প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৭

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৭
নিশাত জাহান নিশি

“হ্যাঁ আমি ঐ সাদমান ভাইয়ার সাথেই প্রেম করব! ঐ সাদমান আপনার চেয়ে ঢেঁড় ভালো! আপনার চোখের সামনে আমি উনাকে বিয়ে করব! দেখব কীভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করেন আপনি। ইডিয়ট, ননসেন্স, ইস্টুপিট কোথাকার! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এতো বড়ো একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেল? পড়তেও তো আমার সময় লেগেছে নাকি? এই কথাগুলো মুখে বলে গেলে কী হতো?”

রাগে গটগট করে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নূরের মুখটাও দেখবেনা বলে শপথ করে নিলো! নূরের প্রতি তার পূর্বের তুলনায় আরও অধিক ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই দুর্নিবার ক্ষোভের কারণটিই চাঁদ চিহ্নিত করতে পারলনা! নূরের প্রতি তার হঠাৎ এতো ক্ষোভ জমে যাওয়ার কারণটা আসলে কী? নূর চলে যাওয়াতে সে কষ্ট পেল নাকি নূর তাকে আর বিরক্ত করবেনা, ভালোবাসি বলে পাগলামি করবেনা, তার পিছু পিছু ঘুরবেনা এই বিষয়টিতে সে আঘাত পেল? ঠিক এই জায়গাটিতেই বড়ো একটি বিস্ময়কর ধাঁধাঁ রয়ে গেল!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পুচি রাগে ফোঁস ফোঁস করে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। একছুটে সে ছুড়ে ফেলা চিঠিটির দিকে এগিয়ে গেল। চিঠিটির মধ্যে সে কী এমন মধু পেল তাই আমার ছোটো মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারলনা! চিঠিটিকে আবারও সে পূর্বের ন্যায় নাড়তে চাড়তে লাগল। গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটির সাথে খেলা করতে লাগল!

চাঁদ লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে ওঠে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সোহানীর মুখোমুখি হয়ে গেল। কটমট দৃষ্টিতে সোহানী চাঁদের দিকে তাকালো। ঝট করেই সে হাতের পেছনে লুকিয়ে রাখা একমুঠো রঙিন জরি চাঁদের চোখে-মুখে ছিটকে দিলো! হেলেদুলে পৈশাচিক হেসে বলল,,

“আর লাগবি আমার পেছনে হ্যাঁ?”
তাৎক্ষণিক চাঁদ খকখক করে কেশে উঠল। নাকে-মুখে ঢুকে গেল কয়েকগুচ্ছ জরি! অস্বস্তিতে চাঁদ চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। তুখাড় জেদ দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“এটা তুমি কী করলা আপু?”
সোহানী খিলখিলিয়ে হাসল। প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উগ্র গলায় বলল,,
“টিথ ফর টেথ ওকে?”

চাঁদ চোখ খুলল। পিটপিটে চোখে সোহানীর দিকে তাকালো। আচমকা চোখের জল ছেড়ে দিলো সে! তিক্ত গলায় বলল,,
“সবসময় ফাইজলামি ভাল্লাগেনা আপু। মানুষের মনমর্জি সবসময় একরকম থাকেনা সেটা তোমার বুঝতে হবে।”
সোহানী উদ্ভট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। উদ্বিগ্নমনা হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই কী হইছে রে তোর? হঠাৎ কাঁদছিস কেন?”

সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা চোখের গড়িয়ে পড়া জলটা মুছে নিলো! ভরাট গলায় জবাবে বলল,,
“কিছু হয়নি। সামনে থেকে সরো।”
হনহনিয়ে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। টুপ করে আবারও একফোঁটা জল তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল! চোখের জলটা চাঁদ সযত্নে হাতে তুলে নিলো। কিয়ৎক্ষণ সূক্ষ্মদৃষ্টিতে জলটিকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর মিনমিনিয়ে জলটার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কী আশ্চর্য! তোরা এভাবে আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিস কেন? আমি তো কারো জন্য আদোতে কোনো আঘাত পাইনি। তবে কেন তোরা এভাবে ঝরে পড়ছিস? কোন কারণে আমাকে কাঁদাচ্ছিস?”

হেয় হাসল চাঁদ। জলটা জামায় মাখিয়ে নিলো। পুনরায় তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। সোহানী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। চাঁদ সচরাচর এতো সহজে রেগে যাওয়ার মেয়ে নয়। উল্টো সে সোহানীকে সবসময় বিভিন্নভাবে ক্ষেপায়। বিনিময়ে সোহানীর কাছ থেকে মার খায়, বকা খায়, কটু কথাও কম শুনেনা।

এতকিছুর পরেও তার চোখে কখনো জল জমেনা। তবে আজ কী এমন হলো তার? কেন সামান্য একটু বিষয়েই তার চোখ থেকে এভাবে জল গড়িয়ে পড়ল? কোন কারণে চাঁদ এতোটা বিমূর্ষ রূপ ধারণ করল? বিষয়টা সেহানীর কাছে ধাঁধাঁ-ই রয়ে গেল!

বৈশাখ মাসের বাইশ তারিখ আজ। আর দুদিন বাদেই নীড় এবং সোহানীর বিয়ে! দুটো প্রাণের মিলনের শুভক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে পিলপিল পায়ে। বিয়ের আমেজে সাঁই সাঁই করছে দুই পরিবার। সবার মনে বইছে আনন্দ-উল্লাস একঝাঁক খুশির বন্যা।

চাঁদ এবং জায়মার পরীক্ষা গতকাল-ই শেষ হলো। তাই তারা দুজনই এখন বেশ রিলাক্স মোডে আছে। সকাল প্রায় এগারোটা বাজতে চলল অথচ তারা দুজনই এখনো নাক টেনে ঘুমুচ্ছে! দুপুরের মধ্যেই যে তাদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে তা তারা প্রায় ভুলে বসেছে। এতোদিনের রাত জাগা সব ধকল তারা আজ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে।

একটু পরেই হয়তো তাশফিয়া এবং তিথী তৈরী হয়ে চলে আসবে চাঁদের পরিবারের সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য! তাশফিয়া এবং তিথীর পরিবার প্রথমে রাজিই হচ্ছিলনা তাদের দুজনকে চাঁদ এবং জায়মার সাথে ঢাকায় সোহানীর বিয়েতে পাঠানোর জন্য। তাদের মানাতে চাঁদ এবং জায়মার প্রায় আদাজল খেয়ে পড়তে হয়েছিল!

বিগত চার-পাঁচদিন তাদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে এরপর তাদের দুই পরিবারকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল চাঁদ এবং জায়মা। অবশ্য এক্ষেত্রে আয়মন বেশি চাপ দিয়েছিল চাঁদকে! উল্টোদিকে আয়মনকে চাপ দিয়েছিল মাহিন! মাহিন যেমন মনে মনে তিথীকে চায়। তিথীর জন্য পাগল পাগল করে। তেমনি আয়মনও এখন মনে মনে তাশফিয়াকে চায়!

হুট করেই ভালো লেগে গেছে তাশফিয়াকে তার! তাছাড়া তাশফিয়ার প্রতি তার আলাদা একটা সফট কর্ণারও কাজ করে। কারণ, তাশফিয়ার বাবা নেই। শুধু একটা মা বলতে মা-ই আছে তার। সেই মা’টাও দুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে! একাই তাশফিয়াকে সব ঝামেলা সামলাতে হয়। তার মাকে আগলে রাখতে হয়।

এসব দিক বিবেচনা করেই তাশফিয়ার প্রতি আয়মনের একটা সফট কর্ণার কাজ করে! যা সে চেয়েও অস্বীকার করতে পারেনা। সারাক্ষণ তাশফিয়ার দুঃশ্চিন্তায় সে বিমূঢ় হয়ে থাকে। তাশফিয়াকে দেখলেই তার মনের ভেতর একধরনের আকুপাকু শুরু হয়।

চাঁদ এবং জায়মা যেহেতু এখন ঘুমুচ্ছে তাই তাদের হয়ে ব্যাগপত্র গোছগাছ করছেন সামিয়া আহমেদ, জায়মার মা এবং আয়মনের মা। চার থেকে পাঁচটা বড়ো বড়ো ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেছে তাদের কাপড়চোপড়ে। বাড়ির পুরুষরা ভারী সব জিনিসপত্র এক এক করে গাড়িতে তুলছে। বড়ো একটা মাইক্রো গাড়ি প্রায় রিজার্ভ হয়ে গেছে শুধু ভারী ভারী জিনিসপত্রে।

আয়মন কিছুক্ষণ পর পর কেবল বাড়ির মেইন গেইটের দিকে অধীর দৃষ্টি বুলাচ্ছে। কখন তাশফিয়া আসবে সেই চিন্তায় সে ব্যাকুল হয়ে আছে। কাজেও ঠিকঠাকভাবে মন দিতে পারছেনা সে। তাশফিয়ার একটুখানি সান্নিধ্য পেতে বিভোর হয়ে আছে!
টানা পাঁচদিনের জন্য ঢাকায় বিশাল হলরুমটা বুক করেছেন জামান আহমেদ। পাতার মতো টাকা উড়াচ্ছেন উনি।

পরিবারের বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আহামরি তো হবেই! এরমধ্যে কাজের ফাঁকেই হঠাৎ আয়মনের ফোনটা সাইলেন্ট মোডে বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই সে ব্যাগপত্র রেখে গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। তার জায়গায় সাব্বিরকে বসিয়ে দিয়ে এলো। ব্যাগপত্র ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে গাড়িতে রাখার জন্য।

বাড়ির পুরুষদের উপেক্ষা করে আয়মন একটুখানি দূরে সরে এলো। ব্যাকুল হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্ক্রিণে নূরের নামটি ভেসে উঠল। মৃদু হেসে আয়মন তাড়াহুড়ো করে ফোনটা তুলল। অমনি অপর প্রান্ত থেকে নূর শিথিল গলায় বলল,,

“হ্যালো।”
“হ্যালো হ্যাঁ বল? কেমন আছিস?”
নূর নাক টানল। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থেকে তার গলায় কফ জমে গেল। তাই সে কেমন যেনো খসখসে গলায় বলল,,
“ভালো আছি। কতদূর তোরা?”

“কই ভালো আছিস? ভয়েস শুনে তো মনে হচ্ছে না।”
“এসব ছাড় তো। আগে বল কতদূর আছিস তোরা?”
“আরে এখনো তো বাড়ি থেকেই বের হলাম না আমরা! বাড়ির মেয়েরা এখনো রেডিই হয়নি। তো কখন বের হবো বল?”
“নীড় ভাইয়া তাড়া দিচ্ছিল। তোরা আসবি বলে সকাল থেকেই হলরুম ওপেন করে রাখা হয়েছে। সেইফটিরও তো একটা ব্যাপার আছে তাইনা? তারপর মালিক হলো একদম খিটখিটে টাইপ।”

“আমাদের আসতে আসতে বিকেল হবে রে। চাঁদ আর জায়মা এখনো ঘুমুচ্ছে। গতকালই তাদের পরীক্ষাটা শেষ হলো মাত্র। বুঝিসই তো এখন তাদের একটু রেস্টের প্রয়োজন। কীভাবে জোর দিই বল?”

চাঁদের নামটা শুনতেই নূরের বুকে যেনো ধারালো তীর গেঁথে যাওয়ার মতো অনুভব হলো! সঙ্গে সঙ্গেই সে ফোনটা কেটে দিলো। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে সে শোয়া থেকে ওঠে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। বুকে হাত রেখে পরপর রুদ্ধশ্বাস ছাড়তে লাগল। মাথা নুইয়ে সামনের পেছনের এলোমেলো চুলগুলো কিছুক্ষণ টানল। চোখজোড়া বুজে সে নিজেকে স্থির করার প্রাণপণ চেষ্টা করল। চাঁদকে মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু না লাভ কিছু হলোনা এতে। উল্টো ক্রমাগত তার আনচান মন বিগলিত হয়ে উঠল৷ চাঁদের মাঝেই ডুবে যেতে লাগল। অস্থির হয়ে সে কঠোর গলায় বলল,,

“না। এভাবে আর হবেনা। আমাকে আরও কঠিন হতে হবে। চাঁদের নাম শুনেই এভাবে মোলায়েম হয়ে গেলে চলবেনা। এনাফ স্ট্রং হতে হবে। চাঁদকে বুঝিয়ে দিতে হবে তাকে ছাড়া আমি ভালো আছি! যথেষ্ট ভাব নিয়ে চলতে হবে আমার। এটিটিউড দেখাতে হবে। এভোয়েড করতে হবে তাকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট। নূর ঠিক কী জিনিস তাকে হারে হারে বুঝিয়ে দিতে হবে। নূর একবার কঠিন হলে মানে সে কঠিন। কিছুতেই তাকে গলানো সম্ভব নয়।”

নিজেকে যথেষ্ট শক্ত করে নূর শার্ট নেওয়ার জন্য আলমারিটা খুলল। অমনি তার মুখের উপর এসে চাঁদের সেইদিনের সেই সুতির ওড়নাটা উড়ে এসে পড়ল! সঙ্গে সঙ্গেই নূর ওড়নাটা মুখ থেকে সরিয়ে নিলো। আবেগপ্রবণ হয়ে হাতে তুলে নিলো ওড়নাটিকে। কিয়ৎক্ষণ ওড়নাটির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। অতঃপর অবিশ্বাস্যভাবে ওড়নাটিতে দীর্ঘ এক চু’মু খেলো! ভরাট গলায় বলল,,

“আমি যতোই তোমার থেকে পিছু ছাড়াতে চাই চাঁদ তুমি ততোই আমার সামনে চলে আসো! ভুলতে পারিনা আমি তোমাকে। হাজারবার চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনা। কিছু কিছু স্মৃতি এমন হয় যা চাইলেও ভোলা যায়না। তুমিই হলে আমার সেই স্মৃতি চাঁদ যা আমার আত্মার সাথে বন্দি। যাকে ভোলার চেষ্টা করা মানে দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করা। নিজেকে বারবার মৃ’ত বলে ঘোষিত করা। এভাবে আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি চাঁদ। সত্যিই ভাবতে পারিনি! আর আমরা যা ভাবতে পারিনা তাই আমাদের সাথে হয়। বার বার হয়, হাজারবার হয়।”

এরমধ্যেই হঠাৎ সাদমানের আবির্ভাব ঘটল নূরের রুমে! চওড়া হাসি হেসে সে নূরের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো। উৎফুল্লিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কীরে কী অবস্থা তোর? সর্দি-কাশি ভালো হইছে?”

সঙ্গে সঙ্গেই নূরের পিলা চমকে গেল! এই মুহূর্তে সাদমানের আকস্মিক উপস্থিতি সে মোটেও আশা করেনি। তড়িঘড়ি করে সে চাঁদের ওড়নাটি দিয়েই গড়িয়ে পড়া চোখের জলগুলো মুছে নিলো। সাদমান কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে ওড়নাটিকে বিশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে আলমারির তাকে রেখে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে ধাতস্থ করে সে তড়িৎ বেগে পিছু ঘুরে তাকালো। শুকনো হেসে সাদমানকে বলল,,

“বাঃহ। তোকে তো আজ বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। কারণ কী হ্যাঁ?”
সাদমান মাথা চুলকালো। স্মিত হেসে বলল,,
“আরেহ্ আজ চাঁদ আসবেনা? ভুলে গেলি?”
নূর নির্বোধ ভাব নিলো! শুষ্ক হেসে বলল,,
“উফফফস সরি। একদমই ভুলে গেছি!”
“ভুলিস নি। আসলে নাটক করছিলি!”
“মানে?”

সন্দিহান দৃষ্টিতে সাদমান নূরের দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আগে বল তুই কাঁদছিলি কেন?”
নূর ভড়কে উঠল! চক্ষুজোড়া চড়কগাছে পরিণত হলো তার। শুকনো ঢোঁক গিলে সে মন্থর পায়ে হেঁটে সাদমানের দিকে এগিয়ে এলো। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বোকা সুরে বলল,,

“কোথায় আমি কাঁদছিলাম হ্যাঁ? কীসব বলছিস তুই হ্যাঁ?”
“সত্যি করে বল কাঁদিস নি?”
“কই না তো!”
“তাহলে চোখ-মুখ ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে কেন?”

নূর অট্ট হাসল! সাদমানের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সে হেঁতো গলায় বলল,,
“আরেহ্ ওটা তো আমার হাচ্চি-কাশির প্রভাব ছিল। কালরাত থেকে নাক টানছি তো তাই চোখ-মুখ কেমন ফুলে গেছে। আমার নিজেরই এখন অতিষ্ট লাগছে। ভাইয়ের বিয়েও এলো আর আমারও অসুখ বাঁধল।”

“সত্যিই কি চাঁদকে তুই ভুলতে পেরেছিস?”
“না ভোলার মতো এমন কঠিন কী জিনিস?”
“সত্যিই কী এতো সহজ চাঁদকে ভুলে যাওয়া?”
“চেষ্টা করলেই ভোলা যায়!”
“করেছিলি চেষ্টা?”

“হ্যাঁ করেছি, অনেকবার করেছি। চেষ্টা করেছি বলেই তো আজ তাকে ভুলতে পেরেছি। বিশ্বাস হয়না তোর?”
সাদমানের দৃষ্টি এখনো সন্দিহান৷ তবে সে বিষয়টাকে বেশি ঘাটাতে চাইলনা। প্রসঙ্গ পাল্টে রাশভারী গলাঢ বলল,,
“বাইরে চল নীড় ভাইয়া অপেক্ষা করছে।”
“আচ্ছা তুই যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সাদমান প্রস্থান নিলো! উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে নূর সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কিছুদূর যেতেই সাদমানের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল। প্রবল জেদ দেখিয়ে নূর আলমারির কার্ণিশে সজোরে এক লাথ মারল! ঘাড়ের রগগুলো টান টান করে সে মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“কেন আমি আমার নিজের ইমোশনগুলো লুকিয়ে রাখতে পারিনা কেন? কেন সবাই খুব সহজেই আমার অভিনয়গুলো ধরে ফেলে? কেন? এতো ইমোশনালফুল কেন আমি? কেন আমি আজও অভিনয় শিখতে পারলামনা?”
রাগে গটগট করে নূর ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ঝর্ণা ছেড়ে সে সোজা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল! ভেতর থেকে গোঙাতে গোঙাতে সে লুকিয়ে রাখা কষ্টে বিশৃঙ্খলভাবে হাঁপাতে লাগল।

রৌদ্রোজ্জল বিকেল। চারটা বেজে প্রায় পয়ত্রিশ মিনিট ঘড়িতে। সূর্যের প্রখর তাপে অতিষ্ট ধরণী। চারিদিকে মানুষের বুকফাঁটা হাহাকার। ঝলসে যাচ্ছে চামড়াশুদ্ধ মানুষ! মুখ থেকে আপনাআপনি জিহ্বা বের হয়ে আসছে। এই সাংঘাতিক রোদের ঝাঁঝ আর মানা যাচ্ছেনা। এই কাঠ ফাঁটা রোদের মধ্যেই নূর এবং মাহিন তাদের বাইকে করে ডেকোরেশন ম্যানেজারের অফিসের দিকে রওনা হয়েছে। দুই বাড়ির প্যান্ডেল এবং বিয়ের গেইট প্রফেশনাল ডেকোরেশন ম্যানেজারদের দিয়ে সাজানো হবে। মাঝরাস্তায় আসতেই অমনি নীড়ের মেসেজ এলো মাহিনের নাম্বারে। ব্যাকসিটে থেকে মাহিন এক নজরে মেসেজটি পড়ে দেখল। মেসেজটিতে লিখা,,

“এই শোন? তোদের দুজনকে একসাথে এক কাজে যেতে হবেনা। তুই মাহিন ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আয়। আর নূরকে পাঠিয়ে দে হলরুমে। সোহানীর সাথে কথা বলে ফুলের অর্ডার নিতে হবে। সব রকমের ফুল কিন্তু এখন এভেইলঅ্যাবল নয়। তাই একদিন আগে থেকেই অর্ডার করে রাখতে হবে।”

নূরকে ডেকে মাহিন বিস্তারিত বলল। নূর প্রথমে নাকাচ করলেও পরে চাপে পড়ে তাকে মেনে নিতে হলো। নূরকে মাঝরাস্তায় দাড় করিয়ে মাহিন বাইকে করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পিছু ফিরে মাহিন চিৎকার করে নূরকে বলল,,
“তিথীকে আমার সালাম দিস নূর! ঐখানের কাজটা সেরেই আমি হলে আসছি।তুই আর সাদমান কিন্তু থাকিস ওকে?”

নূর ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তবে সে মনে মনে দোটানায় ভুগল হলে যেতে! এখন হলে গেলেই তাকে চাঁদের মুখোমুখি হতে হবে। যা সে এখনি চাইছেনা। নিজের ফিলিংস, ইমোশন, খারাপ লাগার জায়গাগুলো সে লুকিয়ে রাখতে চাইছে। যা চাঁদের সামনে গেলে আদোতেই সম্ভব নয়।

রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে দাঁড়িয়ে নূর দু থেকে তিনটি সিগারেট একটানে শেষ করে ফেলল। মনে মনে সাহস যোগাতে লাগল। চাঁদের কাছে গেলে ভেঙে পড়বেনা বলে নিজেকে শক্ত করতে লাগল। মুখে একটা সেন্টার ফ্রেশ নিয়ে সে রিকশা করে হলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

হলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই নূর রিকশা থামাতে বলল। ভাড়া চুকিয়ে হলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে সে বড়ো একটি তাজা শ্বাস নিলো! ফুসফুসে যতোটা সম্ভব দম সঞ্চার করল। মনে মনে নিজেকে বুঝিয়ে বলল,,

“বি স্ট্রং ওকে? নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত রাখতে হবে। কোনোভাবে চাঁদের সামনে পড়ে গেলেও তার দিকে তাকানো যাবেনা। আইসক্রিমের মতো একদমই গলে যাওয়া চলবেনা। কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে হবে। মনের কথা শুনতে হবে। ডোন্ট কেয়ার ভাবসাব নিতে হবে। বুঝছস না?”

নিজেকে বুঝিয়ে শুঝিয়ে নূর হেলে থাকা শার্টের কলারটা ঠিক করল। ভীরু পায়ে হেঁটে গেইটের ভেতর পা বাড়াতেই অমনি সে থেমে গেল! আকস্মিকভাবেই তার চোখের সামনে চাঁদ এসে হাজির হলো। সঙ্গে সঙ্গেই নূর ভূত দেখার মতো চমকে উঠল! থমথমে গলায় গড়গড় করে বলল,,

“এই তোমার মুখের এই অবস্থা কেন?”
ঠোঁট উল্টে চাঁদ জলদি করে ঘুরে নিলো। মুখে মাস্ক পড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,,
“আপনার অভিশাপেই আজ আমার মুখের এই অবস্থা বুঝেছেন? যেদিন থেকে আপনি ইয়া বড়ো একটা চিঠি লিখে ঢাকা ফিরে এসেছেন সেদিন থেকেই আমার মুখে এসব ভ্রুনো গজানো শুরু করেছে! সব আপনার দোষ বুঝেছেন?”
নূর বেশ ভাব নিলো। কঠোরতাকে এখনই কাজে লাগানোর পায়তারা করল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৬

“রুহের হায় বুঝো হ্যাঁ? রুহের হায়? এই রুহের হায়-ই লাগছে তোমার৷ যাই হোক এখন আমি এসব ভুলে গেছি! নতুনভাবে সব শুরু করছি! এসব অতীত ফতীত মনে রেখে এখন কোনো কাজ নেই আমার। দেখি সামনে থেকে সরো। কেন যে তোমার সামনেই আমাকে পড়তে হলো! আজকের দিনটাই খারাপ হয়ে গেল আমার। ডেম ইট!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৮