তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১২

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১২
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

বন্যা ভালো হয়ে যাবেন বললেও তাহসানের জ্বর ভালো হলোনা।টানা দুইদিন জ্বরে ভোগে তারপর ভালো হলো।এই জ্বর তাকে যতোটা না কষ্ট দিয়েছে এর চেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে বন্যা।মেয়েটা সেদিন রাতের পর থেকে ফোন অফ করে রেখেছে,তার উপর সে যে বাসা থেকে বেরোবে তারও উপায় নেই আফিয়া বেগম সারাক্ষণ খেয়াল রাখছেন,সে যে বড়ো হয়ে গেছে এটা তার মা বুঝতেই চায় না।

তার মা বলে কথা না সব বাবা মায়ের কাছেই সন্তান সবসময় ছোটই থাকে কিন্তু বন্যার সাথে যোগাযোগ তো করতেই হবে।তাহসান বিরক্তিতে ফ্লোরে থু থু দেয়,মুখ কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা কতো নিষ্ঠুর;জানে জ্বরে পড়ে আছে তারপরও ফোন দিচ্ছে না।ভালোবাসে এটা জানে বলেই কি এতো কষ্ট দিচ্ছে?আসলে খুব বেশী ভালোবাসলে কখনো প্রকাশ করতে নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আফিয়া বেগম মুরগীর স্যুপ নিয়ে রুমে আসে।ফ্লোরে পিচ্ছিল কিছুতে তে পা পড়াতে উনার গা ঘিনঘিন করে উঠে;খেয়াল করে দেখে থু থু।থু থু ফালানোর জন্য,ঝুড়ি আছে,বাথরুম আছে,বারান্দা আছে কিন্তু সব উপায় একপাশে রেখে এমন বিশ্রী কাজটা কি করে করলো?উনি উনার ছেলে মেয়েকে এমন অভদ্রতা শেখায়নি।তাহসান মায়ের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝে যায় কাহীনি।আফিয়া বেগম তাহসানের বিছানায় বসে বললো,

“ফ্লোর কি থু থু ফালানোর জায়গা?”
তাহসান ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।আফিয়া বেগমই ফের বললো,
“আগে তো এমন ছিলি না এখন এতো অধঃপতন হয়েছে কেনো?এই অভদ্র বন্যা ফন্যার সাথে ঘুরলে তো এমন অধঃপতন হবেই।”
বন্যার প্রসঙ্গ আসাতে তাহসানের কপালে ভাজ পড়ে।

“এখানে বন্যা আসলো কেনো?”
“ওর সাথে থেকেই তো তোর এই হাল।”
“সবসময় ওকে টানবে না।”
আফিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বাড়ায় না স্যুপের বাটি সামনে ধরে বললো,
“আচ্ছা।এখন নে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল।”
স্যুপ দেখে তাহসান অভক্তি সুরে বললো,

“এই স্যুপ ট্যুপ খেতে পারবোনা।এসব রোগীদের খাবার আমাকে কেনো দিচ্ছো?আমি কি রোগী নাকি?”
ছেলের কথা শুনে আফিয়া বেগম অবাক হয়ে বললো,
“তুই কি?রোগী না?খা খা।”
তাহসান মায়ের কথার বিরোধ করে বললো,

“আমি মোটেই রোগী না পুরো ঠিক আছি।এখন বের হবো।”
আফিয়া রাগী চোখে তাকিয়ে কৃত্বিতের সুরে বললো,
“রাত দশটায় আর বের হতে হবে না।এখন ঘুমা।”
বিরক্ত লাগলেও তাহসান স্যুপটা শেষ করে।

রাত বারোটা বাজলেও তাহসানের ঘুম আসে না।ছটফট করে বিছানার এপাশ ওপাশ করে।বন্যার ফোন বন্ধ জেনেও আবারো চেষ্টা করে কিন্তু বরাবরের মতো হতাশ হয়ে বালিশের পাশে মোবাইলটা রেখে দেয়।
বন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।তাহসান যে তার ফোনকলের অপেক্ষায় আছে সে জানে তারপরও ইচ্ছেকৃতভাবেই ফোন বন্ধ করে রেখেছে।তার মনের মাঝে যে টানাপোড়েন তার সমাধান না হওয়া অবধি সে তাহসানের প্রেমের মিষ্টি আলিঙ্গনে সাড়া দিতে পারছেনা।তার মন বলছে,

‘তাহসানের কাছে তুই সচ্ছ।এতো দ্বিধা কিসের?’
বিবেক বলে’ কিন্তু সমাজের কাছে অসচ্ছ,দোষী।’
‘সমাজ দিয়ে কি হবে?সমাজ তোকে নিয়ে সংসার করবে?তাহসান ঠিক থাকলেই হলো।’
‘আমরা যে এই সমাজেরই অংশ,এখানেই আমাদের বসবাস।পরবর্তীতে তাহসানের কষ্টের কারণ হতে চাই না।’
‘তাহলে এখনি তাহসানকে সব খুলে বল,সব শোনার পরে যদি সে এগিয়ে আসতে চায় তাহলে সমস্যা কি?’
বন্যার বিবেক দোনামোনা করে বললো,’এখনি বলবো?’

‘ হ্যাঁ। ‘
‘রাত তিনটা বাজে।’
মনটা হিসহিস করে হাসে।’ফোন দিয়ে দেখ তোর আশিক এখনো জেগেই আছে।’
বন্যা জোড়ে শ্বাস নেয়।এই দুইদিন এই কথাগুলো মন আর বিবেকের মাঝে রীতিমতো ঝগড়া করছে।বন্যা সিদ্ধান্ত নেয় সে ফোন দেবে।টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফোনটা এনে অন করে।তারপর তাহসানের নাম্বারে ফোন দেয়।

তাহসান তখন বই পড়ছিলো।কোনোভাবেই যখন ঘুম আসছিলো না তখন ভাবলো সময়টাকে কাজে লাগাই।সেই ভেবেই বই পড়া।বালিশের পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা যখন আচমকা চিৎকার করে উঠে তাহসান চমকে যায়।হাতে নিয়ে বন্যার ফোন দেখে এক আকাশ হাসি সারা মুখজোড়ে ভর করে।রিসিভ করে খানিক রাগী সুরে বললো,

“এই মেয়ে!ফাজলামি পেয়েছো নাকি?এমন করে কেউ উধাও হয়ে যায়?”
বন্যার মন আনন্দে উল্লাস করে বললো’বলেছিলাম না জেগে আছে।’
বন্যা আস্তে করে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।মিহি গলায় বললো,
“আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”
তাহসান মনোযোগী হয়ে বললো,
“বলো।”

বন্যা জোড়ে শ্বাস ফেলে নেয়।চোখ বন্ধ করে নিজের সবচেয়ে খারাপ মূহুর্তটা আরেকজনের কাছে বলতে প্রস্তুত হয়।
“আমার অতীত নিয়ে বলতে চাইছি।”
তাহসান কিছুক্ষণ কোনো কথা বলেনা।তারপর বললো,
“বন্যা!আমি এসব শুনতে চাই না।তোমার অতীত যেমনি হোক আমার সমস্যা নেই।”
বন্যা বললো,

“আমার সমস্যা আছে।আমি সবকিছু বিস্তারিত না বললে আপনার প্রস্তাবে রাজী হতে পারছিনা।”
তাহসান মাথা নেড়ে বললো,
“বলা কি খুব জরুরী?”
“হ্যাঁ।”
তাহসান নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে বললো,

“সরাসরি বলো।ছাদে আসো।”
বন্যা তড়িঘড়ি করে বললো,
“সরাসরি বলতে পারবো না ফোনেই বলবো।”
তাহসান বন্যার অসস্থির কারণ বুঝতে পারে।সে বললো,
“আচ্ছা বলো।”

“আমি তখন মাত্র ফাইভে পরিক্ষা দিয়েছিলাম।এই বাসায়ই থাকতাম।ছোট গুলুমুলু একটা মেয়ে ছিলাম।ওইটুকুন বয়সেই কোমড় ছাপানো লম্বা চুল সবাইকে বিমোহিত করতো।দেখতে এতোটা মিষ্টি ছিলাম যে আমাকে সবাই আদর করতো।আব্বা আম্মাও এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিতো কিন্তু একদিন সকালে আমি সামনের দোকান থেকে চিপস কিনতে গিয়েছিলাম।

আব্বার সাথে এক আঙ্কেল চাকরি করতো তো উনি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতো আমাকে এটা সেটা কিনে দিতো।চিপস কিনে বাসায় আসার পথে উনি আমাকে উনার বাসায় যেতে বলে উনার বাসায় নাকি আব্বা আম্মা গিয়েছে।ছোট ছিলাম এতোকিছু যাচাই না করেই উনার সাথে উনার বাসায় যাই।গিয়ে দেখি উনার বাসায় কেউ নেই।খালি বাসায় আমরা দুজন।আমি আব্বা আম্মাকে খুঁজলে উনি আমার মুখ চেপে ধরে।

এতোবড়ো একটা মানুষের সাথে পেরে উঠছিলাম না।চিৎকার করে নিজের কষ্ট উনাকে বলেছিলাম কিন্তু পাষাণ লোকটা আমার মুখ চেপে আমার চিৎকার বন্ধ করতে চেয়েছে,হাত দিয়ে জোড়ে থাপ্পড় দিয়ে ব্যাথা দিয়েছে।প্রচন্ড ব্যাথায় আমি যখন কাতর তখন উনি দেহের খুদা মেটাতে ব্যস্ত।জানেন আমি উনার কাছে থেকে ছাড়া পেতে উনাকে আব্বা পর্যন্ত ডেকেছি কিন্তু উনি আমাকে ছাড়েননি।

উনার কর্ম হাসিল করেই আমাকে ছেড়েছে ততক্ষণে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম,ছোট একটা মেয়ে যে কিনা তখনো অপরিণত তার উপরেই এতো বড়ো অত্যাচার করে উনি আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে আমাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায়।তখন সম্ভবত দুপুর আমাকে ওভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে লোকজন আসে।আমার অবস্থা দেখে উনাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না ঘটনা কি।

আব্বা আম্মাকে ডেকে এনে আমায় হসপিটালে নিয়ে যায়।টানা সাতদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে আমায় বাসায় আনা হয় তখন থেকেই আমি পুরোপুরি বদলে গেছি কারো সাথেই কথা বলিনা,পুরুষ সম্পর্কে আমার ধারনা পাল্টে যায়,সব পুরুষকে খারাপ মনে হয়,কোনো পুরুষকে সহ্য করতে পারিনা।আশেপাশের মানুষ আমাকে দেখতে এসে ইঙ্গিতে এটা সেটা বলে যায় আম্মার গুনগুনিয়ে কান্নাকাটি সবমিলিয়ে আমি তখন থেকেই আজকের বন্যার সৃষ্টি হয়।তাহসান আমার বুকে যে কি পরিমান কষ্ট এটা কাউকে বুঝাতে পারিনা।নিজের কাছেই নিজেকে খারাপ মনে হয়।”

সবগুলো কথা বন্যা কেঁদে কেঁদে বলে,এমনভাবে তাহসান ওকে কান্না করতে আগে দেখেনি,প্রিয় রমনীর কান্নায় বুকটা কেঁপে ওঠে।বন্যার কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে তাহসানের চোখ থেকে পানি পড়ছে সে নিজেই জানেনা।বন্যার অতীত আসলেই খারাপ,শুনতেই তার এতোটা খারাপ লাগছে না জানি বন্যার কেমন লাগে।বন্যা ফিসফিস করে বললো,

“এখনও কি আমাকেই আপনার চাই?”
তাহসান জড়ানো গলায় বললো,
“খুব চাই।”
তাহসানের কন্ঠ শুনে বন্যা বুঝতে পারে তাহসান কাঁদছে।বন্যাও আরো জোড়ে কান্না করে দেয়।
“তাহসান..”
তাহসান নরম কন্ঠে বললো,
“কি?”

বন্যা কান্নারত গলায় বললো,
“আমার খুব কষ্ট হয়।”
“আর কষ্ট হবেনা।”
“এখনো আমাকে ভালোবাসেন।”
তাহসান বললো,
“আগের থেকে বেশী ভালোবাসি।”
বন্যা ডুকরে কেঁদে উঠে।
“আমিও ভালোবাসি।খুব বেশী।”

তাহসান বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।দরজা খুলতে খুলতে বললো,
“ছাদে যাচ্ছি।দুই মিনিটে আসবে,আমি অপেক্ষায় আছি।”
বন্যা নিঃশব্দে দরজা খুলে ছাদে যায়।তাহসান বন্যাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দুজন দুজনকে দেখতে থাকে।হঠাৎ তাহসান ছুটে এসে বন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।বন্যা তখনো কাঁদছে।তাহসান ফিসফিস করে বললো,
“এই!তখন কি বলেছিলে আবার বলো না প্লিজ।”

বন্যা তাহসানের পিঠে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে।বুকে নাক ঘষে কাঁদে।সেদিন এমন ইচ্ছেই হচ্ছিলো আজকে পূরণ হয়ে গেলো।তাহসানের কথা শুনে সে ভিষণ আদুরী গলায় বললো,
“খুব খুব বেশী ভালোবাসি।”
তাহসান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

“কোথায় রাখি তোমাকে?বুকের ভেতরে নিয়ে যেতে পারলে বোধহয় শান্তি হতো।”
বন্যা তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।তাহসান বললো,
“এমন জা.নোয়ারের জন্য আমি তোমাকে ভুলে যাবো ভাবলে কি করে?সব কষ্ট আমি ভালোবাসায় মুছে দেবো,আমার উপর বিশ্বাস রাখো।যে ঝড় আসবে আমরা দুজন মিলেই মোকাবিলা করবো।”

তাহসান বন্যাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে ভালোবাসার প্রথম পরশ দেয়।তারপর বন্যাকে ছেড়ে দেখে বন্যা লজ্জা পাচ্ছে।তাহসান হেসে বললো,
“তোমাকে লজ্জা পেতে দেখলে দারুন লাগে।”
বন্যা নিশ্চুপ।তাহসান বললো,

“আর লজ্জা পেও না,বিয়ের আগে আর আদর করবো না না।”
তাহসানের কথা শুনে বন্যা হাসে।তাহসান বন্যার হাত ধরে সেদিন রাতের মতো করে ঘুরায়।তারপর হঠাৎ থেমে চিৎকার করে বললো,
“শোন চাঁদ,আমি আমার ব্যক্তিগত চাঁদ পেয়ে গেছি।”
তারপর বন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১১

“ভালোবাসি লক্ষীটি।”
বন্যা কান্না ভুলে খিলখিল করে হাসে।তাহসানের মতো গলা ছেড়ে বললো,
“ভালোবাসি আমার রাজকুমার।”

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৩