প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৯

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৯
নিশাত জাহান নিশি

চট করে জায়গা থেকে সরে এলো চাঁদ। সোহানীর ব্যাগপত্র ঘেটে অ্যালোভ্যারা জেলটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল! নূর তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। চাঁদের হঠাৎ এতো রিয়েক্ট করার কারণ সে খুঁজতে লাগল।

কিয়ৎক্ষণ চাঁদের যাওয়ার পথে মৌন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নূর আচমকা বাঁকা হাসল! হেলে থাকা শার্টের কলারটা সোজা করল। স্পাইক করা চুলগুলো আরও স্পাইক করতে লাগল। সন্দেহমনা হয়ে মাথাটা নুইয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আচ্ছা সে কী জ্বলছে? আমার এভোয়েডনেসে কী আদোতে সে জ্বলছে?”
ভাবুক রূপে নূর ধপ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। চোখ জোড়া বুজে সে গভীর চিন্তায় ডুব দিলো। শুষ্ক মুখমণ্ডলে চিন্তিত সুর নিয়ে বলল,,

“জ্বলুক পুড়ুক আর যাই করুক। এখন তো তার ফেসের প্রোপার্লি ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। একটা দিন মিস হওয়া মানে তার ফেসের অবস্থা আরও অনেকটা খারাপ হতে যাওয়া। আমি কি তাকে ফোর্স করব ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য? কিংবা রিকুয়েস্ট?”

এরমধ্যেই সোহানী তাড়াহুড়ো করে প্রবেশ করল রুমে। হাতে গরম গরম মসলা চা নিয়ে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নূর ফট করে চোখজোড়া খুলল। ভদ্রতার খাতিরে মলিন হেসে সোজা হয়ে সোফায় বসল। সোহানী মৃদু হেসে চায়ের কাপটা নূরের দিকে এগিয়ে দিলো। গলা ঝেড়ে বলল,,

“নাও। চা টা গরম গরম খেয়ে নাও। গলার জন্য খুব উপকারি।”
নূর ঈষৎ হেসে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলো। সোহানীকে কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করল। কিঞ্চিৎ সংকোচবোধ নিয়ে সোহানীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা ভাবি? চাঁদের ফেসের এই অবস্থা হলো কীভাবে? কোনো খারাপ প্রোডাক্ট ইউজ করেছিল কী?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহানী খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসল। চিন্তিত মুখে নূরের দিকে তাকিয়ে বেসুরো গলায় বলল,,

“না নূর। চাঁদ তো মুখে নরমাল ক্রিমটাও ভালো করে লাগায় না। আর খারাপ প্রোডাক্ট নেওয়া তো দূরে থাক। আসলে সে একটু খা’টা’শ টাইপের! যার তার ইউজ করা টাওয়াল, রোমাল, টিস্যু, সাবান, স্নো ইউজ করে ফেলে! চিন্তা করেনা অন্যজনের ইউজ করা কোনো জিনিস ইউজ করলে নিজের ফেসে খারাপ কোনো এফেক্ট পড়বে কিনা৷

ঐ তো ঐদিন আয়মনের জেঠাতো বোন বেড়াতে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। মেয়েটার এলার্জির প্রবলেম ছিল প্লাস মুখে চাঁদের মতোই এমন বিচি বিচি কিছু ফুটেছিল। ঐ মেয়ের ইউজ করা টাওয়াল, রোমাল, টিস্যু্, সবাবান যা আছে সব ইউজ করেছে! এরপর থেকেই ওর মুখের এই অবস্থা। কিছু কিছু জীবানু আছে ছোঁয়াচে। এই ছোঁয়াচে জীবানু এবং ব্যাকটেরিয়াগুলোর কারনেই আজ ওর মুখের এই দশা হয়েছে।”

মনে মনে নূর রাগে ফোঁসল! চাঁদকে এখনি তার গলা টি’পে ধরতে মন চাইল। একটা মেয়ে কীভাবে পারে এতোটা কেয়ারলেস হতে? কেন তার নিজের প্রতি কোনো যত্ন নেই? সবকিছুতেই কেন তার এমন গাঁ ছাড়া ভাব? সাংঘাতিক রাগে কাবু হয়ে নূর জিহ্বা পুড়িয়ে গরম গরম চা টা তিন/চার ঢোঁকে খেয়ে নিলো! চট করে সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চায়ের কাপটা ডেস্কের উপর রেখে রাগে গটগট করে রুমের দরজায় পা বাড়ালো। পেছন থেকে সোহানীকে লক্ষ্য করে বলল,,

“ভাবি। আমি চাঁদকে নিয়ে একটু হসপিটালে যাচ্ছি! আমার একজন পরিচিত স্কিন কেয়ার ডক্টর আছে। উনার সাথে কনসাল্ট করে দেখি কী হয়।”
সোহানী উত্তেজিত হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ভীরু গলায় নূরকে বলল,,
“কিন্তু নূর, চাঁদ তো আজ কোনো কারণে খুব রেগে আছে। মনে হয়না আজ সে তোমার সাথে কোথাও যাবে। যা জেদি মেয়ে।”

নূর চোয়াল শক্ত করল। কঠিন গলায় বলল,,
“সে যাবেনা তার ঘাড় যাবে ভাবি! আপনি জাস্ট দেখতে থাকুন কী হয়।”

দ্রুত পায়ে হেঁটে নূর রুম থেকে প্রস্থান নিলো। চাঁদের রুমের দিকে গতিপথ নির্ধারণ করল। চাঁদকে আজ দফারফা করবে বলে সে মনোস্তব করে নিলো। দৃঢ় পায়ে হেঁটে সে চাঁদের রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজায় খুব জোরে জোরে করাঘাত করল। অমনি তিথী ঝট করে এসে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। রাগান্বিত নূরকে দেখামাত্রই তিথী শুকনো ঢোঁক গিলল। ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আআআপনি?”
নূর বেশ রূঢ় গলায় বলল,,
“হ্যাঁ আমি। চাঁদ কই?”
“চাঁদ তো ভেতরে।”
“দেখি সরুন।”

নূরের মেজাজ দেখে তিথী সত্যিই ঘাবড়ে উঠল। তাড়াহুড়ো করে সে নূরের সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই নূর চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল। তিথীর দিকে একঝলক তাকালো নূর। শক্ত গলায় বলল,,
“বাইরে যান। মাহিন আপনাকে ডাকছে!”
সঙ্গে সঙ্গেই তিথী নির্বোধ ভাব নিলো। বোকা গলায় শুধালো,,
“মানে?”
“মানেটা বাইরে গেলেই বুঝতে পারবেন। এখন যান তো বাইরে।”

তিথীকে একপ্রকার ফোর্স করে নূর রুম থেকে বের করে দিলো! রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে তিথী ঠোঁট উল্টালো। অপমানিত বোধ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,,
“এই সবগুলা ভাই, ফ্রেন্ডস, ইয়ার সব এক! কারো মধ্যেই কোনো সহবোধ নেই। কথায় কোনো রসকষ নেই। কীভাবে অপমান করে আমাকে রুম থেকে বের করে দিলো! থাকবনা আমি আর এই বাড়িতে হ্যাঁ!”

রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে নূর ড্রেসিং টেবিলের দিকে নজর দিলো। ব্রনযুক্ত ফ্যাকাসে মুখটা ঢেকে চাঁদ হেচকি তুলে কাঁদতে ব্যস্ত! খারাপ কোনোকিছু ব্যবহার না করেও তার মুখের আজ এই অবস্থা হলো৷ সেই কষ্টে তার বুকটা যেনো ভেতর থেকে ফেটে যাচ্ছিল। চাঁদের কান্নায় নূর বিমূর্ষ হয়ে উঠল! বড়ো সড়ো একটা আঘাত পেলেও সেই আঘাতকে বেশি প্রশ্রয় দিলোনা সে৷ বৃহদাকৃতির পা ফেলে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। শাণিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কাঁদছ কেন তুমি হ্যাঁ? কেন কাঁদছ? অন্য কারো ইউজ করা প্রোডাক্ট নিজের মুখে এপ্লাই করার সময় মনে ছিলনা যে এসব প্রোডাক্টগুলো তোমার মুখে কতটা ইফেক্ট করতে পারে? কেন অন্যের জিনিস ইউজ করতে যাও তুমি?”
চাঁদ হেচকি তুলে ফেলল। জেদি গলায় বলল,,
“যা হয়েছে হয়ে গেছে৷ এখন আপনি আমার এই দুঃসময়ে এসেছেন আমাকে জ্ঞান দিতে? কে বলেছে আপনাকে এখানে আসতে হ্যাঁ?”

“এই মুখ থেকে হাতটা সরাও আগে। এরপর কথা বলো।”
চাঁদ কান্নার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলো। হু হু করে কেঁদে বলল,,
“না! আমি নিজেই নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা। ঘৃণা লাগছে খুব। আমার মুখটা কি আর কখনো ঠিক হবেনা? এভাবেই কালসিটে আর ব্রনযুক্ত থাকবে?”

রাগে ফোঁস ফোঁস করে নূর চাঁদের একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। প্রবল জোর খাটিয়ে চাঁদের মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো! চাঁদের লাল হয়ে থাকা পিম্পলযুক্ত মুখমণ্ডলে তাকিয়ে বলল,,
“যে নিজেই নিজেকে ভালোবাসতে জানেনা, সে অন্যজনকে কী ভালোবাসবে হ্যাঁ? আগে তো নিজেকে ভালোবাসতে শিখো। নিজেকে বড়ো করে দেখতে শিখো। তুমি যেমনই হও না কেন, তোমার নিজের কাছে তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক। পৃথিবীর সবার চেয়ে সুশ্রী।”

চাঁদ ফোঁপাতে ফোঁপাতে নূরের দিকে তাকালো। শিথিল চোখে নূরকে দেখল। ব্যথীত গলায় বলল,,
“আজ আমার মুখের এই খারাপ অবস্থা বলেই তো আপনি আমাকে এভোয়েড করছেন নূর ভাইয়া! তাই তো আমার আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে! কারণ, আপনিও তো এখন আমাকে ঘৃণা করেন!”

“আমি ঘৃণা করি বা যাই করি এতে তোমার কী আসে যায় হ্যাঁ? এতে এত কষ্ট পাওয়ার কী আছে? একজনের ঘৃনায় কিছু আসবে যাবেনা ওকে? তোমাকে তো ভালোবাসার অনেক মানুষ আছে! তাদের ভালোবাসাটাকে বড়ো করে দেখো। এতে করে এটলিস্ট যাই হোক তোমার মনে আর খারাপ লাগা কাজ করবেনা।”

তৎক্ষনাৎ চাঁদ মাথা নুইয়ে নিলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে ভেতরে ভেতরে কাঁদতে লাগল। নূর এখন তাকে আর ভালোবাসে না সেই বিষয়ে সে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেল! এই কারণেই যেনো তার কষ্টের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। চাঁদ চাইছেনা নূর তাকে ভালোবাসুক। তবুও কেন জানিনা তার ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! চাঁদের নীরবতা দেখে নূর গলা ঝাড়লো। শান্ত গলায় বলল,,

“রেডি হয়ে নাও। আমরা ডক্টরের কাছে যাব।”
চাঁদ নাক টানল। চোখের জল মুছে খর্ব গলায় বলল,,
“যাবনা আমি। আয়মন ভাইয়াকে অনেক আগেই বারণ করে দিয়েছি।”

“আয়মন তোমার বারণ শুনলেও আমি কিন্তু তোমার বারণ শুনতে রাজি নই! কারণ আমি তোমার আয়মন ভাইয়া নই, যে খামোখা তোমাকে আহ্লাদ করব। ননাই দেখিয়ে তোমায় মাথায় তুলে রাখব।”
“আমাকে আপনার ফোর্স করা সাঁধেনা।”
“না সাঁধলেও ফোর্স করব। প্রয়োজনে কোলে তুলে নিয়ে যাব!”

চাঁদ হকচকিয়ে উঠল। নূরের দিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হতবাক হয়ে সে নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নূর কঠিন ভাব নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী? ফোর্স করব? কোলে তুলব? আ’ম সো সিরিয়াস ওকে?”

অতিশয় বিপাকে পড়ে চাঁদ মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। নূরকে দেখেই বেশ বুঝা যাচ্ছে সে খুব সিরিয়াস মুডে আছে। কথানুযায়ীই কাজ করবে! চাঁদের বারণ সে শুনবেই না। তাই চাঁদ একপ্রকার বাধ্য হলো নূরকে সায় জানাতে। চাঁদের চাহনিতে নূর কাবু হয়ে গেল! শীতল গলায় বলল,,

“চোখ মুছো।”
চাঁদ মাথা নুইয়ে নিলো। হাত দ্বারা চোখজোড়া মুছে নিলো। নাক টেনে বলল,,
“আপনি বাইরে যান। আমি রেডি হয়ে আসছি।”
“রেডি হতে হবেনা। ওখানে কেউ তোমাকে দেখতে আসবেনা। তুমি জাস্ট ডক্টর দেখাবে আর চলে আসবে।”
“আচ্ছা। মাস্কটা তো পড়ে নিই?”
“ওকে।”

ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাঁদ মাস্কটা বের করল। নূর অধৈর্য্য হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। পকেটে দু’হাত গুজে দরজার বাইরে পায়চারি করতে লাগল। চাঁদকে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরে চ্যাচিয়ে বলল,,
“আরে এই চাঁদ হারি আপ। আর কতক্ষণ লাগবে?”

পার্সটা কাঁধে ঝুলিয়ে চাঁদ তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়ে এলো। ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,,
“একটা মিনিটও সহ্য হয়না না? চলুন!”
নূর সূক্ষ্মদৃষ্টিতে আগা গোড়া চাঁদকে খুঁটিয়ে দেখল। অতঃপর তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মাথায় ঘোমটা কই?”
চাঁদ বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ক্ষীণ গলায় বলল,,
“দিচ্ছি তো। আপনিই তো তাড়া দিচ্ছিলেন।”

জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো নূর। পকেট থেকে হাত দুটো বের করে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,,
“তাড়াতাড়ি এসো। আর একটু লেইট হলেই ডক্টরের সিরিয়াল পাওয়া যাবেনা।”
মাথায় বড়ো করে ঘোমটা টেন চাঁদ নূরকে অনুসরন করল। পেছন থেকে তাদের দুজনের যাওয়ার পথে জায়মা এবং তিথী তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল! দুজনই বেশ ভাবুক হয়ে সমস্বরে বলল,,

“ওহ্। তাহলে এই ব্যাপার? এর জন্যই চাঁদ এতক্ষণ যাবত নাটক করছিল? কী আ’হা’ম্ম’ক রে আমরা! কিছুই বুঝলামনা।”
মাথা চাপড়ে দুজন দুজনের দিকে তাকালো। হায় হুতাশ করে পেছনের দিকে হাঁটা ধরল। নূর এবং চাঁদ হলরুম পাড় করে রাস্তায় চলে এলো। রাস্তার এদিক-ওদিক অস্থির দৃষ্টিকে তাকিয়ে নূর চাঁদকে শুধালো,,

“রিকশায় যাবা না বাইকে যাবা?”
“রিকশায়।”
নূর একটা রিকশা দাঁড় করালো। প্রথমে চাঁদকে রিকশায় উঠতে বলল। এরপর চাঁদের ঠিক বাঁ পাশটায় নূর গুটিশুটি হয়ে বসল! দুজনই মাঝখানে যথেষ্ট ব্যবধান নিয়ে বসল। কেউ কারো গাঁয়ের সাথে ঘেঁষলনা। এমনকি কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকালো না। রিকশাওয়ালা মামা রিকশা ছেড়ে দিলো। দুজনই সোজা রাস্তায় তাদের দৃষ্টি স্থির করল।

রাস্তার অপর পাশ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাদমান সব দেখছিল! হিংস্রতায় কাবু হয়ে সে হাতে থাকা সিগারেটটি নিচে ছুড়ে ফেলল। পা দ্বারা সিগারেটটি পিষিয়ে সে কয়েকদফা বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,,
“তুই বন্ধু হয়ে আমার এতবড় ক্ষতি করছিস নূর? কথা দিয়েও তুই কথা রাখছিস না? একটা মেয়ের জন্য তুই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করছিস? আমার সাথে চিট করছিস?”

হলরুমের বাইরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে তাশফিয়া। তার মায়ের সাথে সে গভীর ফোনালাপে লিপ্ত। তাশফিয়ার মা খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন তাশফিয়াকে নিয়ে। উনি কখনো উনার মেয়েকে ছাড়া একটা রাতও কোথা থাকেননি! কখনো চোখের আড়াল করেননি মেয়েকে। দূরে যেখানে গেছেন মেয়েকে সাথে নিয়ে গেছেন।

কিন্তু আজ উনার মেয়ে উনার থেকে কতদূরে! তিন থেকে চারদিন মেয়েকে ছাড়া উনার এভাবেই কাটাতে হবে। সেই দুঃখেই যেনো উনার বুকটা ফেটে কান্না আসছে। সবসময় তো আর ছেলে-মেয়েকে এভাবে নিজেদের কাছে বন্দি করে রাখা যায়না। কখনো কখনো হাওয়া পরিবর্তনের জন্য এখানে ওখানে যেতে দিতে হয়। আর সেই কাজটাই এবার তাশফিয়ার মা করেছেন।

তাশফিয়া নিজেও খুব বিষণ্ণ হয়ে আছে তার মায়ের কথা ভেবে। তার অনুপস্থিতিতে তার মা টাইমলি খাবে কিনা, প্রোপার্লি ঔষধ নিবে কিনা, ঠিকমতো ঘুমুবে কিনা সেই চিন্তায় সে অস্থির প্রায়। পরিশেষে তাশফিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় তার মাকে বলল,,

“তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো মা। টাইমলি ঔষধ খেয়ো। আর যখনি তোমার আমার কথা খুব মনে পড়বে তখনি আমাকে কল করবে। আমি সারাক্ষণ তোমার সাথে কথা বলব মা।”

“আমার কথা তুই চিন্তা করিসনা মা। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিব। তুই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস কেমন? সবার সাথে মিলেমিশে থাকিস। বেশি সাহস দেখাতে যেয়ো না যেনো। তিথীকেও বলে দিও শান্ত-শিষ্ট হয়ে থাকতে। হুট করেই কারো সাথে খারাপ ব্যবহার না করতে।”

“ঠিক আছে মা। আমি তিথীকে সব বুঝিয়ে বলব। তুমি একদম চিন্তা করোনা। আমি খুব শীঘ্রই তোমার কাছে চলে আসব মা। তোমাকে বেশিদিন একা থাকতে হবেনা।”

“এত তাড়াহুড়ো করে আসতে হবেনা তোমাকে বুঝেছ? কয়েকদিন ভালো করে ঘুরে টুরে এসো। হাওয়া বদলের দরকার আছে তোমার। ঘরের ভেতর থেকে থেকে তো আবুল হচ্ছিলে। খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠছিলে। এবার যদি একটু ঠিক হও আর কী। আচ্ছা তোমার আশেপাশে কেউ আছে?”

“কেন মা? কোনো দরকার?”
“না। বড়ো কেউ থাকলে ভালো হতো। একটু কথা বলতাম। তুমি তো খুব লাজুক স্বভাবের মা। নিজের প্রয়োজনের কথা কাউকে মুখ খুলে বলবেনা। কেউ থাকলে আমি একটু বলে দিতাম।”
এরমধ্যেই আয়মন যেনো কোথা থেকে দৌঁড়ে এলো তাশফিয়ার কাছে! হাঁপিয়ে ওঠা গলায় সে তাশফিয়াকে বলল,,
“এই শোনো? তোমাকে সোহানী আপু ডাকছে। ভেতরে যাও।”

থতমত খেয়ে তাশফিয়া ফোনটা কান থেকে নিচে নামিয়ে নিলো। পা কচলে ইতস্তত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আপু আবার কেন ডাকছে?”
“আমি কী করে জানব হ্যাঁ? আমাকে কিছু বলছে?”
আয়মনের রাগী মুখভঙ্গি দেখে তাশফিয়া মাথা নুইয়ে নিলো। কম্পিত হাতে ফোনটা কানে তুলে বলল,,
“মা আমি এখন রাখছি কেমন? পরে কল করব।”

তাশফিয়ার মা বাঁধ সাধলেন। উত্তেজিত গলায় মেয়েকে বললেন,,
“এই না না রেখো না। যে তোমাকে ডাকতে এসেছে তার কাছে একটু ফোনটা দাও। মা কথা বলব।”
তাশফিয়া দাঁতে দাঁত চাপল। মিনমিনে গলায় বলল,,
“উফফফ মা! তুমি আয়মন ভাইয়ার সাথে কী কথা বলবে হ্যাঁ?”

“দে না রে ফোনটা। বললেই তো শুনবি কী কথা বলছি।”
“না দিতে পারবনা। উনি কী না কী মনে করবেন। তাছাড়া লোকটা খুব জাদরেল স্বভাবের! যদি তোমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে তো?”

তাশফিয়ার ফিসফিসানি দেখে আয়মন ভ্রু কুঁচকালো। তাশফিয়ার দিকে খানিক ঝুঁকে এসে দাঁড়ালো। সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই? কী ফুসুর ফুসুর করছ?”
তাশফিয়া ভড়কে উঠল। শুকনো ঢোঁক গিলে আয়মনের দিকে তাকালো৷ আমতা আমতা স্বরে বলল,,
“কককই কিছুনা তো।”

আয়মন তার সন্দেহে অটল রইল। ভ্রু উঁচিয়ে একরোঁখা গলায় বলল,,
“আমি নিজ কানে শুনেছি তুমি কারো সাথে ফুসুর ফুসুর করছিলে! আই থিংক আমাকে নিয়ে কিছু বলছিলে!”
আয়মনের দিকে তাশফিয়া এবার ঘুরে দাঁড়ালো। ফোনটা আয়মনের দিকে ধরল। চোখ বুজে গড়গড় করে বলেই দিলো,,
“মা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে।”

ব্যাপারটায় আয়মন বেশ খুশি হলো। বিনাসংকোচে সে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। অকুতোভয় হয়ে ফোনটা কানে তুলল। বিনয়ী হয়ে তাশফিয়ার মাকে সে সালাম জানালো। আয়মনের ভদ্রুতা দেখে তাশফিয়ার মা বেশ খুশি হলেন। গলা ঝেড়ে বললেন,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম বাবা। কেমন আছো?”
“ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো বাবা। তোমার ফ্যামিলির সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছে আন্টি৷ আগে বলুন আপনার শরীরের কী অবস্থা? সুস্থ আছেন তো আপনি?”
“আমার আর সুস্থতা। এই ভালো তো এই খারাপ। ঔষধের উপরই বেঁচে আছি বাবা।”

“আপনার এত টেনশান কীসের আন্টি? টেনশান ফ্রি থাকতে পারেন না? তাহলেই একটু সুস্থ থাকতে পারেন।”
“টেনশান ছাড়া জীবনে আর কী আছে বাবা? মেয়েটার মা হলেও আমি, বাবা হলেও আমি। একটা মাত্র মেয়ে। তবুও আমার টেনশানের শেষ নেই। যদি আমার কিছু একটা হয়ে যায় বাবা মেয়েটার কী হবে সেই টেনশানেই আমি দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।”

“সেই চিন্তা আপনার করতে হবেনা আন্টি। আল্লাহ্’ই তখন একটা পথ দেখাবেন৷ আপনি প্লিজ টোটালি টেনশান ফ্রি থাকুন। নিজেকে সুস্থ রাখুন। অন্তত মেয়েটার জন্য হলেও নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করুন। ভবিষ্যৎ ভেবে বর্তমান নষ্ট করবেন না প্লিজ। আপনার মেয়েকে দেখে রাখার জন্য নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আছে! যে আপনার মেয়েকে মন থেকে খুব চায় বা চাইবে। আপনার মতো করে আগলে রাখবে।”

তাশফিয়ার দিকে আড়চোখে তাকালো আয়মন। তাশফিয়ার প্রতিক্রিয়া বুঝার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গেই আয়মনের ফলাফল মিলে গেল। মাথা উঁচিয়ে তাশফিয়া মগ্ন দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। আয়মন মৃদু হাসল। তাশফিয়ার মাকে কিছু বলতে দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই সে পুনরায় বলল,,

“আপনার মেয়ের খাওয়াদাওয়া নিয়ে আপনার কোনো টেনশান করতে হবেনা আন্টি। আমি ওর খেয়াল রাখব। যেকোনো প্রয়োজনে আমি তার পাশে থাকব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করুন, আরামসে ঘুমান, আর ঔষধ খেয়ে নিজেকে সুস্থ রাখুন। আচ্ছা আন্টি, আপনার মেয়ের সাথে কথা বলুন। আমি একটু আসছি।”
তাশফিয়ার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে আয়মন একছুটে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। পিছু ঘুরে বাঁকা দৃষ্টিতে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। ব্যগ্র হেসে গড়গড় করে বলল,,

“একটা কথাও কিন্তু মিথ্যে নয়। আমি সত্যিই তোমার খেয়াল রাখব!”
তাশফিয়ার বুক ধুকপুক করে উঠল! হাত-পা অনবরত কাঁপতে আরম্ভ করল। হাতে থাকা ফোনটিও তার ঢকঢক করে কাঁপতে লাগল। এই অবস্থায় সে ফোনে কথা বলতে পারবেনা সেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়ে গেল! তাই সে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা কেটে দিলো। তার মাকে মেসেজ করে বলল,,

“মা। আমি একটু পরে তোমাকে পরে কল ব্যাক করছি। ওকে?”
মেসেজটি পাওয়া মাত্রই তাশফিয়ার মা ম্লান হাসলেন। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে উনি ভাবুক হয়ে উঠলেন৷ তৎপর গলায় বললেন,,
“আয়মন ছেলেটাকে খুব পজেটিভ মনে হচ্ছে। আমার মেয়ের প্রতি তার খুব টান দেখতে পেলাম। এছাড়াও খুব কনসার্ন মনে হলো আমাকে এবং আমার মেয়েকে নিয়ে!”

তিথী একা হাঁটতে হাঁটতে হলরুমের বাইরে চলে এলো। ভেতরে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা রুমে আর কতক্ষণ বন্দি থাকা যায়? দম যেনো বন্ধ হয়ে আসে। জায়মা এবং তাশফিয়া বিকেলের হালকা চা-নাশতা করছে। তিথী তাদের দুজনের আগেই খাবারটা শেষ করে নিয়েছে। তাই একা একাই তার হাঁটতে বের হতে হলো।

হলরুমের বাইরের এরিয়াটা খুবই সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এবং মনোরম পরিবেশে ঘেরা। চারিদিকে নানান জাতীয় ফুলের গাছ, বড়ো বড়ো ফুলের টব, বিশাল বিশাল ঝাউ গাছ, দোলনা থেকে শুরু করে পর পর অনেক গুলো ইটের বেঞ্চি। আড্ডা দেওয়ার জন্য একদম পার্ফেক্ট। তার উপর হাওয়ার সাথে সাথে বাহারি ফুলের ঘ্রাণ ভেসে নাকে এসে প্রবেশ করে। সুবাসে হারিয়ে যাওয়া যায়। সব মিলিয়ে এক্কেবারে অসাধারণ।

চিল মুডে হেঁটে তিথী দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসল। অমনি তার দৃষ্টি পড়ল হলরুমের মূল ফটকে। মাহিন তার বাইকটা পার্কিং এরিয়ায় পার্ক করছে। তাকে দেখতে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে। তার পাশাপাশি ক্লান্তও দেখাচ্ছে। সে পারছেনা বাইকটা ছেড়েই হলের ভেতর ঢুকে যেতে৷ তার এমন তাড়াহুড়ো দেখে তিথী তড়িঘড়ি করে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। মুখটা ওড়না দ্বারা ঢেকে বিড়বিড় করে বলল,,

“ছাগলটা এখন আমাকে এখানে দেখলেই দৌঁড়ে চলে আসবে। বকবক করে কান দুটো জাস্ট ঝালাফালা করে দিবে। আমি বরং মুখটা ঢেকে এখানেই বসে থাকি। তাহলে আর ছাগলটা আমাকে দেখবেনা। আর আমিও অহেতুক প্যাচাল থেকে বেঁচে যাব।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৪৮

কথাগুলো গড়গড় করে বলে দম নেওয়ারও সময় পেলনা তিথী! মাহিনের স্লো ভয়েসের আওয়াজ তার কানে এসে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধে গেল। টিটকারিপূর্ণ গলায় মাহিন ফিসফিসিয়ে বলল,,
“হেই সুন্দরি? আমি তো এদিকে!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫০