প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬০

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬০
নিশাত জাহান নিশি

“এই নূর, মাহিন, আয়মন কোথায় তোরা? আমাকে ছাড়াই তো ভাবির বাড়ি চলে এলি। এত পর হয়ে গেলাম আমি হ্যাঁ?”

সাদমানের গলার স্বর পাওয়া মাত্রই চাঁদ এবং নূর যার যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! চাঁদও নূরকে দেওয়া শাস্তির কথা একদদদম ভুলে গেল। নিজেদের শ্রবণ শক্তিকেই যেন তারা বিশ্বাস করতে পারছেনা সত্যিই সাদমান এসেছে। ঝট করে নূর তার কান থেকে হাত দুখানা নামিয়ে নিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নির্বীক চিত্তে দাড়িয়ে থাকা চাঁদকে উপেক্ষা করে সে এক দৌঁড়ে প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকে গেল। পেছন থেকে হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত সাদমানকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখামাত্রই নূর একঝাঁক খুশি নিয়ে পেছন থেকে সাদমানের কাঁধে হাত রাখল। হাসি যেন তার বাঁধ ভাঙছিল। রুদ্ধশ্বাস ফেলে সে প্রাণোচ্ছ্বল গলায় শুধালো,,

“তুই এসেছিস সাদমান?”
তৎক্ষনাৎ পিছু ঘুরে দাঁড়ালো সাদমান। নূরের দিকে নির্ভেজাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শুকনো মুখমণ্ডলে অচিরেই এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। ভাবশূণ্য গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেন? আসব বলে ভাবিস নি তুই?”

“না! ভেবেছিলাম তোকে ফোর্স করে আনতে হবে। এবার আমাদের একসাথে হওয়াটা হয়তো অন্যরকম হবে। আগের মতো অতোটা মসৃণ হবেনা।”
“উঁহু। ফোর্স করে যেমন ভালোবাসা হয়না। তেমনি বন্ধুত্বও হয়না। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা কিন্তু ফোর্সের সম্পর্ক না।”

নূর প্রাণ খুলে হাসল। সাদমানের বন্ধুত্বসূলভ আচরণে সে সীমাহীন খুশি হলো। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই সে অতি দ্রুত সাদমানকে জাপটে ধরল! হৃদয় নিংড়ানো সমস্ত আবেগ একত্রিত করে সে আনন্দিত গলায় বলল,,

“আমি জানতাম তুই ঠিক বুঝবি। বুঝতে কিছুটা দেরি হলেও তুই বুঝবি। আর আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকেই সবার আগে প্রাধান্য দিবি। কখনো আমার সাথে অকারণে রাগ করে থাকতে পারবি না। আমাকে অযথা ভুল বুঝবিনা। আর এজন্যই তো আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এতটা স্পেশাল।”
সাদমান মলিন হাসল। কিছু একটা ভেবে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শূণ্য গলায় বলল,,

“চল ছাদে যাই।”
সাদমানকে ছেড়ে দাঁড়ালো নূর। হাসিমুখে সাদমানের গলায় হাত ঝুলিয়ে দিলো। আগের মতো আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। সাদমানের প্রস্তাবকে সায় জানিয়ে বলল,,
“হ্যাঁ চল।”

গলাগলি করে দুই বন্ধু ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হতেই চলতি পথে তারা হঠাৎ চাঁদের মুখোমুখি হয়ে গেল। তারা তিনজনই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। চাঁদ জোরপূর্বক হেসে সাদমানের দিকে তাকালো। শুষ্ক গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
সাদমান রুক্ষ হাসল! গলাটা কেমন শুকিয়ে এলো তার! শুকনো গলাটা থুথু দ্বারা খানিক ভিজিয়ে সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

“তোমার বযফ্রেন্ডকে নিয়ে একটু ছাদে যাচ্ছি। পারমিশন কি গ্রেন্টেড হবে?”
চাঁদ ইতস্তত বোধ করল। নূরের দিকে দ্বিধাহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গলা খাদে এনে সাদমানকে বলল,,
“কেন নয় ভাইয়া? অবশ্যই হবে। তবে এর আগে নূর ভাইয়ার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিল। জাস্ট দু’মিনিট। এরপর আপনারা যেখানে খুশি সেখানে যান আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সাদমান খিলখিলিয়ে হেসে উঠল! চাঁদের দ্বিরুক্তি সে বুঝতে পারল! চাঁদের এই আবদার শুনে নূর বেশ অবাক হলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী কথা চাঁদ?”
সাদমানের দম ফাঁটা হাসি দেখে চাঁদ বিব্রতবোধ করল। নূরের দিকে বিশৃঙ্খল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“সাইডে আসুন। এরপর বলছি।”
সাদমান তার হাসি থামাল। চাঁদকে ইন্ধন যুগালো। নূরকে উদ্দেশ্য করে টিটকারিপূর্ণ গলায় বলল,,
“যা যা। চাঁদকে চার্জ করে আয়! আমি ছাদে যাচ্ছি। পার্সোনাল কথা তো আমার সামনে বলা যাবেনা।”

ইতোমধ্যেই জায়মা খুব তাড়াহুড়ো করে তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। দু’হাতে তার দুটো কোল্ড ড্রিংকস। হয়তো মেহমানদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। জায়মাকে এক ঝলক দোখামাত্রই নূর গলা ছেড়ে তাকে ডাকল। উচ্চ আওয়াজে জায়মার নাম ধরে ডেকে বলল,,

“এই জায়মা শোনো? সাদমানকে ছাদে কিছু স্ন্যাংকস আর কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে যেও।”
সাদমানের নামটা শোনামাত্রই তার বুকটা কেমন যেন ধক করে কেঁপে উঠল! ব্যতিব্যস্ত দৃষ্টিতে সে পিছু ফিরে তাকালো। সাদমানের দিকে একবার সুগভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সঙ্গে সঙ্গেই সেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সে। মাথা নুইয়ে নূরকে লক্ষ্য করে বলল,,

“ঠিক আছে ভাইয়া। এই ড্রিংকসগুলো আমি একটু মামানিকে দিয়ে আসছি। এরপর ছাদে যাচ্ছি।”
প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করেই জায়মা দ্রুত পায়ে হেঁটে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। এই দম বন্ধকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই সে জানে বাঁচে। নূর হাসিমুখে সাদমানের দিকে তাকালো। সাদমানের কাঁধে হাতে রেখে মিঠি স্বরে বলল,,

“যা তুই ছাদে যা। আমি একটু চাঁদের সাথে কথা বলে আসছি।”
সাদমান রুদ্ধ শ্বাস ফেলে শেষের বারের মতো চাঁদের দিকে একদফা তাকালো। অতঃপর বেহায়া দৃষ্টি গুটিয়ে সে তৎক্ষনাৎ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো।

দিশাহীন হয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে ছুটে চলল৷ সাদমানের প্রস্থান দেখে চাঁদ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল! নূরকে টানতে টানতে সে প্যান্ডেলের পেছনের দিকটায় নিয়ে এলো। নিরিবিলি জায়গায় নূরকে দাঁড় করিয়ে সে সরু দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। মুখমণ্ডলে কেমন যেন চিন্তিত ভাব ফুটিয়ে তুলল! ভাবুক গলায় শুধাল,,

“সাদমান ভাইয়ার আচরণ আপনার অস্বাভাবিক লাগছেনা?”
নূর নির্বোধ ভাব নিলো। চাঁদের এহেন বিরূপ মন্তব্য সে মানতে পারলনা। তাই সরল গলায় বলল,,
“কই না তো। আমার কাছে তো সবকিছু ঠিকঠাকই লাগছে।”
“ওকে। দেন আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কী কাজ?”

“সাদমান ভাইয়ার মনে জায়মার জন্য একটুখানি জায়গা করে দিতে হবে!”
নূর যেন তাজ্জব বনে গেল। তৎক্ষণাৎ সে মাথাটা ঝাঁকুনি দিলো। হঠকারি গলায় শুধালো,,
“মানে?”

নূরের পাশ ঘেঁষে দাড়ালো চাঁদ। কর্ণতলে উষ্ণ ঠোঁটদ্বয় ঠেকালো। মিষ্টি মধুর গুঞ্জন তুলে বলল,,
“শুনুন। আই থিংক জায়মা সাদমান ভাইয়াকে পছন্দ করে! কথাবার্তায় খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলাম আমি। এখন আপনার কাজ হবে, সাদমান ভাইয়াকেও জায়মাকে ভালোবাসতে বাধ্য করানো!
দুজনই তো পিওর সিঙেল তাইনা? তো তাদের এক হওয়াতে প্রবলেম কী বলুন? তাছাড়া আমাদের জায়মাও তো কোনো অংশে কম নয়। রূপে, গুণে, ভদ্রতায় আমার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। যে কোনো ছেলে চোখ বুজে জায়মাকে ভালোবাসতে রাজি হয়ে যাবে। জায়মা মেয়েটাই তো এমন। তাই সাদমান ভাই কেন এর অন্যথায় হবে হুম?”

বাঁকা হেসে নূর ঝট করে চাঁদকে জড়িয়ে ধরল! চাঁদের কথা তার মনে ধরল। চাঁদ বেকুব হয়ে নূরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী হলো ব্যাপারটা? আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন কেন?”

“আরে বুঝলা না? তোমাকে জড়িয়ে ধরলে বিষয়টা ভাবতে আরও সুবিধো হবে তাই! একদম নড়াচড়া করবেনা ওকে? বিষয়টা মনোযোগ দিয়ে ভাবতে দাও।”
চাঁদ মনে মনে হাসল! নূরের পাগলামি সত্যিই তাকে আনমনে হাসতে বাধ্য করে। এভাবে কে কাকে জড়িয়ে ধরে ভাবনাচিন্তা করে ভাই?

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাদমান একের পর এক সিগারেট ফুঁকছে। ভেতরটা কেমন যেন জ্বালা পোঁড়া করছে তার! একপ্রকার তুষের আগুনের ন্যায় জ্বলছে। চাঁদকে চোখের সামনে দেখলে তার ভীষণ কষ্ট হয়। না দেখলেই যেন ভালো থাকে!

শান্তিতে থাকে। তাই তো সে খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে আগামী মাসেই সে জর্ডান চলে যাবে! তার সিদ্ধান্তে সে অটল থাকবে। কেউ তাকে এই সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারবেনা। এই দেশ ছেড়ে গেলেই তাকে আর এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হবেনা! চাঁদও নূরের সাথে বেশ ভালোভাবেই থাকতে পারবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই সাদমান আরও একটি সিগারেট জ্বালালো। ইতোমধ্যেই ছাদে হঠাৎ জায়মার আগমন ঘটল! কোল্ড ড্রিংকস এবং স্ন্যাকসের ডিশ হাতে নিয়ে জায়মা নিঃশব্দে সাদমানের পিছনে এসে দাঁড়ালো। অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সাদমানকে দেখতে লাগল।

সাদমান তার পেছনে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেতেই ভাবল নূর হয়তো তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই সে সিগারেটটি দুই ঠোঁটের মাঝখানে রেখেই পিছু ঘুরে তাকালো। অমনি জায়মাকে সে আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পেল! ঘটনার আকস্মিকতায় তাড়াহুড়ো করে সাদমান মুখটা সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো!

সিগারেটটি মুখ থেকে বের করে পা দ্বারা পিষিয়ে নিলো। নাক-মুখ থেকে ধোঁয়া বের করতেই জায়মা খুকখুক করে কেশে উঠল! কাশি তার নাকেমুখে ওঠে গেল। থামার নাম-ই নিলো না! সাদমান তার বেখেয়ালীপনার জন্য নিজেকে দোষারোপ করল। তাড়াহুড়ো করে সে পিছু ঘুরে জায়মার মুখোমুখি দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো। পেরেশানিত গলায় শুধালো,,

“আর ইউ ফাইন জায়মা?”
জায়মা মাথা নুইয়ে অনবরত কাশতে লাগল। কাশতে কাশতে এক প্রকার দলামোচড়া হয়ে গেল। তবুও অসুস্থ শরীর নিয়ে সে ড্রিংকস এবং স্ন্যাংকসের ডিশটা সাদমানের দিকে এগিয়ে দিলো। অস্পষ্ট গলায় বলল,,
“আপনার ড্রিংকস।”

সাদমান বিরক্তবোধ করল। নাক সিটকে বলল,,
“আরে ছাড়ো তো ওসব। আগে বলো তুমি কেমন আছো?”
“ভাভাভালো আছি।”
“উঁহু ভালো নেই৷ দেখি ডিশটা আমার হাতে দাও।”

জায়মার হাত থেকে সাদমান টেনে হেছড়ে ডিশটা কেড়ে নিলো! ব্যতিব্যস্ত হয়ে ডিশ থেকে কোল্ড ড্রিংকসটা নিয়ে সে জায়মার দিকে এগিয়ে দিলো। উত্তেজিত গলায় বলল,,
“খেয়ে নাও। কাশিটা কমে যাবে।”

নিবিষ্ট দৃষ্টিতে জায়মা একপলক সাদমানের দিকে তাকালো। সাদমানের উদগ্রীব দৃষ্টি তাকে অতিসত্বর দৃষ্টি নুয়াতে বাধ্য করাল। কাশির মাত্রাটাও যেন বেগতিক বাড়ছিল তার। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে কম্পিত হাতে কোল্ড ড্রিংকসটা হাতে তুলে নিতে হলো। ঢকঢক করে ড্রিংকসটা পান করল সে।

মুখ থেকে গ্লাসটা সরিয়ে অস্থির শ্বাস ফেলতে লাগল। চোখ থেকে তার টলটলিয়ে পানি ঝড়তে শুরু করল। সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধটা তার মোটেও স্যুট করেনি। তাই এই বেহাল অবস্থা হলো তার। সাদমান তার কৃতকর্মের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগল! স্ন্যাংকসের ডিশটা মেঝেতে রেখে সে জায়মার বিমূর্ষ মুখমণ্ডলে তাকালো। নতজানু হয়ে আড়ষ্ট গলায় বলল,,

“আ’ম সো সরি জায়মা। আমি আসলে বুঝতে পারিনি তুমি হঠাৎ পেছন থেকে চলে আসবে। আর আমার বেখেয়ালির জন্য এতটা সিক হয়ে পড়বে।”
জায়মা অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। জোরপূর্বক কাশি থামিয়ে সে চোখের জল ছেড়ে দিলো। গলায় নমনীয়তা এনে বলল,,

“ইট’স ওকে ভাইয়া। নো প্রবলেম। আমি ঠিক আছি। আপনি প্লিজ স্ন্যাংকসগুলো খেয়ে নিবেন। আসছি আমি।”
পিছু ঘুরে দাঁড়ালো জায়মা। সাদমানকে প্রতিউত্তর করার সুযোগ না দিয়েই সে এক দৌঁড়ে ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো। সাদমান ব্যাকুল হয়ে জায়মার পিছু ডাকল! সত্যিই অপরাধবোধ তার মধ্যে প্রগাঢ়ভাবে কাজ করতে লাগল। কপাল চাপড়ে বিরক্তি প্রকাশ করল সাদমান। তিক্ত সুরে বলল,,

“শিট। কেন যে আমি এই টাইমিংটাতেই সিগারেটটা ধরাতে গেলাম!”
এরমধ্যেই হঠাৎ নূরের আগমন ঘটল জায়মার মুখোমুখি! দুজনই দুজনের জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দ্রুত ছুটে আসার দরুন জায়মার শ্বাস খুব জোরে উঠা নামা করতে লাগল। বেদিশা হয়ে একপ্রকার হাঁপাচ্ছিল সে। বিষয়টা নূর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখল!ভ্রু উঁচিয়ে জায়মার দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো জায়মা? তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?”
জায়মা শুকনো ঢোঁক গিলল। মাথা নুইয়ে আমতা আমতা করে বলল,,
“কিকিকিছুনা।”

নূরকে উপেক্ষা করে পুনরায় সে জায়গা পরিত্যাগ করল। সিঁড়ি টপকে নিচে নেমে গেল। নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে জায়মার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ একই দৃষ্টিতে জায়মাকে নিরক্ষর করে সে পাঞ্জাবির কলারটা ঝাড়ল। ভাবুক গলায় বলল,,

“যাহ্ বাবা। এখন থেকেই এর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল?”
ধীর পায়ে হেঁটে নূর ছাদে প্রবেশ করল। ফুড়ফুড়া মনে পিছু ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদমানের কাঁধে হাত রাখল। গলা ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই? জায়মার কী হয়েছিল রে?”

সাদমান ঘাড় ঘুরালো। উদগ্রীব দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ক্ষীণ গলায় বলল,,
“আর বলিস না ভাই। সিগারেট টানছিলাম। হঠাৎ করেই দেখি জায়মা পেছনে। নাকমুখ থেকে ধোঁয়া বের করতেই খুকখুক করে কেশে দিলো।”

“যাহ্ বাবা। বুঝে শুনে খাওয়া উচিৎ ছিল।”
“আরে আমি জানতাম নাকি যে জায়মা হুট করেই আমার পেছনে এসে দাঁড়াবে?”
নূর বাঁকা হাসল! সাদমানকে উস্কে দেওয়ার জন্য পায়তারা করল। হেয়ালি গলায় বলল,,
“কেন? কষ্ট হচ্ছে জায়মার জন্য?”
“মানে?”

“খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তোকে তাই বললাম!”
“আমার জন্য একটা মেয়ের শরীরের ক্ষতি হলো আর আমি উদ্বিগ্ন হব না? এরমধ্যে তুই আবার কী মিনিং বের করতে চাইছিস বুঝলাম না?”

“আচ্ছা বাদ দে এসব। এখন বল তুই কেমন আছিস?”
মন মেজাজ বিগড়ে গেল সাদমানের। তাই অকপট গলাতেই সে বলল,,
“ভালো আছি। আগামী মাসেই আমার ফ্লাইট!”
জায়গা থেকে নড়েচড়ে দাঁড়ালো নূর। অবিলম্বেই তার হাসিমুখ দুঃশ্চিতায় মিলিয়ে গেলো। আঘাত পাওয়া স্বরে বলল,,

“মানে কী সাদমান? তুই সত্যিই চলে যাবি?”
সাদমান মাথাটা নুইয়ে নিলো৷ ভরাট গলায় বলল,,
“হ্যাঁ! এখানে তৃতীয় পক্ষ হয়ে থাকতে আমার আর ভালো লাগছেনা। চাঁদের চোখে আমি অপরাধী। এত শত অপরাধবোধ নিয়ে আমি একই শহরে তোদের সাথে থাকতে পারছিনা নূর।”
সাদমানকে দুহাত দিয়ে ঝাঁকালো নূর। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“চাঁদ তোকে মোটেও অপরাধী ভাবছেনা সাদমান। তোর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। চাঁদ তোকে খুব ভালো জানে। সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে৷ এতটুকুই কি যথেষ্ট নয়?”
“না নয়! কারণ, আমার কষ্ট হয়! তোদের কাছাকাছি থাকতে আমার কষ্ট হয়। দম বন্ধ লাগে। হিংসা হয়। ইভেন তোদের দুজনকে একসাথে দেখলেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। হোপ সো তুই চাইবিনা আমি কষ্ট পাই!”
নূর তব্ধ শ্বাস ছাড়ল! ব্যর্থ গলায় বলল,,

“ফাইনালটা দিয়ে গেলে হয়না?”
“পড়াশোনা দিয়ে আর কী হবে? আমার জীবনের মোড়ই তো এখন পাল্টে গেছে! জর্ডানে বাবার বিজনেস সামলাব। আর এটাই এখন ঠিক হবে আমার জন্য!”
নূর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাদমানকে বুঝানোর সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। শরীরের সমস্ত শক্তি সে ছেড়ে দিলো। গলা খাদে এনে বলল,,

“নিজেকে খু্ব অপরাধী লাগছে জানিস? তোর এই চলে যাওয়ার পিছনে একমাত্র আমিই দায়ী! শেষ পর্যন্ত তোকে আমি ধরে রাখতে পারলামনা সাদমান! খু্বই সেলফিস আমি।”
নিজের আবেগকে সংযত করে রাখতে পারলনা নূর। অবিলম্বেই চোখের জল ছেড়ে দিলো! নূরের কান্না দেখে সাদমান ও নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা! জাপটে ধরল নূরকে। কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“চিন্তা করিসনা নূর। আমাদের আবারও দেখা হবে। আগের সাদমানকে আবারও তুই নতুনভাবে খুঁজে পাবি। সেজন্য একটু কষ্ট তো পেতেই হবে। দূরত্বও সহ্য করতে হবে। চাঁদকে বিয়ে শাদি করে সুখে থাক তুই। সবসময় আমার দোয়া তোদের মাথার উপর থাকবে! তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।”

আজ সোহানী এবং নীড়ের বিয়ে। দীর্ঘ ছয়মাস অপেক্ষার পর তাদের ভালোবাসা আজ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। ঘুচে যাবে সমস্ত দূরত্ব। পবিত্র এক বন্ধনে বাঁধা পড়বে তাদের পরিশুদ্ধ দুটি মন। শুভ সময়ের অপেক্ষা মাত্র এবার। সকাল দশটা নাগাদ সোহানীকে নিয়ে তাশফিয়া, তিথী এবং জায়মা পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে।

চাঁদ, রুহি, নাদিয়া, সাদিয়া বাড়িতেই রয়ে গেছে। কারণ তারা চারজনই আজ গভীর ঘুমে বুদ হয়ে আছে। সারারাত সোহানীর সাথে দুষ্টুমি করে তারা ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিল। তাদের ঘুম ভারী বলে ভাঙার এখনও কোনো নাম গন্ধ নিলো না। ঐ বাড়িতে নূর, মাহিন, সাদমান এবং নীড় রিলাক্স মোডে ঘুমিয়ে!

দুপুর একটা বাজতেই তারা রেডি হয়ে বরযাত্রী নিয়ে বের হবে। তাই তাদের তেমন প্যারা নেই। ভোররাত অবধি তারা নীড়ের বন্ধুমহলদের সাথে ব্যাচালর পার্টি করেছে! প্রচুর ড্রিংকস ট্রিংকস করেছে। জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে। যার দরুন ঘুমের রেশ তাদের চোখ থেকে কাটছেই না।

সকাল এগারোটা নাগাদ চাঁদ আচম্বিতেই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। উঠেই সে চোখ বুজা অবস্থায় জোরে চিৎকার করে পুচির নাম ধরে ডাকতে লাগল! স্বপ্নে সে পুচিকে নিয়ে অশুভ কী যেন দেখেছে। তাই মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকদিন যাবত পুচির প্রতি কোনো যত্ন নেই তার!

পুচির খোঁজ-খবরও ঠিকমতোও নেওয়া হচ্ছেনা। অবশ্যই তা ইচ্ছে করে নয়। বেচারী পুচি খুব অসুস্থ এই কয়েকদিন ধরে! জ্বরে ভীষণ আক্রান্ত সে। তার আশেপাশে কাউকে সহ্য করতে পারছেনা সে। এমনকি চাঁদকেও না! শুধু নিরিবিলি এক জায়গায় বসে থাকতে পছন্দ করছে। বিয়ে বাড়ি বিধায় চাঁদ ও পুচিকে তেমন ঘাটায় নি। পুচি যেভাবে থাকতে চেয়েছে ঠিক সেভাবেই তার ফুফিমনির কাছে পুচিকে যত্নে রেখেছে।

চাঁদের চিৎকার শুনে পাশ থেকে নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। ভয়াল দৃষ্টিতে তারা চাঁদের দিকে তাকালো। কোনো দিকে না তাকিয়ে চাঁদ অগোছালো শরীর নিয়ে চট জলদি শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়ালো। পিটপিটে চোখে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তার ফুফিমনির রুমের কাছে এসে সে থামল।

দরজা ঠেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখতে পেল পুচি কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে! ফাঁকা রুম। কোথাও কেউ নেই। কম্পিত শরীর নিয়ে চাঁদ একছুটে পুচির পাশে বসল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে পুচিকে জড়িয়ে ধরল। অমনি পুচি ঘুম ভেঙে উঠল। মিনমিনে দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। রোষভরা গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। চাঁদ মিটিমিটি হেসে পুচিকে তার বুকের সাথে একাত্নভাবে মিশিয়ে নিলো। আদুরে গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৫৯

“আজ আমি তোর কোনো বারণ শুনবনা পুচি। তোর জ্বর নেমে গেছে আমি জানি। সোহানী আপুর বিয়েতে আজ তোকে আমি লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে দিব। সবাই তোকে দেখে জাস্ট তাক লেগে থাকবে।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬১