ফাঁদের অন্তরালে গল্পের লিংক || আবীর হোসেন।

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ১
লেখকঃ আবীর হোসেন।

পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবনীর পেট বরাবর লা*থি মারতেই চেয়ার সহ ফ্লোরে পড়ে গেল। সামনে দাড়ানো কিডন্যাপার একটা ধারালো ছু*রি বের করে অবনীর গলায় ধরে বললো– দেখ তোর জন্য সত্যি ভীষণ মায়া হয়, তোর পেটেও আরেকটা জীবন। মিস্টার আয়ানের কথা মেনে নে একদম, এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যা, তাহলে তোকে ছেড়ে দেই। নয়তো দুটো জীবনের কোরবানি হয়ে যাবে আজকেই।

ফ্লোরে পড়ে অবনীর কপালের পাশে কে*টে গিয়ে রক্ত*ক্ষর*ণ হচ্ছে। অবনী ভাবছে তাহলে কি এসব আয়ানের কাজ, আয়ান গুন্ডা লাগিয়েছে অবনী ও তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে! এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অবনীর। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অবনীর কয়েকদিন আগের কথা মনে পড়লো, সেদিন হুটকরে আয়ান অফিস থেকে বাসায় ফেরে, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
তারপর আয়ানকে জড়িয়ে ধরে অবনী বলে–আয়ান আমার গর্ভে তোমার সন্তান, তুমি আমাকে অস্বীকার করছো মানে তুমি তোমার সন্তানকেও অস্বীকার করছো। তোমার সন্তানের কথা ভেবে হলেও এবার অন্তত আমাদের বিষয়টা সবার সামনে আনা উচিৎ। এরকম লুকোচুরি আর ভালো লাগেনা।

ধাক্কা দিয়ে অবনীকে সরিয়ে দিয়ে আয়ান বললো– এসব ন্যাকামি দেখবার সময় আমার একদম নেই অবনী, এ শহরে দশজন ইয়াং বিজনেস ম্যানদের মধ্যে আমিও একজন। শুরুতেই তোমাকে বলেছিলাম গর্ভপাত করিয়ে নিতে কিন্তু তুমি শুনলে না। আর হ্যা এই বিষয় নিয়ে যদি তুমি বাড়াবাড়ি করো তাহলে আমি সোজা বলে দিবো তোমার গর্ভের সন্তান আমার নয়, তখন তুমি নিজেই বিপাকে পড়বে। যদি মনে করো থানা পুলিশের দ্বারস্থ হবে তাহলে জেনে রাখো টাকার ওপরে কিছুই নেই। সবখানে তুমি হেরে যাবে।
অবনীর চোখে জল টলমল করছে।

পকেট থেকে একটা চেকবই বের করে সিগনেচার করা একটা ফাকা পৃষ্ঠা ছিড়ে অবনীর দিকে বাড়িয়ে ধরে আয়ান বললো– যত টাকা লাগে টাকার অংকটা বসিয়ে নাও। তবুও আমাকে এসব থেকে মুক্তি দাও প্লিজ।
জল টলমল চোখের জল মুছে কান্না জড়িত কন্ঠে অবনী বললো– এত এত টাকার মালিক তুমি যে টাকার নিচে সবটুকু আবেগ ও ভালোবাসা চাপা পড়ে গেছে। টাকা দিয়ে যদি তোমার সংসার করার সুখটা কিনতে পারতাম তবে টাকাই নিতাম।

টাকা দিয়ে যদি তোমার একটু কেয়ার, ভালোবাসা কেনা যেত তবে টাকা নিতাম। টাকার বিনিময়ে যদি আমার গর্ভের সন্তানের প্রতি তোমার স্নেহ মায়া ভালোবাসা কিনতে পারতাম তবে টাকাই নিতাম। এসব তো আর টাকা দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়, তাই টাকা তোমার কাছেই রেখে দাও, আমার দরকার নেই আয়ান।

আয়ান আর কোনোকথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে প্রাইভেটকারে উঠে চলে গেল। ব্যালকনিতে দাড়িয়ে অবনী স্পষ্টই দেখতে পেল গাড়িতে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে মারিয়া বসা ছিল আগে থেকেই।
মারিয়া মেয়েটা আয়ানের কোম্পানিতে চিপ একাউন্টিং ম্যানেজার পদে জয়েন করার পরে থেকেই আয়ান ধীরে ধীরে কেমন বদলে যেতে শুরু করে।

অথচ এই আয়ান একসময় রাতদিন অবনীর পেছনে পড়ে থাকতো অবনীর মন পাবার জন্য।
অবনীর মা-বাবা অবনীর বয়স যখন সাত বছর তখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আর তখন থেকেই অবনী তার নানা বাড়িতে থাকে। অবনীর নানার বিল্ডিং এর পাশের বিল্ডিংটা আয়ানদের। যেতে আসতে চোখে চোখ পড়তে পড়তে একসময় অবনীকে ভালো লেগে যায় আয়ানের।

ছোটবেলা থেকেই অবনী দেখতে যেমন সুন্দরী, মেজাজে তেমন চড়া, আর ঠোঁটকাটা স্বভাবের।
একদিন বাসার সামনে দাড়িয়ে ঝালমুড়িঅলার গাড়ির সামনে দাড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলো অবনী ও তার বান্ধবীরা।
আয়ান বাইকে করে অবনীদের ক্রস করে যাবার সময় পেছনের চাকা রাস্তার পেজ উঠে গর্ত হওয়া যায়গায় পড়ে যেখানে পানি জমে ছিল। চাকা সেই গর্তে পড়তেই নোংরা পানি ছিটকে এসে পড়লো অবনীর ফুচকার প্লেটে, ব্যস অবনীর মস্তিষ্কে মেজাজের বিস্ফোরণ।

আয়ান বাইক থামিয়ে মিষ্টি হেসে বললো– স্যরি ম্যাডাম।
অবনী দৌড়ে গিয়ে চুলের ক্লিপ খুলে বাইকের পেছনের চাকায় ঢুকিয়ে পাংচার করে উঠে দাড়িয়ে বললো– আমিও ভেরি স্যরি।
আয়ান ভীষণ অবাক হয়ে বললো– এটা কি হলো!

– এটা উচিৎ শিক্ষা দেয়া হলো, বাইকে চেপে বসলে দুনিয়ার আর কিছু খেয়াল থাকেনা তাইনা? রাস্তার এতবড় গর্তটা চোখে পড়েনি?– দাঁত কটমট করে অবনী বললো।
– ম্যাডাম পনেরো টাকার ফুচকার জন্য আমার পাঁচ হাজার টাকার টায়ার লিক করাটা কিন্তু একদম ঠিক হয়নি।
– আচ্ছা! কিন্তু আমার কাছে ঐ পনেরো টাকার ফুচকা পাঁচ লাখ টাকার সমান, মেয়েদের ফুচকা প্রেমের প্রতি কোনো ধারণা আছে আপনার? প্লেটে সবকিছু পরিমান মতোই ছিল আপনাকে নোংরা পানি ছিটিয়ে ঝোল বাড়িয়ে দিতে বলেনি কেউ।
ঝোলের কথা শুনে আয়ান হেসে ফেললো।

আয়ানকে হাসতে দেখে অবনী বললো– দাঁত ভেঙে হাতে ধরিয়ে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিলেই হাসি গায়েব হয়ে যাবে একদম। এর পর থেকে দেখেশুনে রাস্তায় গাড়ি চালাবেন মিস্টার।
আয়ান দাঁত বের করে হেসেই আছে, আর আনমনে অবনীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতার গভীরে ডুবছে।
অবনীর সোজাসাপটা কথা, চঞ্চলতা সবকিছুই ভীষণ ভালোলেগে যায় আয়ানের।
এরপর থেকে দীর্ঘ তিনটি বছর অবনীর পেছনে লাইন মেরে অবনীর মন পায় আয়ান। কত কি না করেছে আয়ান সেই তিন বছরে।

আসলে অবনী যেমন সুন্দরী তেমন বুদ্ধিমতী। ধীরে ধীরে আয়ানকে ভালো লাগতে শুরু করলেও অবনী তখন প্রকাশ করেনি। অবনী দেখছিল সে কোনো সাড়া না দেয়ায় মাঝপথে আয়ান বিরক্ত হয়ে ছেড়ে যায় কিনা। যদি কেউ কাউকে মন থেকে চায়, ভালোবাসে, সে কখনও বিরক্ত হয়ে ছেড়ে যায়না। আয়ান তাই করেছিল বিরক্ত না হয়ে টানা তিন বছর লেগেছিল। এবং শেষমেশ অবনী রাজি হয়ে গেল।

তা-ও অবনী বলেছিল আগে বিয়ে তারপর প্রেম। আয়ান তাতেও রাজি হয় কিন্তু একটা অনুরোধ করে অবনীকে যে– বিয়ে হবে কিন্তু আয়ানের বাবার বিজনেস এর দায়িত্ব যতদিন আয়ানকে না দেয়া হয় ততদিন গোপন রাখতে হবে সবকিছু। কারণ আয়ানের বাবা আয়ানের জন্য তার বন্ধুর মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে। আয়ান এভাবে অন্য কাউকে চুপচাপ বিয়ে করে নিয়েছে শুনলে আয়ানের বাবা আয়ানকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে এবং সবকিছু থেকে বঞ্চিত করবে। আয়ানের বাবা ভীষণ রাগী এবং বদমেজাজী।

এই তিন বছরে আয়ান প্রমাণ করেছে সে অবনীকে কতখানি চায় এবং ভালোবাসে। তাই অবনী আয়ানের অনুরোধ রাখে এবং দুজনের কোর্ট ম্যারেজ হয়।
সেই আয়ানের হঠাৎ করে এরকম বদলে যাওয়া সত্যিই অবিশ্বাস্য এবং অপ্রত্যাশিত।
ফ্লোর অবনীর রক্তে লাল হয়ে আছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হবার কারণে মাথা ও শরীর ঝিমঝিম করছে। আধখোলা চোখে ঝাপসা দৃষ্টিতে পৃথিবীর ভয়ঙ্কর এবং অসহায় রূপ দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

নাহ এত সহজে হেরে গেলে চলবে না, নিজের সন্তানকে পৃথিবী আলো দেখানোর আগেই অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবেনা। একজন মা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো যোদ্ধা। অবনী ভাবলো যেভাবেই হোক বেঁচে ফিরতেই হবে।
পরিস্থিতি যত কঠিন তত দ্রুত বুদ্ধি দিয়ে খাপ খাইয়ে নিয়ে পারলেই পরিস্থিতি সামলে নেয়া সম্ভব। চালাকের সঙ্গে চালাকি, ধুরন্ধরের সঙ্গে ধুরন্ধরী করতে না পারলে বেঁচে থাকা কঠিন বর্তমান যুগে।
অবনী ভাঙা ভাঙা গলায় কিডন্যাপারকে বললো– আপনি আমাকে খু*ন করলে ঠিক কত টাকা পাবেন?
কিডন্যাপার অবাক হয়ে বললো– কেন মরার আগে নিজের এবং সন্তানের প্রানের দামটা জানতে ইচ্ছে করছে?
অবনী বললো– বলুন কত টাকা?

: দশ লাখ টাকায় কন্ট্রাক্ট নিয়েছি।
: আমি যদি আপনাকে বিশ লাখ দেই তাহলে আমাকে যেতে দেবেন তো? আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। দরকার হলে অনেক দূরে চলে যাবো।

বিশ লাখ টাকার কথা শুনে চেয়ার সহ অবনীকে টেনে তুলে সোজা করে বসিয়ে কিডন্যাপার বললো– দ্যাখ চালাকি করে কিন্তু এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না। তুই এখন একটা বিল্ডিং এর পাঁচ তলায় আছিস, নিচে অসংখ্য গুন্ডারা পাহারায় আছে। আমার মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে ওদের সবাইকে নিয়ে একটা গ্রুপ খোলা আছে। একটা মেসেজ দিলেই সবাই এসে তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। সুতরাং সাবধান।

অবনী জানে অবনী যে প্ল্যান করেছে সেটা সাকসেসফুল না হলে পেটের সন্তান সহ নিজে এই কিডন্যাপারের হাতে প্রান হারাবে। তবে বাঁচার জন্য প্রাণ বাজি রেখে কিছু তো একটা করতেই হবে…

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ২