প্রেমের পরশ পর্ব ৩০

প্রেমের পরশ পর্ব ৩০
লেখিকাঃ দিশা মনি

ছোয়া পথহারা পথিকের মতো থাইল্যান্ডের রাস্তায় হাটছিল। এই অচেনা যায়গায় এখন তার সহায় সম্বল বলতে কিছু নেই। পাসপোর্ট, ভিসা, ফোন এমনকি টাকাও নেই তার কাছে। যার কারণে সে এখন সম্পূর্ণ অসহায়। এখন তার সামনে যে কি অপেক্ষা করছে সে জানে না। ছোয়া কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ভাবল থানায় যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল সেখানে গিয়ে লাভ নেই কারণ পুলিশ তাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। অগত্যা রাস্তার মধ্য দিয়ে হাটতে লাগল সে।

দিনের আলো হারিয়ে গেল রাতারের আধারে৷ এখন প্রায় ৭ টা বাজে। ছোয়া থাইল্যান্ডের একটি পার্কে এসে পার্কের বেঞ্চে বসেছে। তার মাথা একদম কাজ করছে না। হঠাৎ করেই সে খেয়াল করল দূরে দাড়িয়ে থাকা একজন মহিলা অনেকক্ষণ থেকেই তাকে দেখছে। ছোয়ার অস্বস্তি হলো খুব। তবুও সে ঠায় বসে রইল। একটু পরেই মহিলাটি এগিয়ে আসল ছোয়ার কাছে। ছোয়া একবার মহিলাটিকে ভালো করে পরখ করে নিল। মধ্যবয়সী একজন মহিলা। হয়তো থাইল্যান্ডের স্থানীয় কেউ। হাতে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ। পরনে লাল কালারের একটি গ্রাউন। ছোয়া অস্বস্তি থেকে ইংরেজিতে মহিলাটির উদ্দ্যেশ্যে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আপনি কি কিছু বলবেন?’
মহিলাটি ঠোট প্রসারিত করে হাসল। অতঃপর ইংরেজিতে বলল,
‘আমি আসছি থেকেই খেয়াল করেছি তুমি এখানে বসে আছ। তোমাকে দেখে তো বিদেশি মনে হচ্ছে। তোমার কি কোন সাহায্য লাগবে?’

ছোয়া হঠাৎ ভিনদেশে একজন মহিলাকে ভরসাযোগ্য মনে করল না। তাই নিজের অসহায়ত্বের কথা গোপন রেখে বলল,
‘না আমার কোন সমস্যা নেই।’
কিন্তু মহিলাটি যেন বিশ্বাস করল না ছোয়ার কথা। ছোয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতেই বলল,
‘তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে কিছু খাওনি৷’

কথাটা বলে তিনি নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কলা এবং পাউরুটি বের করে ছোয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ছোয়া প্রথমে নিতে চায়নি। কিন্তু মহিলাটির জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে নিয়ে নেয়। মহিলাটি ছোয়ার দিকে মায়াবী দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিল। ছোয়ার পাশেই বসে পড়ে। অতঃপর বলে,
‘জানো আমারও না তোমার মতো একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু গতবছর একটা রোড এক্সিডেন্টে ও মারা গেছে। তারপর থেকে আমি একদম একা হয়ে গেছি।’

ছোয়ার বেশ খারাপ লাগল মহিলাটির জন্য। মহিলাটি আরো অনেক কথা বলল নিজের সম্পর্কে। ছোয়া ধীরে ধীরে সহজ হয়ে গেল তার সাথে এবং একপর্যায়ে নিজের সমস্ত সমস্যার কথাও খুলে বলল মহিলাটিকে। সব শুনে মহিলাটি দুঃখপ্রকাশ করে বললেন,

‘তোমার অবস্থা তো সত্যিই ভীষণ খারাপ। তুমি জানো কি থাইল্যান্ডে আইন কতো কঠোর? যদি তোমাকে এখানকার পুলিশ একবার ধরে ফেলে তাহলে কিন্তু তোমাকে এরেস্ট করা হবে। কারণ তোমার কাছে পাসপোর্ট ভিসা কিছুই নেই।’
ছোয়া অসহায় কন্ঠে বলল,
‘কিন্তু ছিল তো। ওসব তো চুরি হয়ে গেছে।’
‘পুলিশ তো এত কথা বুঝবে না। ওরা সরাসরি তোমাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে।’

রাতের আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এলো৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে থাইল্যান্ডের রাজপথ৷ ছোয়া একটি গাছের তলে আশ্রয় নিয়েছে। সাথে রয়েছে সেই মহিলাটিও। মহিলাটি ছোয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলল,

‘এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। এমনিতেই তোমার অবস্থা এত খারাপ, তার উপর যদি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর-টর বাধাও তাহলে সমস্যা হবে। তার থেকে বরং তুমি আমার বাড়িতে চলো। এখান থেকে বেশিদূর নয়, এই তো পাশেই আমার বাড়ি।’
ছোয়া প্রথমে তো একদম রাজি হয় না এমন প্রস্তাবে। কারণ এভাবে ভিনদেশে অচেনা কাউকে ভরসা করে ওঠাই কঠিন। সেখানে কারো বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া তার কাছে ঠিক মনে হয়না। কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা। তিনি নিজের দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,

‘আমার স্বামীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমার মেয়েটাও মারা গেছে। এখন আমার আপন বলতে আর কেউ নেই। তুমি যদি আমার সাথে গিয়ে থাকো তাহলে আমার কোন সমস্যা হবে না। বরং আমি খুশিই হবো।’
মহিলার মুখে এহেন কথাবার্তা শুনে ছোয়াও আর বেশিক্ষণ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে না। রাজি হয়ে যায় মহিলার সাথে যেতে। মহিলা অনেক খুশি হয় ছোয়া তার সাথে যেতে রাজি হয়েছে জন্য। অতঃপর ছোয়াকে সাথে করে রওনা দিলো। বৃষ্টিতে ভিজেই দুজনে একটি বাড়িতে এসে উঠল।

ছোয়া খেয়াল করে দেখল, বাড়িটা বেশ পুরানো মনে হচ্ছে। তবে বেশি মাথা ঘামাল না৷ মহিলাটির সাথে বাড়িতে প্রবেশ করল। মহিলাটি বাড়িতে প্রবেশ করেই প্রথমে নিজের ওয়ারড্রব থেকে একটি জিনস আর টপস বের করে দিয়ে বললেন,
‘এটা আমার মেয়ের ড্রেস। এই ভেজা কাপড় পড়ে থাকলে তোমার শরীর খারাপ হবে। তাই তুমি এটা পড়ে নাও।’

ছোয়া আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিয়ে নিলো ড্রেসটা। অতঃপর চলে গেলো বাথরুমে। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রাতে মহিলাটি ডিনারের ব্যবস্থা করলো৷ ছোয়া ডিনার করে নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ল। বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে ধরা দিলো তার চোখে। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ছোয়া। তবে আমানের এবং আব্দুল হোসেনের জন্য তার মনে যথেষ্ট চিন্তাও ছিল। না জানি কিভাবে সব কিছু ঠিক হবে। বা আদৌ সবকিছু ঠিক হবে কিনা।

সূর্যের কিরণ জানালার পর্দা ভেদ করে ছোয়ার চোখে এসে ধরা দিলো। ইতিমধ্যেই অনেক বেলা হয়ে গেছে।
ছোয়া আর দেরি না করে বিছানা থেকে উঠল। অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতেই চোখে পড়ল গতকাল তাকে আশ্রয় দেওয়া মহিলাটি ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছেন। ছোয়াকে আসতে দেখে তিনি মৃদু হেসে ইংরেজিতে বললেন,
‘শুভ সকাল। তুমি এখানে বসে পড়ো। আমি তোমাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমাদের আবার আজ এখান থেকে আমার ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে।’

ছোয়া চুপচাপ খেতে বসে পড়ে। সকালে ব্রেকফাস্টে পাউরুটি এবং বাটার রয়েছে। ছোয়া পাউরুটিতে বাটার মেখে খেতে থাকে এবং বলে,
‘আপনার ভাইয়ের বাড়ি এখান থেকে কত দূর?’
মহিলাটি বলে,
‘বেশিদূর নয়, এই ব্যাংকক শহরেই। আমি কিছু কাজে ওখানে যাচ্ছি। তোমাকে তো আর একা রেখে যেতে পারিনা তাই নিয়েই যাই।’

ছোয়া আর কোন প্রশ্ন করল না। চুপচাপ খেতে লাগল। মহিলা খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ ছোয়ার খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করল। ছোয়ার খাওয়া শেষ হতেই দুজনে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে এসে একটি ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল দুজনেই। ছোয়া মহিলার কাছে আবদার করল হঠাৎ। সে বললো,
‘যদি কোনভাবে আমার স্বামী আর শ্বশুরের সাথে দেখা করতে পারতাম তাহলে ভালো হতো।’
মহিলাটি বলে,

‘আমার ভাই একজন উকিল। সে তোমায় সাহায্য করতে পারে।’
ছোয়া এবার যেন একটু আশ্বাস পায়। সারা রাস্তা আর তেমন কথা বলে না সে। কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌছানোর পর দুজনেই নেমে যায়। ছোয়া খুব অবাক হয়ে যায়। কারণ এটা দেখে কারো বাড়ি মনে হচ্ছে না। এখানে অনেক মানুষের সমাগম। ভেতরেও মনে হচ্ছে অনেক মানুষের সমাগম।

ছোয়া মহিলাটিকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই দুটো ছেলে এসে তাকে ঘিরে ধরল। ছোয়া কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে আসলো। মহিলাটি সেই লোকটির উদ্দ্যেশ্যে থাই ভাষায় কিছু বলল। লোকটি বিশ্রীভাবে হেসে মহিলাটির হাতে এক বান্ডিল টাকা ধরিয়ে দিল। মহিলাটি তৎক্ষণাৎ বিদায় নিলো। ছোয়া খুব ভয় পেয়ে চিৎকার করতে লাগল।

প্রেমের পরশ পর্ব ২৯

মধ্যবয়সী লোকটি হেসে বললো,
‘চিৎকার করে লাভ হবে না। আজ থেকে তোমাকে এই বোথ্রেলেই থাকতে হবে একজন প্র’স্টিটিউড হিসেবে।’
ছোয়া আৎকে ওঠে। এ নতুন কোন বিপদের আগমন ঘটল তার জীবনে!

প্রেমের পরশ পর্ব ৩১