প্রেমের পরশ পর্ব ২৯

প্রেমের পরশ পর্ব ২৯
লেখিকাঃ দিশা মনি

ছোয়া হোটেলের রুমে বসে অলস সময় পার করছে। মনে তার নানা ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। হিসাব মতো কালকে তাদের দেশে ফিরে যাবার কথা। ছোয়ার মনটা কেমন ছটফট করছে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য। কারণ সেখানেই তো তার সব আপনজন রয়েছে। নিজের দেশের মাটি, মাটির গন্ধ সব মিস করছে সে। আমরা যতই ভিনদেশে সুযোগ সুবিধা পাই না কেন নিজের দেশকে কখনো ভুলতে পারি না। যারা ভুলে যায়, তাদের মধ্যে অন্তত দেশপ্রেম বলতে কিছু নেই।

ছোয়া একটু নিজের ফোনটা বের করল৷ বসে বসে সময় যেন যেতেই চায়না। হঠাৎ করেই ফোনে একটি রোম্যান্টিক ভিডিও চলে আসায় ছোয়ার গতকালকের ঘটনাগুলো মনে হতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যেই লজ্জায় তার মুখ লাল বর্ণ ধারণ করে। ছোয়া ভাবে কাল সে আমানের কত কাছে ছিল, তাদের মধ্যকার এতদিনের দূরত্ব যেন এক নিমেষেই ঘুচে গেল। ছোয়ার খুব আফসোস হতে থাকে এটা নিয়ে যে সে কেন এত দেরি করল নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যদি একটু আগে প্রকাশ করত তাহলে হয়তো সবকিছু আরো আগেই ঠিক হয়ে যেত। আমানের প্রেমের পরশ পেতেও তাকে এত অপেক্ষা করতে হতো না৷ নানান ভাবনার মাঝে আচমকা ছোয়ার চোখ যায় একটি নিউজে। ফেসবুকে একটি নিউজ খুব ভাইরাল হয়ে গেছে সে, থাইল্যান্ডে নাকি কোন বাংলাদেশী কোম্পানি একটি থাই কোম্পানির সাথে জালিয়াতি করার চেষ্টা করেছে। এইজন্য সেই কোম্পানির অন্যতম এক সদস্যকে থাইল্যান্ডে আটক করা হয়েছে।

নিউজটি দেখামাত্রই ভয়ে শিউরে ওঠে ছোয়া। ছোয়ার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বারংবার মনে হতে থাকে, আমানের আবার কোন বিপদ হলো নাতো? ছোয়া ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। আমানকে বার বার কল করতে থাকে। কিন্তু আমান ফোনটা রিসিভই করে না। তখনই হঠাৎ করে আব্দুল হোসেন ছোয়াকে ফোন করে। ছোয়া ফোনটা রিসিভ করলে আব্দুল হোসেন বলে,

‘এসব আমি কি শুনছি ছোয়া? আমানকে নাকি থাইল্যান্ডে গ্রেফতার করা হয়েছে?’
ছোয়ার মনে একটু আগেও যেটুকু আশার আলো ছিল সেটুকু যেন দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিয়ে গেলো। সে তো ভাবতেও পারে নি, যে তার ধারণা এভাবে সত্য হয়ে যাবে। ছোয়া কান্নাভেজা গলায় বলে ওঠে,

‘আমি এই ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না। একটু আগে নিউজে শুধু দেখলাম থাইল্যান্ডে বাংলাদেশী একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখন আমার মনে হয়েছিল বটে,,কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি যে এমন কিছু হবে। আমরা এখন কি করবো বড় আব্বু? ওকে কিভাবে জেল থেকে বের করে আনব?’
আব্দুল হোসেন বলে উঠলেন,

‘আমাকে থাইল্যান্ডের ঐ কোম্পানিটা থেকে ফোন করেছিল। ওরাই আমাকে সব জানিয়েছে। এমনকি থ্রেট দিয়েছে যে আমাকেও গ্রেফতার করবে। তবে আমি এসব নিয়ে ভয় পাচ্ছি না। আগে আমার আমানকে রক্ষা করতে হবে। তুই কোন চিন্তা করিস না, আমি আজকে রাতেই থাইল্যান্ডের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিচ্ছি। কাল ভোর নাগাদ পৌঁছে যাব। ততক্ষণ তুই হোটেলেই থাক। আমি গিয়ে সব ঠিক করে দেবো। এখনো আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি না যে, আমানকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে। ওখানে গিয়ে সব খোজও নিতে হবে।’

কথাগুলো বলে আব্দুল হোসেন ফোনটা রেখে দেন। ছোয়া অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগল আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল যেন আমানের বড় কোন বিপদ না হয়।

আব্দুল হোসেন থাইল্যান্ডে এসে পৌছেছেন। এসেই সবার প্রথমে ছোয়ার সাথে হোটেলে এসে সাক্ষাৎ করলেন তিনি। ছোয়া আব্দুল হোসেনকে দেখামাত্রই কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমানের জন্য দুশ্চিন্তায় গোটা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি বেচারি মেয়েটা। আব্দুল হোসেন ছোয়াকে সামলে নিয়ে বলল,

‘তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি তো এসে গেছি এখন সবকিছু ঠিক করে দেবো।’
ছোয়া যেন একটু ভরসা পেলো। অতঃপর আব্দুল হোসেনের সাথে বেরিয়ে পড়লো থানার দিকে। থানায় পৌছে আব্দুল হোসেন ও ছোয়া ভেতরে ঢুকে আমানের সাথে দেখা করার জন্য প্রথমে পুলিশের সাথে কথা বলে। কিন্তু পুলিশ জানায় আমানের সাথে দেখা করতে দেওয়া যাবে না। আব্দুল হোসেন একজন থাই পুলিশকে ইংরেজিতে বলেন,

‘আমার ছেলে আমান হোসেন। আমি ওর বাবা। আমি কেন ওর সাথে দেখা করতে পারব না?’
পুলিশ অফিসার ইংরেজিতে বললো,
‘দেখা করার জন্য আগে আপনাদের অনুমতি নিতে হবে।’

আব্দুল হোসেন অনেক অনুরোধ করলেন কিন্তু কোন লাভ হলো না। কারণ থাইল্যান্ডের রুলস অনেক স্ট্রিক্ট। তাই আব্দুল হোসেন অবশেষে বাধ্য হয়ে থাইল্যান্ডে তার পরিচিত একজন উকিলের সাথে যোগাযোগ করলেন। তার মাধ্যমেই আদালত থেকে অনুমতি পত্র এনে অতঃপর দেখা করার সুযোগ পেলেন। তবে পুলিশ অফিসারসা শুধু একজনকেই ভেতরে যেতে দেবেন। যার ফলে ছোয়াকে হতাশ হতে হলো৷ আব্দুল হোসেন ছোয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘তুই চিন্তা করিস না একদম। আমি গিয়ে আমানের সাথে কথা বলছি। আর খুব শীঘ্রই আমানকে বাইরে বের করবো ইনশাআল্লাহ।’
ছোয়া চাতক পাখির মতো বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আর আব্দুল হোসেন ভেতরে প্রবেশ করলেন
আমান জেলের ভেতরে মাথা নিচু করে বসে ছিল। আব্দুল হোসেন সেখানে এসে একবার আমানের নাম ধরে ডাকতেই সে মাথা তুলে তাকালো। ছুটে চলে আসলো আব্দুল হোসেনের কাছে। এসেই কান্নাভেজা গলায় বললো,

‘বিশ্বাস করো আব্বু, আমি কিছু করিনি। আমাকে ফাসানো হচ্ছে। ঐ থাই কোম্পানি আমাদের নামে মিথ্যা মামলা করেছে যে আমরা নাকি ওদের ভুল প্রোডাক্ট সেল করেছি। আমাদের জন্য নাকি ওদের কোম্পানির লস হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ।’
আব্দুল হোসেন জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে প্লিজ খুলে বলো।’
আমান বললো,

‘আমরা এখানে যে প্রোডাক্টগুলো রপ্তানি করেছিলাম সেটা তো সম্পূর্ণ ঠিক ছিল। ওরা সেটা নিয়ে নিজেদের অনেক লাভও পেয়েছে। এখানে আমাদের ডাকা হয়েছিল এইরকম আরো প্রোডাক্টের চুক্তি করার জন্য কিন্তু এখানে এনে আমাদের কাছে ওরা সব টাকা ফেরত চায় এবং বলে প্রোডাক্টগুলো নাকি সব নকল। আমি ওদের সাথে তর্কে জড়ালে পুলিশ ডেকে আমায় ধরিয়ে দেয়। আমার মনে হয়, এটা কোন বড় চক্রান্ত। আমাদের দেশে আমাদের কোন রাইভাল কোম্পানিই এটা করিয়েছে।’
আব্দুল হোসেন চিন্তিত গলায় বললেন,
‘হুম বুঝলাম। আচ্ছা দেখি কি করা যায়।’

আব্দুল হোসেন আমানের সাথে দেখা করে বের হতে যাবেন এমন সময় কয়েকজন পুলিশ এসে তাকে হাতকড়া পড়ায়। একজন পুলিশ বলে,
‘আপনি তো হাসান এন্টারপ্রাইজের মালিক তাইনা? আপনার ছেলের সাথে আপনিও এই জালিয়াতির সাথে জড়িয়। তাই আপনাকেও এরেস্ট করা হচ্ছে।’

আব্দুল হোসেন অনেক তর্কাতর্কি করেন কিন্তু কোন লাভ হয়না। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে ছোয়া বেচারি তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখে৷ তার আজ কিছুই করার নেই। সব দিক থেকে এখন সে অসহায়।
ছোয়া পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে অসহায়ের মতো রাস্তায় হাটতে লাগল। এখন সে যে বড্ড অসহায়। কিভাবে নিজের স্বামী এবং শ্বশুর কে রক্ষা করবে সেটাই বুঝতে পারছে না সে।

প্রেমের পরশ পর্ব ২৮

এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে একটা চোর এসে তার পার্স চুরি করে দৌড় দেয়। ছোয়াও সেই চোরের পেছনে দৌড় দেয়। কিন্তু কোন লাভ হয়না। নিমেষের মধ্যেই চোরটা ধরাছোয়ার বাইরে চলে যায়। ঐ পার্সটিতে ছোয়ার পাসপোর্ট, ভিসা, মোবাইল ফোন সবকিছু ছিল। বিপদ যখন আসে তখন সব দিক দিয়েই আসে। এখন এই ভিনদেশে এমন পরিস্থিতিতে ছোয়া সম্পূর্ণ অসহায়। ছোয়া আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। মাটিতে লুটিয়ে অসহায়ের মতো কাদতে থাকে।

প্রেমের পরশ পর্ব ৩০