প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৩

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৩
নিশাত জাহান নিশি

“এতো পড়ে কী হবে হ্যাঁ? যদি পরীক্ষার হলে দুর্বল হয়ে পড়ো? তখন তোমার পরীক্ষাটা কে দিবে হ্যাঁ? তোমার হয়ে কে লিখবে? কীভাবে পাশ করবে তুমি?”

অবিলম্বেই চাঁদ মাথাটা নুইয়ে নিলো। নূরের কথাগুলো কোনো অংশে ভুল না হলেও এই মুহূর্তে এই প্রিয় সত্যিগুলো সে মানতে পারছেনা। পরীক্ষা অতি সন্নিকটে এলেই তার খাওয়াদাওয়ার রুচি এক্কেবারে কমে যায়। সবক্ষেত্রেই অবসাদ এবং বিষণ্ণতা দেখা দেয়। মাথার ভেতর একটা আলাদা চাপ অনুভব হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যতক্ষণ অবধি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হবে ততক্ষণ অবধি সেই মানসিক চাপ তাকে উভয়দিক থেকে ঘিরে ধরবে। নূরের রোষের মুখে পড়েও সে বইয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে পড়ছে! এই মুহূর্তে পড়াটাই যেনো হলো তার একমাত্র ধর্ম। বিষয়টাতে নূর আরও অধিক রুষ্ট হয়ে উঠল। গরম চোখে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল।

নূরের রোষাগ্নি দেখেও চাঁদের কোনো ভাবান্তর না দেখে নূর এবার রাগে এবং জেদে টেবিলে সজোরে এক লাথ মারল! সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ কেঁপে উঠল! অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। নূর ঝট করে চাঁদের সামনে থেকে বইটা ছিনিয়ে নিলো। কোনোরকম তর্কে না জড়িয়ে সে বইটা নিয়ে সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেল! নূরের যাওয়ার পথে চাঁদ নির্বোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“এই? বই নিয়ে কই যাচ্ছেন আপনি?”
নূর কোনো প্রত্যত্তুর করলনা। দ্রুত পা ফেলে সোজা বাড়ির ড্রয়িংরুমে চলে এলো। পুরো ফ্ল্যাট এখন ফাঁকা প্রায়। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। নীড়, মাহিন এবং হাবিব আবরার একটু আগেই বেরিয়েছেন জামান আহমেদের অফিসটা একটু ঘুরে দেখতে। আয়মন তার বাবার সাথে অফিসে গেছে কিছু জরুরি কাজে।

পড়ালেখাের ফাঁকে ফাঁকে আয়মন তার বাবাকে অফিসের কাজে সাহায্য করে। এই বছরই আয়মন অনার্স ফোর্থ ইয়ারে উঠল। সোহানীর পরের ব্যাচ সে। নূর ও তার ব্যতিক্রম নয়। সোহানীর ফোর্থ ইয়ার ফাইনালের পর পরই থার্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়েছিল।

থার্ড ইয়ারের এক্সাম কোনোমতে শেষ করে নূর সেকেন্ড ইয়ারের এক সাবজেক্ট ইম্প্রুভমেন্ট দিয়েই পরেরদিন কুমিল্লা এসেছে। নূর এবং আয়মনের থেকে সোহানী তিন বছরের বড়ো হলেও সে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি এক্সামে দুইবার ইম্প্রুইমেন্ট দিয়ে সবেমাত্র অনার্স কমপ্লিট করেছে! ভালো রেজাল্টের জন্যই মূলত ইম্প্রুভমেন্ট দেওয়া।

ডাইনিং টেবিলের একটা কর্ণারে ঝট করে বইটা রেখে নূর নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসল। ঘামে সিক্ত শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো। সামনের অপরিপাটি চুলগুলো টেনে সে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে গরমের প্রাদুর্ভাবে আঁখিযুগল বুজে নিলো। দাঁতে দাঁতে চেপে চাঁদকে আবিষ্কার করে বলল,,

“খাবার তুমি খাবা না, না? তোমার জামাইসহ খাবে বুঝলা? তোমার জামাই তোমার চেয়ে আরও বড়ো ঘাড়ত্যাড়া!”
শ্লেষাত্নক হাসল নূর। রান্নাঘরে হেঁশেল সামলানো সামিয়া আহমেদকে উচ্চস্বরে ডাকল। রাগী গলায় বলল,,
“খালামনি? চাঁদের খাবারটা দিয়ে যাও।”

সামিয়া আহমেদ পুটি মাছগুলো মাত্র কষালেন। বেশ ব্যস্ত গলায় জবাবে বললেন,,
“চাঁদ তো খাবে না বলল বাবা। আমি অনেকবার সেঁধেছিলাম তো।”
“খাবে খালামনি। তুমি খাবারটা নিয়ে এসো তো।”

সামিয়া আহমেদ নিবোর্ধ ভাব নিলেন। নূরের জেদের কাছে হার মেনে চাঁদের জন্য আলাদা প্লেটে খাবার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চাঁদ হাত-পা কচলাতে কচলাতে রুম থেকে বের হয়ে এলো! রাগে গটগট করে অনুমান বশত সোজা ড্রয়িংরুমে চলে এলো। ডাইনিং টেবিলে নূরকে দেখামাত্রই চাঁদ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“বইটা দিন বলছি। পড়াটা শেষ করে এক্ষণি আমাকে বের হতে হবে।”
পাশ থেকে নূর বইটা তার বুকের পাঁজরে আঁকড়ে ধরল। ট্যারা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ব্যগ্র গলায় বলল,,
“আগে খাবার খাবে। তারপর বই পাবে। শরীরে এনার্জি না থাকলে হাজার পড়েও লাভ হবেনা বুঝছ? দুর্বল শরীর নিয়ে পরীক্ষার হলে একঘণ্টার বেশি স্টে করতে পারবেনা। এতে হীতে ক্ষতি তোমার-ই হবে।

আমার বা খালামনির কিছুই হবেনা কিন্তু। সো, যদি বুদ্ধিমতী হও তাহলে আমার কথা মেনে নাও। আর যদি নির্বোধও হও তবে আমার কোনো সমস্যা নেই। কজ ত্যাড়া ঘাড় কীভাবে সোজা করতে হয় আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে!”
চাঁদ হুড়মুড় করে নূরের দিকে তেড়ে এলো। তেজী দৃষ্টিতে নূরকে কিয়ৎক্ষণ প্রদর্শন করে সে আচমকা নূরের পাশের চেয়ারটা টেনে বসল। ঠোঁট উল্টে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তাহলে খেতে খেতে পড়ি?”
নূর গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে বলল,,
“ইট’স ইউর চয়েজ। বাট খেতে খেতে না আবার পড়া খেয়ে বসো সেদিকে খেয়াল রেখো!”
“খাবো না। বইটা দিন এবার।”

হাত বাড়িয়ে চাঁদ নূরের কাছ থেকে বইটা চাইল। সোজা হয়ে বসে নূর ভাবলেশ ভঙ্গিতে বইটা চাঁদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। বইটা পেয়ে চাঁদ মৃদু হাসল। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করেই সে তড়িঘড়ি করে বইটা খুলে পুরোনো পড়াগুলো বিড়বিড় করে পড়তে লাগল। থুতনিতে ডান হাতটা ঠেকিয়ে নূর বেখবর দৃষ্টিতে অপলক চাঁদকে দেখতে লাগল!

রোদের তাপে মাথার উপরে থাকা ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানটাও এখন বেশ উত্তপ্ত হাওয়া দিচ্ছে। যার প্রভাবে চাঁদের কপাল, নাক এবং থুতনিতে খুবই স্পষ্টভাবে ঘামরাশি দেখা দিয়েছে। এলোকেশী চুলগুলো উন্মুক্ত থাকার দরুণ যেনো তার শরীরের গরমের মাত্রা অধিক বেড়ে যাচ্ছে। গলা বেয়েও টুপটুপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে। নূর বিব্রত হলো বিষয়টাতে।

চাঁদকে এই নাজেহাল রূপে দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছেনা। চাঁদকে তো কেবল স্নিগ্ধ রূপেই মানায়! যার স্নিগ্ধতায় চোখ জুড়িয়ে যায়। মন-প্রাণ স্থির হয়ে ওঠে। চাঁদের আলোয় আলোকিত হওয়ার ব্যাকুলতা কাজ করে। তড়িঘড়ি করে নূর চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদের পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো।

কোনো রকম জড়তা বা দ্বিধাদ্বন্ধ ছাড়াই সে চাঁদের উন্মুক্ত চুলে হাত রাখল! চাঁদকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সে চুলগুলো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খুব সুন্দর করে একটা খোঁপা বেঁধে দিলো! পড়াশোনা ভুলে চাঁদ ঘাড়টা খানিক বাঁকিয়ে আড়চোখা দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি খোঁপা বাঁধতে পারেন নূর ভাইয়া?”
খোঁপাটা বিজ্ঞ হাতে বেঁধে নূর হাত দুটো ঝাড়ল। অতঃপর আবারও চেয়ার টেনে চাঁদের পাশে বসল। শার্টের কলারটা ঝাঁকিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,,
“এ আবার কঠিন কী কাজ? সবাই পারে। আম্মুর চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।”

চাঁদ কিছু বলার পূর্বেই পেছন থেকে সাবরিনা আররার এসে চাঁদের মুখের কথা টেনে নিলেন। নূরকে ইন্ধন যুগিয়ে বললেন,,
“হ্যাঁ রে চাঁদ। নূর মাঝেমধ্যেই আমার চুলে খোঁপা বেঁধে দেয়। মাঝেমধ্যে রান্নাঘরে কাজে এতো কাজের চাপ থাকে যে চুল বাঁধার সময় থাকেনা। তখনই উচ্ছৃঙ্খল চুলগুলো খুব বিরক্ত করে। কখনো সখনো শক্ত খোঁপা থেকেও চুল খুলে যায়। আর তখনই নূর আমার খোঁপা বেঁধে দেয়।”

সাবরিনা আবরার রান্নাঘরের দিকে মোড় নিলেন। চাঁদ মগ্ন দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। বিড়বিড় গলায় বলল,,
“ইশশশ। আমার ফিউচার জামাইটাও যদি এভাবে খোঁপা বাঁধতে জানত! তাহলে আমাকে আর আধাঘণ্টা পরিশ্রম করে খোঁপা বাঁধতে হতোনা। পাঁচ মিনিটেই মুশকিল আছান হয়ে যেতো!”

নূর ফিক করে হেসে দিলো। চাঁদের কানের কাছে তার ঠোঁট ঠেকালো! রসাত্মক গলায় বলল,,
“কোনো ব্যাপার না। তুমি চাইলে আমি-ই তোমার ফিউচার জামাই হবো!”
চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! শুকনো ঢোক গিলে আবারও মনে মনে আওড়ে বলল,,
“এই লোকটা আমার মনের কথা কীভাবে শুনল?”

ভর দুপুর। সূর্যের প্রখর আস্তরণে ঢাকা মহাকাশ। সমগ্র পৃথিবীকে যেনো মুহূর্তের মধ্যেই গ্রাস করে তুলছে আকাশে বিস্তরণ করা এই রোষানল সূর্যটি। অসহনীয় গরমে জনজীবন তিক্তময়, ক্লান্তময় এবং বিষাদময়। প্রকৃতির কোথাও কোনো বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই। রোদের তীর্যক ঝাঁজে শরীর ঝলসে একাকার সবার!

চাতকপাখির ন্যায় সবাই একটুখানি শিথীল হাওয়ার অপেক্ষায় অপেক্ষমান। আকাশজুড়ে কালো মেঘের অপেক্ষায় দুড়ুদুড়ু সবার মন। ফুটপাতে অবস্থান করা মুদি দোকান এবং শরবতের স্টলগুলোতে মানুষের একাধিক লাইন পড়ে গেছে। কেউ বরফের টুকরো চিবিয়ে খাচ্ছে তো কেউ আস্ত আইসক্রীম চিবিয়ে খাচ্ছে। আবার কেউ শরীর ঝরা ঘাম নিয়ে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে একটুখানি স্বস্তির খুঁজে। গাঁ জ্বালানো গরম থেকে একটুখানি পরিত্রান লাভের জন্যে।

ঘড়িতে খুব সম্ভবত ২টা বেজে ৩০ মিনিট চলমান। পরীক্ষার হলে বসে খুব নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিচ্ছে চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়া। প্রশ্ন এতোটাই কমন পড়েছে যে কোনটা ছেড়ে তারা কোনটার আনসার করবে তা নিয়েই চিন্তিত! আগেপিছে, ডানে-বায়ে না তাকিয়ে তারা একমনে পরীক্ষা দিচ্ছে। অতি উত্তেজনায় চাঁদ তার মাথার হিজাব খুলে ওড়নার মতো পড়ে নিয়েছে! অত্যধিক গরমে মাথার তুলি গরম হয়ে উঠছিল তার। সারা শরীর জ্বালা করে উঠছিল।

যার কারণে লিখায় মনোযোগ বসাতে পারছিলনা সে। তার উপর হাত দুটো ঘেমে নেয়ে একাকার। কলমটা পিছলিয়ে ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে লিখতে। হিজাব দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর সে হাতটা মুছছে। টিস্যু না থাকার দরুন হিজাব দিয়েই মুখের ঘামগুলো মুছছে। তার পাশের সিটে বসা মেয়েটি কেমন যেনো ঢুলুঢুলু করছে। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যেনো এক্ষণি সে জ্ঞান হারাবে। গরমের ভাপে এবং অভুক্ত থাকার কারণে তার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে! নিজের শরীরকে স্থির করে কিছুতেই লিখালিখি করতে পারছেনা সে!

নূর, মাহিন এবং আয়মনের অবস্থান এখন কলেজ গেইটের বাইরে! বাইকের উপর বসে তারা ঢকঢক করে লেবুর শরবত গিলছে। আয়মন আস্ত বরফ চিবিয়ে খাচ্ছে। গরমে একেকজনের অবস্থা খুবই দুর্বিষহ। ঘামের অতিরিক্ত প্রভাবে তাদের চোখ-মুখই বুঝা যাচ্ছেনা! গাঁয়ের রং কুচকুচে কালো হয়ে উঠেছে৷ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা পর্যন্ত। চাঁদ বারণ করা সত্ত্বেও নূর ঘাড়ত্যাড়ামো করে চাঁদের পিছু পিছু কলেজ অবধি ছুটে এসেছে!

সারা রাস্তায় চাঁদকে জ্বালিয়ে মেরেছে সে। এটা ওটা নিয়ে বকর বকর করে। বিভিন্নভাব চাঁদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথার মারপ্যাচে চাঁদকে জড়িয়ে ফেলেছে। অফিস থেকে ফিরে আয়মনও মাহিনকে নিয়ে নূরের কথামতো কলেজের দিকে চলে এসেছে! আয়মন মূলত আসতে চায়নি তবে মাহিনের জোরাজুরিতেই তাকে বাধ্য হয়ে আসতে হলো।

কোথাও না কোথাও মাহিনের মন জানান দিচ্ছিল “আজ তিথী আসবে!” তাশফিয়াকে পিক করতে সে কলেজে একবার হলেও আসবে। মনের ডাকে সাড়া দিয়েই সে জোরজবরদস্তি করে আয়মনকে সাথে নিয়ে কলেজে আসা। তিথীর সাথে একটিবার দেখা করার সুযোগ যেনো সে মিস করতে চাইছেনা।

টানা দুইদিন পর আজ তিথীর সাথে দেখা হবে তার। এই ভেবেই খুশিতে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তিথীর কন্ট্রাক্ট নাম্বার জোগাড় করতে সে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
চার থেকে পাঁচ গ্লাস শরবত শেষ করে আয়মন এবার বাইক থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ঘর্মাক্ত শার্টের কলারটা ঝেড়ে সে ঝাঁঝালো গলায় নূরকে বলল,,

“এই? তোরে কি শ’য়’তা’নে লা’ড়’ছিল? কে কইছিল ঢঙ দেখিয়ে আজ এখানে আসতে? চাঁদ, জায়মা ওরা কী বাড়ি-ঘর চিনে না নাকি? ছোটো ওরা? সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে ওরা একই কলেজে পড়ছে। তাছাড়া এটা আমার কলেজ। আমার বোনদের সবাই খুব ভালোভাবেই চিনে। কোথায় কী করলে কী হবে তারা বেশ ভালোভাবেই জানে। তো কী দরকার ছিল কলেজের সামনে এসে এভাবে বডিগার্ডের মতো দাঁড়ানোর?”

নূর চোখ টিপল! আয়মনকে শান্ত করার জন্য বাঁকা হেসে বলল,,
“ইউ আর লুকিং সো হ’ট ব্রো! রাগলে মেয়েদের খু্ব সুন্দর লাগে দেখেছি তবে ছেলেদেরও যে এতোটা সুন্দর লাগে আজ তোকে দেখে বুঝলাম!”

মাহিন হু হা শব্দে হেসে দিলো! নূরের কাঁধে চাপড় মেরে আয়মনকে লক্ষ্য করে বলল,,
“তোকে দেখে আজ মেয়ে মেয়ে ফিলিংস হচ্ছে আয়মন! সিরিয়াসলি ইউ আর লুকিং সো হ’ট!”
আয়মন রক্তিম দৃষ্টিতে নূর এবং মাহিনের দিকে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে বেফাঁস গলায় বলল,,

“তোরা দুইভাই মিলে হি’জ’রা’গি’রি শুরু করছস হ্যাঁ? কেন ভাই? মেয়ে খুঁজে পাস না? অভাব পড়ছে দেশে?”
নূর তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। আয়মনের দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। স্বাভাবিক গলায় বলল,,
“পেয়েছি বলেই তো এই রোদে পুড়ে তার কাছাকাছি থাকতে আসা!”
আয়মন ভ্রু কুঁচকালো। নূরের দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কৌতূহলী গলায় শুধালো,

“কোন মেয়ে? কার কথা বলছিস তুই?”
নূর ঝট করে বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। শার্টের কলার ঠিক করে আয়মনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই সোজাসাপ্টা গলায় বলল,,
“আমি তোর বোনকে খুব চাই! নিজেকে যতোটা চাই তাকেও ঠিক ততোটাই চাই।”
“কোন বোন? কার কথা বলছিস তুই?’
“চাঁদের কথা বলছি আমি!”

আয়মন থমকালো! হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। বিদ্বেষি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তুই জানিস না? সাদমান চাঁদকে পছন্দ করে?”
“জানি! আমি সব জানি! তবে ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে কিন্তু অনেক ফারাক আয়মন। সাদমান চাঁদকে পছন্দ করে আর আমি চাঁদকে ভালোবাসি!

এখানেই আমাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য! আমার ভালোবাসাটাও কিন্তু মিথ্যে নয় আয়মন। চাঁদ ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকেই কেনো জানি না আমি তার প্রতি একটু একটু করে দুর্বল হতে শুরু করি! সারাক্ষণ আমার আশেপাশে চাঁদকে ফিল করতে থাকি। চাঁদের চঞ্চলা হাসি, চাঁদের দুষ্টুমিষ্টি কথা, চাঁদের মায়াবি চোখ, চাঁদের স্নিগ্ধ মুখ, চাঁদের পাগলাটে স্বভাব সব আমাকে সত্যিই পাগল করে তুলেছে!

রোজের মায়া কাটানোর জন্য চাঁদের ঐ সময়ের সাপোর্ট সব আমাকে চাঁদের প্রতি খুব আকৃষ্ট করে তুলেছে। প্রথমবারের মতো চাঁদের প্রতি মুগ্ধতা খুঁজে পাই আমি। কোথাও হেঁটে, বসে, খেয়েদেয়ে একরত্তিও শান্তি পাইনি আমি। রোজের প্রতি দুর্বলতা কাটতে শুরু হয় আমার। রোজকে ভুলতে বসি প্রায়। মন থেকে চাঁদকে গ্রহণ করতে শুরু করি!

লাস্ট পাঁচমাসে এসে মনে হয়, “না, তাকে ছাড়া আর একদন্ডও থাকা সম্ভব না! বেঁচে থাকার স্পৃহাও আর কাজ করছেনা। তার কাছে এবার আমার ধরা দিতেই হবে। আমার ভালো থাকার ঔষধকে আমার করে পেতেই হবে। একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে। লাইফের প্রথম প্রেম সাকসেস না হলেও দ্বিতীয় প্রেমকে সাকসেস করতেই হবে! এবার তাকে না পেলে আমি ম’রে’ই যাব! তাই আমি স্বার্থপরের মতো সাদমানের কাছে লাস্ট কয়দিন আগে এই প্রস্তাবটা রাখি।

বুঝতে পারিনি সাদমান এতোটা হিংস্র হয়ে ওঠবে! আমাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হবে! তুখার ঝগড়া হয় ঐদিন সাদমানের সাথে। ঝগড়াঝাঁটির এক পর্যায়ে এসে সাদমান বলে, “চাঁদ যাকে মন থেকে নিবে, যাকে সে মন থেকে ভালোবাসবে চাঁদ শুধু তারই হবে!” আমি মেনে নিলাম তার শর্ত! কারণ, আমার যেকোনো মূল্যেই হোক চাঁদকে চাই।

তাই চাঁদের মন জয় করার জন্যই আমি মূলত কুমিল্লায় আসি! তবে এখানে আমার একটা প্লাস পয়েন্ট হলো যে, সাদমান কোনো একটা বিরাট সমস্যার কারণে কুমিল্লায় আসতে পারেনি। ঢাকায় আটকে পড়েছে। জানিনা এই সময়টাতে আমি কতোখানি চাঁদের মন জয় করতে পেরেছি। তবে শেষ পর্যন্ত আমি লেগে থাকব। যতক্ষণ অবধি না চাঁদ আমাকে মন থেকে মেনে নিবে ততক্ষণ অবধি আমি চাঁদের পিছনে লেগে থাকব। চাঁদকে নিজের করেই তবে আমি শান্ত হবো।”

আয়মন নির্বাক মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! চাঁদকে নিয়ে দুই ফ্রেন্ডের মধ্যে রেষারেষি দেখে সে হতবাক হলো। মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে এই প্রথমবার নিজের ফ্রেন্ডের মধ্যে হওয়া হানাহানি দেখে সে হতাশ হলো। বিষয়টাতে চাঁদ কতোটা আঘাত পাবে তা ভেবেই সে হয়রান হয়ে উঠল! পকেট থেকে সিগারেট বের করে নূর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো। লম্বা একটা ফুঁক দিলো সিগারেটটায়। ঘাড়ের রগ টান টান করে বলল,,

“যেকোনো মূল্যেই হোক চাঁদকে আমার চাই আয়মন। দুনিয়া লন্ডভন্ড করে হলেও তাকে আমার চাই। ভাগ্য এবার আমাকে নিয়ে আর খেলতে পারবেনা। দোয়া নাকি ভাগ্য বদলাতে পারে? চাঁদকে পাওয়ার জন্য আমি পৃথিবীতে যতো রকম দোয়া আছে সব দোয়া মন থেকে করব! আল্লাহ্’র সন্তুষ্টি কোথায় আছে সব আমি খুঁজে বের করব। এরজন্য যদি আমার নিজেকে পরিবর্তন করতে হয় প্রয়োজনে আমি তাও করব। একজনকে ভালোবেসে আমি বাবা-মাকে ছাড়তে চেয়েছি। এবার চাঁদকে ভালোবেসে আমি দুনিয়া ছাড়তে রাজি!”

মাহিন আপাতত এসব ক্যাচালে নেই! সে অস্থির দৃষ্টিতে কেবল রাস্তার এদিক-ওদিক দৃষ্টি বুলাচ্ছে। তিথী কখন এসে তার সামনে হাজির হবে তার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। দমটা যেনো তার হাঁসফাঁস করছে তিথীকে এক ঝলক দেখার জন্য।

দুপুরের খাবার খেয়ে মাত্র সোহানী তার বেডরুমে প্রবেশ করল। নীড় খুব রিলাক্স মোডে আছে! খোশমেজাজে সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। নীড়ের এই হাসিমাখা বদন দেখে সোহানীর রাগটা যেনো আরও তড়তড় করে বেড়ে গেল! রুমের দরজাটা সে সশব্দে বন্ধ করল। চট করে নীড় আঁচ পেয়ে গেল ঘরের চেয়ারম্যান আজ বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে! সোহানীর রাগকে আরও উস্কানোর জন্য নীড় ছলনার আশ্রয় নিলো।

ইচ্ছে করে বিষয়টাকে তেমন আমলে নিলো না! এমনকি সোহানীর দিকেও ফিরে তাকালো না। সোহানী বেশ বিরক্ত হলো। দ্রুত পা ফেলে সে নীড়ের দিকে তেড়ে এলো। রাগে গজগজ করে নীড়ের পাশে বসল। নীড় ফোন চাপতে এতোটাই ব্যস্ত ভঙ্গি নিলো যে রুমে সোহানীর অস্তিত্ব সে টের পেল তা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে দিলোনা।

সোহানী আরও বিগড়ে গেল। নীড়ের মুখের সামনে সে ভেজা চুলগুলো খুলে দিলো! টুপ টুপ করে চুলের জলগুলো নীড়ের চোখে-মুখে আছড়ে পড়তে লাগল! নীড় বাঁকা হাসল। ফোনটা সে হাত থেকে সরালো। হেঁচকা টানে সোহানীকে তার বিপরীত পাশে শুইয়ে দিলো। সোহানীর গাঁয়ের উপর ওঠে সে সোহানীর থুতনি চেপে ধরল। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী? জামাইয়ের ট’র্চা’র ভাল্লাগে? তাই আমাকে রাগাতে এসেছ?”
উজবুক ভঙ্গিতে সোহানী মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। অস্ফুটে গলায় বলল,,
“আমাকে বললেন না কেন কাল আপনারা ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন?”
“আগে বললে কী হতো হ্যাঁ? জামাইকে আরও বেশি আদর দিতা? ওমাগো! টুরু আদর?”
সোহানী রাগী শ্বাস ছাড়ল। তিক্ত গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪২

“ফা’ই’জ’লামি ছাড়া কি জীবনে আর কিছুই শিখেন নাই? জানতে চেয়েছিলাম বিয়ের ডেইট ফিক্সড না করেই কি আপনারা চলে যাবেন?”
সোহানীর থুতনিটা ছেড়ে দিলো নীড়। উত্তেজিত হয়ে সোহানীর ঘাড়ে দীর্ঘ এক ভালোবাসার পরশ ছুঁইয়ে দিলো। ঘোরজড়ানো কণ্ঠে বলল,,
“উঁহু বউ। আজ রাতেই বিয়ের ডেইট ফিক্সড করব দেন কাল সকালে বাড়ি ফিরব।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৪