প্রেয়সী পর্ব ৪

প্রেয়সী পর্ব ৪
নন্দিনী নীলা

ফুয়াদ দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্লাবের সামনে। ঘড়িতে রাত আড়াইটে বাজে। ও ক্লান্ত চোখে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সামনে তাকাল। অনেক দিন ধরেই রমেশ চন্দ্রের বিরুদ্ধে একটা জড়ালো প্রমাণ খুঁজছিল। রমেশ চন্দ্র একজন পুলিশ অফিসার। বয়স পঞ্চাশের উপরে।

তিনি আইনের কর্মকর্তা হলেও আইন মোতাবেক কোন কাজ করেন না। টাকা পেলে তিনি খুনি, আসামি কেও চোখের সামনে বসিয়ে খুন করতে সাহায্য করে। আর নিরিহ মানুষ তার কাছে সাহায্য চাইতে আসলে পাত্তা দেয় না। টাকা চেয়ে বসে। যদি মেয়ে মানুষ আসে তাহলে তার কাজটা হয়তো করেন। কারণ তার জীবনে দুইটা লোভ এক টাকা, দুই নারীর শরীর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ রমেশ চন্দ্র এক মেয়েকে নিয়ে ক্লাবে এসেছে ফুর্তি করতে সেই জড়ালো খবর পেয়েছে ফুয়াদ তার সহকর্মী প্রান্তের কাছে। গতকাল বান্দরবান থেকে এতো জার্নি করে ফিরেছে একটু রেস্ট প্রয়োজন ছিল তবুও নিজের শরীরকে এক পাশে ফেলে ও ছুটে এসেছে নর্দমার কীট ধ্বংস করতে। রমেশ চন্দ্রের বিরুদ্ধে একটা শক্ত প্রমাণ হাতে আসলেই তাকে থামানো যাবে। নচেৎ তাকে থামানো অসম্ভব।

কয়েকবার ফুয়াদের সাথে তার দেখা হয়েছে তিনি কিটকিট করে হেসে ফুয়াদের সাথে বিনয় আচরণ করেছে। যেন কত আপন ফুয়াদ তার। কিন্তু ফুয়াদ যে তাকে এক দন্ড ও পছন্দ করে না সেটা হয়ত রমেশ চন্দ্র বুঝেনি। বুঝতে দেয় নি তাকে ফুয়াদ। আজকেও ফুয়াদ কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারল না। ঘন্টা খানিক দাঁড়িয়ে থেকেও রমেশ চন্দ্রের ছায়াও ক্লাব থেকে বেরোতে দেখল না।

ও নিজেই ক্লাবে ঢুকল। তিন চার জোড়া ছেলে মেয়ে মাতাল অবস্থায় ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ও চোখ বুলিয়ে নিল ক্লাবে ও কেবিন রুমে রমেশ চন্দ্রের টিকিটিও নাই রাগে ওর কপালের রগ ফুলে উঠল। প্রান্ত ওকে মিথ্যা বলল কেন? নিজের ক্লান্তির চিন্তা না করে ছুটে এসেছে কি এভাবে ধোঁকা খেতে। নিজের গাড়িতেই একটা লাথি মেরে প্রান্ত কে কল করবে তখন প্রান্ত নিজেই কল করল।

” তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে মিথ্যা বলার? আন্সার মি।”
প্রান্ত ফুয়াদ এর রাগের কারণ বুঝেছে। রাগ করাটা স্বাভাবিক।
” সরি আসলে রমেশ আজ অন্য ক্লাবে গেছে তিনি বর্তমানে নিজের বাসায় আছে। আমাকে যে খবর দিয়েছিল সে ক্লাবের ঠিকানা ভুল করে ফেলেছিল।”
ফুয়াদের মন চাইল অকথ্য ভাষায় কয়টা গালি দিতে। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে রাগে ফোন কেটে গাড়িতে উঠে বসল।

মধু রাতে ঘুমাতে পারেনি কিন্তু ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল এজন্য উঠতে উঠতে দশটা বেজে গেল। মাঝরাতে শরীর খারাপ লাগলেও ঘুমানোর ফলে এখন খারাপ লাগা কেটে গেছে। বিছানায় মুখ গোমড়া করে বসে আছে মধু এখন কোথায় যাবে?তিন্নির সাথেও তো কন্টাক্ট করতে পারছে না। এখন করবে কি? বাসায় ফিরে যাবে? নো নো বাসায় ফিরে গেলেই আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। বর যে আমার আপন ফুফাতো ভাই। ও গড এখন আমি করব কি? চিন্তিত মুখে মধু নখ কাটছে দাঁত দিয়ে। তখনি রুমে প্রবেশ করল রাহী‌। মধু রাহীর দিকে তাকাল। রাহী বলল,,” আরে মধু উঠেছো।”

মধু মুখটা মলিন করে তাকিয়ে আছে তখনি পেছনে পেছনে আরেকটা মেয়ে রুমে প্রবেশ করে।
তাকে দেখে মধু চিৎকার করে তিন্নি বলে উঠে। তিন্নি নিজেও হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মধুর দিকে। মধুকে এখানে একদম আশা করেনি।
” মধু তুই?”

মধু খাট থেক লাফ দিয়ে নেমে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরেছে। খুশিতে ও পারেনা লুঙ্গি ডান্স দেয়। রাহী নিজের ছোট বোন তিন্নি ও একরাতের পরিচিত মধুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ফেসবুকে পরিচয় হলেও দুজনের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ওদের। দুজন সেইম ইয়ারে পরে বিধায় তুই করেই কথা‌ বলে।

” মধু তুই গতকাল সকালে বলেছিলি আমার এখানে পালিয়ে আসবি আমিও তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কখন কল করবি কিন্তু তুই আর কল করলি না। পরের দিকে আমি কল‌ করলাম বন্ধ দেখাল ফোন। আমি ভেবেছিলাম তুই হয়ত পালাতে পারিস নাই। তোর শয়তান ফুফাতো ভাইয়ের সাথেই তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তুই যে এইভাবে পালিয়ে অজান্তেই আমার বাড়ি আসবি কল্পনাও করি নাই।”

” হ্যা রে কাল কত কি করেছি জানিস? পালিয়ে আসছি ঠিক‌ই কিন্তু পার্স বা ফোন আনতে পারি না। সব তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফেলে এসেছি। তোর নাম্বার ও মনে ছিল না এজন্য আর যোগাযোগ করতে পারি নাই।”
রাহী ওদের কথোপকথন শুনেই বুঝতে পারল মধু যার ভরসায় পালিয়ে এসেছে সে হলো তিন্নি। আর তিন্নিকে রাহী রা বান্দরবান ঘুরতে নিয়ে যায়নি গতকাল এজন্য রাগ করে দরজা আটকে বসে ছিল। সারারাত বের হয়নি।

সবাই ডেকেছে খায় ও নি। সকালে বের হয়ে সব কাহিনী শুনেছে রাহীর থেকে তখন থেকেই তিন্নি ভাবছিল এই মেয়েটা মধু হলে ভালো হতো। ওর চাওয়া আল্লাহ তাআলা এভাবে পূরণ করল। তিন্নি মধুর সমবয়সী হলেও ওকে দেখে তিন্নির থেকে ছোট লাগে। তিন্নি মোটাসোটা আর মধু খুব চিকন ও না আবার খুব মোটাও না। তিন্নি শ্যামলা বর্ণের হলেও রাহী ধবধবে ফর্সা।

মধু যখন শুনল রাহীর ছোটো বোন তিন্নি তখন সে কি খুশি। মধু ফ্রেশ হতেই ওরা তিনজন নিচে নেমে এসেছে।‌ তিন্নি বাসা মাথায় নিয়েছে চেঁচিয়ে সবাইকে ডেকে মধু কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তিন্নির পরিচিত ফ্রেন্ড শুনে নাফিসা শান্ত হয়েছে এমনিতেও মধু কে তার খারাপ মনে হয়নি তবু ও চিন্তা করছিল। এখন নিশ্চিন্ত হলো নাফিসা এগিয়ে এসে মধুকে বললেন ওর যতদিন ইচ্ছে ওর এই বাসায় থাকতে পারে। মধু এতোক্ষণ শান্ত শিষ্ট মেয়ের অভিনয় বন্ধ করে চঞ্চল হয়ে উঠল।

নাফিসা কে জড়িয়ে ধরে বলল,,” থ্যাংকিউ আন্টি।”
নতুন পরিবেশে এসে মধু একদম শান্ত শিষ্ট হয়ে ছিল। কিন্তু মোটেও শান্ত শিষ্ট নয় ও। প্রচুর দুরন্ত, মেয়ে মধু। না হলে মানিকগঞ্জ থেকে পালিয়ে কি ঢাকা আসার এতো সহজ নাকি? রাহী বেশিরভাগ ফোনেই মুখ গুজে থাকে। এদিকে তিন্নি কে পেয়ে মধু গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে। সোফায় দুজনে কথা বলছে আর উচ্চ স্বরে হাসছে। মধুকে নিয়ে তিন্নি খাবার টেবিলে আসলো। নাস্তা করে মধু আর তিন্নি তিন্নির রুমে আসছিল তখন পথে দেখা হলো একটা সিল্কি শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। তিন্নি ফিসফিস করে বলল,,” এটা বড় ভাইয়ের ব‌উ। আমাদের চিত্রা ভাবি।”

চিত্রা ওর দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। তিন্নি মধুকে নিয়ে নিজের রুমে এসে গল্প করতে লাগল। মধু বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে বলল,,” সবাইকে মিস করছি ভীষণ ভাবে।”
” ফোনে কথা বলবি আন্টির সাথে?”
” অসম্ভব। কথা‌ বললেই ধরে ফেলবে আমি কোথায় আছি তারপর জোর করে ধরে নিয়ে বিয়ে দেবে।”
” তোর বাপ বিয়ে দিতে এতো পাগল হয়েছে কেন?”

” আমার ফুপি মাথার দিব্যি দিয়ে রাজি করিয়েছে বাবাকে। আর বাবা কথা দিলে কথা রাখে। এখন তার কথা রাখার জন্য আমাকে বলির পাঁঠা করতে চায় আমি তো পাঁঠা না আমি তাই বলি ও হবো না। কয়েকমাস নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। দোস্ত আজ বিকেলে আমি শপিং করতে যাব। আমার কাছে স্বর্ণের গহনা আছে বিয়ের সময় বাবা যা দিয়েছিল সব পড়ে চলে এসেছি ওগুলো রাস্তা ঘাটের মানুষ কে বলেছি স্বর্ণের না। ইমিটিস্বর্নের বলেছি তাই ডাকাত আর চোরের হাত থেকে বেঁচেছি। ওগুলো বিক্রি করে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনব।”

” এতো বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কেমনে?”
” থাকতে হয় জান। না থাকলে পালাতাম কেমনে।”
দুজনেই হেসে উঠল।
বাসার সবার কাছে খবর পৌঁছে গেছে মধু তিন্নির বন্ধু। সমুদ্র লাঞ্চের সময় মধু কে বলল,,” ভালোই তো বিনা কষ্টে সঠিক জায়গায় পৌঁছেছ তবে।”
মধু হাসি মুখে বলল,,” জি ভাইয়া। এখানে তিন্নি কে পেয়ে কি পরিমাণ খুশি হয়েছি বুঝাতে পারব না।”

” তা বাসায় কবে ফিরে যাবে?”
” বাবার মাথা থেকে বিয়ের ভূত না যাওয়া অবধি বাসায় ফিরব না।”
একটা দুইটা কথা বলল সবাই মধু হাসি মুখে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল। মধু এদিক ওদিক তাকিয়ে সকাল থেকে ফুয়াদ কে খুঁজে যাচ্ছে। সেই যে রাতে বের হলো চোরের মতো বাসা থেকে লোকটা কি আর ফিরে নি? লাঞ্চ শেষে মধু সমুদ্র পেছনে পেছনে এল। সবার আড়ালে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,,” আপনার ভাই বাসায় ফিরে নাই?”
সমুদ্র কপাল কুঁচকে তাকাল মধুর দিকে। মধু থতমত খেয়ে গেল। এভাবে তাকাল কেন?

” না মানে আসলে সকাল থেকে দেখছি না তো তাই।”
” ফিরেছে‌। ও ঘুমে আছে সন্ধ্যার আগে ওর পাত্তা, দেখা কিছুই পাবে না। ”
” আমি উনার পাত্তা পাওয়ার জন্য বসে নাই।” ঝাঁঝালো গলায় বলল মধু।
সমুদ্র বোকা কন্ঠে বলল,,” তাহলে ছোটো কে খোঁজ কেন?”
” রাতে চোরের মতো যেতে দেখলাম তাই তাকে নিয়ে কৌতুহল হলো!”
সমুদ্র ওহ বলে সোফায় বসল।
মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,” বসো।”

মধু বসল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল,” উনি কিসের জব করে?”
” আচ্ছা তুমি বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে কেন এলে? বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?”
মধু উত্তর না পেয়ে এমনিতেই রেগে গেছে। তারপর উপর পাল্টা প্রশ্ন শুনে রেগে গেল।
” আপনি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন কেন?”
সমুদ্র মধুর কোঁকড়ানো খোলা চুলের দিকে তাকিয়ে বলল,,” তোমার চুল এতো আঁকাবাঁকা কেন?”

প্রেয়সী পর্ব ৩

” মানে?”
” মানে তোমার চোখ দুটো সুন্দর।”
মধু থপ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর রাগে কটমট করে চলে গেল। সমুদ্র মধুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে র‌ইল। কোঁকড়ানো চুল গুলো হাঁটার তালে দুল খাচ্ছে। সমুদ্র পিঠে ছাড়ানোর চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মধু রাগী চোখে ওর দিকে পেছন ঘুরে তাকাল। চোখ দিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র মধুর রাগ দেখে হাহাহা করে হেসে উঠল‌।

প্রেয়সী পর্ব ৫