প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৫

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৫
নিশাত জাহান নিশি

নূরকে উপেক্ষা করে চাঁদ বিষণ্ণ মনে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। এখনো সেইদিনের কথাটা চাঁদ মনে রেখেছে তা ভেবেই নূর হয়রান হয়ে উঠল। আয়মন, জায়মা এবং তাশফিয়া অনেকক্ষণ পূর্বেই তাদের বুকড করা টেবিলে চলে এসেছিল। জায়মা এবং তাশফিয়া পাশাপাশি বসে নানাধরনের গল্প-গুজব করছিল। আয়মন হাতে মেন্যু কার্ড নিয়ে বসে আছে। তবে সে মেন্যুতে খাবারের আইটেমগুলো দেখছে কম উঁকি ঝুঁকি মেরে তাশফিয়াকে দেখছে বেশি!

জায়মার সাথে গভীর কথোপকথনে লিপ্ত থাকায় তাশফিয়া এদিক-ওদিক দৃষ্টি ঘুরাতে পারছেনা। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে বুঝতে পারছেনা পিপাসায় কাতর একজোড়া তৃষ্ণার্ত চক্ষু তাকে নির্ভেজাল চাহনিতে দেখছে! হঠাৎ তাশফিয়ার মাঝে কী এমন বিশেষ কিছু খুঁজে পেল আয়মন যার কারণে সে এতোটা সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাশফিয়াকে খুঁটে খুঁটে দেখছে? তা বুঝার-ই অন্তপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে আয়মন। মুখ দেখে যদি মনের কথা বুঝা যায়!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইতোমধ্যে চাঁদও এসে আয়মন, জায়মা এবং তাশফিয়ার সাথে যোগ দিলো। বিমূঢ় হৃদয়ে সে এক আকাশ মন খারাপকে সঙ্গী করে মাথা নুইয়ে বসল জায়মা এবং তাশফিয়ার পাশে। নূরের প্রতি খুব অভিমান জমে আছে তার। ঐদিন নূরের ঐ কটূক্তিটায় চাঁদ ভেতর থেকে বেশ আঘাত পেলেও সেই আঘাতটা সে তখন বাইরে প্রকাশ করেনি

! হাসিমুখে বিষয়টা এড়িয়ে গেছে। চাঁদের মতে পৃথিবীর কোনো মানুষ-ই পার্ফেক্ট নয়। সবার মাঝেই দু’একটা খুঁত থাকে। ভালো-খারাপ মিলিয়েই মানুষ। নিজে একজন মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষের খুঁত খোঁজাটা বোকামী। একটা মানুষ যেমনই হোক আল্লাহ্ তাকে ভালোবেসেই সৃষ্টি করেছেন।

সৃষ্টিকর্তার সেই সীমাহীন ভালোবাসার কাছে কার মধ্যে কী আছে না আছে সেসব ম্যাটার করেনা। সব অবস্থাতেই আল্লাহ্’র কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিৎ। তাশফিয়ার থেকে কোমল দৃষ্টি সরাতেই আচম্বিতে আয়মনের সূক্ষ্মদৃষ্টি পড়ল চাঁদের উপর। উদ্বেগি হয়ে সে মুখের সামনে থেকে মেন্যু কার্ডটা সরিয়ে নিলো। সামনের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে তৎপর গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“এই কী হইছে তোর? মুখ ফোলাইয়া রাখছস কেন?”
জায়মা এবং তাশফিয়ারও টনক নড়ল এবার। দু’জনই আলাপচারিতা ভুলে অধীর দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা আয়মন এখন তিলকে তাল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। চাঁদের মনের কথা না শোনা অবধি সে কিছুতেই ক্ষান্ত হবেনা। একদম লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়বে। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য চাঁদ চট করে মাথাটা উপরের দিকে তুলে নিলো। বিমূঢ়তা ভুলে জোরপূর্বক হেসে আয়মনের দিকে তাকালো। আমতা আমতা সুরে বলল,,

“কই কী হইছে? মুখ ফোলাইছি কই?”
আয়মন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ চাঁদকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“নূর কই?”
“করিডরে।”
“নূর কিছু বলছে তোকে?”
“কই না তো!”
“তাহলে মুখ ফোলাইছিলি কেন?”
“তুমি একটু বেশিই দেখো ভাইয়া।”

“নূরকে ফালাইয়া হঠাৎ এখানে আসলি কেন? সন্দেহ হবেনা?”
“ওখানে ঠাণ্ডা লাগছিল ভাইয়া। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। শীত শীত লাগছিল।”
আয়মন এবার ক্ষান্ত হলো। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে সোফার পেছনের গদিতে হেলান দিলো। শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী খাবি বল?”
“হালকা কিছু খাব। দুপুরে খেয়ে এসেছি। পেট ভর্তি খাবার। তুমি এক কাজ করো জায়মা এবং তাশফিয়াকে জিজ্ঞেস করো ওরা কী খাবে।”

তাশফিয়া অস্বস্তিবোধ করল। জায়মা কিছু বলার পূর্বেই তাশফিয়া ইতস্তত গলায় মাথা নাড়িয়ে চাঁদকে বলল,,
“তোরা যা খাবি আমিও তাই খাব। আলাদা করে আমার কোনো পছন্দ নেই।”
আয়মন মেন্যু কার্ডে মনোযোগ দিলো। বিজ্ঞ দৃষ্টিতে পুরো মেন্যু কার্ডটা এক ঝলক দেখল। অতঃপর গম্ভীর গলায় তাশফিয়াকে বলল,,

“সবারই কিছু না কিছু পছন্দ থাকে। তোমারও থাকা উচিৎ। না হয় লোকজন তোমাকে এলিয়েন ভাববে!”
তাশফিয়া রাগী রূপ ধারণ করল। আড়চোখে আয়মনের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,,
“আইছে আমারে জ্ঞান দিতে। আর কত বড়ো সাহস? আমাকে ইনডিরেক্টলি এলিয়েন বলে? কিছু বলিনা বলে এই লোকটা দেখি বহুত আশকারা পেয়ে গেছে।”

আয়মন মনে মনে হেঁতো হাসল। ব্যগ্র গলায় বলল,,
“জানি মনে মনে আমাকে অনেক বকাঝকা দেওয়া হচ্ছে। আমিও দেখব কতক্ষণ অবধি এই মানবী শান্ত রূপে থাকতে পারে!”

আয়মন মাথা চুলকালো। চাঁদের দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,
“চিকেন মম অর্ডার করি কী বলিস?”

চাঁদ মাথা দুলালো। আয়মন ওয়েটারকে ডেকে চিকেন মম’র অর্ডার বুঝিয়ে দিলো। নূর রাগে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে! করিডরের গ্রীলে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর সে ঘুঁষি মারছে তো কিছুক্ষণ লাথ মারছে! নিজের প্রতি নিজের-ই খু্ব ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে তার।

ঐদিনের বলা কথারটার তাৎপর্য সে আজকের দিনে এসে বুঝতে পারছে। চাঁদকে জোশের বসে ঐ কথাটা বলা মোটেও উচিৎ হয়নি তার। যার জন্য সে এখন খুব বাজেভাবে পস্তাচ্ছে। চাঁদের মনে তার প্রতি একটু খারাপ ধারণা জন্ম নেওয়া মানেই হলো চাঁদকে তার হারিয়ে বসা! তার দুর্বল জায়গা সাদমানকে বুঝতে দেওয়া!

দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল নূর। মাথাটা পাগল পাগল করছে তার। কিছুতেই যেনো নিজেকে স্থির করতে পারছেনা সে। দ্রুত বেগে সে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। তুখোড় রাগ দেখিয়ে আয়মনের পাশে এসে বসল। রক্তিম মুখশ্রীতে সামনাসামনি বসে থাকা চাঁদের দিকে তাকালো। নূরের এই বিভৎস রূপ দেখে চাঁদ ভড়কে উঠল। থমথমে দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো নূর। সামনের চুলগুলো টেনে গলায় নমনীয়তা এনে চাঁদের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বলল,,

“আগে যা বলছি সব ভুলে যাও ওকে? আগের কথা সব বাদ। এখন বর্তমান নিয়ে ভাবো, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। তোমার সামনে এখন নূরের যেই শান্ত রূপটা বসে আছে সেই রূপটাকে এখন গ্রহণ করো।”
চাঁদ মুখ খুলল। তেজী দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এতোদিনের জমানো সমস্ত রাগ অভিমান ঝাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই সে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“কী গ্রহণ করব হ্যাঁ? কী গ্রহণ করব? কুমিল্লায় আসার পর থেকেই দেখছি আপনি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন। সারাক্ষণ আমার পেছনে আদাজল খেয়ে পড়ে আছেন! একদণ্ডের জন্যও আমাকে শান্তি দিচ্ছেননা। যা আমি কখনো আপনাকে নিয়ে ভাবিনি বা ভাবতে চাইও নি সেই ভাবনা চিন্তাগুলোই আপনি বেশি করে আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কী লাভ হচ্ছে এতে বলুন? কী লাভ হচ্ছে? এসব করে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন হ্যাঁ?

কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি আমাকে পছন্দ করেন? ভালোবাসেন? আগে তো আমার চঞ্চলতা নিয়ে আপনার হাজারটা প্রবলেম ছিল! কম ইনসাল্ট করেন নি আপনি আমাকে। আপনার কথার ঝাঁজে আমি কেঁদেছি অবধি। ভেতরে ভেতরে খুব আঘাত পেয়েছি। তবুও উপরে উপরে হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছি। ঐ রোজ মেয়েটার জন্য আপনি আমাকে কম অপমান অপদস্ত করেননি। কম হুমকি ধামকি দেননি।

কাজিন হিসেবেও মিনিমাম সম্মানটুকু দেননি। কিন্তু কী হলো হ্যাঁ? শেষ পর্যন্ত পেরেছেন তাকে ধরে রাখতে? পেরেছেন তাকে আগলে রাখতে? তাই কোনোকিছুতেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা ভালো নয় বুঝেছেন? আর আপনিও আমার সাথে এসব ফালতু বাড়াবাড়ি করা কমিয়ে দিন! আপনিও ভালো থাকুন। আর আমাকেও ভালো থাকতে দিন। এসব ফালতু ইমোশন নিজের কাছেই রাখুন! দয়া করে আমাকে এসব আর দেখাতে আসবেনা। সত্যি বলছি মন থেকে আপনাকে আমি একরত্তিও পছন্দ করিনা! আর ভালোবাসা তো দূরে থাক।”

নূর সম্পূর্ণ শকড হয়ে বসে রইল। চাঁদের রুক্ষতা তার ভেতরটাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলল। মাথায় এক প্রকার অসহ্য যন্ত্রণার অনুভব হলো তার। চাঁদকে সে ঘুনাক্ষরেও বুঝাতে পারছেনা সেই যন্ত্রণার কথা। আর একদণ্ড চাঁদের মুখোমুখি বসে থাকা মানে হলো মরণ তার চোখের সামনে দেখা! নিজেকে কোনোরকম ধাতস্থ করল নূর। শুকনো ঢোঁক গিলে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আমার ইমোশন তোমার ফালতু মনে হয়?”
“হ্যাঁ হয়! ফালতু-ই মনে হয়। ফালতু না হলে হুট করেই আমার প্রতি এতো ইমোশন জন্ম নিলো কোথা থেকে শুনি হ্যাঁ?”
নূর নির্বিকার গলায় বলল,,

“হুট করেই কিন্তু ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে যায় না। এর দীর্ঘ একটা প্রসেস থাকে। আমি তোমাকে এক দুইদিনে ভালোবাসিনি। ভালোবাসা হতে সময় লেগেছে। লাভ এট ফার্স্ট সাইড। বিশ্বাস করো না তুমি এতে?”
“না করিনা। মোট কথা আমি আপনাকে সহ্য করতে পারিনা! আর জোর করেও কারো প্রতি ইমোশন আনা যায়না। আমিও আমার মনকে কোনো ভাবেই জোর করতে পারিনা।”

নূরের মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলোনা। চোখে বেদনার একসমুদ্র জল নিয়ে সে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। হনহন করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা আয়মন এবার বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদের দিকে সে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। খরখরে গলায় বলল,,

“বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললি না? কারো ইমোশনকে এভাবে ফালতু বলার রাইট নেই তোর।”
“বাড়াবাড়ি আমি করিনি৷ করেছে তোমার ফ্রেন্ড! তুমিই বলোনা পাঁচ ছয়মাসের ব্যবধানে কীভাবে সম্ভব নতুন করে আবার আমাকে ভালোবেসে ফেলা? ভালোবাসা কী এতোই সহজ?”

“যেদিন তুইও নূরকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবি না? সেদিন তুইও বুঝতে পারবি কীভাবে সম্ভব একবারের একটুখানি চাহনিতেই কাউকে ভালোবেসে ফেলা! তার সাথে গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প করা।”

নূরের পিছু পিছু ছুটল আয়মন। তবে লাভ কিছু হলোনা এতে! ঝুম বৃষ্টিতে নূর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় নেমে গেল। ভেতর থেকে এক অভেদ্য গোঙানির আওয়াজ নির্গত হচ্ছে তার। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। একতরফা রাগে-জেদে-দুঃখে দাঁতে দাঁত সংঘর্ষ হচ্ছে। অর্ধফাঁকা রাস্তায় সে বৈরাগ্যের মতো দিশাহীনভাবে হেঁটে চলছে! এলোমেলো তার সমস্ত চিন্তাভাবনা। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক জ্বলন হচ্ছে। যার প্রভাবে তার চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি ঝরছে!

বৃষ্টির ফোঁটার সাথে চোখের সেই জলগুলো মিশে আশপাশটা ঝাপসা হয়ে এলো তার। রাস্তা-ঘাট, যানবাহন কিছুই ঠাওর করতে পারলনা সে। হঠাৎ করেই পিছন থেকে জোরে জোরে গাড়ির হর্ণ বাজতে লাগল। অতিষ্ট হয়ে উঠল নূর এই জোরালো হর্ণের আওয়াজে। পিছু ঘুরে তাকাতেই দেখল বড়ো একটি ট্রাক ধেঁয়ে আসছে তার দিকে! সঙ্গে সঙ্গেই সে পিছু হটে দাঁড়ালো। তীব্র আতঙ্কতায় ডান হাত দ্বারা কান দুটো চেপে ধরল। হতাশায় মোড়ানো রক্তিম চোখজোড়া বুজে সে গর্জণ করে বলল,,

“আমার ইমোশনকে তোমার ফালতু মনে হয় না? আমার ভালোবাসাকে তোমার বাড়াবাড়ি মনে হয়? কু’ত্তাটার মতো যে তোমার মন জোগানোর জন্য আমি সারাটাক্ষণ তোমার পেছনে পড়ে থাকি বুঝতে পারো না তুমি? ওকে ফাইন! আজ থেকে নূর আর তার ভালোবাসা তোমার কাছে জাহির করবেনা। তার হৃদয় নিংড়ানো কোনো অনুভূতির কথাও তোমার কাছে প্রকাশ করতে যাবেনা। তোমাকে পাওয়ার আক্ষেপে তার মরণব্যধি দেখা দিলেও সে তোমার কাছে ধরা দিবেনা। কারণ, তোমরা কেউ আমার অনুভূতি বুঝোনা! তোমরা শুধু বেগ বুঝো, আবেগ বুঝোনা!”

আয়মন মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রেস্টুরেন্টের বর্হিপথে সে থম মেরে দাঁড়িয়ে নূরের হারিয়ে যাওয়া দেখল। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা চাঁদের কথায় নূর ঠিক কতখানি আঘাত পেয়েছে। এখন তার পিছু ছুটেও আর কোনো লাভ নেই। খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা সে এখন থেকেই বেশ আঁচ করতে পারছে!

অন্যদিকে তাশফিয়া এবং জায়মা চাঁদকে হাত দ্বারা পিঞ্চ করছে। চাঁদ রাগের চোটে এসব এলোপাথাড়ি কী বলে ফেলল তার জন্য তারা চাঁদকে বকতে আরম্ভ করল। বিশেষ করে জায়মা খুব রেগে গেল চাঁদের উপর। চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এসব কী বললি তুই নূর ভাইয়াকে হ্যাঁ? কিছুদিন আগে না বললি নূর ভাইয়াকে দেখলে তোর অন্যরকম ফিলিংস কাজ করে? ভালোলাগা কাজ করে? তাহলে আজ কেন এমন অন্য সুরে কথা বললি হ্যাঁ? কেন নূর ভাইয়াকে এভাবে হার্ট করলি?”
চাঁদ পুরোপুরি শান্ত রইল। সোজাসাপটা গলায় বলল,,

“দেখ জায়মা? নূর ভাইয়াকে আমার জাস্ট ভালো লাগে। লোকজন বলেনা ক্রাশ? আমারও নূর ভাইয়াকে ক্রাশই মনে হয়! উনাকে পেতে হবে, ভালোবাসতে হবে, সম্পর্কে জড়াতে হবে এমন কোনো ফিলিংস এখনো কাজ করেনা! তো এখন আমি কী করব হ্যাঁ? কেনো উনার এসব ওভার পজেজিভনেসকে এভাবে সায় দিব?”

“ওকে ফাইন মেনে নিলাম। নূর ভাইয়ার প্রতি তোর কেবল ভালোলাগা কাজ করে। তবে যদি দুইদিন পর ঠিক উনার প্রতিই তোর ভালোবাসা কাজ করে তখন কী করবি হ্যাঁ? পারবি তখন এই মুখ নিয়ে উনার সামনে দাঁড়াতে? এতোকিছুর পরেও তুই আশা করিস উনি তোকে গ্রহণ করবে?”

“তুই একটু বেশিই ভাবছিস জায়মা। যে জায়গায় আমাদের পরিবারের বড়ো মেয়ে ঐ বাড়ির বড়ো ছেলের বউ। সেই জায়গায় আমিও একই পরিবারে নতুন কেউ হতে যাব? দূরে থাকলেই সম্পর্ক ভালো থাকে জানিস? সম্পর্ক বাড়ানোর চেয়ে এখন যে সম্পর্কটা আছে তাকে ধরে রাখাটাই শ্রেয়।”

জায়মা আর কথা বাড়ালোনা। চাঁদের প্রতি তার রাগ জমতে লাগল। ধপ করে সে চেয়ারে টেনে বসে পড়ল। জায়মার সাথে সাথে তাশফিয়াও বসল। দুজনই মন খারাপ করে বসে রইল। চাঁদ বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে গেল। বেপাত্তা হয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল।

মধ্যরাত প্রায় তিনটা। ঘুমের তীব্র রেশ ছড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টির তাণ্ডবে শিথীল রূপ ধারণ করা এক আংশিক ভূমণ্ডলে। আরামদায়ক ঘুমে লিপ্ত ঘুমপ্রিয় মানুষরা। তবে ঘুম নেই শুধু আয়মনের চোখে। তার রুমের লাইন এখনো জ্বলছে! মাহিন এবং নূরকে নিয়ে সে পড়েছে মহাফ্যাসাদে! দুজনই জ্বরে প্রলাপ বকছে!

বৃষ্টিতে বেশি সময় ধরে ভেজার দরুন দুজনেরই তুখোড় জ্বর উঠেছে! নূর ভিজেছিল বিচ্ছেদের তাড়নায়। আর মাহিন ভিজেছিল তিথীকে ক্যাম্পাসের কোথাও খুঁজে না পেয়ে! তিথীকে না দেখার বিরহ থেকে! আয়মনের দু’পাশে দুইভাই তাদের ভালোবাসার মানুষদের নাম ধরে চ্যাচাচ্ছে আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে!

একজন চাঁদ বলে বুলি আওড়াচ্ছে তো অন্যজন তিথী বলে ফ্যাস ফ্যাস করছে। দুই অদ্ভুতূড়ে প্রেমিকের মাঝখানে পড়ে আয়মন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কী করবে না করবে কোনো উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছেনা সে। দুজনেরই কপালে হাত রাখা যাচ্ছেনা। শরীরের টেম্পারেচার উর্ধ্বগতিতে। এতো রাতে সে সাবরিনা আবরারকেও ডেকে দিতে পারছেনা। বয়স্ক শরীর। ঘুম ভেঙে গেলে সমস্যা। এইদিকে জ্বরে ভুক্ত দুই রোগীকেও মাথায় জলপট্টি দিতে পারছেনা। জায়গা থেকেই কোনোভাবে উঠতে পারছেনা সে। দুজনই আয়মনকে তাদের মাঝখানে বন্দি করে রেখেছে! এরমধ্যেই মাহিন ঘোরের তাড়নায় অস্পষ্ট সুরে বলল,,

“তুমি কই গেলা তিথী হ্যাঁ? আমারে ছাইড়া কই গেলা? পুরো ক্যাম্পাসটা খুঁইজাও তোমারে পাইলামনা। বৃষ্টিতে একা একা ভিজে এখন আমার তুখার জ্বর বেঁধে গেল। তুমি পাশে থাকলে তো শরীরটা এমনিতেও গরম থাকত! তোমার হাতে হাত ধরে রাখলে এভাবে জ্বর টর বাঁধত না।”

নূর হঠাৎ চট করে শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়ালো। উদোম শরীরে সে নড়বড়ে শরীর নিয়ে রুমের দরজার দিকে হাঁটা ধরল! গোঙাতে গোঙাতে বলল,,

“এরে পানি ঢালতে হবে আয়মর। গরম পানি এর গাঁয়ের উপর ঢেলে চামড়া শুদ্ধ ছিলতে হবে! মেয়েদের এভাবে পাগলের মতো ভালোবাসতে নেই! এরচেয়ে ভালো আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া!”
প্রস্থান নিলো নূর। আয়মন নির্বোধ দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। খিটখিটে গলায় বলল,,
“শা’লার মাথা কী গেছে? সত্যিই কী মাহিনকে ছিলবে আজ?’

এলোমেলো পায়ে হেঁটে নূর রাস্তা ভুলে সোজা বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো! কম্পিত হাতে দরজার খিলটা খুলতেই সে ছোট্টো পুচির মুখোমুখি হয়ে গেল! নূরকে দেখামাত্রই পুচি শান্ত স্বরে ম্যাও ম্যাও বলে ডেকে উঠল। কোমড়ে ভর করে সে স্থির রূপে দাঁড়ালো। ঝাপসা চোখে পুচির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নূর। দরজা থেকে দু’কদম হেঁটে সে ধপ করে পুচির মুখোমুখি বসে পড়ল! পুচির দিকে খানিক ঝুঁকে এসে মিনমিনে গলায় বলল,,

“তুই হঠাৎ এখানে কেন হুম? তোর মালকিন কই?”
পুচি জিভ চেটে পুনরায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। অসহায়ের মতো ভাব নিলো। পুচির শরীরের গন্ধ থেকে নূরের হাচ্চি কাশি শুরু হলো। বিতৃষ্ণা হয়ে নূর নাক ঢেকে নিলো। ঢুলুঢুলু চোখে পুচির দিকে তাকালো। বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,,
“তোর মালকিনের খুব ভাব না? একটা ছেলে তার ভালোবাসায় পাগল বলে তাকে যা ইচ্ছে তা বলে অপমান করবে? মেয়েরা এত নিষ্ঠুর কেন হয় জানিস? কেন তারা ছেলেদের মনের গাঢ়-গভীর অনুভূতিগুলো বুঝতে চায়না বল তো? কেন তারা আমাদের অনু্ভূতি নিয়ে মজা করে জানিস তুই?”

অমনি চাঁদের আবির্ভাব ঘটল একতলার সিঁড়িতে! হন্ন হয়ে সে পুচিকে খুঁজতে লাগল। ভয়ার্ত গলায় পুচির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আয়মনদের ফ্ল্যাটের সামনে চলে এলো। চাঁদকে এক ঝলক দেখা মাত্রই নূরের চোখের কোণায় জল জমে এলো। অচিরেই সে মাথা নুইয়ে নিলো। নাক টেনে দুঃখ সংবরণ করল।

চাঁদের গলার আওয়াজ পেয়ে কী হলো জানিনা পুচি হঠাৎ দৌঁড়ে নূরের পিছনে আশ্রয় নিলো! নূরের পিঠের সাথে একাত্নভাবে মিশে রইল। মনে হলো যেনো নূর ছাড়া পৃথিবীতে তার আরও আপন কেউ নাই। পুরো বিষয়টাতে নূর বেশ অবাক হলো! পুচির আবার কী হলো? কেন সে চাঁদের গলার আওয়াজ পেয়েও নূরের পেছনে নিজেকে লুকালো? কী মাজরা লুকিয়ে আছে এর ভিতরে?

এরমধ্যেই চাঁদের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকা নূরের দিকে। দ্রুত পা ফেলে সে নূরের দিকে এগিয়ে এলো। বিমূর্ষ হয়ে বসে থাকা নূরের দিকে উজবুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। উদ্বেগি গলায় শুধালো,,
“কী ব্যাপার? এই মাঝরাতে আপনি এখানে কী করছেন?”
চাঁদের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলানোর সাহস পেলনা নূর। তাই সে মাথা নুয়ানো অবস্থাতেই প্রত্যত্তুরে বলল,,
“কিছুনা। তুমি এতো রাতে এখানে কী করছ?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৪

“পুচিকে খুঁজতে এসেছিলাম। দিন দিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছে পুচিটা৷ বারবার পড়ার মাঝখানে এসে আমাকে ডিস্টার্ব করছিল। তাই রাগের চোটে দু’ঘা দিয়েছিলাম! এরপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছিনা। আপনি দেখেছেন পুচিকে কোথাও?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৬