প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৬

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৬
নিশাত জাহান নিশি

“পুচিকে খুঁজতে এসেছিলাম। দিন দিন ফা’জিল হয়ে যাচ্ছে পুচিটা৷ বারবার পড়ার মাঝখানে এসে আমাকে ডিস্টার্ব করছিল। তাই রাগের চোটে দু’ঘা দিয়েছিলাম! এরপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছিনা। আপনি দেখেছেন পুচিকে কোথাও?”

নূর বিচলিত হয়ে উঠল। এই পর্যায়ে এসে ঠিক বুঝতে পারল পুচি হঠাৎ কেন তার সাথে এতো ভাব জমালো! কেন অবলা প্রাণীর ন্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য নূরের পেছনে এসে এভাবে আশ্রয় নিলো। অভিমান জমেছে পুচির চাঁদের উপর! বোবা প্রাণী বিধায় ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারছেনা। ভাবভঙ্গিতে ঠিক বুঝিয়ে দিচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কী অদ্ভুত লীলা জগতের! সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণীর-ই রাগ, অভিমান, হিংস্রতা, দয়া-মায়া, ভালোবাসা সব কাজ করে। হয়তো কেউ বলে বুঝাতে পারে, আর কেউ বা পারেনা। পুচির ভঙ্গিমা দেখে আনমনেই নূর কিঞ্চিৎ হাসল! মাথাটা ঈষৎ ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,

“মালকিনের মতোই হয়েছে আগা গোড়া ঢঙি! কেউ কোনো অংশেই কম নয়! পুচিকে এখন কীভাবে সেইফ করব আমি? চাঁদকে বলব পুঁচি এখানে আসেনি? মিথ্যে বলব চাঁদকে? আবারও তার কাছে নিজেকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করব?”
নূরের মৌনতা দেখে চাঁদ বিরক্তবোধ করল। এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে পুচিকে খুঁজতে লাগল। তবে বরাবরই সে ব্যর্থ হলো। কোথাও খুঁজে পেলনা পুচিকে। অতঃপর চাঁদ নাক সিটকালো। কোমরে দু’হাত গুজে বলল,,

“কী হলো বলুন? পুচিকে কোথাও দেখেছেন?”
দোটানায় জর্জরিত নূর। কী বলবে না বলবে ভেবে হয়রান হয়ে উঠছিল। জ্বরের তাড়নায় তার শরীরটাও ক্রমাগত বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ হয়ে উঠছিল। সমস্ত শরীর জ্বালা-পোড়া করে উঠল। মাথাটাও কেমন ঝিম ধরে এলো। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। নাকের গড়িয়ে পড়া সর্দি মুছে নূর অস্ফুটে গলায় বলল,,

“না দেখিনি কোথাও! তুমি এখন যেতে পারো। রুমে যাব আমি।”
চাঁদ পুনরায় চিন্তিত হয়ে উঠল। পুচি কোথায় গেল বা কোথায় যেতে পারে তা ভাবতে ভাবতে সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। চোখে-মুখে দুঃশ্চিতার ছাপ ফুটিয়ে উল্টোদিকে ঘুরল চাঁদ। দ্রুত পা ফেলে দু’তলার সিঁড়িতে পা বাড়ালো। এতো রাতে পুচি বাড়ির বাইরে কোথাও যাবেনা এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত সে। হয়তো প্রচুর রাগ করে বাড়ির চিপায়-চাপায় কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। লণ্ডভণ্ড শরীর নিয়ে নূর বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। মিনমিনে গলায় পুচিকে বলল,,

“চলে গেছে ভূমিকম্পটা। তুই কি আজ রাতটা আমার সাথেই থাকবি?”
অমনি পুচি নূরের পায়ের ফাঁক দিয়ে পেছন থেকে তার সামনে চলে এলো। আহ্লাদি হয়ে নূরের পা দুটো আঁকড়ে ধরে পুনরায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো আজ রাতটা সে নূরের সাথেই থাকতে চায়! পুচির প্রতি আলাদা এক মায়াবোধ জন্ম নিলো নূরের! অকেজো শরীরেই সে উবুড় হয়ে পুচিকে তার কোলে তুলে নিলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পুচিকে তার উষ্ণ বুকের মাঝে একাত্নভাবে মিশিয়ে নিলো। আক্ষেপভরা গলায় বলল,,

“চাঁদকে দেখলে তার প্রতি যে মায়াবোধের জন্ম নেয় না? আজ কেন জানিনা তোকে দেখেও আমার সেই মায়াবোধের জন্ম নিচ্ছে! তোরা দুজনই কি একই সত্ত্বা? কী জাদু আছে তোদের মাঝে বল তো?”
অমনি নূরের হাচ্চি-কাশির মাত্রা আরও বেড়ে গেল! এক সেকেন্ড অন্তর অন্তর সে হাচ্চি দিতে লাগল। তার শরীর আরও অতিরিক্ত খারাপ হয়ে উঠল। উপরের তলা থেকে চাঁদ হঠাৎ নূরের হাচ্চি-কাশির আওয়াজ শুনতে পেল। সন্দিহান হয়ে সে বিড়বিড় গলায় বলল,,

“এই লোকটা হঠাৎ এতো হাচ্চি দিচ্ছে কেন হ্যাঁ? পুচি কি তাহলে এই লোকটার কাছেই আছে? একবার গিয়ে দেখে আসব?”
যেই ভাবা সেই কাজ। এক দৌঁড়ে চাঁদ দু’তলার সিঁড়ি টপকে একতলায় নেমে এলো। নূরও এই সময় ফ্ল্যাটের দরজাটা লাগাতে যাচ্ছিল। অমনি চাঁদ প্রাণপণে দৌঁড়ে এসে নূরকে বাঁধা দিলো! স্ব-চক্ষে নূরের কোলে পুচিকে দেখতে পেল। তৎক্ষণাৎ তার মাথায় রক্ত চেপে বসল। চোয়াল শক্ত করে সে চুপসে থাকা নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই? এতো মিথ্যেবাদী কেন আপনি হুম? একটু আগে না বলছিলেন পুচিকে আপনি দেখেন নি?”
নূর কম্পিত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। কিছুতেই সে কোথাও তার দৃষ্টি স্থির করতে পারছেনা। শরীরের অবস্থা বেহাল তার। ক্রমাগত নেতিয়ে উঠছে। তাই সে অস্পষ্ট সুরেই জবাবে বলল,,

“আমি কী করব? পুচিই তো তোমার সাথে যেতে চাইছিলনা। আবদার করে বলল আজ আমার কাছেই থাকবে।”
চাঁদ রাগান্বিত ভাব নিলো। নূরের সাথে কোনো কথা না বাড়িয়ে সে পুচিকে নূরের কোল থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। দাঁতে দাঁত চেপে অভিমান পুষে রাখা পুচিকে বলল,,

“তুই আমার সাথে যাবিনা তাই না? আমাকে ছেড়ে অন্য একটা ছেলের সাথে থাকবি? অন্যায় করলে মারধরও করা যাবেনা না এখন? মুখটা ফুলিয়ে রাখতে হবে? আদরে আদরে বাঁদর তৈরি করছি।”
পুচি মন্থর গতিতে ম্যাও ম্যাও বলে ডাকতে লাগল। নূরকে ছেড়ে সে চাঁদের কাছে যেতে নারাজ বুঝাল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে এসে চাঁদের হঠাৎ অনুভব হলো নূরের শরীরটা সাংঘাতিক গরম হয়ে আছে। একটু স্পর্শ লাগাতেই মনে হলো হাতটা যেনো তার পুড়ে গেল! উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল চাঁদ। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূরের দিকে তাকালো। শুকনো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“জ্বর আপনার?”
নূর ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। চাঁদ একরত্তিও বিশ্বাস করলনা নূরের কথায়। উতলা হয়ে সে বিনা সংকোচে নূরের কপালে হাত রাখল! আগুনে হাত রাখা আর নূরের মাথায় হাত রাখা তার কাছে একই মনে হলো! অমনি চাঁদ হাতটা সরিয়ে নিলো। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। উত্তেজিত গলায় শুধালো,,

“মিথ্যে বলছিলেন কেন হ্যাঁ? সত্যিই তো আপনার সাংঘাতিক জ্বর।”
নূর হেয় হাসল। অর্ধখোলা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,
“আমার সব কথাই তো তোমার মিথ্যে মনে হয় তাই না? তাই আপাতত সত্যি বলাটাকে বাঞ্চনীয় মনে করছিনা! তুমি এখন যেতে পারো চাঁদ। আমি এখন ঘুমুবো!”

“এতো জ্বর নিয়ে কীভাবে ঘুমাবেন হ্যাঁ? ঘুম আসবে?”
“আমাকে নিয়ে তোমার এতো ভাবতে হবেনা চাঁদ। অসুখ তুমি দিয়েছ। সারানোর মালিক আমি। যেভাবেই হোক আমি নিজেকে সারিয়ে তুলব। যদি উপর ওয়ালা সহায় হোন তো! এবার তুমি যেতে পারো।”
“খালামনিকে ডেকে দিই একবার?”

“না। মা ঘুমুচ্ছে। অযথা বিরক্ত করতে হবেনা। ঘুম ভালোভাবে না ফুরালে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যায়। চাইছিনা মা অসুস্থ হয়ে পড়ুক।”

রাগে বুদ হয়ে থাকা পুচিকে নিয়ে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! মনটা তার হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বুঝতে পারছিলনা নূরকে এভাবে ফেলে যাওয়াটা তার উচিৎ হবে কিনা। বিমূর্ষ হৃদয় নিয়ে নূর দরজা আটকানোর পূর্বেই চাঁদ হঠাৎ আবার দৌঁড়ে এলো নূরের কাছে! দরজা আটকানোতে বেগড়া দিলো সে। পুচিকে কোল থেকে নামিয়ে বিক্ষুব্ধ নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ছটফটে গলায় বলল,,

“একজন মানুষকে এভাবে অসুস্থ অবস্থায় রেখে আমি চলে যেতে পারিনা নূর ভাইয়া। তার সেবা করাটাকেই এখন পরম দায়িত্ব বলে মনে করছি।”

জবাবে নূরকে কিছু বলার সময় দিলোনা চাঁদ! নূরের ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে সে নূরকে টেনে হেছড়ে জোর করে সোফায় শুইয়ে দিলো। নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। কী থেকে না হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকলনা। তার শরীর এখন এতোটাই খারাপ হয়ে গেল যে কোনোরকম রিয়েক্টও করতে পারলনা সে।

কেবল অসহায়ত্বে ভরা চোখ দিয়ে সব দেখছে। বাকশক্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার। ভেতরে ভেতরে পুরোটা শরীর কবেল চিবিয়ে উঠছে। সারা শরীর ব্যথা করছে। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ থেকে তার টলটলিয়ে পানি ঝড়ছে! অবিলম্বেই চোখজোড়া বুজে এলো তার। নূরের এই মুমূর্ষু অবস্থা দেখে চাঁদ আরও ঘাবড়ে উঠল।

উদগ্রীব হয়ে সে নূরের সামনে থেকে ওঠে আয়মনের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। আয়মনের রুমে উঁকি মারতেই দেখল আয়মনও যেনো কারো মাথায় পানি ঢালছে! আরেকটু ভেতরে যেতেই দেখতে পেল আয়মন মাহিনের মাথায় পানি ঢালছে। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা মাহিনেরও জ্বর হয়েছে। আয়মনের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো চাঁদ। উদ্বেগি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ইশশশ দু-ভাইয়েরই একসাথে জ্বর হয়েছে?”
পিছু ফিরে তাকালো আয়মন। চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এতো রাতে তুই এখানে কী করছিস?”
“সে কথা না হয় পরে হবে ভাইয়া। আগে রোগীকে সুস্থ করতে হবে।”

একমুহূর্তও দাঁড়ালোনা চাঁদ। আয়মনের ওয়াশরুমে প্রবেশ করে ছোটো একটি বালতিতে পানি ভরে একটি মগ এবং একটি তোয়ালে নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে রওনা হলো। সোফায় নূরের পাশে সে হাঁটু গুজে বসল। নূরের মাথাটা খানিক ডানপাশে হেলিয়ে দিলো। তারপর মগ কেটে নূরের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। হঠাৎ ঠাণ্ডার অনুভূতি পেয়ে সে নড়েচড়ে উঠল। দাঁতে দাঁত সংঘর্ষ হতে লাগল। শরীরের প্রতিটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠল। হাত দ্বারা শরীরটা ঢেকে নেওয়ার চেষ্টা করল। চোখ বুজে রেখেই মিনমিনে গলায় বলল,,

“শীশীশীত।”
উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে চাঁদ তার গাঁয়ের ভারী সুতির ওড়নাটা নূরের গাঁয়ে মেলে দিলো! ব্যস্ত গলায় বলল,,
“নিন। এবার আর শীত করবেনা।”

ওড়নাটা ভালোভাবে গাঁয়ে পেচিয়ে নিলো নূর। তবুও সে শীতে কাঁপতে লাগল। মিনমিনে গলায় প্রলাপ বকতে লাগল। চাঁদ খুব যত্নের সহিত নূরের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। নূরের প্রতি জমে থাকা রাগ-অভিমান কিছু মুহূর্তের জন্য সে মাটিচাপা দিলো। জ্বরের ঘোরে নূর হঠাৎ করেই চাঁদের বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে গেল! পরম ভালোবাসায় হাতটা তার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরল। অধীর গলায় বলল,,

“প্লিজ চাঁদপাখি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না! তুমি ছেড়ে গেলে আমার এই হার্টটা বিট করা বন্ধ করে দিবে চাঁদ৷ ম’রে যাব আমি! বিশ্বাস করো ম’রে যাব আমি! তোমার বিরহে আমি ম’রতে বাধ্য হবো।”

নূরের প্রলাপকে আমলে নিলো না চাঁদ! বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিলো। তৎক্ষণাৎ নূরের বুকে পাজর থেকে এক ঝটকায় সে হাতটা সরিয়ে নিলো! গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে আবারও নূরের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। প্রায় আধঘণ্টা যাবত মাথায় ঢালার পর নূরের হঠাৎ চোখ লেগে এলো। জ্বরের প্রকোপ নামতেই সে শান্তির ঘুম দিলো। যাওয়ার সময় চাঁদ নূরের কপালে ভালো করে জলপট্টি দিয়ে গেল। তার গাঁয়ের ওড়নাটাও নূরের গাঁয়েই রয়ে গেল। শেষবারের মতো নূরের দিকে তাকিয়ে সে বিদ্রুপাত্নক হেসে বলল,,

“রোজ আপুর সাথে ব্রেকাপের সময়ও আপনি এই কথাটাই বলেছিলেন নূর ভাইয়া। রোজ আপুকে ছাড়া আপনি বাঁ’চবেন না! কিন্তু বেঁচে তো আছেন? এসব শুধু কথার কথা নূর ভাইয়া। আদোতে কেউ কারো জন্য ম’রেনা! সবাই বাঁচে। হয়তো সীমিত সময়ের জন্য কষ্ট পায়। তবে একটুখানি সুখের ছোঁয়া পেলেই আবার সেই পুরোনো ক্ষত ভুলে যায়।”

পরের দিন সকাল ঠিক এগারোটায় ঘুম ভাঙল চাঁদের! সারারাত পড়াশোনা করে সে প্রায় ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘুম থেকে উঠতে অনেকটাই বেলা হয়ে গেল তার। অর্ধখোলা চোখে সে ঘুম থেকে ওঠেই পুরো বাড়িটা ফাঁকা দেখতে পেল! বাড়িভর্তি মেহমান কাউকেই দেখতে পেলনা কোথাও।

পুরো বিষয়টাতে চাঁদ বেশ অবাক হলো। কৌতূহল দূর করতে সে চোখ কচলাতে কচলাতে সোহানীর রুমে প্রবেশ করল। ঘটে গেল আরেক বিপত্তি! বিছানার উপর হাঁটু ভাজ করে সোহানী ন্যাকা কান্না করছে! কিছুক্ষণ পর পর শাড়ি দিয়ে চোখের জল মুছছে তো কিছুক্ষণ নাকের জল মুছছে। তৎক্ষণাৎ চোখ থেকে হুড়মুড়িয়ে ঘুমেরা বিদায় নিলো চাঁদের। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সে সোহানীর দিকে তাকালো। দরজার ওপার থেকেই প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হয়েছে আপু? তুমি কাঁদছ কেন?”
জলে ভেজা চোখ দুটো উঠিয়ে সোহানী দরজার ঐ প্রান্তে থাকা চাঁদের দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হেচকি তুলে বলল,,
“ওরা সবাই ঢাকা ফিরে গেছে চাঁদ।”
চাঁদ অবাক হলো। নাক-মুখ কুচকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“এ্যাঁ! এই জ্বর নিয়ে নূর ভাইয়া ঢাকা ফিরে গেছে? জ্বরটা ভালো হলে আর একদিন পরে গেলে কী হতো?”
মনে মনে দুঃশ্চিন্তা করলেও চাঁদ সোহানীর সামনে স্বাভাবিক থাকার ভাব নিলো। ভাবলেশহীন গলায় বলল,,
“হ্যাঁ তো? কী হয়েছে? এর জন্য কাঁদতে হবে?”

“তুই কী বুঝবি হ্যাঁ? তুই কী বুঝবি? তোর কি জামাই আছে যে বুঝবি? কত ভালো লাগত যখন নীড়টা আমার আশেপাশে থাকত। এখন তো টানা পনেরোদিন দেখা হবেনা আমাদের! কীভাবে থাকব আমি হ্যাঁ?”
চাঁদ হেঁতো হাসল! ব্যগ্র গলায় বলল,,

“ছিঃ আপু ছিঃ! তুমি এতো জামাই পাগলি? বাপের বাড়িতে থেকেও কেমন জামাই জামাই করছ?”
সোহানী বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। রাগ দেখিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদের দিকে রুখে এসে বলল,,
“দাঁড়া আজ আমি তোরে খা’ইছি। আমার ইমোশন নিয়া ফাই’জ’লামি করিস না?”

চাঁদ আর একমুহূর্তও এখানে দাঁড়ালোনা। দৌঁড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচতলায় নেমে গেল। উচ্চ আওয়াজে চিৎকার করে বলল,,
“তোমার মতো এতো জামাই পাগলি মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি আপু! তুমিই আছো এক পিছ! বাপের বাড়িতে সুখে থেকেও কেবল জামাই জামাই করো।”

ফ্ল্যাটের সদর দরজা চাঁদ বাইরে থেকে আটকে দিয়েছিল বিধায় সোহানী হাজার চেষ্টা করেও ফ্ল্যাট থেকে বের হতে পারেনি। চাঁদকে আর ধাওয়াও করতে পারেনি। শরীরের সব রাগ তার শরীরেই মজলো। ভাগে না পেয়ে চাঁদকে আচ্ছেমতো বকতে লাগল সে। দু’বোনের কাণ্ড দেখে সামিয়া আহমেদ রান্নাঘর থেকে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। কোথাও না কোথাও কষ্টের ছাপও বয়ে বেড়ালেন! আর মাত্র পনেরো দিন!

পনেরো দিন পরই এই বাড়িটা পুরো ফাঁকা হয়ে যাবে। দুবোনের খুনশুটি আর দেখা হবেনা তাদের! কথায় কথায় ঝগড়া, মারামারি সব বন্ধ হয়ে যাবে! পুরো বাড়িটা নীরবতায় বিলীন হয়ে যাবে।
গতকাল রাতেই সোহানী এবং নীড়ের বিয়ের ব্যপারে সমস্ত কথাবার্তা ভাঙচূড় করা হয়েছে। আজ বৈশাখ মাসের দশ তারিখ। বৈশাখ মাসের আগামী পঁচিশ তারিখ সোহানী এবং নীড়ের বিয়ের দিন/ তারিখ/ ক্ষণ ঠিক করা হয়েছে।

এর ফাঁকে চাঁদ এবং জায়মার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালও শেষ হয়ে যাবে। এমনকি বিয়ের প্রস্তুতিও সুস্থ মতো নেওয়া যাবে। আর মাত্র দুটো পরীক্ষা বাকি আছে তাদের। আগামী ছয়দিনের মধ্যেই পরীক্ষার অন্তিম ক্ষণ পাড় করবে তারা। সোহানীর বিয়েটাও ফ্রিলি এঞ্জয় করতে পারবে।

এরমধ্যে আরেকটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সোহানীর বিয়েটা কুমিল্লা থেকে নয় বরং ঢাকা থেকেই হবে! কারণ কুমিল্লা টু ঢাকা জার্ণি করতে করতে দুই পরিবারের সবারই বেশ অসুবিধা হবে। ধকলের উপর ধকল যাবে। তাছাড়া তাদের সমস্ত রিলেটিভসদের বাড়ি ঢাকাতেই।

তাই বিয়েতে এটেন্ড করতে কারো তেমন কোনো অসুবিধা হবেনা। সবদিক বিবেচনা করেই অতঃপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে চাঁদ এবং জায়মার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই তারা সবাই ঢাকায় একটি হলরুম বুক করবে। ঐ হলরুম থেকেই সোহানী এবং নীড়ের বিয়েটা হবে। এখন থেকেই জিনিসপত্র যা আছে যাবতীয় সব গোছগাছ করে রাখতে হবে। পরবর্তীতে যাওয়ার সময় যেনো কোনো ভেজাল না হয় তাই।

চাঁদ হাসতে হাসতে বাড়ির আঙিনায় পা বাড়াতেই হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল দোলনায় বসে থাকা দুষ্টু পুচির দিকে। পুচি কোনো একটা সাদা রঙের কাগজ নিয়ে বেশ খেলাধূলা করছে। কাগজটাকে সে কিছুক্ষণ কামড়াচ্ছে তো কিছুক্ষণ পা দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে। তার বেশ কঠিন মনোযোগ এই কাগজটির দিকে। যেকোনো মূল্যেই হোক ভাজ করা কাগজটিকে তার খুলতেই হবে। দেখতে হবে কাগজটিতে কী আছে। কোনো মাছের কাটাকুটা আছে কিনা! আদুরে হয়ে চাঁদ পুচির দিকে এগিয়ে গেল। আহ্লাদি গলায় শুধালো,,

“উলে লেলেলে! আমার পুচিসোনাটা এখানে কী করছে হ্যাঁ? কী নিয়ে খেলছে সে?”
চাঁদের আওয়াজ পেয়ে পুচি চোখ তুলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অগ্রে তাকালো। চাঁদকে দেখামাত্রই সে পিছু ফিরে গেল! কাগজটা লুকানোর অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা করল।

শেষ অবধি কোনো উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে সে কাগজটির উপরই বসে পড়ল! চাঁদের দিকে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আক্রোশিত গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল৷ চাঁদকে বারণ করল যেনো তার কাছে না আসে। এই সময়ে চাঁদের উপস্থিতি তাকে বড্ড বিরক্ত করছে। পুচির পাকামো দেখে চাঁদ হাসতে হাসতে ফিট হয়ে গেল। বুকে হাত রেখে সে মন্থর পায়ে পুচির দিকে এগিয়ে এলো। অস্পষ্ট গলায় শুধালো,,

“আমার মেয়েটা দেখছি খুব পাকা হয়ে গেছে হ্যাঁ? কী লুকোচ্ছ তুমি মায়ের থেকে? দেখাও মাকে?”
পুচি গর্জে উঠল। কিছুতেই সে চাঁদকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিলোনা। এমন একটা পর্যায়ে এসে সে ফেঁসে গেল যে চাইলেও সে জায়গা থেকে উঠতে পারছেনা। জায়গা থেকে উঠলেই কাগজটা চাঁদ পেয়ে যাবে।

ঘটবে তখন আরেক আপত্তি! কাগজটা নিয়ে সে একদণ্ডও খেলতে পারবেনা। পুচির বাঁদরামো টের পেয়ে চাঁদ কৌশলে পুচির দিকে এগিয়ে দিলো। সুযোগ বুঝে খপ করে পুচিকে কোলে তুলে নিলো! টুপ করে চিঠিটা তার হাতে তুলে নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই পুচি ক্ষেপে গেল। ভয়ঙ্করভাবে ডেকে ওঠে চাঁদের গাঁয়ে আঁচড় কাটতে লাগল। পুচির এই অদ্ভুত আচরণ দেখে চাঁদ হেসে কুটিকুটি। অশান্ত পুচিকে শান্ত করার জন্য সে মোলায়েম স্বরে বলল,,

“আচ্ছা বুঝেছি তো কাগজটা তোমার লাগবে। আগে মা একটু দেখি নিই কাগজটাতে কী আছে। এরপর না হয় প্রমিস করছি কাগজটা মা তোমাকে দিয়ে দিব।”

কার কথা কে শুনে? পুচি সমানে চাঁদকে আচড় কেটে যাচ্ছে। একদণ্ডের জন্যও শান্ত হচ্ছেনা। চাঁদের উপর প্রখর বিদ্বেষ ফুটিয়ে তুলছে। চাঁদ কিছুক্ষণ পর পর ব্যথায় কুঁচকিয়ে উঠছে। তবুও কাগজটা সে খুলে দেখার অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ অবধি চাঁদ কাগজটা খুলেই ফেলল! অমনি তার চক্ষুজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল।

এটা শুধু একটা সাদা কাগজ নয়। এটা একটা খোলা চিঠিও বটে! গুটি গুটি অক্ষরে অনেকগুলো বাক্য লিখা চিঠিটিতে। সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ কৌতূহলী হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। হিংস্র পুচির কাছ থেকে সরে এসে অনেকখানি দূরে দাঁড়ালো। অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে চিঠিটি পড়তে লাগল। চিঠিটিতে সুন্দর, সাবলীল এবং গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,,

“প্রিয় চাঁদপাখি। ওহহো সরি! তোমাকে তো ‘চাঁদপাখি’ বলে সম্বোধন করার অধিকারটুকুও নেই আমার! সেই অধিকারটুকু হয়তো কেবলমাত্র সাদমানের জন্যই বরাদ্দ! জানি কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছ। তবে এটাই সত্যি! আমার ভালোবাসা তোমার চোখে মিথ্যা প্রমাণিত হলেও সাদমানের ভালোবাসা তোমার চোখে মিথ্যে হতে পারেনা।

কারণ, একসাথে দুটো মানুষ মিথ্যে হতে পারেনা! আমার ইমোশন তোমার কাছে ফালতু মনে হলেও সাদমানের ইমোশন তোমার কাছে একটু পাগলাটে মনে হবে! কারণ, একসাথে দুজন প্রেমিকের ইমোশন কখনো ফালতু হতে পারেনা। একজনকে ঠিক হতে হবে আর অন্যজন ভুল। সেই ভুলের খাতায় যেহেতু আমার নামটাই তোমার চোখে পড়ল তো ঠিক মানুষটা নিশ্চয়ই সাদমান হবে!

এই নিয়ে দু’দুটো বার আমি ভালোবাসা নামক ধোঁয়াশায় হেরে গেলাম। খুব বাজেভাবে হেরে গেলাম। জানিনা কেনো একফোঁটাও আপসোস হচ্ছেনা এতে! তবে নিজের প্রতি খুব ঘৃণা হচ্ছে। আমি এমন একটা নিকৃষ্ট মানুষ যাকে কেউ মন থেকে ভালোবাসতে পারেনা! তার অনুভূতি নিয়ে সবাই কেবল হাসি তামাশাই করতে পারে! তাই এবার আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি চাঁদ! কারো কাছ থেকে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পাওয়ার আশা আমি ছেড়ে দিব!

নিজের ভাঙা মনকে বুঝাব পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। যা আছে সব হলো আপেক্ষিক, মিছে মায়া। মায়া জিনিসটা আমি যতোই কাটিয়ে উঠতে পারব ততোই এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমি খুশি থাকতে পারব। আজকের পর থেকে আমি তোমাকে আর জ্বালাবনা চাঁদপাখি। এটা আমার বিবেকের কাছে আমার ওয়াদা! আর থ্যাংকস হ্যাঁ?

মাঝরাতে দয়া করে এসে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তির সেবাযত্ন করার জন্য। সুস্থ হয়ে ওঠে আমার একবারের জন্যও মনে হলোনা তোমার সাথে অন্তত একটিবার দেখা করা উচিৎ! কারণটা খুবই সহজ। যার মনে আমি নেই। তাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে পোষণ করাটাও সেখানে নেহাত বোকামী। কারো ভালোবাসায় পিছলে পড়ে আমি আর বোকা হতে চাইনা!

এবার থেকে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকবে চাঁদপাখি! তোমাকে ভালোবাসার আগে দূরত্বটা যেমন ছিল ঠিক তেমনই থাকবে! আই হোপ এবার সাদমানকে মন থেকে মেনে নিতে তোমার আর কোনো আপত্তি থাকবেনা! মাঝের রাস্তাটা তো একদম ক্লিয়ার হয়ে গেল! তোমার সাথে সম্পর্কটা আমার মনের জানো?

কাগজে কলমে লিখা কোনো দলিল বা শারীরীক সম্পর্কের নয়! তোমার কাছে এসব বাড়াবাড়ি মনে হলেও আমার কাছে এটাই ফিলোসফি! অনেককিছুই লিখার ইচ্ছে ছিল আজ। তবে হাতটা খুব ঘামছে, কাঁপছে, কলমটা বারবার থেমে যাচ্ছে, চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে, অনুভূতিরা বারবার আত্মাহুতি দিচ্ছে, ভেতরে এক নিগূঢ় জ্বলন হচ্ছে চাঁদপাখি। তুমি কি টের পাও ভেতরের সেই জ্বলন? আমার কোমল হৃদয়টা ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাও তুমি? হয়তো পাও না! পাওয়ারও কথা না। হৃদয়হীনারা কখনো অন্যের হৃদয় ভাঙার কষ্ট বুঝতে পারেনা।”

ইতিতে আর কী লিখব বলো? তোমার কাছ থেকে চরম আঘাত পাওয়া একজন ছ্যাঁকাখোর নিঃস্ব প্রেমিক? যার আদোতে কোনো নিজস্বতা নেই? কারো লাইফে যার কোনো তাৎপর্যতা নেই?
ঝট করে চাঁদ চিঠিটা দুহাত দিয়ে দলেমোচড়ে একদম নিংড়ে দিলো! চিঠিটাকে বল আকারে রূপান্তরিত করে সে ছুড়ে মারল বাড়ির এক কোণায়। রাগে ফোঁস ফোঁস করে সে হাত-পা কচলাতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৫

“হ্যাঁ আমি ঐ সাদমান ভাইয়ার সাথেই প্রেম করব! ঐ সাদমান আপনার চেয়ে ঢেঁড় ভালো! আপনার চোখের সামনে আমি উনাকে বিয়ে করব! দেখব কীভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করেন আপনি। ইডিয়ট, ননসেন্স, ইস্টুপিট কোথাকার! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এতো বড়ো একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। পড়তেও তো আমার সময় লেগেছে নাকি? এই কথাগুলো মুখে বলে গেলে কী হতো?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৭