প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৮

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৮
নিশাত জাহান নিশি

“রুহের হায় বুঝো হ্যাঁ? রুহের হায়? এই রুহের হায়-ই লাগছে তোমার৷ যাই হোক এখন আমি এসব ভুলে গেছি! নতুনভাবে সব শুরু করছি! এসব অতীত ফতীত মনে রেখে এখন কোনো কাজ নেই আমার। দেখি সামনে থেকে সরো। কেন যে তোমার সামনেই আমাকে পড়তে হলো! আজকের দিনটাই আমার খারাপ হয়ে গেল। ডেম ইট!”

চাঁদ তব্ধিত! পিছু ঘুরে তাজ্জব দৃষ্টিতে নূরের পানে তাকালো। চক্ষুজোড়া ছানাবড়া করে সে তেড়ে এসে নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাথায় সিল্কের কালো রঙের ওড়নাটা বড়ো করে টেনে নিলো। সন্দিহান গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী বললেন? আমাকে অভিশাপ দিয়ে এখন সব নতুনভাবে শুরু করা হইছে না? এতো স্বার্থপর কেন আপনি হুম?”
নূর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ভ্রুযুগল উঁচিয়ে ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“স্বার্থপর আমি না তুমি?”
জবাবে কিছু বলতে পারলনা চাঁদ। নূরের রূঢ় মুখমণ্ডলের তাকিয়ে সে খামোশ খেয়ে গেল। আগের নূর এবং এখনকার নূরের মধ্যে সে আকাশ পাতাল তফাৎ দেখতে পেল। যা হওয়াটাই হয়তো নেহাত জরুরী ছিল! মানুষের জীবনের কিছু কিছু পরিবর্তন আসা নিতান্তই প্রয়োজন। যা মানুষকে বদলাতে সাহায্য করে। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে চাঁদ সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা নুইয়ে নিলো। প্রসঙ্গ পাল্টে অসহায় সুরে নূরকে বলল,,

“দুইদিন পর আপুর বিয়ে। আর এখনই আমার মুখে এসব হতে হলো? বিয়েতে আমি সাজব কীভাবে হুম? সব এক্সাইটমেন্ট-ই তো মাটি হয়ে গেল।”

“ডোন্ট ওরি ওকে? সাদমানকে বলো ভালো টালো একজন ফেইস স্পেশালিষ্ট দেখাতে! ঢাকায় অনেক ভালো ভালো ডক্টর আছে। তাদের মধ্যে যেকোনো একজনকে দেখালেই হবে। যাই হোক কিছুদিন পরেই তো সাদমানের সাথে তোমার কিছু একটা হতে চলেছে! সো এখন থেকেই তার উচিৎ তোমার দায়িত্ব নেওয়া! তোমার ভালো-মন্দের খেয়াল রাখা। তোমার সুবিধা-অসুবিধাগুলো বুঝে নেওয়া। আউট পার্সন হয়ে আমাদের কেন এসব বলে দিতে হবে?”

চাঁদকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে নূর বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। চাঁদ হতভম্ব দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মুখে দু’হাত চেপে সে বিড়বিড় করে বলল,

“ওমা। এ তো দেখছি রাতারাতি বদলে গেছে! এখন কি অন্যকাউকে পেয়ে সে আমাকেই ভুলে গেছে? হাউ ইট’স পসিবল?”
হলরুমের মেইন দরজায় দাঁড়াতেই হঠাৎ আয়মন এবং সাদমানের সাথে দেখা হয়ে গেল নূরের। দুজনই গলাগলি করে হাসতে হাসতে বের হচ্ছিল হলরুম থেকে।

নূরকে দেখামাত্রই দুজন থেমে গেল। আকস্মিক নূরের দেখা পেয়ে আয়মন বেশ খুশি হলেও সাদমান খুশি হতে পারলনা! চাঁদের আশেপাশে নূরকে সে একদম-ই সহ্য করতে পারেনা। বিষাক্ত লাগে সবকিছু। তখন নূরকেও তার বিষের মতো মনে হয়! দ্রুত বেগে নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সাদমান। রাগে মাথাটা নুইয়ে নিলো সে! নূর বিষয়টা বেশ বুঝতে পারল। তাই সে সাদমানকে শান্তনা দেওয়ার জন্য আয়মনের কাঁধে হাত রাখল। মলিন হেসে বলল,

“আরে ভাই। ভাবির সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। ফুল টুল নিয়ে আর কী। নীড় ভাইয়া জোর করে পাঠালো এখানে। আমি তো প্রথমে আসতেই চাইনি।”

সাদমান স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সন্দেহ ভুলে সে মাথা তুলে নূরের দিকে তাকালো। অতি স্বাভাবিক তার চাহনি। মনে হলো যেনো একটু আগেও সে নূরের দিকে এমন স্বাভাবিক চাহনিতেই তাকিয়েছিল! নূরের কথাটায় আয়মন বেশ আঘাত পেল। কঠিন গলায় বলল,,

“এখানে আসার জন্য তোর আবার কারণ লাগবে নাকি হ্যাঁ? অ্যানি টাইম তুই আসতে পারিস। এখন আমাদের মধ্যে শুধু একটা-ই সম্পর্ক নয়। বরং দু’দুটো সম্পর্ক ওকে? এখন তো অধিকারও আরও বেশি বেড়ে গেল না?”
নূর খুব সূক্ষ্মভাবে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল! প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,,
“ওকে ছাড় এসব৷ কোথায় যাচ্ছিস?”

“চাঁদকে ডক্টর দেখাতে! মুখে কীসব গজিয়েছে তার। এতোদিন পরীক্ষার চাপ ছিল বলে ডক্টর দেখাতে চায়নি। এখন ভাবলাম যেহেতু পরীক্ষাও শেষ আর আমরাও ঢাকায়। তাই একটা ভালো ডক্টর দেখিয়েই আসি।”
নূর বেশ ব্যস্ত ভাব নিলো! গাঁ বাঁচিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। বিরামহীন গলায় বলল,,

“ওকে তোরা তাহলে যা আমি ভাবির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”
আয়মন এবং সাদমানকে উপেক্ষা করে নূর দ্রুত পায়ে হেঁটে হলরুমের ভেতর প্রবেশ করতেই আয়মন পেছন থেকে নূরকে ডাকল! নূরের গাঁ বাঁচিয়ে যাওয়াটা আর সম্ভব হলোনা। সে মৃদুস্বরে চিৎকার করে বলল,,
“এই নূর দাঁড়া। তুইও চল আমাদের সাথে।”

নূর বিরক্তবোধ করল। মুখমণ্ডলে রূঢ়তার ছাপ ফুটিয়ে তুলল। পিছু ঘুরে আয়মনের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকালো। আপত্তিকর গলায় বলল,,
“না রে! তোরা যা। আমার অনেক কাজ আছে।”

সাদমান মনে মনে বেজায় খুশি হলো! তবুও সে মুখরক্ষার খাতিরে গলা ঝাঁকালো। নূরকে ডেকে বলল,,
“আরে চল। ঘণ্টা খানিকেরই তো ব্যাপার। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে এই এক/দেড় ঘণ্টায়?”
সাদমানের ট্রিকস নূর বেশ বুঝতে পারল! তাও সে তুচ্ছ হেসে বলল,,

“না রে তোরা যা। আমি সত্যিই এখন যেতে পারবনা। এরচেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার পড়ে আছে। চাঁদের জন্য তো তোরা আছিসই!”

পিছু ঘুরে প্রস্থান নিলো নূর। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে সে নিজেকে ধাতস্থ করতে লাগল! ভেতরে ভেতরে চেপে রাখা কষ্টের পাহাড়টা সে বাইরে প্রকাশ করতে লাগল। অনেক অভিনয় করা হয়েছে আজ তার। এইটুকু অভিনয়েই এভাবে হাঁপিয়ে গেলে চলবেনা। আরও অনেক মহা অভিনয়ের পালা বাকি আছে তার। যা তাকে আরও অনেক নতুন নতুন পরিস্থিতির মধ্যে এনে দাঁড় করিয়ে দিবে। বুকের বাঁ পাশটাতে হাত রেখে নূর ভীরু পায়ে হেঁটে হলরুমের অনেকখানি ভেতরে ঢুকে গেল।

এবার শুধু সোহানীকে খুঁজে নেওয়ার পালা তার। কাজ শেষে এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়তে পারলেই সে বাঁচে!
এতক্ষণ অবধি নূর, আয়মন এবং সাদমানের সাথে যা যা কথা হচ্ছিল সব চাঁদ পেছন থেকে দাঁড়িয়ে শুনছিল। চাঁদের আর বুঝতে বাকি রইল না নূর কতোখানি বদলে গেছে! খারাপ লাগা কাজ করতে লাগল তার মনে। হঠাৎ করেই নূরের এই পরিবর্তন তাকে একটু হলেও ভাবালো। হসপিটালে যাওয়ার মুডটাও যেনো তার হাপিশ হয়ে গেল! বিমূঢ় মনে সে আয়মন এবং সাদমানের দিকে এগিয়ে এলো। আয়মনকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বলল,,

“আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে ভাইয়া। কোথাও যেতে মন চাইছেনা আমার। আমরা বরং কাল যাব। আজ আরও একটু রেস্ট নিয়ে নিই।”
দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদ প্রস্থান নিলো! আয়মন অবাক হলো তবে কিছু বললনা। সাদমান বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। পেছন থেকে অধীর গলায় চাঁদকে ডেকে বলল,,

“আরেহ্ চাঁদ শোনো। দুদিন পরেই তো প্রোগ্রাম। এরমধ্যেই তোমাকে ফেইসের ট্রিটমেন্টটা নিতে হবে। রেদার বিয়েতে তুমি হেভি সাজগোজ করতে পারবেনা। বিয়ের মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাও তোমার বড়ো আপুর বিয়ে বলে কথা। ভেবে দেখেছ বিষয়টা?”

সাদমানের কথায় একফোঁটাও গ্রাহ্য করলনা চাঁদ! এই মুহূর্তে এই জায়গা থেকে দৌঁড়ে পালাতে পারলেই যেনো সে বাঁচে! মুখ থেকে মাস্কটা খুলে সে একছুটে তার রুমে প্রবেশ করল। হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতেই সে জায়মা, তাশফিয়া এবং তিথীর তোপের মুখে পড়ে গেল! তিনজনই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো৷ চাঁদের হঠাৎ ফিরে আসা দেখে তারা তিনজনই বেশ অবাক হলো। দল বেঁধে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো তারা। ভ্রু উঁচিয়ে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। সমস্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী রে? আবার ফিরে এলি যে?”
চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। দরজা থেকে পিঠ সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো৷ সংকীর্ণ গলায় বলল,
“শরীর খু্ব খারাপ লাগছে তাই।”

জায়মা কোমরে হাত গুজল। চাঁদের নেতিয়ে থাকা মুখমণ্ডলে তুখার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রূঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“দিনের একটা দেড়টা পর্যন্ত ঘুমিয়েও তোর শরীর খারাপ লাগছে হ্যাঁ? কী এমন শরীর খারাপ তোর? বেকুব বুঝাস? এখনই ডক্টর না দেখালে বিয়েতে সাজবি কীভাবে শুনি?”

চাঁদ মুখটা ফুলিয়ে নিলো। মাথাটা নুইয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,,
“আপুর বিয়েতে সাজার নসিব আমার ভাগ্যে নাই! তো আর কী করব বল?”
তাদের তিনজনকে ডিঙিয়ে চাঁদ সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। উবুড় হয়ে শুয়ে সে মুখটা ওড়না দ্বারা ঢেকে নিলো। গম্ভীর গলায় বলল,,

“নূরের বাচ্চা নূরটা আস্ত ফা’জিল হয়ে গেছে। কী সুন্দর আমাকে এভোয়েড করে চলছে! আর এভোয়েড করলেই বা আমার কী হ্যাঁ? আমি তো তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাইনা? তার আশা ছেড়ে দিয়েছি। আর সেও আমাকে ভুলে এখন নতুন করে সবকিছু শুরু করেছে। তো এখানে আমার কষ্ট পাওয়ার কী আছে হ্যাঁ? কেন অকারণে আমি কষ্ট পাচ্ছি?”

মন খারাপের রেশ কাটাতে চাঁদ চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। মন এবং মর্জিকে স্থির করার জন্য সে কিছুক্ষণের চোখ বুজে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো৷ জায়মা, তাশফিয়া এবং তিথী হতবাক হয়ে একজন আরেকজনের মুখ দেখাদেখি করল। চাঁদের বিষণ্ণতা দেখে তারা তিনজনই একটু বেশি অবাক হলো। তাশফিয়া উৎকণ্ঠিত হয়ে জায়মা এবং তিথীর কানে কানে বলল,,
“এই কী হলো রে ব্যাপারটা? এতো এক্সাইটমেন্ট নিয়ে সে ডক্টরের কাছে যাবে বলে বের হলো এখন আবার গোমড়ামুখো হয়ে ফিরে এলো। কাহিনী কী?”

জায়মা ভাবুক হয়ে উঠল। থুতনির কাছে এক আঙুল ঠেকিয়ে গভীর চিন্তিত হয়ে বলল,,
“কাহিনী তো আমিও বুঝতে পারছিনা রে। তবে বিষয়টা নিয়ে একটু ঘেটে দেখতে হবে। চল আমরা বরং আয়মন ভাইয়ার কাছে যাই। একটু নাড়াচাড়া দিয়ে আসি।”

এরমাঝে তিথী আবার বাঁধ সাধল। জায়মা এবং তাশফিয়ার দিকে তাকিয়ে সে অন্য সুরে বলল,,
“তোরা বরং যা। আমি চাঁদকে একটু খোঁচাই। দেখি মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারি কিনা।”
জায়মা এবং তাশফিয়া হেঁতো হাসল। তিথীকে বাহবা জানিয়ে জায়মা বলল,,

“বাহ্। তোর মাথায় তো বেশ বুদ্ধি। তুই বরং চাঁদকে খোঁচা। আর আমরা ঐখানে আয়মন ভাইয়াকে বাজিয়ে আসি।”
তিনজনই দুদিকে ছিটকে গেল। জায়মা এবং তাশফিয়া রুম থেকে বের হয়ে আয়মনকে খুঁজতে লাগল। আর তিথী একা চাঁদকে খোঁচানোর জন্য চুপটি করে চাঁদের পাশে এসে বসল। চাঁদকে হাতে আনার জন্য সে বেশ আদুরে হয়ে চাঁদের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। ননাই করে বলল,,

“আহারে বেচারি মেয়েটা! বোনের বিয়েটাও এলো আর মেয়েটার মুখেও এসব পিম্পল উঁকি দিলো। সত্যিই খুব আপসোস হচ্ছে তোর জন্য।”
সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ চোখ খুলে উল্টোদিকে ফিরল। তিথীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টালো। বিমূর্ষ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আচ্ছা আমাকে কি খুব বিশ্রী দেখায় তিথী? ধর কিছুদিন আগেও কেউ আমাকে খুব পছন্দ করত কিন্তু এখন আমার মুখের এই অবস্থা দেখে সে আমাকে এভোয়েড করা শুরু করল বিষয়টা কি এমন?”

“না তো! এমন হবে কেন? তাছাড়া তোকে তো পিম্পল মুখেও এতোটা খারাপ লাগছেনা। হয়তো আগের মতো সুশ্রী দেখাচ্ছে না। তবে কুশ্রীও দেখাচ্ছে না। কেন? কী হয়েছে একটু বলবি?”

চাঁদ মাথাটা নুইয়ে নিলো। রাশভারী গলায় বলল,,
“না কিছুনা। তবে আমার মনে হয় আমার মুখের এই অবস্থা দেখে এখন আমাকে কেউ পছন্দ করেনা।”
“ওহ্ আচ্ছা এ ব্যাপার? এজন্যই তোর মন খারাপ?”

“হ্যাঁ! আমি চাই আমার মুখটা খুব তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে যাক। কেউ এই কুৎসিৎ লুকে আমাকে দেখে এভোয়েড না করুক।”
“কে তোকে এভোয়েড করল শুনি?”
“বিশেষ কেউ না! তবে আমার নিজের কাছেই নিজেকে কেমন খারাপ লাগছে। কারো সামনেও যেতে মন চায়না। রুম থেকে বের হতেও মন চায়না।”

“আরে গাঁধি৷ এজন্যই তো বললাম আজই ডক্টরটা দেখিয়ে আয়। দেখনা এক দুইদিনে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা।”
“উঁহু। আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা আমার! দেখি কাল পরশু যাব! নূরের বাচ্চাটা না থাকলে।”
শেষোক্তিটা চাঁদ খুবই আস্তে করে বলল। যার কারণে কথাটা তিথীর কান অবধি পৌঁছালো না। তিথী নিজেও মন খারাপ করে চাঁদের পাশে শুয়ে পড়ল। বিভিন্নভাবে হাসি তামাশা করে চাঁদের মন ভালো করার চেষ্টা করল।

জায়মা এবং তাশফিয়া আয়মনকে খুঁজতে খুঁজতে হলরুমের বাইরে চলে এলো। এসেই তারা মেইন গেইটের সামনে আয়মন এবং সাদমানকে দেখতে পেল। দুজনই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কী বিষয় নিয়ে যেনো গভীর আলোচনা করছিল। কিছুটা দূর থেকে আয়মন তাশফিয়াকে একঝলক দেখামাত্রই আবুল মার্কা ভাবসাব বদলে হিরো সাজতে আরম্ভ করল! এলোমেলো চুলগুলো টেনে সে পরিপাটি ভাবে গুছিয়ে নিলো। শার্টের কলারটা টেনে সোজা করল। ঘামে সিক্ত মুখটা টিস্যু পেপার দ্বারা নিঁখুত ভাবে মুছে নিলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলল আয়মন। হাত উঠিয়ে জায়মা এবং তাশফিয়াকে ইশারা করল। গলা উঁচিয়ে বলল,,

“কী হলো? তোরা এখানে কী করছিস?”
তাশফিয়া স্টেচুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল! আয়মনকে দেখলেই তার ভীষণ ভয় কাজ করে। আয়মনের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনা সে৷ হাত-পা কাঁপাকাঁপি করে। জায়মা অবিচল হয়ে আয়মনের দিকে ছুটে গেল। পাশে থাকা সাদমানকে এড়িয়ে সে আয়মনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“ভাইয়া তুমি না বলছিলা চাঁদকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবা? তো হঠাৎ চাঁদ এভাবে মুখ ফুলিয়ে ফিরে গেল কেন হ্যাঁ?”
আয়মন চোখ ঘুরিয়ে কেবল মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাশফিয়াকে দেখার নেশায় অটল রইল। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ কেবল তাশফিয়াকে ঘিরে। তাশফিয়ার দিকে তাকিয়ে সে জায়মাকে বলল,,

“ওর শরীর খারাপ লাগছে আজ। তাই যাবেনা।”
আয়মনের মুখের কথা টেনে নিলো সাদমান। চিন্তিত ভঙ্গিতে সে জায়মাকে বলল,,

“আচ্ছা জায়মা তুমিই বলো মুখের এই ক্রিটিক্যাল অবস্থা নিয়ে তার এভাবে বসে থাকলে চলবে? ডক্টর দেখাতে হবেনা? আমি এতো করে পেছন থেকে ডাকলাম আমার ডাকটা সে শুনলনা। আমি তো তার ভালোর জন্যই বলছি নাকি? তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে চাঁদকে? যদি তোমার কথা শুনে।”

“যা ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে চাঁদ৷ জীবনেও কারো কথা শুনবে না সে। নিজে যা ভালো মনে করবে ঠিক তাই করবে। আজ যেহেতু যাবেনা বলেছে যাবেই না সে। পৃথিবীর কেউ তাকে হ্যাঁ করাতে পারবেনা তাকে। আমার বোন আমি চিনিনা?”

এরমধ্যেই হঠাৎ তাশফিয়ার ফোন বেজে উঠল। হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে তাশফিয়া হকচকিয়ে উঠল। থমথমে হয়ে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি তার মায়ের নাম্বারটা ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই তাশফিয়ার ঠোঁটের কোণে সহজাত রেখায হাসি ফুটে উঠল। মৃদু হেসে তাশফিয়া ফোনটা তুলতে যাবে অমনি আয়মনের কর্কশ গলার স্বর তার কানে ভেসে এলো। উত্তেজিত হয়ে আয়মন দূর থেকেই তাশফিয়াকে শুধিয়ে বলল,,

“এই? কে ফোন করেছে?”
তাশফিয়া থতমত খেলো। আয়মনের দিকে ভীরু দৃষ্টিতে তাকালো। বিব্রতকর গলায় বলল,,
“মা।”
আয়মন স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। দুঃশ্চিন্তা ভুলে ঈষৎ হেসে বলল,,
“কথা বলো।”

তাশফিয়া অভয় পেল। বিনিময়ে সেও মিষ্টি হাসল। আয়মনের মাথা ঘুরে গেল। মাথা নুইয়ে সে বুকে হাত রাখল। মোহিত স্বরে বলল,
“মার ডালা মুঝে!”
সাদমান রাগে হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল! চাঁদের প্রতি তার ভালোবাসার সাথে সাথে রাগটাও বাড়তে লাগল! তবে চাঁদের হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলের কারণ সাদমানের বোধগম্য হলোনা। আসল ব্যাপারটাই সে বুঝতে পারলনা।

সোহানীর সাথে কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর নূর বসা থেকে উঠতে গেল। অমনি সোহানী নূরকে থামিয়ে দিলো। সোহানী নিজে বসা থেকে ওঠে ব্যস্ত স্বরে নূরকে বলল,,
“তুমি বসো নূর। আমি তোমার জন্য মসলা চা করে আনছি। গলাটা একদম বসে গেছে তোমার। মসলা চা খেলে এক্ষণি ঠিক হয়ে যাবে।”

“আরেহ্ না ভাবি। আপনাকে এতো ব্যস্ত হতে হবেনা। বাইরে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। একটা একটা করে সব কাজ আজকের মধ্যেই কমপ্লিট করতে হবে। আপনি প্লিজ বসুন। আমি আসছি।”

“এই চুপ করো তো! পাঁচ দশমিনিটের জন্য কিছু বসে থাকবেনা। সব কাজই হবে। তোমার শরীরের অবস্থা দেখেছ? খুব একটা ভালো না দেখেই বুঝা যাচ্ছে৷ চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন তোমার? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করো না নাকি? ঘুমটুম ঠিকমতো হয়?”

নূর মাথা নুইয়ে নিলো। নাক টেনে জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“সবকিছুই ঠিকঠাক হয় ভাবি৷ কথা হচ্ছে ইদানিং একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়ছি! জ্বর, সর্দিকাশি একসাথে লেগেই আছে। হোপ সো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“ভালো একটা ডক্টর দেখাও বুঝছ? রোগ নিয়ে এভাবে অলসতা করলে চলবেনা। ভাবি তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি। তুমি বসো।”

সোহানীর জেদের কাছে নূর হার মানল। নিরুপায় হয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সোহানী রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। নূরের নাকে পুনরায় সর্দি জমে এলো। অধীর হয়ে সে পকেটে হাত দিয়ে টিস্যু খুঁজতে লাগল। তবে হয়রানির বিষয় হলো টিস্যুর একটা কণাও নূর পকেটে খুঁজে পেলনা।

ফেঁসে গেল সে মহা ফ্যাসাদে। কীভাবে নাক পরিষ্কার করবে তা ভেবে সে উদগ্রীব হয়ে উঠল৷ অমনি পেছন থেকে চাঁদের আবির্ভাব ঘটল! গাঁয়ের সুতির ওড়নাটা নূরের মুখের সামনে সে এগিয়ে দিলো। শিথীল গলায় বলল,,
“ধরুন। নাকটা পরিষ্কার করে নিন!”

নূর ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। চোখ ঘুরিয়ে চাঁদের দিকে তাকালো। অমনি চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া জন্ম নিলো। মুখটা একদম পিম্পলে ছেয়ে গেছে তার। হয়তো খুব জ্বালাপোড়াও করে। নিশ্চয়ই চাঁদ খুব কষ্ট পায়। সহ্য করে পারে তো এই জ্বালা চাঁদ? এসব ভেবে নূর ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তবে তার উদ্বিগ্নতাকে সে বেশিক্ষণ প্রশ্রয় দিলো না। চাঁদের থেকে ভগ্ন দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ওড়নাটা তার মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিলো! ঝট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে নাক টেনে বলল,,

“যার তার ওড়না আমি ব্যবহার করিনা ওকে? সো নেক্সট টাইম থেকে এসব ঢং দেখাতে আসবেনা আমার সাথে।”
বিগড়ে গেল চাঁদ। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে নূরের পেছনে এসে দাঁড়ালো। নাক পরিষ্কার করতে থাকা নূরকে বেশ শাসিয়ে বলল,,
“আমিও আমার ওড়না যাকে তাকে ইউজ করতে দিইনা ওকে? বুঝতে হবে আপনার।”
নূর কদাচিৎ হাসল। পিছু ফিরে চাঁদের দিকে তাকালো। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,,

“সিরিয়াসলি? তো একটু আগে ওটা কী ছিল? আমার মুখের সামনে ওড়নাটা কে ধরেছিল?”
“ডেমো ছিল ওকে? যখনি আপনি ওড়নাটা খপ করে ধরতে যেতেন না? ঠিক তখনই আমি ওড়নাটা টুক করে সরিয়ে নিতাম! আর আপনি হালকা করে ধোঁকা খেয়ে যেতেন! কী ভেবেছেন কী আপনি আমাকে হুম? বোকার হদ্দ?”

নূর মনে মনে খুব হাসল। বিড়াল মাছের নাগাল না পেলে যা করে আর কী! ঠোঁটের কোণে অট্ট হাসি ফুটিয়ে সে আবারও পিছু ঘুরে নিলো। চাঁদকে মোটেও পাত্তা দিলোনা। সম্পূর্ণ গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। নূরের হঠাৎ মুখিয়ে যাওয়া দেখে রাগে চাঁদের গাঁ টা রি রি করে উঠল। আক্রোশিত গলায় সে শুধালো,,

“হাসছেন কেন হ্যাঁ হাসছেন কেন? আমার কথা আপনার ফাইজলামি মনে হয়?”
নূর নিরুত্তর। ইচ্ছা করে সে কোনো কথা বাড়ালো না। চাঁদের প্রতিক্রিয়া বুঝার চেষ্টা করল। নূরের নীরবতা চাঁদকে ভেতরে ভেতরে পোড়াতে লাগল! উদ্ভ্রান্ত হয়ে চাঁদ পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো হ্যাঁ? কথা বলছেন না কেন?”
“কী বলব হ্যাঁ? কী বলার আছে আর?”
“ঝগড়া করবেন না?”
“না। অনেস্টলি তোমার সাথে ঝগড়া করার কোনো মুড নেই আমার। তবে একটা প্রশ্ন করতে পারি।”
“কী প্রশ্ন?”

“ডক্টর দেখাতে যাওনি কেন?”
“আপনার নাটক আমার ভাল্লাগছেনা তাই!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৭

চট করে জায়গা থেকে সরে এলো চাঁদ। সোহানীর ব্যাগপত্র ঘেটে অ্যালোভ্যারা জেলটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল! নূর তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। চাঁদের হঠাৎ এতো রিয়েক্ট করার কারণ সে খুঁজতে লাগল।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৯