্বরে শুধালো,,

“কী হলো? ক্ষমা টমা চাইবেনা নাকি? চড় মারার কথাটা এতো জলদি ভুলে গেলে হ্যাঁ?”
“ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম ওকে? তবে আপনাদের দুই ফ্রেন্ডের হাবসাব আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা। একজন রাগ ঝাড়ছেন তো অন্যজন ফ্লার্টিং করছেন। সব অ’সভ্যের দল এখানে! এদের মাঝে থাকতে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। বিচ্ছিরি লাগছে সব।”

বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা তিথী মাহিনের উপর বেশ ক্ষেপে গেছে। এখনই এই জ্বলন্ত আগুন না নিভালে তিথীর সাথে ভাব জমানো তার আজন্মের জন্য অসম্ভব রয়ে যাবে। যে ব্যর্থতা মাহিনের পক্ষে সহ্য করা নিতান্ত-ই অসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে৷ হন্তদন্ত হয়ে মাহিন তিথীর পেছনে ছুটল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে তিথীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। হাঁসফাঁস গলায় বলল,,

“ক্ষমা না চাইলে তুমি বাড়ি ফিরবে কীভাবে হ্যাঁ? আন্টিকে কী জবাব দিবে?”
“ক্ষমা আর কীভাবে চাইব হ্যাঁ? পায়ে ধরে চাইব? দুই ফ্রেন্ডের পায়ে ধরব এখন?”
“না। তবে একটা পথ খোলা আছে! সরি বলা ছাড়া বা পায়ে ধরা ছাড়াও তুমি ক্ষমা পেতে পারো! যদি আমার দেখানো পথ তুমি মানো।”

“কী সেই পথ শুনি?”
“যা বলব সত্যি মানবে?”
তিথী গলায় ঝাঁঝ এনে বলল,,
“আপনাকে না আমার একদম বিশ্বাস হয়না! চূড়ান্ত ব’দ’মা’ইশ আপনারা! কখন কোন পথের কথা বলে কোন ট্রেপে ফেল দেন বলা যায়না।”

মাহিন বেশ ভাব নিলো! শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে তিথীর একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো৷ অপলক দৃষ্টিতে তিথীর দু’চোখে তাকিয়ে রইল। মুখশ্রীমে প্রেমময় ভাব ফুটিয়ে একরোঁখা গলায় বলল,,
“আমার শর্ত না মানলে আমি কিছুতেই তোমাকে ক্ষমা করবনা ওকে? আর ক্ষমা না পেলে তুমি তো জানোই বাড়িতে ফিরলে তোমার ঠিক কী অবস্থা হবে! কতোটা সাফার করতে হবে।”

তিথী ফেঁসে গেল মহা ফ্যাসাদে! নিজের মনের কথা শুনবে নাকি মাহিনের করা প্রস্তাবে রাজি হবে তাই ভেবে সে হয়রান হয়ে উঠল। অস্বস্তিতে সে হাত-পা কচলাতে লাগল। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল। মনে মনে মাহিনের ষষ্ঠী পূজো করতে লাগল! তিথীর বর্তমান অস্বস্তিকর অবস্থাটা মাহিন বুঝতে পারল। গলা খাঁকিয়ে সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,,

“কী হলো বলো? আমার শর্তে রাজি তুমি?”
তিথী সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। জেদের সাথে না পেরে আক্রোশিত গলায় বলল,,
“কী শর্ত? আগে তো শুনি?”

মাহিন আর কোনো ভনিতার আশ্রয় নিতে নিলো না। গলা ঝেড়ে একদম সোজাসাপ্টা গলায় বলল,,
“তোমার ফোন নাম্বারটা দিতে হবে!”
তিথী মাথা তুলল। উজবুক দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। সচকিত গলায় বলল,,

“এ্যাহ্?”
“এ্যাহ্ না হ্যাঁ।”
“হোয়াট রা’বি’শ!”
রাগে গটগট করে তিথী মাহিনকে উপেক্ষা করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! মাহিন আচমকা ফিক করে হেসে দিলো। তিথীর যাওয়ার পথে সে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সম্ভাবনাময় গলায় বলল,,

“তোমার নাম্বার কালেক্ট করতে কিন্তু আমার পাঁচমিনিটও সময় লাগবেনা। তবে সুন্দুরীদের এতো রাগতে নেই বুঝলে? উফফ! দেখলেই কেমন প্রেম প্রেম পেয়ে যায়! ছেলের প্রেমে আকৃষ্ট করার জন্য কিন্তু তোমরা মেয়েরাই দায়ী!”
অসহ্য হয়ে তিথী কানে হাত চেপে ধরল। পিছু ঘুরে লোহিত দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। শাণিত গলায় বলল,,

“হেই ইউ লিসেন টু মি। এই পর্যন্ত কোনো ছেলে আমার সাথে ফ্লার্ট করে পাড় পায়নি ওকে? আর আপনিও পারবেননা? সো এসব দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। বাস্তবে ফিরে আসুন।”
“আমি তো তোমার সাথে ফ্লার্ট করছিনা মিস সুন্দুরী! যা বলছি সব মন থেকেই বলছি। যদি উদ্দেশ্য সৎ হয় না? তবে দিবাস্বপ্নও সত্যি হয় বুঝলে?”

দ্বিধাদ্বন্ধ ভুলে চাঁদ এবার ফ্ল্যাটের দরজায় সশব্দে টোকা মারল। আয়মনের নাম ধরে ডাকতে লাগল। এতক্ষণ যাবত সে একমনে ভেতরের সব কথাবার্তা শ্রবণ করেছিল। তাশফিয়ার গলার স্বর পেয়ে সে যতোটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে আয়মনের সাথে তাশফিয়ার তর্কাতর্কির আভাস পেয়ে! দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আয়মন হম্বিতম্বি হয়ে দরজার কাছে ছুটে এলো। রাগী ভাবভঙ্গি নিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই চাঁদের মুখোমুখি হয়ে গেল। চাঁদ বুকে দু’হাত গুজে আয়মনের মুখশ্রীতে ভ্রু যুগল উঁচিয়ে তাকালো। দৃষ্টিতে অপার সন্দেহের ছাপ ফুটিয়ে তুলল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“ভেতরে কে?”
আয়মন কিছু আড়াল করলনা। উল্টো চাঁদকে দেখে অভয় পেল। রাগে গজগজ করে চোয়াল শক্ত করে বলল,,
“ভেতরে আয়। দেখ কে এসেছে।”
চাঁদকে টানতে টানতে আয়মন ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকিয়ে নিলো। তাশফিয়ার মুখোমুখি চাঁদকে দাঁড় করালো। ভয়ার্ত তাশফিয়ার মুখশ্রীতে রাগের ছটা বিলিয়ে দিয়ে আয়মন খরখরে গলায় চাঁদকে বলল,,

“দেখ। এই মেয়েটা বাড়ি বয়ে এসেছে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে। বলছে নাকি প্রয়োজনে আমাদের পা ধরেও ক্ষমা চাইবে! তুই-ই বল এসব কথা কি আদো বিশ্বাসযোগ্য?”
তাশফিয়া অসহায় দৃষ্টিতে চাঁদের বিবর্ণ মুখমণ্ডলে তাকালো। মাথা নুইয়ে গলা খাদে এনে বলল,,

“আমি সত্যিই তোদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি চাঁদ। ঐদিনের ঘটনার জন্য আমি এবং তাশফিয়া সত্যিই খুব লজ্জিত এবং অনুতপ্ত! খুব বড়ো রকম অন্যায় করে ফেলেছি আমরা। যার ক্ষমা হয়তো হয়না! তবুও নির্লজ্জের মতো আমরা তোদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। বিশ্বাস কর কাল রাত থেকে আমার খাওয়াদাওয়া টোটালি বন্ধ হয়ে গেছে! ঘুম-নিদ্রা সব চোখ থেকে পালিয়েছে। মানসিক শান্তির অভাবে ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

পড়াশোনায়ও ঠিকভাবে মন বসাতে পারছিনা। কাল প্রথমবারের মতো আমি রিয়েলাইজ করতে পেরেছি জানিস? বন্ধুত্বহীনতা কতোটা ভয়ঙ্কর! এরচেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু আর হতেই পারেনা। বিশ্বাস কর এতোটা কষ্ট হচ্ছিল আমার যে আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলাম! চেয়েও যেনো কান্না থামাতে পারছিলাম না একরত্তি। ভেতরে ভেতরে একধরনের শূণ্যতা কাজ করছিল। যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো না চাঁদ।”

তাশফিয়ার গলাটা ধরে এলো। নেত্রকোটরে অশ্রুরাজির আনাগোনা শুরু হলো! নিজের আবেগকে ধরে রাখতে না পারে সে অবিলম্বেই চোখের জল ছেড়ে দিলো। চাঁদের অশান্ত মন বিগলিত হয়ে উঠল! রাগ-জেদ-অভিমান সব যেনো জানালা দিয়ে পালালো। আবেগে আপ্লুত হয়ে সে তাশফিয়াকে জড়িয়ে ধরল! কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“আর কিছু বলতে হবেনা তোকে। চুপ কর এবার। যা বুঝার আমি বুঝে নিয়েছি। আসলে আমিও বুঝতে পেরে গেছি জানিস? তুই আমাদের ঠিক কতোটা ভালোবাসিস। এই ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে একটা জিনিস ভালোই হলো বল? আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরও স্ট্রং হলো! আমরা বুঝতে পারলাম একে-অপরকে ছাড়া আমরা কতোটা অসহায়। কতোটা নাজুক আর ভঙুর।”

তাশফিয়া মৃদু হাসল৷ চাঁদকে ছেড়ে তার হাত দুটো আঁকড়ে ধরল। হাত দু’খানার দিকে তাকিয়ে সে চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলল,,
“মন থেকে আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছিস তো?”
তাশফিয়ার হাত দুটোও চাঁদ আঁকড়ে ধরল। তাশফিয়াকে অভয় দিলো। মিষ্টি হেসে বলল,,

“হ্যাঁ পেরেছি। সব ভুলে আমরা আবার এক হতে পেরেছি।”
তাশফিয়া এবার চোখ ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়মনের দিকে তাকালো। অশ্রুসিক্ত চোখে সে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আয়মনের দিকে। নাক টেনে বলল,,

“আমার মা খুব অসুস্থ ভাইয়া। সেই অসুস্থ মা’কে ফেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি! আমার একটা মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই ভাইয়া। মায়ের কথা রাখতেই আপনাদের কাছে এভাবে ছুটে আসা। প্লিজ আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।”

সঙ্গে সঙ্গেই আয়মন মাথা নুইয়ে নিলো। আর কিছুক্ষণ তাশফিয়ার নির্মম আকুতিভরা মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার জানটাই হয়তো এখন বের হয়ে যাবে! তাই আয়মন ঝুঁকি নিতে চাইলনা। গলা খাকিয়ে উঠল সে। মন্থর গলায় বলল,,
“ফারদার এসব ভুল কারো সাথে করবেনা। পরিচিত, অপরিচিত কারো সাথেই না। মেয়ে হয়েছ নিজেকে যথেষ্ট আগলে রাখবে। নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা নিজের মধ্যে ধরে রাখবে। অবশ্যই সাহসী হতে হবে। তবে অতিরিক্ত সাহসী হলে এভাবেই ছেলেদের তোপের মুখে পড়তে হবে। আই থিংক তোমাকে সবটা বুঝাতে পেরেছি?”

তাশফিয়া মাথা নাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বলল,,
“হুম। বুঝতে পেরেছি।”
“আন্টিকে আমার সালাম দিও। আর উনার যত্ন নিও!”

হনহন করে আয়মন জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। বেডরুমে ঢুকে সে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। তিথী এসে তাশফিয়া এবং চাঁদের সাথে যুক্ত হলো। মাহিন তার পিছু নেওয়া বন্ধ করে দিলো। আজ তিথীকে যা জ্বালিয়েছে যথেষ্ট জ্বালিয়েছে। এরচেয়ে বেশি জ্বালাতে গেলে হীতে বিপরীত হতে পারে। সবকিছুরই তো একটা লিমিট থাকে। সেই লিমিটের বাইরে গেলেই মহা বিপদ।

তাশফিয়া এবং তিথীকে আজ নাশতা করানো ছাড়া কিছুতেই ছাড়ল না চাঁদ এবং জায়মা। দুজনকে ঠেসেঠুসে খাইয়ে এরপরই বিদায় দিলো দুজনকে। চাঁদ বাড়ির প্রত্যককে তাশফিয়া এবং তিথীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তাদের দুজনের সাথে পরিচিত হয়ে বাড়ির সবাই বেশ খুশি। তবে তাদের হঠাৎ এই বাড়িতে আগমনের কারণ বাড়ির কেউ জানতে পারলনা! চাঁদ, জায়মা, আয়মন এবং মাহিন কাউকে কিছু খোলসা করে বললনা। রীতিমতো বাড়ির সবার থেকে বিষয়টা আড়াল করে গেল। যেনো তাশফিয়া এবং তিথীকে ভুল না বুঝে তাই।

দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল মাঝখানে! আজ দুপুর একটা থেকে চাঁদ এবং জায়মার এক্সাম। এই দুইদিন নূর খুব কমই বিরক্ত করেছে চাঁদকে! চাঁদকে যথেষ্ট সময় দিয়েছে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে। তবে প্রতিরাতে সে ঘুমুনোর পূর্বে অন্তত একবার হলেও চাঁদকে দূর থেকে দেখে গেছে! নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করে গেছে। বেহায়া মনকে তৃপ্তি স্বাদ দিয়েছে। এই দুইদিন তার আয়মন এবং মাহিনের সাথে ফাজলামো করতে করতেই সময় কেটে গেছে। তিন বন্ধু মিলে পুরো কুমিল্লা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে। জায়গায় জায়গায় ফ্রেন্ডসদের সাথে আড্ডা মেরেছে।

দুপুর বারোটা বাজতেই চাঁদ এবং জায়মা রেডি হয়ে যাচ্ছে এক্সাম হলের উদ্দেশ্যে। নাওয়া খাওয়া ভুলে চাঁদের করুন এক অবস্থা। পরীক্ষার টেনশানে এবং পড়ার চাপে পড়ে তার মুখমণ্ডল বেশ নেতিয়ে গেছে। ফ্যাকাসে হয়ে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। এই নিয়ে সামিয়া আহমেদ বেশ চিন্তিত। একটু আগেও তিনি খাবার নিয়ে চাঁদকে অনেক সেঁধে গেছেন৷ তবে চাঁদ কিছুতেই মুখে কিছু তুললনা! অভুক্ত অবস্থাতেই পড়া রিভাইস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কথাটা কোনোভাবে নূরের কানে গেল! মুহূর্তের মধ্যেই সে বেশ হাইপার হয়ে উঠল। রাগে দিশাহীন হয়ে চাঁদের রুমে প্রবেশ করল। চাঁদকে পড়ার টেবিলে দেখে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদের পড়ার টেবিলের দিকে ছুটে গেল। পড়াশোনায় চাঁদ এতোটাই ব্যস্ত যে রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি সে টের পেলোনা!

অনর্গল ভনভন করে পড়তেই লাগল। অধৈর্য্য হয়ে নূর সশব্দে টেবিলের উপর হাত রাখল। চাঁদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। টেবিলে আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথেই অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল চাঁদের! থমথমে হয়ে সে পাশ ফিরে তাকালো। অমনি নূরের রাগান্বিত চোখদুটো তার ভয়াল দু’চোখে স্পষ্ট হলো। শুকনো ঢোঁক গিলল চাঁদ। মনে মনে নূরের রাগের কারণ খুঁজতে লাগল। নূর চোয়াল শক্ত করল। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪১

“কাল রাত থেকে কিছু খাওনি কেন?”
“পপপড়ছিলাম!”
“এতো পড়ে কী হবে হ্যাঁ? যদি পরীক্ষার হলে দুর্বল হয়ে পড়ো? তখন তোমার পরীক্ষাটা কে দিবে হ্যাঁ? তোমার হয়ে কে লিখবে? কীভাবে পাশ করবে তুমি?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৩