প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬১

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬১
নিশাত জাহান নিশি

“আজ আমি তোর কোনো বারণ শুনবনা পুচি। তোর জ্বর নেমে গেছে আমি জানি। সোহানী আপুর বিয়েতে আজ তোকে আমি লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে দিব। সবাই তোকে দেখে জাস্ট তাক লেগে থাকবে।”

চাঁদের অযাচিত জোরাজুরিতে পুচির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো! তুখোড় রেগে গেল সে। ম্যাচম্যাচে শরীর নিয়ে তীব্র আক্রমনাত্নক হয়ে উঠল। চাঁদের শরীরে একের পর এক আঁচড় কাটতে লাগল! ম্যাঁও বলে উচ্চশব্দে চিৎকার করতে লাগল। পুচির হিংস্রতায় চাঁদের আদুরে ভাবটা যেন বেগতিক বেড়ে গেল!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পুচির অসুস্থতা এবং রাগ ভাঙানোর জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠল। একরোখা হয়ে পুচিকে বুকে চেপে ধরে সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল! ক্ষুদ্ধ পুচির মাথায় মোলায়েম ভাবে হাত বুলাতে লাগল। পুচিকে আরাম দিতে লাগল। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই শরীরের আরাম পেয়ে পুচি সমস্ত রুক্ষতা ভুলে গেল। দীর্ঘ এক হামি তুলে চাঁদের বুকে মাথা ঠেকিয়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে পড়ল! পুচির আরামদায়ক ঘুম দেখে চাঁদের চোখের পাতায়ও কেমন যেন ঘুম ভর করল। সে নিজেও পুচির সাথে তাল মিলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল!

রৌদ্রময় দুপুর। আকাশে বিদ্যমান লাল সূর্যটা তার তেজস্ক্রিয় আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরণীর একাংশ জুড়ে। রোদের ঝাঁজে মুর্ছা যাচ্ছে ধূসর প্রকৃতি এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে আশেপাশের পরিবেশ। মাঝে মাঝে প্রলয়মান বৈরী বাতাসও ছুটে আসছে দিক-বিদিক থেকে। খরখরে মেজাজটা শীতল হয়ে যাচ্ছে ফুরফুরা বাতাসের প্রভাবে।

উভয় ধরনের অনুভূতিকে সঙ্গে নিয়েই নীড় বর ভেসে আসছে সোহানীকে তার ভাগ্যের সাথে আজীবনের জন্য বেঁধে নিতে। সোহানীকে বিয়ে করতে। মনে যেনো বসন্তের রঙ লেগেছে তার। ঠোঁটের কোণ থেকে খুশির সেই হাসিটা যেন কিছুতেই মিলছেনা। পরিপূর্ণভাবে কেবল ফুটে-ই উঠছে।

পাশ থেকে নূর, মাহিন, সাদমান এবং নীড়ের সব বন্ধুরা মিলে নীড়কে নানাভাবে বিরক্ত করছে। ঠাট্টা মশকরার মাধ্যমে নীড়কে ক্ষেপিয়ে তুলছে। তবে কোনো দিকেই কান দিচ্ছেনা নীড়। শুধু কল্পনায় সোহানীকে অনুভব করছে। বধূ ভেসে সোহানীকে কতটা অপরূপা লাগছে তার ছবি-ই মনে মনে আঁকছে।

বেশ কিছুক্ষণ হলো সোহানীকে নিয়ে জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া পার্লার থেকে ফিরেছে। সোহানীর সাথে সাথে তারা তিনজনও পার্লার থেকে বেশ ঘটা করে সেজে এসেছে! চাঁদের মুখে ব্রনগত সমস্যা থাকার কারণে চাঁদ ইচ্ছে করেই পার্লারে সাজতে যায়নি। নিজে নিজে যতখানি পেরেছে ঠিক ততখানিই সেজেছে।

তাছাড়া নূরেরও কঠোর বারণ আছে মুখে যেন ভারী মেকাপ না করে চাঁদ। মেকাপ থেকে যতটা দূরে থাকা যাবে তার জন্য ততটাই ভালো হবে। ডক্টর যা সাজেস্ট করেছে তাই যেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে চাঁদ। সোহানীকে যে রুমে রাখা হয়েছে সে রুমে আত্নীয়-স্বজনদের ভীড় জমে গেছে।

একের পর এক সবাই দল বেঁধে সোহানীকে দেখতে আসছে৷ বধূ ভেসে সোহানীকে এতটাই রূপেশ্বরী দেখাচ্ছে যে সবাই কেবল হা করে সোহানীকে দেখছে! এদিক ওদিক থুথু ছিটিয়ে তারা নানাভাবে সোহানীর রূপের প্রশংসা করছে। লজ্জায় এবং জড়তায় মাথা নুইয়ে সোহানী বিছানার এক কোণায় বসে আছে। সবার মুখ থেকে প্রশংসা শুনে সত্যিই তার ভীষণ লজ্জা করছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে সোহানী অপেক্ষা করছে কখন নীড় আসবে! কখন নীড়কে দেখে তার চোখ দুটো জুড়াবে!

পার্লার থেকে ফিরে এসেই জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া ছুটে গেল চাঁদের কাছে। নিরিবিলি রুমে বসে চাঁদ নিজে পুরোপুরি না সেজেই পুচিকে লাল শাড়ি পড়িয়ে লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে দিচ্ছে! কপালের মাঝখানে বড়ো একটা লাল টিপ পড়িয়ে দিয়েছে পুচিকে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ঘঁষে দিয়েছে। চুলে ছোটো ছোটো বিভিন্ন কালারের বেবি ক্লিপ লাগিয়ে দিয়েছে।

নতুন বউদের মতো মাথায় বড়ো করে একটা ঘোমটা টেনে দিয়েছে! দেখতে পুরো বউ বউ দেখাচ্ছে পুচিকে। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। আজ যে কত সুদর্শন বিল্লিরা পুচির প্রেমে হাবুডুবু খাবে তা ভেবেই চাঁদের বড্ড হাসি পাচ্ছে! তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো পুচি নিজেও এই পুরো বিষয়টাতে বেশ মজা নিচ্ছে! একটুও বিরক্তবোধ হচ্ছে না।

উল্টে চুপটি করে কেমন বসে আছে। চাঁদ যেভাবে বলছে ঠিক সেভাবেই থাকছে। একটুও নড়াচড়া করছেনা। মাঝে মাঝে শুধু হামি তুলছে। পেছনে দাঁড়িয়ে তারা তিনজন চাঁদ এবং পুচির কাণ্ডকীর্তি দেখে মিটিমিটি হাসছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে চাইছে দুয়ে দিলে আর কী কী হাস্যকর কাজ করতে পারে।

সাজগোজ শেষে চাঁদ শেষবারের মতো পুচির দিকে তাকিয়ে আমোদের হাসি হাসল। আহ্লাদি হয়ে পুচির গালে চুমু খেয়ে বলল,,
“আহ হা কত কিউট দেখাচ্ছে তোকে! মন চাইছে খেয়ে ফেলি। আজ যে কত বিল্লা তোর পিছনে ঘুরবে তা ভেবেই আমি হয়রান হয়ে যাচ্ছি।”

লিপস্টিক ভরা ঠোঁটে পুচি জিভ চা’টল! চাঁদের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ম্যাঁও বলে ডেকে উঠল। হয়তো বুঝাতে চাইল বিল্লারা তার পিছনে ঘুরলে সে খুশি হবে! চাঁদ হঠাৎ বিরক্তি প্রকাশ করল। পুচির দু’গালে হাত রেখে বলল,,
“ইশশশ। জিভ চা’টছিস কেন? লিপস্টিকটা ওঠে যাবে না?”

এই বলে চাঁদ আরও একটু লিপস্টিক পুচির ঠোঁটে লাগিয়ে দিলো। বালিশের তলা থেকে তার সেলফোনটা খুঁজে বের করল। পুচি ইচ্ছে করে আরও জিভ চা’টতে লাগল। চাঁদকে লুকিয়ে লুকিয়ে জিভ চা’টতে লাগল! লিপস্টিকের ফ্লেভারটা বোধ হয় তার বেশ পছন্দ হয়েছে! তাই আবুলের মতো সব খেয়ে নিচ্ছে! বউ সেজে থাকা পুচিকে চাঁদ তার বুকে আঁকড়ে ধরল। মৃদু হেসে বলল,

“চলো পুচিমনি। আমরা সেলফি তুলি। তোমাকে কতটা সুন্দর লাগে একটু দেখি। ভাবছি পিপিটা চেঞ্জ করব বুঝলি? তোর আর আমার ছবিটা পিপিতে দিব।”

মুখের কাছে ফোনটা ধরতেই চাঁদ হঠাৎ ফোনের স্ক্রীনে দেখল তার শাড়ি পড়াই এখনো কমপ্লিট হয়নি! শাড়িতে কুঁচিও তোলা হয়নি। কোমর অবধি গুজেই শাড়িটাকে কোনো রকমে গাঁয়ে পেচিয়ে রেখেছে সে। কেবল মুখটাই সাজিয়ে বসে আছে। ঠোঁটেও এখনো লিপস্টিকও পড়া হয়নি। পুরোপুরি অগোছালো সে। তাড়াহুড়ো করে চাঁদ পুচিকে বিছানার উপর বসিয়ে দিলো। চট জলদি সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। শাড়ির কুঁচিটা ধরে বলল,,

“ধ্যাত। এখন এই শাড়ির কুঁচি তুলতে জানি কতক্ষণ সময় লাগে আল্লাহ্ মাবুদ-ই ভালো জানে।”
জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া এবার চাপা হাসি থামালো। নীরবতা ভেঙে তারা এবার চাঁদকে সাজিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই হঠাৎ নিচতলা থেকে আওয়াজ এলো “বরযাত্রী এসে গেছে।” জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া খুশিতে চিৎকার করে উঠল। দৌঁড়ে তারা তিনজন রুম থেকে বের হয়ে গেল। চাঁদকে উদ্দেশ্য করে আনন্দিত গলায় বলল,,

“এই বর এসে গেছে। বর এসে গেছে! চাঁদ তাড়াতাড়ি আয়। গেইট ধরতে হবে।”
চাঁদ থতমত খেয়ে শাড়ির কুঁচি ছেড়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল! ভয়ে তার বুকটা দুড়ুদুড়ু করে কেঁপে উঠল। ঐ তিনজনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে সে ফোঁসফোঁস করে তেজী শ্বাস ছাড়ল। তিক্ত সুরে বলল,,

“তোদের তিনজনকে তো আমি ছাড়বই না! কলিজা গুদ্দা সব নাড়িয়ে দিলো। একটু আস্তে চ্যাচালে কী হতো?”
অর্ধ শাড়ি পড়া অবস্থাতেই চাঁদ খোলা জানালা দিয়ে আড়চোখে হলগেইটে তাকালো। গেইটে খুব মাতামাতি হচ্ছে। বরযাত্রীরা গেইটের বাইরে ভীড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জায়মা, তিথী, তাশফিয়া, রুহি, নাদিয়া, সাদিয়া এবং বাড়ির সব ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা গেইট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

মোটা অঙের টাকা ছাড়া বরকে কিছুতেই তারা ভিতরে ঢুকতে দিবেনা। চাঁদ কেবল উতলা দৃষ্টিতে নূরকে খুঁজে চলছে! নীড়, মাহিন, সাদমান এবং নীড়ের অন্যান্য ফ্রেন্ডসরা সবাইকে সে দেখছে। শুধু নূরকেই দেখছেনা! তবে কোথায় গেল নূর? সে আদো এসেছে তো? বিষণ্ন মনে চাঁদ শাড়ির কুঁচিটা আবার হাতে তুলে নিলো। তাড়াহুড়ো করে সে শাড়িটা পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুচি বসে বসে ঝিমুচ্ছে! বেসামাল হয়ে বিছানায় পড়ে যাচ্ছে। পুচির এই বেহাল অবস্থা দেখে চাঁদ ব্যস্ত হয়ে উঠল৷ দ্রুত গলায় বলল,,

“এই পুচি ঘুমাস না। আমরা এখনি বের হচ্ছি।”
পুনরায় দরজা খোলার আওয়াজ হলো। চাঁদ তড়িঘড়ি করে পিছু ঘুরে তাকালো। নূর বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুমের ভেতর প্রবেশ করল! এদিক ওদিক না তাকিয়েই সে রুক্ষ স্বরে বলল,,
“কী ব্যাপার চাঁদ? জায়মা বলল তুমি এখনো রেডি হও নাই?”

লজ্জায় পড়ে গেল চাঁদ! তাড়াহুড়ো করে সে কোনোমতে শাড়িটা গাঁয়ে পেচিয়ে সামনে ঘুরে দাড়ালো। কম্পিত দৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটার দিকে তাকালো। লাল পাঞ্জাবীতে যে নূরকে ঠিক কী পরিমাণ সুলক্ষণ দেখাচ্ছে তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। চোখ ধাঁধিয়ে আসছে চাঁদের।

নূরের নীলাভ চোখের নেশায় ডুবে যাচ্ছে। ফর্সা রঙটা লাল পাঞ্জাবীতে বেশ চমকানো ভাবে ফুটে আছে। শাড়ির আঁচলটা হুট করেই পড়ে গেল চাঁদের হাত থেকে! গভীর এক ঘোরে তলিয়ে পড়ল সে। নূর হা করে তাকিয়ে রইল চাঁদের অর্ধনগ্ন শরীরে! না চাইতেও তার বেহায়া দৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে চাঁদের সর্বাঙ্গ জুড়ে। সম্বিত ফিরে পেতেই নূর দৃষ্টি সংযত করে নিলো। পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। মাথা ঝাঁকিয়ে শুকনো ঢোঁক গিলল। পেছনের চুলগুলো টেনে ধরে অধীর গলায় চাঁদকে বলল,,

“শাড়িটা ঠিক করো চাঁদ৷”
জিভ কেটে চাঁদ শাড়িটা আবার হাতে তুলে নিলো। মাথা চুলকে বিষণ্ণ গলায় বলল,,
“কুঁচি তুলতে পারছিনা।”

ফট করে নূর পিছু ঘুরে তাকালো! সরাসরি চাঁদের দিকে না তাকিয়ে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। পাঞ্জাবীর হাতা ফোল্ড করে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে অন্য পাশে তাকালো। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে ব্যগ্র হেসে বলল,,

“তুমি চাইলে কুঁচিটা আমি তুলে দিতে পারি!”
চাঁদ দাঁত কেলিয়ে হাসল৷ জোর করে নূরের হাতে কুঁচির অংশটা তুলে দিলো। আবদারসূচক গলায় বলল,,
“দিন।”

হাঁটু গেড়ে বসল নূর। দৃষ্টি নুইয়ে সে অগোছালো ভাবে শাড়ির কুঁচি তুলল। ছয় থেকে সাতটি কুঁচি তোলার পর সে কুঁচির অংশটা চাঁদের দিকে এগিয়ে দিলো। অন্যপাশ ফিরে নিচু গলায় বলল,,
“গুজে নাও।”

মিটিমিটি হেসে চাঁদ কুঁচির অংশটা কোমরে গুজে নিলো। নূর ব্যস্ত হয়ে পড়ল এক এক করে কুঁচি গুলো গুছিয়ে দিতে। আড়চোখে চাঁদকে ঘুরে ঘুরে দেখতে! চাঁদের অপরিমেয় সৌন্দর্যে চোখদুটো জুড়িয়ে আসছে নূরের। ক্রমশ বেখেয়ালী হয়ে পড়ছে সে! চাঁদের মধ্যেই বারংবার ডুবে যাচ্ছে।

নিজেকে সংযত করে রাখা যেন মুশকিল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে চাঁদ বেশ ব্যস্ত হয়ে আঁচলের অংশটা ঠিক করছে। এক্ষুণি তার গেইট ধরতে যেতে হবে! নয়তো সব টাকা তার হাত থেকে ফসকে যাবে। একটা কানা কড়িও পাবেনা। সবাই লুটেপুটে নিবে। চাঁদের তাড়াহুড়ো দেখে নূর কপাল কুঁচকালো। বসা থেকে সে ওঠে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো? এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?”
চাঁদ পিছু ঘুরে আয়নার দিকে তাকালো। কসমেটিকসের বক্স থেকে লাল রঙের একটি লিপস্টিক বের করল। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে লিপস্টিকটি ঠোঁটে লাগাতে লাগাতে বলল,,
“গেইট ধরতে যেতে হবে না? ইশশ কতটা লেইট হয়ে গেল আমার।”

“আমাকে রেখেই চলে যাবে হ্যাঁ? আমি যে ঠিক কতজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি বুঝো না তুমি?”
চাঁদ লিপস্টিক লাগানো থামিয়ে দিলো। সচকিত দৃষ্টিতে নূরের গম্ভীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। নূরও বিমূর্ষ চিত্তে চাঁদের বিস্মিত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল।

অভিমান জমাট বাঁধল তার চাঁদের প্রতি। কাছে থেকেও চাঁদকে কেমন দূরে দূরে মনে হতে লাগল। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক তোলপাড় হতে লাগল। মনটা অস্থির অস্থির করতে লাগল। নূরের বিমূর্ত অবস্থা দেখে চাঁদ হাত থেকে লিপস্টিকটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখল। পিছু ঘুরে সরল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। অমনি চাঁদকে অবাক করে দিয়ে নূর সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো চাঁদকে বুকে জড়িয়ে নিলো! চাঁদের পিঠে মুখ ঠেকিয়ে অস্ফুটে স্বরে বলল,,

“ভালোবাসি তোমাকে। অসম্ভব রকম ভালোবাসি। তোমাকে একটা পলক না দেখলে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় চাঁদ। তুমি কাছে নেই ভাবলে পরে দুনিয়াটা নিরর্থক মনে হয় আমার।”
আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠল চাঁদ। চোখে অপ্রত্যাশিত জল নিয়ে সে নূরকে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল৷ দ্বিধাহীন গলায় বলল,,

“আমারও আপনাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয় নূর। ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে!”
পরম ভালোবাসায় আবিষ্ট হয়ে তারা প্রায় অনেকক্ষণ যাবত একে অপরের দেহ এবং মনের সাথে একাত্নভাবে মিশে রইল! আবেগ, অনুভূতি, ভালোলাগায় বিভোর হতে লাগল।

সময় যত গড়াতে লাগল তাদের আলিঙ্গন আরও গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগল। হৃদয় যেন সায় দিচ্ছিল না একে-অপরকে ছেড়ে দাঁড়াতে। মন-প্রাণ তৃপ্তিতে ভরে উঠতেই তারা বাধ্য হয়ে একে অপরকে ছেড়ে দাঁড়াল। পুচিকে কোলে নিয়ে চাঁদ রুম থেকে বের হলো। নূরও চাঁদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। পুচির এহেন বউ বউ সাজ দেখে নূর বাঁকা হাসল। চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“ওরে কি আজ বিয়ে টিয়ে দিবা নাকি? বউ সাজালে যে।”
“হুম দিব! পাত্র খুঁজতেছি। ভালো কোনো পাত্র পেলে বলবেন তো!”
নূর হু হা শব্দে হেসে দিলো। সায় জানিয়ে বলল,,
“ঠিক আছে। খুঁজে পেলে বলব নে!”

গেইটের সামনে দেরিতে পৌঁছায় চাঁদের ভাগ্যে একটা কানা কড়িও জুটলনা! সব টাকা জায়মা, তিথী, তাশফিয়া, নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি এবং সাব্বির মিলে ভাগাভাগি করে নিলো! বরকেও সাদরে গেইটের ভেতরে ঢুকার পারমিশন দিয়ে দিলো। আয়মন এবং বাড়ির সব মুরুব্বীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল বরযাত্রীদের আদর-অ্যাপায়নে।

সার্ভ বয়দের ভালো করে সব দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে লাগল কাকে কীভাবে খাওয়াতে হবে। বিশেষ করে সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীকে ভালো করে খাতির যত্ন করতে লাগল সবাই। সাবরিনা আবরার বার বার করে বলে দিয়েছেন তাদের জায়গায় তারা সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীকে পাঠিয়েছেন। আদর-অ্যাপায়নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়!

নূর, নীড়, মাহিন, সাদমান এবং নীড়ের সব বন্ধুরা মিলে স্টেজে গোল হয়ে বসল। জিরিয়ে টিরিয়ে হাসি ঠাট্টা করে তারা একটু পরেই বরপাতে বসবে। চাঁদ মুখ ভাড় করে পুচিকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ জায়মার কাছে টাকার জন্য ভাগ বসাতে যাচ্ছে তো কিছুক্ষণ তাশফিয়া এবং তিথীর কাছে! কেউ কারো হক থেকে চুল পরিমাণও ছাড় দিতে রাজি হচ্ছেনা।

চাঁদকে কেবল ঘাঁটাচ্ছে। পুরো প্যান্ডেল জুড়ে তারা শুধু এদিক থেকে ওদিক ছুটোছুটি করছে। মাহিন এবং নূর স্টেজে সবার মাঝে বসে থেকেও আড়চোখে চাঁদ এবং তিথীকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে! ভেতরে ভেতরে শান্তি অনুভব করছে তারা। সম্মোহনী হাসিতে নাজেহাল হয়ে উঠছে। উসখুস করছে কখন তারা এখান থেকে বের হবে।

তাদের প্রেয়সীদের কাছাকাছি যাবে। পাশাপাশি বসে কথা বলবে। ভাব আদান-প্রদান করবে। সাদমান মাথাটা নুইয়ে বসে আছে। আসার পর থেকে সে একটি বারের জন্যও চোখ তুলে চাঁদের দিকে তাকায়নি! বুকে একপ্রকার যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে তার। যা চাইলেও সে দমিয়ে রাখতে পারছেনা। তাশফিয়াকে যা দেখার আয়মন অনেক আগেই দেখে নিয়েছে!

নতুন করে আর কিছু দেখার নেই। কাজে ভীষণ ব্যস্ত আছে সে। কীভাবে মেহমানদের সন্তুষ্ট করবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত। জায়মার পিছনে ছুটতে ছুটতে চাঁদ এক পর্যায়ে প্যান্ডেলের পেছনের দিকে চলে গেল। জায়মাকে পাকড়াও করে নিলো! টাকায় হাত দিয়ে বলল,,

“এই? নীড় ভাইয়া কিন্তু আমার আপন জিজু হয়। তাহলে তুই আমার জিজুর টাকা আমাকে দিবি না কেন?”
জায়মা টাকাটা টান দিয়ে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো! খরখরে গলায় বলল,,
“যা তোর আপন জিজুর থেকে টাকা খুঁজে নে যা। পরিশ্রম করে আমরা টাকা হাতে নিলাম, কত তর্ক বিতর্ক করে সময় নষ্ট করে বহু কষ্টে টাকাটা বের করলাম আর তুমি আসছ আরামে থেকে টাকার ভাগ নিতে হ্যাঁ? দিবনা আমি টাকা! কী করবি কর যাহ্।”

চাঁদ ভীষণ রেগে গেল। জায়মার মুখের কাছে হাত নিয়ে গেল। রাগে গজগজ করে বলল,,
“এখনি আমি জিজুর থেকে টাকা নিব। তখন যেন আসিস না আমার কাছে নির্লজ্জের মতো টাকা খুঁজতে। হাত ধোঁয়ার একটা টাকাও তুই পাবিনা। একটা পয়সাও না।”

প্রচণ্ড রেগে চাঁদ পিছু ঘুরতেই হঠাৎ কারো বলিষ্ঠ দেহের সাথে ধাক্কা খেলো! চোখ উঠিয়ে চাঁদ অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সাদমানকে দেখতে পেল! সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সাদমানের সম্মুখ থেকে এককদম পিছু হটে দাঁড়ালো। স্থির দৃষ্টিতে সাদমান চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। উদ্বেগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কিছু হয়েছে? রেগে আছো কেন?”
চাঁদ মাথাটা নুইয়ে নিলো। গম্ভীর গলায় বলল,,
“জায়মা আমাকে টাকা দিচ্ছেনা!”

সাদমান ভ্রু উঁচিয়ে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো। জায়মা এবার ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল! অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে। সাদমানের সামনে সে মোটেও লজ্জিত হতে চাইছেনা। নিজের ইমেজ বজায় রাখার জন্য সে যত সম্ভব চেষ্টা করতে চাইছে। শুকনো ঢোঁক গিলে জায়মা চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে চাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালো। গলা খাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“আরে ধূর। আমি তো মজা করছিলাম। তুই আমার বোন তোকে টাকা দিব না তো কাকে টাকা দিব হ্যাঁ?”

চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো। হঠাৎ পল্টি খাওয়া জায়মাকে চিনতে তার বড্ড বেগ পেতে হলো। চাঁদকে জোর করে টেনেটুনে জায়মা সাদমানের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। নিচু স্বরে চাঁদকে বুঝিয়ে বলল,,
“আমরা বোন বোন হই। আমাদের মধ্যে কতকিছু হবে। আর তুই কিনা সাদমান ভাইয়াকে বলে দিবি আমি তোকে টাকা দিচ্ছিলাম না হ্যাঁ? কেমন না বিষয়টা?”

চাঁদের মাথায় এতক্ষণে ঢুকল জায়মা কেন হঠাৎ এত ভালো মানুষির আশ্রয় নিলো! সাদমানের কাছে নিজেকে ছোটো করতে চাইছিলনা বলেই এত ছলা কলা করল। হাসিমুখে সব মেনে নিলো। পক্ষান্তরে চাঁদ বাঁকা হাসল। জায়মার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“পছন্দ করিস তুই সাদমান ভাইয়াকে না?”
সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদের কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো জায়মা! অস্থির দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। শুকনো কেশে উত্তেজিত গলায় বলল,,
“কী যা তা বলছিস তুই। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর!”

চাঁদকে রেখেই জায়মা এক দৌঁড়ে হলের ভেতর ঢুকে গেল! একটি বারের জন্যও আর পিছু ফিরে তাকাল না। জায়মার যাওয়ার পথে তাকিয়ে চাঁদ মিটিমিটি হাসল। গুনগুনিয়ে বলল,,
“আমার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই জায়মা। তুই আমার চোখে ধরা পড়ে গেছিস। এবার শুধু সাদমান ভাইয়ার মনে তোকে বসিয়ে দেওয়ার পালা!”

প্রায় অনেকক্ষণ যাবত নূরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে চাঁদ। হলের কোথাও দেখা মিলছেনা তার। ফোনেও কোনো রকমে পাওয়া যাচ্ছেনা তাকে। প্রতিবার-ই সংযোগ বিচ্ছিন্ন আসছে। চিন্তায় ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে চাঁদ। একটু আগেও নূর এখানে ছিল হঠাৎ করে কোথায় গেল তাই ভীষণ ভাবাচ্ছে তাকে।

নূরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কারো এখনো বরপাতেও বসা হয়নি! যদিও কিছুক্ষণ আগে সবাই একটু একটু করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে। তবে নীড় এখনও অভুক্ত! বরপাতের আশায় তার খাওয়াদাওয়া এখনো চাঙে ওঠে আছে। এদিকে বিয়ের সময়ও প্রায় ঘনিয়ে আসছে। এজন্যই সবার মনে বেশ উত্তেজনা কাজ করছে। অন্যদিকে মাহিন ব্যস্ত আড়ালে বসে তিথীর সাথে প্রেম করতে! তিথীর হাত ধরে ছাদের উপর বসে ভাব বিনিময় করতে। নানান উপমা দিয়ে তিথীর সাজগোজের প্রশংসা করতে! তার ভালোবাসায় তিথীকে আরও আকর্ষিত করতে।

এরমধ্যেই নূরের দেখা মিলল বাড়ির হলগেইটে। তার পাশেই নীল শাড়ি পরিহিত অবস্থায় মিস নায়লা হেঁটে আসছে! দুজনই খুব হেসে হেসে এবং বেশ খোলামেলাভাবে কথা বলতে বলতে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে ভীষণ হাসিখুশি এবং রসিক দেখাচ্ছে তাদের।

দূর থেকে এই দৃশ্য চাঁদের দৃষ্টিতে পড়া মাত্রই মাথায় যেন তার আকাশ ভেঙে পড়ল! বিশ্বাস-ই করতে পারছেনা চাঁদ যাকে অপছন্দ করে সেই ব্যক্তিটির সাথেই নূর পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে আসছে! তবে কী মিস নায়লাকে এগিয়ে আনার জন্যই নূর সবাইকে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করাচ্ছিল? সবার সময় নষ্ট করছিল? নীড়কেও কষ্ট দিচ্ছিল? ফোনটাও পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছিল? আকাশ সমান অভিমান নিয়ে চাঁদ স্টেজ থেকে সরে এলো।

প্যান্ডেলের বাইরে এক কোনায় আড়ালে এসে দাঁড়ালো। মিস নায়লাকে স্টেজে নিয়ে এলো নূর। নীড়, মাহিন, সাদমান, আয়মন এবং নীড়ের সব বন্ধু মহলের সাথে মিস নায়লার পরিচয় করিয়ে দিলো। সবার সাথে মিস নায়লা বেশ হেসে হেসে কথা বলল৷ নূরও মিস নায়লার সাথে খুব হাসল। চোখের সামনে তাদের এত গলায় গলায় ভাব যেন সহ্য হচ্ছিলনা চাঁদের! তবুও সে নিজেকে যতখানি সম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করল। হঠাৎ আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালেন মিস নায়লা। নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“নূর? তোমার ঐ কাজিনটা কোথায়? তাকে তো কোথাও দেখতে পারছিনা।”
নূর মাথা চুলকালো। ম্লান হেসে বলল,,
“আছে হয়তো এখানে সেখানে। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসেনা সে। সারাক্ষণ শুধু দৌঁড় ঝাপ। কারো কোনো কথাই শুনবেনা সে। নিজের মর্জি মতো চলবে। তবে আপনি প্লিজ খেতে আসুন আপু। অনেক বেলা হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আপনার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”

মিস নায়লা মিষ্টি হাসলেন। মাথা নুইয়ে বললেন,,
“ঠিক ধরেছ। আমার সত্যিই খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”
নূর ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিস নায়লাকে খাওয়ানোর জন্য। শত হোক নূরের ইনভিটিশানে মিস নায়লা এসেছেন তার বড়ো ভাইয়ার বিয়েতে। অধীর গলায় নূর মিস নায়লাকে বলল,,
“প্লিজ আপু আপনি আসুন। টেবিলে খাবার সার্ভ করা আছে।”

মিস নায়লাকে টেবিলে বসিয়ে দিলো নূর। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সে উনার খাবার দাবারের খেয়াল রাখছিল। কী কী লাগবে তা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বাড়িয়ে বাড়িয়ে খাবার দিচ্ছিল তাকে। চাঁদ প্যান্ডেলের বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দমটা খিঁচে সব দেখছিল! অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই চোখের কোণে তার জল জমে এলো!

সে ছাড়া অন্য কারোর উপর নূরের এতটা দরদ দু’চোখে সহ্য করতে পারছিলনা সে। রাগে-দুঃখে-জেদে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল তার। সব সহ্য ক্ষমতা যেন তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এরমধ্যেই বরপাতে সবাই বসে পড়ল। নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া সবাই। নূরকেও টেনেটুনে আয়মন বরপাতে নিয়ে এলো। স্টেজে সবার মধ্যে চাঁদকে দেখতে না পেয়ে নূর ব্যাকুল হয়ে উঠল। উদ্ভ্রান্ত গলায় সে আয়মনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“কী রে? চাঁদ কোথায়?”
দূর থেকে দাঁড়িয়ে চাঁদ অট্ট হাসল। চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো মুছল৷ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,,
“এতক্ষণে তবে আমার কথা মনে পড়েছে জনাবের।”

নূরের সাথে অযথা রাগ দেখিয়ে চাঁদ এই অনুষ্ঠানটা নষ্ট করতে চাইল না। রাগটা বহু কষ্টে দমিয়ে নিলো। ফুসফুসে দম সঞ্চার সে ধীর পায়ে হেঁটে স্টেজের দিকে এগিয়ে এলো। চাঁদকে দেখামাত্রই নূর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অভিমানী স্বরে বলল,,
“কই ছিলা এতক্ষণ হ্যাঁ?”

নূরের প্রশ্নকে খুব নিঁখুতভাবে উপেক্ষা করল চাঁদ! জোরপূর্বক হেসে সে নীড়ের পাশ ঘেঁষে বসল। জোর খাটিয়ে নীড়ের থেকে হাত ধোঁয়ানোর টাকা আদায় করল! হাসিখুশিতে কেটে গেল বরপাতের পুরোটা সময়। নূর নানাভাবে চাঁদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও চাঁদকে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও চাঁদ পুরোপুরি নূরকে এড়িয়ে গেল!

নীড়ের হাত থেকে মাহিনের হাত থেকে এবং সাদমানের হাত থেকেও সে খাবার খেল তবে নূরের হাত থেকে কিছু খেলো না! বিষয়টাতে নূর তেমন গুরুত্বারোপ না করলেও একটু আধটু খারাপ লাগা তো কাজ করেছেই! মাহিন যেমন তিথীকে খাইয়ে দিয়েছে। তদ্রুপ তিথীও মাহিনকে খাইয়ে দিয়েছে।

আয়মন অনেক জোরাজুরি করে তাশফিয়াকে মাত্র এক পিস গরুর মাংস খাওয়াতে পেরেছে। লজ্জায় উৎকণ্ঠায় তাশফিয়া আয়মনের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না! যদিও তাশফিয়া এখনো আয়মনকে তার মনের কথা খুলে বলতে পারেনি তবে আয়মনের দেওয়া সেই আংটিটা এখনো সে সযত্নে হাতে পড়ে রেখেছে! আর আয়মন যেনো এতেই বেশ সন্তুষ্ট!

চাঁদ এবং নূরের মান-অভিমান কেউ ধরতে না পারলেও সাদমান বেশ ধরতে পেরেছে! মিস নায়লাকে চাঁদ সহ্য করতে পারছেনা তাও বেশ বুঝতে পারছে। সব বুঝেও সাদমান চুপ করে আছে। নীরব দর্শকের মতো বাঁকা হেসে সব দু-চোখ ভরে দেখছে! শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখার অপেক্ষাতেই যেন সে চাঁতক পাখির মতো বসে আছে।

বরপাতের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বিয়ে পড়ানোর জন্য পর্ব শুরু হলো। কাজী সাহেব এবং রেজিস্ট্রার অফিসার খুব দ্রুত চলে এলেন বিয়ে পড়াতে। সোহানীর রুমে এবার ভীড় বাঁধলো সবার। বাড়ির সব মেয়েরা এবং আত্নীয়-স্বজনরা। একটু আগেই সোহানীকে জোর করে খাইয়ে দিয়ে গেছেন সামিয়া আহমেদ!

নিজেও মেয়ের সাথে কেঁদেকেটে মুখে দু’লোকমা ভাত তুলেছেন। মুরুব্বিদের সাথে নিয়ে কাজী সাহেব সোহানীকে বিয়ে পড়ানোর জন্য রুমে এলেন। দরজায় এক কোণায় দাঁড়িয়ে চাঁদ মুখ চেপে কাঁদছিল! সে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল যে কিছুতেই সোহানীর সামনে এসে দাঁড়াতে পারছিল না! কেবল কান্না পাচ্ছিল।

রেজিস্ট্রি খাতায় সাইন করে সোহানী তার মা এবং বাবাকে জড়িয়ে ধরে জোরে চিৎকার করে কেঁদে দিলো! সামিয়া আহমেদ প্রায় বেহুশের মতো হয়ে গেলেন! জামান আহমেদ কোনোমতে সামলাচ্ছেন সামিয়া আহমেদকে। চাঁদ এবার ফুপিয়ে কেঁদে দৌঁড়ে এলো রুমের ভেতর। চাঁদের ছিটেফোঁটা দেখামাত্রই সোহানী বসা থেকে ওঠে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। চাঁদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

“মা-বাবার খেয়াল রাখিস চাঁদ।”
চাঁদ হেচকি তুলে কেঁদে উঠল। আবেগে আপ্লুত হয়ে অস্ফুটে স্বরে বলল,,
“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো আপু!”

তিন কবুল বলার পর সোহানী নীড়কে বিয়ে করল। কান্নার ঢল যেন কিছুতেই থামছিল না সোহানীর। কাজী সাহেব এবং রেজিস্ট্রি অফিসার এবার নীড়ের কাছে এলেন বিয়ে পড়াতে। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে নীড় অল্প সময়ের মধ্যেই কবুল বলে দিলো। সম্পন্ন হয়ে গেল বিয়ে! চারিদিকে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল।

সবাই মিষ্টি মুখ করতে লাগল। মিস নায়লার কারণে নূর এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা! মিস নায়লাকে নিয়ে কেবল এদিক থেকে ওদিক ছুটোছুটি করছে। পুরো হলটা উনি ঘুরে ঘুরে দেখছে। বাধ্য হয়ে নূরকেও উনার সঙ্গ দিতে হচ্ছে। অতিথী বিধায় মুখ খুলে মিস নায়লাকে সে কিছু বলতে পারছেনা। শুধু অপেক্ষা করছে কখন মিস নায়লা বলবে “সে যাচ্ছে!”

বিয়ে পড়ানোর পর বিদায়ের পালা ঘনিয়ে এলো। সামিয়া আহমেদ নিজের মুখে বলে দিলেন সোহানীর সাথে যেনো চাঁদ, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া যায়। নূরের সাথে চাঁদ রাগ করে জেদ ধরে বসে আছে সোহানীর সাথে সে কিছুতেই ঐ বাড়িতে যাবেনা। যার কারণে জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়াও যেতে নাকচ বোধ করছে। মিস নায়লাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে নূর হলের ভেতর প্রবেশ করতেই মিস নায়লা পেছন থেকে নূরকে ডাকলেন! চোখে থাকা চশমাটা এক ইঞ্চি উপরে তুলে মিষ্টি হেসে বললেন,,

“থ্যাংকস নূর। আজকের দিনটা এত স্পেশাল করার জন্য!”
পিছু ঘুরে দাঁড়ালো নূর। মিস নায়লার দিকে আড়ষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মলিন হেসে বলল,,
“ইট’স ওকে আপু। প্লিজ সাবধানে যাবেন।”
প্রফুল্ল হাসলেন মিস নায়লা। হাত নাড়িয়ে মধুর স্বরে বললেন,,
“বায়।”

নূরও হাত নাড়িয়ে বায় জানালো। অতিসত্বর নূরের থেকে মোহিত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন মিস নায়লা। রিকশা চালককে বললেন রিকশা ছেড়ে দিতে। নূরের প্রতি বেশ দুর্বল তিনি! সময় সুযোগ বুঝে নূরকে মনের কথা বলতে চান তিনি! দ্রুত পায়ে হেঁটে নূর হলের ভেতর প্রবেশ করল। চাঁদ ভীষণ রেগে আছে তার উপর বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। গেইটের ভেতর ঢুকতেই নূর আনাগোনায় শুনতে পেল জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া বলছে,,

“চাঁদ না গেলে কিন্তু আমরাও ঐ বাড়িতে যাব না বলে দিলাম। কথাটা সবাই মাথায় রাখিস।”
মেজাজ চটে গেল নূরের! সামনের চুলগুলো টেনে সে তিনজনের আড্ডায় এসে হামলা দিলো। তটস্থ গলায় বলল,,
“এই চাঁদ কই?”
উপস্থিত সবাই ভড়কে উঠল। জায়মা থতমত গলায় বলল,,

“চাঁদ তো প্যান্ডেলে ভাইয়া। ঐ বাড়িতে যাবেনা বলছে। খালামনি জোর করছে তবুও যাবেনা বলছে।”
রাগে গজগজ করে নূর প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকে গেল। তক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে থাকা সোহানীকে কোলে তুলে নীড় তাদের বিয়ের গাড়িতে ওঠে গেল! সামিয়া আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে বারবার বেহুশ হয়ে যাচ্ছেন।

জামান আহমেদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। দুঃখে দুঃখে তিনি শেষ প্রায়। চাঁদ তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হেচকি তুলে কাঁদছে। সোহানীর জন্য তার সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ছোটো বেলা থেকেই সোহানীর আদর পেয়ে সে বড়ো হয়েছে। কষ্ট তো হবেই। সবার থেকে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলো নীড়। কথা দিয়ে গেল সোহানীকে খুব সুখে রাখবে সে। অতঃপর সোহানীকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে নীড় শো শো বেগে ছুটে চলল তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে!

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬০

কান্নারত অবস্থাতেই চাঁদকে টানতে টানতে নূর তাদের পরের গাড়িতে ঢুকিয়ে দিলো! চাঁদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে গাড়ির দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলো। জানালার কাঁচ দ্বারা চাঁদের বিমূর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“খবরদার। গাড়ি থেকে যদি বের হওয়ার চেষ্টা করেছ তো!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬২