বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৫

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৫
দিশা মনি

আলো জোনাকির সাথে গাড়িতে করে তার ভার্সিটির উদ্দ্যেশ্যে যাচ্ছিল। নতুন পরিবেশে কিভাবে মানিয়ে নেবে সেই নিয়ে অনেক ভয় হচ্ছে আলোর। জোনাকি আলোকে বলে,

‘এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই৷ গিয়ে দেখ সব ঠিক হবে। কত বন্ধু হবে তোর।’
‘হয়তোবা।’
ড্রাইভার মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামায়। আলো জিজ্ঞেস করে,
‘কি হলো এখানে গাড়ি থামালেন কেন?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘গাড়ির মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে। গাড়িটা ঠিক করতে সময় লাগবে। আপনাদের তো তাড়া আছে। আমি দেখছি কি করা যায়।’
ড্রাইভার একটি রিক্সা ডেকে আনেন। জোনাকি এবং আলো সেই রিক্সাতে উঠে পড়ে।
রিক্সায় কিছুদূর যাওয়ার পর জ্যামে তাদের গাড়ি আটকে যায়৷ আলো খুব বিরক্ত হয় এতে। ভার্সিটির সময় হয়ে আসছিল। রিক্সাওয়ালা বলেন,

‘এখানে ভিড় তো মনে হয় সহজে থামবে না। আপনারা ফুটপাত ধরে ১০ মিনিট এগিয়ে গেলেই ভার্সিটিতে পৌছে যাবেন।’
আলো আর জোনাকি রিক্সা থেকে নেমে যায়। ফুটপাত ধরে হাটতে থাকে। রাস্তার অপর পাশে যাওয়ার সময় আচমকা একটি গাড়ি আলোদের সামনে চলে আসে। অল্পর জন্য তারা বেচে যায়। আলো রেগেমেগে বলে,

‘চোখে দেখতে পারেন না। রাস্তায় এরকম উন্মা’দের মতো গাড়ি চালাচ্ছিলেন কেন? আপু তুমি ঠিক আছো তো?’
আলোর কথা শুনে গাড়ি থেকে নেমে আসে একজন যুবক। তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছে। কালো ফ্রেমের চশমাটা খুলে যুবক বলে,

‘রাস্তা পারাপারের নিয়ম না জানলে আসো কেন? যতসব গেয়ো ভূত।’
কথাটা শুনে আলো খুব রেগে যায়। যুবকটির দিকে না তাকিয়েই বলে,
‘আপনাদের মতো মানুষ যারা কাউকে সম্মান দিতে পারে না তাদের আর কি বলব। আমরা যদি আজ ম’রে যেতাম তাও আপনার কিছু যায় আসতো না। আমরা কোন ঝামেলা চাইনা আপনি চলে যান।’

যুবকটি এক হাজার টাকার একটি নোট ছু’ড়ে দিয়ে চলে যায়। আলো রা’গে ফুসতে থাকে।
‘তুই লোকটাকে দেখেছিস আপু? তোর পায়ে ব্যাথা লেগেছে জন্য আমি একটু দেখছিলাম তাই লোকটার দিকে খেয়াল করি নি। যদি দেখতে পেতাম তাহলে চেহারাটা মনে রেখে দিতাম। কোনদিন দেখা হলে,,,’

‘আচ্ছা বাদ দে। এই শহরে এত মানুষের মধ্যে ওনাকে আর কিভাবে খুজে পাবি। চল এখন।’
‘এই হাজার টাকার নোটটা আমি নিচ্ছি। যদি কোনদিন ওনার দেখা পাই তাহলে মুখের উপর ছু’ড়ে মা’রব। কি ভেবেছেন উনি টাকা আছে জন্য যা খুশি করবে।’

আলো এখন ভার্সিটিতে নিজের ক্লাসে এসে বসেছে। জোনাকি তাকে পৌছে দিয়েই চলে গেছে। আলো সেখানে বসে আপনমনে কিছু ভাবছিল। আচমকা একটা মেয়ে এসে তার পাশে বসে। আলোর নজর যায় মেয়েটার দিকে। মেয়েটার পোশাকে আধুনিকতার ছোয়া। জিনস আর টপস পড়ে এসেছে।
মেয়েটা আলোর দিকে একবার অদ্ভুতভাবে তাকায়। আলো সাধারণ একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছে।
মেয়েটি আলোকে ভালো করে পরখ করে বলে,

‘তোমার নাম কি? তোমাকে নতুন মনে হচ্ছে। তোমার ড্রেসসেন্স এত ব্যাকডেটেড কেন?’
আলোর খুব খারাপ লাগে মেয়েটির কথা শুনে।
‘আমার নাম আলো। হ্যা আমি নতুন। আমার শালীন পোশাক পড়তেই ভালো লাগে।’
আলোর র’গচটা উত্তরটা মেয়েটার ঠিক হজম হয়না। মেয়েটা বিড়বিড় করে বলে,

‘আমি রুহি বনানী। এই ভার্সিটির সবথেকে স্টাইলিশ আর আধুনিক মেয়ে। আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে।’
আলো রুহির কথা ইগনোর করে। রুহির খুব মানে লাগে। এই ভার্সিটির সবাই তাকে মাথায় তুলে রাখে। অথচ এই মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিচ্ছেনা।
রুহি এটেনশন পাওয়ার জন্য বলে,

‘তুমি তো এখানে নতুন তাই জানো না। আমাদের এখানে ইংলিশ লেকচারার কে জানো? একটু পরই তার ক্লাস। স্যারকে দেখে ক্রাশ খেয়ে যেতে পারো। সব মেয়েরাই তাকে দেখে ক্রাশ হয়। তবে আমি সিউর উনি আমারই হবেন।’
আলো নিরুত্তর। আলোকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে রুহির এবার খুব রাগ হয়৷ সে আলোর কানের কাছে গিয়ে চি’ৎকার করে বলে,

‘তুমি কি বোবা? কথা বলতে পারো না।’
‘আমি কথা বলতে পারি। অযথা কথা বলি না রুহি বনানী।’
রুহি এবার মনে মনে বলে,

‘এই মেয়েকে তো আমি,,,,আমাকে এটিটিউড দেখাচ্ছে তো। আমি দেখব এই মেয়ের এত এটিটিউড কোথায় থাকে।’
ধীরে ধীরে ক্লাসে সবাই আসতে থাকে। সবার শেষে হাফাতে হাফাতে একটি মেয়ে আসে। মেয়েটিকে দেখে রুহি মুখ বাকিয়ে বলে,

‘জানো আলো এই মেয়েটার নাম লতা। মেয়েটাকে দেখো একবার কি কালো। মেয়েটার গা থেকেও ঘামের দূর্গন্ধ আসে। প্রতিদিন এরকম লেইট করে আসে।’
এবার আর আলো চুপ থাকেনা।
‘কারো সম্পর্কে এরকম কথা বলা ঠিক নয়। সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখে মন তার মন মানসিকতা দেখে বিচার করা উচিৎ।’

রুহি বনানী চুপ হয়ে যায়। প্রথম প্রথম মেয়েটার উপর রাগ হলেও এখন কিরকমটা লাগছে। মেয়েটাকে তার খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। রুহি ভাবে, এই মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। মেয়েটাকে আমার অন্যরকম মনে হচ্ছে।
একটু পরই ইংলিশ লেকচারার ক্লাসে প্রবেশ করেন।

তাকে দেখেই সব মেয়েরা পুরো ফিদা হয়ে যায়। টকটকে ফর্সা, কালো ফ্রেমের চশমার মধ্য দিয়ে সুন্দর চোখদুটো দেখে যে কেউই ক্রাশ খাবে। ক্লাসে প্রবেশ করেই সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন তিনি। তার নজর যায় আলোর দিকেও। আলোকে দেখেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

‘আরে এটা তো সেই মেয়ে যে রাস্তায় আমার গাড়ির সামনে চলে এসেছিল। আমাকে কতকিছু বলল। মেয়েটা এই ভার্সিটিতে পড়ে। আগে তো দেখিনি। জরিনা খালা যেই মেয়েটার কথা বলল এটা কি সেই মেয়ে নাকি।’
আলো তাকায় তার চোখের দিকে। চোখদুটোর মধ্যেই যেন হারিয়ে যায়। মুখ ফুটে আনমনে বলে দেয়,
‘বর্ষ,,,’

জোনাকি আলোকে ভার্সিটিতে রেখে এসে এখন নিজেও চলে এসেছে তার কার্যালয়ে। চানাচুরের কোম্পানিতে জানাচ্ছি প্যাকেটজাত করার কাজ দেওয়া হয়েছে জোনাকি সহ আরো নতুন কিছু মেয়েদের।
জোনাকি নিজের কাজই করছিল তখন কোম্পানির ম্যানেজার এসে বলে,

‘আজ আমাদের কোম্পানির মালিক নিজে আসছেন পরিদর্শন করতে। এতদিন তিনি কিছু কাজে বিদেশে ছিলেন এখন দেশে ফিরেই সোজা চলে আসবেন। তোমাদের জানিয়ে দিলাম যাতে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারো। ওনার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে।’
সবাই বলে,
‘জ্বি স্যার’
১০ মিনিটের মধ্যেই ম্যানেজার এসে বলেন,
‘সবাই এদিকে দেখো স্যার নিজে এসেছেন সবকিছু দেখতে। উনি হলেন বর্ণ মাহমুদ। আরাম চানাচুর কোম্পানির মালিক।’

জোনাকি বর্ণ নামটা শুনেই কালকের কথা ভাবে। মালি বলছিল যে বর্ণ নাকি ফুলের ব্যাপারে খুব সৌখিন। বর্ণর দিকে তাকাতেই আলো আরো চমকে যায়। এটা তো সেই লোকটা যার গাড়ির সামনে সকালে তারা পড়েছিল। লোকটিকে দেখে জোনাকির খুব ভয় হয়। না জানি জোনাকিকে দেখে কিরকম প্রতিক্রিয়া করবেন তিনি।

বর্ণ চারপাশটা ভালো ভাবে দেখে। সবার সাথে কত সুন্দর করে কথা বলছিল সে। জোনাকি হতবাক হয়ে সব দেখতে থাকে। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না এই লোকটাই সকালে তাদের সাথে এত রুঢ় ব্যবহার করেছিল।
বর্ণর এবার নজর যায় জোনাকির দিকে। জোনাকি ভয়ে আঁটোসাটো হয়ে যায়। বর্ণ জোনাকির কাছে এসে বলে,
‘আপনার কি কোন সমস্যা হয়েছে? আপনার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোন বিষয়ে ভয় পেয়ে আছেন।’

‘আসলে,,, সকালের ঘটনা,,’
জোনাকি কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই ম্যানেজার বলে,
‘স্যার চলুন আপনাকে কিছু ফাইল চেক করতে হবে।’
বর্ণ জোনাকির হাতে পানির বোতল দিয়ে বলে,

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৪

‘এটা খেয়ে নিন। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কোন সমস্যা হলে নিঃসংকোচে বলতে পারেন।’
জোনাকি শুধু হা করে তাকিয়ে থাকে। বর্ণ কত সুন্দর কথা বলে! এই লোকটা কিভাবে সকালের ঐ রাগী লোকটা হতে পারে!

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৬