প্রেমের পরশ পর্ব ২৬

প্রেমের পরশ পর্ব ২৬
লেখিকাঃ দিশা মনি

আমান ও ছোয়া দুজনেই শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কাল সকালে তাদের থাইল্যান্ড যাওয়ার কথা। ছোয়া অনেক বেশি উত্তেজিত থাকলেও সেটা প্রকাশ করছে না। তবে আমানের যেন কোন আগ্রহই নেই থাইল্যান্ডে যাওয়া নিয়ে। যদি ছোয়ার সাথে তার সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক থাকত তাহলে হয়তো পরিস্থিতিটা ভিন্ন হতো!

আমান অনেক বেশি খুশি থাকত থাইল্যান্ডে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু তাদের মধ্যকার এই দূরত্ব যেন আমানের মনে বসন্ত আসার পথ মলিন করে দিয়েছে। বিভিন্ন ভাবনার মাঝেই ছোয়া অর্ধেক রাত পার করে দিল। মাঝরাতের দিকে আমান খেয়াল করে ছোয়া এখনো জেগে আছে। আমান ছোয়াকে প্রশ্ন করেই ফেলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘তুই এত রাত জেগে আছিস কেন বল তো?’
ছোয়া হাই তুলতে তুলতে উত্তর দেয়,
‘ঘুম আসছে, কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না। এই প্রথম বিদেশে যাচ্ছি, তাই আরকি একটু,,’
আমান ছোট করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ওহ বুঝলাম। ঠিক আছে তোর যদি খুব বেশি চিন্তা হয় তাহলে যাওয়ার দরকার নেই।’
ছোয়ার মুখটা পানসে হয়ে উঠল। তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বলল,
‘না, আমি যাবো। আমার কি যাওয়ার ইচ্ছা নেই নাকি?’
আমান রাগী গলায় বলে,

‘তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। কালকে সকালের ফ্লাইটের কিন্তু আমাদের যেতে হবে মনে রাখিস।’
ছোয়া এবার নিজের দুচোখের পাতা বন্ধ করে নিল। আজ সকালেই ইউটিউবে থাইল্যান্ডের একটা ভিডিও দেখেছে। সেই অনুযায়ী থাইল্যান্ডের একটা কল্পিত দৃশ্য ভেসে উঠল তার মনের মধ্যে। ছোয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে মনে মনে বলল,
‘আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। উফ, কখন যে সকাল হবে আর আমি থাইল্যান্ডে যাবো। এই রাত যেন শেষই হচ্ছে না।’

ভোরের আলো ইতিমধ্যে মেঘ ভেদ করে ফুটে উঠেছে। পাখিদের কিচির মিচির শব্দে মুখরিত প্রকৃতি। ছোয়া যথাসময়ে ঘুম থেকে উঠেই ফজরের সালাত আদায় করে নিয়েছে। অতঃপর মন দিয়েছে থাইল্যান্ডের ভাবনায়।
সকাল হতেই আমান তাড়া দিলো। ফ্লাইটের টাইম নাকি হয়ে এসেছে। ছোয়া বেশ হালকা কাপড়ই নিয়েছে। কারণ থাইল্যান্ডে এখন গ্রীষ্মকাল চলছে। আর গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশ অনেকটাই বেশি সেখানে।
ছোয়া একটি লাল রঙের শাড়ি সাথে হিজাব পড়ে নিয়েছে। এই সাজেই নাকি সে থাইল্যান্ডে যাবে। আমানের সামনে এসে উপস্থিত হতেই আমান ভ্রু কুচকে বলল,

‘তুই কি এভাবেই যাবি?’
‘হুম, কেন কো অসুবিধা আছে?’
‘বিদেশে কেউ শাড়ি পড়ে যায়?’
তখনই সেখানে উপস্থিত হলেন জান্নাতুল খাতুন। তিনি আমানের কথার উত্তরে বেশ ভারী গলায় বললেন,
‘আমরা বাঙালি। বিদেশে যাচ্ছি জন্য কি সাহেবদের মতো সেজে যেতে হবে নাকি? আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই সুন্দর আছে। তাই ছোয়া যেভাবে চাইছে সেভাবেই যাবে।’

আমান চুপ হয়ে গেল নিজের মায়ের কথা শুনে এবং এভাবেই রওনা দিল ছোয়াকে নিয়ে।
ঢাকা থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে রওনা দিলো আমান এবং ছোয়া।কয়েক ঘন্টা উড়ান দেওয়ার পর অবশেষে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে অবতরণ করল তারা। অতঃপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলো। যাওয়ার পথে ব্যাংককের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল ছোয়া।

ব্যাংকক শহরটা বেশ সুন্দর আর গোছানো। রাস্তার মাঝে অনেক গাড়ি, বাস রয়েছে। ঢাকায় রাস্তার মধ্যে যেমন ফুচকা, ঝালমুড়ি পাওয়া যায় তেমনি ব্যাংককের রাস্তার ধারেও বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড রয়েছে। তবে এগুলোর নাম ছোয়ার জানা নেই। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বহুতল ভবন ও মার্কেট।

কিছু সময়ের ব্যবধানে তারা পৌছে গেল নোভা সিটি হোটেলে। এটি ব্যাংককের অন্যতম পরিচিত হোটেল। হোটেল থেকে আশেপাশের অনেক সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায় এবং এখানে অনেক সুযোগ সুবিধাও রয়েছে।
প্রথমেই আমান ছোয়াকে সাথে নিয়ে রিশেপসনে গেল। সেখান থেকে নিজেদের জন্য বুক করা রুমের চাবি নিয়ে রওনা দিল রুমের দিকে। রুমে প্রবেশ করেই ছোয়া দেখল এটা একটা ডবল বেড রুম। যা দেখে বেশ অবাকই হলো সে। কারণ বাড়িতে তো তারা একই বেডে থাকে। তাই এখানে এসে আলাদা বেডের ব্যবস্থার কোন কারণ খুজে পেল না। আমানকে এই নিয়ে প্রশ্ন করার সাহসও পেল না ছোয়া। অগত্যা চুপটি করেই রইল।

বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সর্বপ্রথম ছোয়া এসে দাড়ালো থাই গ্লাসের পাশে। সেখান থেকে বাইরের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলো ছোয়া।
পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো আমান মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়েই রয়েছে তার পানে। ছোয়াও তাকিয়ে রইল আমানের দিকে। যেন কিছু হবে তাদের মধ্যে এমন সময়ই দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। এত সুন্দর একটা মুহুর্ত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমানের বেশ রাগ হলো। আমান গিয়ে দরজা খুলতেই একজন হোটেল বয়কে দেখতে পেল। সে ইংরেজিতে বলল,
‘এই নিন স্যার, আপনাদের খাবার।’

আমান তাকে ভেতরে আসতে বলল। হোটেল বয় ভেতরে এসে খাবার রেখেই চলে গেল। আমান তখনো মনে মনে হোটেল বয়ের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে ব্যস্ত ছিল। এরমধ্যেই ছোয়া এসে দেখল তাদের জন্য একটি নুডলস পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এটা কেমন লুডুলস বা কি দিয়ে তৈরি সেটা ছোয়া জানে না। ছোয়ার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমান বলল,
‘এটা প্যাড থাই নুডলস। মুরগী এবং গরু দিয়ে তৈরি, তুই খেতে পারিস।’
আমানের বলতে দেরি কিন্তু ছোয়ার খেতে মোটেই দেরি হলো না। চটজলদি একটি প্লেট উঠিয়ে খেতে শুরু করল। নতুন খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ একটু বেশিই থাকে! এবং বেশ তৃপ্তি করেই খেয়ে নিলো ছোয়া।

আগামীকাল সারাদিন আমান মিটিং নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। সেই কারণেই আজ ছোয়াকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। আজকে তাদের প্ল্যান ব্যাংককে অবস্থিত গ্রান্ড প্যালেসে ঘুরতে যাওয়া। গ্রান্ড প্যালেসে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠে পড়ে দুজনে। কারণ সেখানে নৌকায় করেই যেতে হয়। তাদের সাথে রয়েছে ব্যাংককের স্থানীয় একজন ট্রাভেল গাইড।
নৌকায় করে যাওয়ার সময় অদ্ভুত ভাবে গ্রান্ড প্যালেসের সৌন্দর্য সবার চোখে পড়তে লাগল। ট্রাভেল গাইড তাদের উদ্দ্যেশ্যে ইংরেজিতে বলল,

‘এই প্যালেসটি থাইল্যান্ডের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ১৭৮২ সাল থেকেই এই প্যালেস থাইল্যান্ডের রাজা ও রয়্যাল কোর্টের সরকারি ভবন।’
গ্রান্ড প্যালেসে গিয়ে অনেকটা রাজকীয় বেশেই আমান ও ছোয়ার কিছু ছবি তুলে দিল ট্রাভেল গাইড। আমান এবং ছোয়া থাইল্যান্ডের রাজকীয় পোশাক পড়েই এসেছিল এখানে। তাদেরকে বেশ সুন্দরই লাগছিল। আশেপাশের অনেক পর্যটকই তাদের মুগ্ধ হয়ে দেখে এবং প্রশংসা করে।

গ্রান্ড প্যালেস ভ্রমণ শেষে তাদের হাতে কিছুটা সময় বেচে ছিল। তাই দুজনে ঠিক করে আপাতত খাওয়া দাওয়া করে নিয়ে আবার কোথাও ঘুরতে যাবে। ট্রাভেল গাইডকে সাথে নিয়ে পাশেই একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢোকে দুজনে। চিকেন ফ্রাই এবং ফ্রাইড রাইস খায় সকলে। অতঃপর রওনা দেয় থাইল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ ওয়াট অরুনের দিকে। গ্রান্ড প্যালেসের বিপরীতে পুরো চাও ফ্রায়া নদী জুড়ে এই মন্দিরের বিস্মৃতি। এটি মূলত ব্যাংককের একটি বৌদ্ধ মন্দির(প্যাগোডা)। মন্দিরটির কারুকার্য এবং নির্মাণশৈলি অনেক সুন্দর যা সকলকে মুগ্ধ করে।
ট্রাভেল গাইড আমান ও ছোয়ার উদ্দ্যেশ্যে ইংরেজি ভাষায় বলে,

‘এই ওয়াট অরুন মন্দিরটি অনেকের কাছে টেম্পল অফ ডন নামেও পরিচিত। পাশেই চাও ফ্রায়া নদী। এই মন্দিরে একটি ঘন্টা আছে। অনেকের বিশ্বাস এই ঘন্টাটি বাজালে মনের সব ইচ্ছা পূরণ হয়। আপনারা চাইলে এটা করতে পারেন।’
আমান ছোয়াকে বলে,
‘তুই কি ট্রাই করে দেখবি?’
ছোয়া সরাসরি জানিয়ে দেয়,

প্রেমের পরশ পর্ব ২৫

‘না। এসব বিশ্বাস করা মানে শিরক। একটা ঘন্টা বাজালে কখনো মনের ইচ্ছা পূরণ হতে পারে না। আল্লাহর কাছে মোনাজাতে কিছু চাইলে তখন তিনি আমাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করে দেন। থাইল্যান্ডের মানুষের এটা বিশ্বাস হতে পারে, তারা এটা মান্য করে, কিন্তু একজন মুসলিম হিসাবে ইমানের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কাজ করা আমাদের উচিত নয়।’
ছোয়ার কথা শুনে অভিভূত হয়ে যায় আমান। অতঃপর ট্রাভেল গাইডকে জানিয়ে দেয় তারা এখন এখান থেকে যেতে চায়। ট্রাভেল গাইডকে সাথে নিয়ে দুজনে ফিরে আসার পথে রওনা দেয়।

প্রেমের পরশ পর্ব ২৭