ফেরারি প্রেম পর্ব ৪২

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪২
নিশাত জাহান নিশি

রূপলের সাথে তর্কে জড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলোনা নীহারিকার! ফট করে সে কলটি কেটে দিলো। শুধু তাই নয় হোয়াটসঅ্যাপ থেকেও রূপলকে ব্লক করে দিলো!
নীহারিকা কলটি কেটে দেওয়ার সাথে সাথেই রূপল স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো! পরমুহূর্তেই সেই নাজুক হাসি থামিয়ে সে চেহারায় দুষ্টু ভাব এনে ব্যগ্র হেসে বলল,

“ইয়েস, ক্ষেপে গেছে ক্ষেপিটা! নিশ্চয়ই এখন সাপের মত ফনা তুলছে! আরও একটু রাগিয়ে দিই!”
নীহারিকাকে পুনরায় ক্ষেপানোর জন্য রূপল যখন আবারও নীহারিকার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে কল করতে গেল তখনি খেয়াল করল নীহারিকা তাকে অলরেডি হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ব্লক করে দিয়েছে। ফুরফুরা মেজাজ মুহূর্তেই রগচটা হয়ে উঠল রূপলের! চোখ দুটিতে অসম্ভব ক্ষোভের ছায়া নেমে এলো। কপালেও ভাজ পরে গেল তার। দাঁত কিড়মিড়িয়ে সে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হোয়াট? সি ব্লকড মি! এত বড়ো সাহস তার?”
এই বলে রূপল তার অন্য সিমটি দিয়ে নীহারিকার নাম্বারে ননস্টপ কল করতে লাগল। নীহারিকাও রাগে ফোঁসফোঁস করে কলটি কাটছিল! কল ঢুকার সাথে সাথেই সে কলটি কেটে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন সে ওঁৎ পেতে ছিল কখন কলটি আসবে আর সে ছোঁত করে কেটে দিবে।

এতে করে রূপল পূর্বের তুলনায় আরও বেশী ক্ষেপে গেল। ফোনটি পাশে রেখে সে গড়গড় করে লেবুর শরবতটুকু খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। তবে মুখ থেকে সেই শরবতটুকু ফেলে দিতেও তার সময় লাগলনা! অতিরিক্ত লবণ কটা হয়ে গেছে শরবতটি। মুখে তুলবার মত নয়! মুখটিকে খরতরভাবে কুঁচকে রূপল বমি করার মত ভাব নিলো। অসহনীয় গলায় বলল,
“ওয়াক। ক্ষেপিটার অভিশাপ লেগেছে হয়ত! নিশ্চয়ই বসে বসে আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। আমাকে ব্লক করা তাইনা? আজ তার একদিন কী আমার একদিন!”

বলেই রূপল হনহনিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে তার বেডরুমে চলে গেল। গিয়ে দেখল হৃদি তার রুমে নেই। ড্রইংরুমের দিকে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখল হৃদি তার দাদুর সাথে বসে পুতুল নিয়ে খেলা করছে। পুনরায় রুমে ফিরে এসে রূপল গাঢ় নীল রঙের শার্টটি পরে অগোছালো অবস্থায় রুম থেকে বের হয়ে গেল। রূপলের প্রতি রেগে আছেন বিধায় নাজনীন বেগম জানতে চাইলেন না রূপল কোথায় যাচ্ছে! বরং রূপলকে দেখে তিনি মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন। মায়ের রাগ বুঝতে পেরে রূপল যেতে যেতে তার মা লক্ষ্য করে বলল,

“আমি একটু আসছি মা। এলাকার মধ্যেই থাকব।”
প্রত্যত্তুরে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না নাজনীন বেগম। মুখটা কেবল ফুলিয়ে রাখলেন। রূপলও তার মাকে আর ঘাটালো না। কারণ সে পরিস্থিতি বিগড়াতে চাইলনা। বাইক নিয়ে শো শো বেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে। তখন চারিদিকে মাগরিবের আযানও পরে গেল। একটু পরেই সন্ধ্যে সাতটা বেজে যাবে। এই মোক্ষম সুযোগ নীহারিকাকে ধরার! কারণ রূপল জানে সন্ধ্যা সাতটায় নীহারিকা তার টিউশনিতে যায়!

আর নীহারিকা কোথায় টিউশনি করায় তা ভালোভাবেই জানা আছে তার। সরাসরি বাড়িতে গিয়ে নীহারিকাকে ধরাটা উচিৎ হবে বলে মনে হলোনা রূপলের! এতে বাড়ির লোকজন তাকে এবং নীহারিকাকে অসঙ্গত কারণে ভুল বুঝতে পারে। বোনের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বোনের সম্মান নষ্ট করতে চায়না সে।

ফ্রেশ হয়ে নীহারিকা তার টিউশনির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। রূপলের বিষয়টা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। ব্লক করতে পেরেছে এতেই সে শান্তি। তাই রূপলের অপমানও তার তেমন গাঁয়ে লাগছেনা। রাস্তায় বের হতেই একটি খালি রিকশা পেয়ে গেল নীহারিকা। গাড়িটিতে ওঠে বসল সে। মিনিট দশের মধ্যেই নীহারিকা তার ছাত্রীর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালো। গাড়িভাড়া চুকিয়ে সে বাড়ির গেইটের ভেতরে ঢুকার পূর্বেই হঠাৎ যেন রূপল কোথা থেকে দৌড়ে এসে গেইটের সামনে দাড়িয়ে নীহারিকাকে আটকে দিলো! অকস্মাৎ রূপলকে দেখে যেন চোখ দুটি কপালে ওঠে গেল নীহারিকার! মুখটা হা করে সে বিস্মিত গলায় রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই? আপনি এখানে?”
মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া বের করে রূপল দ্রুত দু-হাত দিয়ে ধোঁয়াগুলো সরিয়ে দিলো। বাঁ পাশের ভ্রুটি উঁচিয়ে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। ডানপিটে গলায় শুধালো,
“কেন? ভয় পাচ্ছেন? ভেবেছেন সিক্স প্যাক দেখাতে এসেছি? দেখবেন সিক্স প্যাক? দেখাব?”
রূপলের কথা শুনে দু-কদম পিছিয়ে গেল নীহারিকা। চোখেমুখে রূপলের হিংস্রতা ফুটে উঠছিল। এই প্রথম রূপলকে দেখে নীহারিকা সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেল। শুকনো ঢোঁক গিলতে সে বাধ্য হলো। আমতা আমতা গলায় বলল,

“মামামানে? কীকী বলছেন আপনি?”
নীহারিকা যত পিছিয়ে যেতে লাগল রূপল ততই নীহারিকার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল! আঙুল উঁচিয়ে রূপল সূচালো দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। তেজী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমাকে ব্লক করলেন কেন? কোন সাহসে আপনি আমাকে ব্লক করেন? হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস?”

যদিও নীহারিকা রূপলের ব্যবহার আচরণে ভয় পাচ্ছিল তবুও সে হিম্মত রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করল। বিপদে ঘাবড়ে গেলে বিরোধী দল আরও শক্তি যুগিঢে বসে। তাই ফট করে সে জায়গায় দাড়িয়ে গেল! উল্টো রূপলের দিকে এগিয়ে এসে সে রূপলের একদম মুখোমুখি দাড়ালো। সোজাসাপটা গলায় বলল,

“বেশ করেছি ব্লক করেছি! প্রয়োজনে নতুন সিমটা থেকেও ব্লক করব! আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেই আমি ব্লক করব। এবার আপনি যেই হোন না কেন আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার!”
রাগ সংযত করতে পারলনা রূপল! তার মুখে মুখে কেউ কথা বলুক তা মোটেও পছন্দ নয় তার। দাঁতে দাঁত চেপে সে ঝাঁজালো গলায় নীহারিকাকে বলল,

“ব্লকটা খুলুন বলছি।”
ঘাড়ত্যাড়ামো করে নীহারিকা বলল,
“না খুলব না!”
রূপল পুনরায় জেদ দেখিয়ে বলল,
“খুলুন বলছি।”
গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে নীহারিকা তার সামনে পরে থাকা চুলগুলি পেছনের দিকে সরিয়ে নিলো। বুকে হাত গুজে এক রোঁখা গলায় বলল,

“খুলব না। এবার আপনি যা ইচ্ছা তা করুন। আমার দেখার বিষয় না।”
শেষবারের মত রূপল নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,
“খুলবেন না তাই তো?”
নীহারিকা তার সিদ্ধান্তে অটল রইল। একগুঁয়ে ভাব নিয়ে বলল,
“না না না। খুলব না। এক কথা আর কত বার বলব?”
“ওকে। এবার আমি যা করব তার জন্য কিন্তু আমি দায়ী থাকব না!”

বলেই রূপল এদিক সেদিক তাকালো। কেউ তাদের দেখছে কী-না তা খেয়াল করল! সুযোগ বুঝে রূপল অবিশ্বাস্যভাবেই নীহারিকার বাঁ গালে টুপ করে চুমু খেয়ে দিলো! রাগে গজগজ করে সে নীহারিকার সামনে থেকে প্রস্থান নিলো! যেতে যেতে তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকা নীহারিকাকে শিথিল গলায় হুমকি দিয়ে বলল,
“আজ থেকে আপনার ঘুম হারাম করার দায়িত্ব আমার! চাইলেও আপনি আমার এই প্রতিশোধ ভুলতে পারবেন না! আমার স্পর্শ ভুলতে পারবেন না। আমি সবসময় আপনার গালে লেগে থাকব! আমাকে উপেক্ষা করা আপনার প্রিয় অসুখ হয়ে দাঁড়াবে।”

পিছু ঘুরে রুপলের দিকে ফিরে তাকানোরও পরিস্থিতিতে রইলনা নীহারিকা! নিস্তব্ধতায় মূর্তমানবী হয়ে রইল৷ কী থেকে কী হয়ে গেল? সব তার মাথার উপর দিয়ে গেল। আদৌতেই কী তার সাথে কল্পনার অতীত কোনো ঘটনা ঘটে গেল? যা তার ভাবনার বাইরে ছিল? রূপল এতক্ষণে বাইক স্টার্ট করে দিলো। নীহারিকার উপর জমে থাকা সমস্ত রাগ সে বাইকের উপর ঝাড়ল! দু-চোখ যেখানে যায় সেখানে হারিয়ে গেল। রেগে গেলে সে নিজেকেই ভয় পেয়ে যায়! হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

পড়ানো বাদ দিয়ে নীহারিকা উল্টো পথে হাঁটা ধরল! তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাল থেকে হাত তার কিছুতেই সরছিল না। নির্বাক, হতবাক, স্তব্ধ সে। এই প্রথম কোনো পুরুষ তার গালে স্পর্শ করল। তাও আবার এত গাঢ় গভীর সেই স্পর্শ! সে চাইলেও যে স্পর্শের কথা ভুলতে পারবেনা।

এই অদ্ভুত স্পর্শটি তার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে মিশে থাকবে। উদাসীন ভাবে নীহারিকা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। অমনি মনে হলো সে কারো সাথে একটা ধাক্কা খেলো। হালকা ব্যথা পেলেও সে কোনো উহ্ আহ্ শব্দ করলনা। তেমন কোনো অনুভূতিই হলো না। নীহারিকার সাথে ধাক্কা খাওয়া ব্যক্তিটি বিনিময়ে নীহারিকাকে সরি ও বলল। সেদিকে ফিরেও তাকালো না নীহারিকা। নিজের খেয়ালে ব্যস্ত থেকে সে ইট’স ওকে বলে চলে এলো।

রাত আটটায় বাড়ি ফিরে এলো নীহারিকা। অমনোযোগী হয়ে সে বাড়ির ড্রইংরুমে প্রবেশ করল। সবকিছু থেকে অবিচ্ছিন্ন ভাব তার। ফোনে মারজিনা বেগম তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলছিলেন। নীহারিকাকে দেখা মাত্রই তিনি কলটি কেটে নীহারিকার দিকে এগিয়ে এলেন। প্রফুল্ল গলায় বললেন,

“একটা গুড নিউজ আছে।”
গাল থেকে হাত সরিয়ে নীহারিকা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকালো। অনুভূতিশূণ্য হয়ে শুধালো,
“কী নিউজ?’
“আসছে শুক্রবার নিহাল আর পিয়াসার রিসিপশন!”
“বিয়ে তো সেই কবেই হয়ে গেল মা। এখন আবার রিসিপশন কেন?”

“আর বলিসনা তো। আত্নীয়-স্বজনরা খেয়ে ফেলছে আমাকে। নিহালের বিয়েতেও তাদের দাওয়াত করিনি। রিসিপশনটাও করলাম না। তাদের কী বিয়ের দাওয়াত খেতে মন চায়না? সবক্ষেত্রে কিপ্টেমি মানায় না। হেনতেন বলছিল। তাই ভাবলাম রিসিপশনটা এবার করেই ফেলি। সবাই মিলে একটা গেট টুগেদার হবে। হৈ-হুল্লোড় হবে। কী বলিস তুই?”
“ভাইয়া আর ভাবি এই ব্যাপারে কিছু জানে?”

“হ্যাঁ। ইঙ্গিত দিয়েছিলাম অবশ্য। নিহাল অফিস থেকে ফিরলে এই বিষয়ে সরাসরি আলোচনা হবে। তার শ্বশুর বাড়িতেও তো খবরটা পাঠাতে হবে। তাদেরও তো একটা প্রস্তুতি আছে।”
“যা ভালো মনে করো তাই করো মা। তবে রিসিপশনটা হলে ভালো হবে! আত্নীয় স্বজনরা সবাই একসাথে হওয়া যাবে।”
এই বলে নীহারিকা তার রুমে চলে গেল। মারজিনা বেগম অবাক হয়ে নীহারিকার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন। চুপচাপ নীহারিকাকে তিনি সত্যিই অবাক হলেন। চিন্তিত গলায় মিনমিনিয়ে বললেন,
“কী হলো মেয়েটার? চুপচাপ মনে হলো না?”

রাত এগারোটা বেজে যাওয়ার পরেও নীহারিকাকে ঘুম থেকে জাগানো যাচ্ছিলনা! মনে হচ্ছিল যেন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে সে। নীহারিকাকে ডাকতে ডাকতে নিহাল এবং মারজিনা বেগম উভয়ই ক্লান্ত হয়ে গেলেন। বিষয়টায় বেশ ভয় পেয়ে গেল নিহাল। তবে তার মাকে তা বুঝালো না। এতে খামোখা টেনশন করবেন তিনি। চুপিসারে নিহাল যদিও নীহারিকার শ্বাস প্রশ্বাস চেইক করে দেখল শ্বাস নিশ্বাস পরছিল তবে নীহারিকার কোনো নড়াচড়া বা ঘুম ভেঙে ওঠার কোনো সম্ভাবনা দেখছিল না সে! আর তখনই সে আরও বেশী ঘাবড়ে গেল! তাড়াহুড়ো করে সে পানি ছিটাতে লাগল নীহারিকার চোখেমুখে।

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪১

এক পর্যায়ে নীহারিকা ঘুম ভেঙে উঠল। চোখ খুলে নীহারিকা সামনে তাকাতেই নিহাল এবং মারজিনা বেগম ভয়ে পেয়ে গেলেন। কারণ, চোখ দুটি তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে! যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে চোখ থেকে। নেশাখোরদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা তাকে!

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪৩