বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৬

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৬
দিশা মনি

আলো ক্লাসে চুপচাপ বসেছিল। পাশ থেকে রুহি বনানী বলে,
‘এই হলো আমাদের সবার ক্রাশ বর্ষ স্যার। দেখলে ওনাকে? কেমন লাগল?’
‘ভালোই।’

মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলল আলো। লজ্জায় এখন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। বর্ষ যে সুমনার ছেলে যে আলো জানে। বাড়িতে ছবি দেখেছিল তবে আজ সকালে বর্ষকে খেয়াল করেনি আলো। আলো খেয়াল না করলেও বর্ষ ঠিকই খেয়াল করেছে। বর্ষ তো আলোর দিকে বারবার আড়চোখে দেখছিল আর কিছু একটা ভাবছিল। রুহি বনানী আলোকে বলে,
‘জানতাম তুমিও আমাদের মতো স্যারের উপর ক্রাশ খাবেই। এটাই তো সাইন্স।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘এটা কোন সাইন্স না এটা ইংলিশ ক্লাস।’
বর্ষর ঝাঝালো গলা শুনে ক্লাসের সবাই চুপ হয়ে যায়। বর্ষ বলে,
‘রুহি বনানী আর তার পাশে যে নতুন মেয়েটা বসে আসো তোমরা খুব ডিস্টার্ব করছ। এভাবে ক্লাস করতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। তাই তোমাদের জন্য ক্লাসটা ভালো না লাগে তাহলে বাইরে যেতে পারো আর তা নাহলে চুপচাপ ক্লাস করো।’
‘সরি স্যার এই ভুল আর হবে না।’

রুহি বনানী সরি বললেও আলো কিছু বলে না। বর্ষ আলোর দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। রুহি বনানী ইশারা করে আলোকে বলে ক্ষমা চাইতে।
‘আমি তো কোন দো’ষ করিনি তাহলে ক্ষমা চাইব কেন। আমি ক্ষমা চাইবো না।’
আলোর কথা শুনে ক্লাসের সবাই হতবাক হয়ে যায়। আজ অব্দি বর্ষর মুখের উপর কেউ কথা বলে নি। বর্ষ খুব রেগে যায় আলোর উপর।

‘এই মেয়ে তোমার নাম কি?’
‘আলো।’
‘তুমি এক্ষুনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও।’
‘আমার অপরাধ জানতে পারি?’
‘আবার মুখের উপর কথা বলছ! যা বলছি চুপচাপ করো।’

আলোর সব ভালো লাগা মুহুর্তে রাগে পরিণত হয়। মনে মনে বর্ষকে অনেক গালি দিয়ে ক্লাস থেকে চলে আসে আলো। বিনা কারণে এভাবে শাস্তি পেতে কারই বা ভালো লাগে?

জোনাকি কোম্পানি থেকে বাড়ি আসে৷ সুমনা লাঞ্চ করছিল৷ জোনাকিকে দেখে বলে,
‘জোনাকি এসো একসাথে লাঞ্চ করি।’
জোনাকি বসে পড়ে। তার মনে বর্ণর ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। জোনাকিকে কোন ভাবনায় মশগুল থাকতে দেখে সুমনা জিজ্ঞাসা করে,

‘কি হয়েছে তোমার? এত কি ভাবছ?’
‘আপনার ছেলে বর্ণ কি আজই দেশে ফিরেছে?’
‘হ্যা আজ সকাল ১০ টার ফ্লাইটে ল্যান্ড করেছে কেন?’
জোনাকি আরো অবাক হয়। কারণ ৯ঃ৩০ টার সময় দেখল। এবার জোনাকি সুমনাকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে সুমনা হেসে ফেলে।

‘তুমি জানোনা আমার তো দুই যমজ ছেলে বর্ষ আর বর্ণ। চশমা পড়া রাগী ছেলেটা বর্ষ আর অন্যজন মানে যে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে সে বর্ণ।’
এবার জোনাকির কাছে সবটা পরিস্কার হয়। সুমনা বলতে থাকে,

‘আমার দুই ছেলেকে নিয়েই সমস্যা। বর্ষ টা হয়েছে একদম ওর বাবার মতো। সবসময় নাকের ডগায় রাগ আর অহংকার। আলোর ভার্সিটিরই টিচার ও। কোম্পানির কাজে ওর কোন ইন্টারেস্ট নেই। আর বর্ণ হয়েছে আমার মতো। আমার থেকেও বেশি প্রাণখোলা ও। তবে ওর সমস্যাটা শারীরিক। জন্মের পর থেকেই ওর হার্টের সমস্যা। যার কারণে ওকে মাঝে মাঝেই বিদেশে যেতে হয় চিকিৎসা করাতে।’

জোনাকির খুব খারাপ লাগে বর্ণর অসুখ সম্পর্কে জেনে। বর্ণর হাসি মুখটার কথা মনে পড়ে যায়। এরকম হাসি আগে কখনো দেখেনি সে।
‘আম্মু দিস ইজ ভেরি ব্যাড। আমি এতদিন পর ফিরে আসলাম আর তুমি আমাকে ছাড়া একা একা লাঞ্চ করছো।’
কারো গলার শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকায় জোনাকি। বর্ণর সাথে আবার তার চোখাচোখি হয়। বর্ণ জোনাকিকে দেখে চমকে যায়।

‘তোর কথা কিভাবে ভুলব?যা চিন্তায় রেখেছিলি। আয় বস আমার পাশে আমি তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দেব।’
বর্ণ সুমনার পাশে বসে। সুমনা তাকে খাইয়ে দিচ্ছিল। মা ছেলের এমন ভালোবাসা দেখে জোনাকির অনেক ভালো লাগে।
‘এই মেয়েটা কে আম্মু? কোম্পানিতে ওকে দেখেছিলাম খুব নার্ভাস লাগছিল।’
‘ও হলো জোনাকি। ওর ব্যাপারে সব বলব তোকে আগে খেয়ে নে তুই।’

বর্ণ খাচ্ছিল আর জোনাকিকে বারবার দেখছিল। জোনাকির খুব অস্বস্তি হয় বর্ণর চাহনিতে। অন্যরকম এক অনুভূতির জন্য হয় তার হৃদয়ে। বর্ণ তার মায়ের সাথে কি নিয়ে কথা বলছিল আর হাসছিল। বর্ণর হাসিটা দেখে জোনাকি আরেকদফা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়। হারিয়ে যায় ঐ মিষ্টি হাসির মধ্যে। হাসতে হাসতে জোনাকির দিকে চোখ যায় বর্ণর। জোনাকিকে নিজের দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বর্ণ তার দিকে তাকিয়ে হাসি থামিয়ে দেয়। জোনাকি লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়।

জরিনা রান্নাঘর থেকে সব খেয়াল করছিল।
‘এই মেয়েটাকে ভালো মনে হচ্ছে না। বর্ণর দিকে কিভাবে দেখছিল। মেয়েটাকে নজরে রাখতে হবে।’
খাওয়া শেষ হলে জোনাকি উঠে যায় গেস্টরুমের দিকে। বর্ণকে সুমনা জোনাকিদের ব্যাপারে সব বলব। সব শুনে বর্ণ বলে,
‘তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ আম্মু মেয়েগুলোকে সাহায্য করে।’

কথাটা বলে সে উঠে চলে যায়।
জরিনা বর্ণকে যেতে দেখে সুমনার কাছে এসে বলে,
‘আমার এসব ঠিক লাগছে না ম্যাম। ঐ জোনাকি বর্ণর দিকে কিভাবে জেনো তাকাচ্ছিল।’
‘তোমার এসব বাজে কথা বন্ধ করো তো৷ যাও গিয়ে কফি নিয়ে আসো।’
জরিনা বিড়বিড় করে কফি আনতে যায়।

‘ইংলিশ ক্লাস শেষ হয়ে গেছে ভেতরে চলো এখন।’
কারো কন্ঠস্বর শুনে আলো পিছনে তাকায়। দেখে লতা নামের মেয়েটি এসেছে।
‘হুম যাচ্ছি। তুমি বাইরে এলে কেন?’
‘তোমায় ডাকতে।’
‘অন্য কোন উদ্দ্যেশ্য নেই।’

‘সত্য বলতে আছে। জানো এখানে আমার কোন বন্ধু নেই। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাকে দেখে সবাই আমার থেকে দূরে চলে যায়। আমার খুব ইচ্ছে কারো সাথে বন্ধুত্ব করব। আমার নাম লতা দাস তুমি?’
‘আমার নাম আলো রহমান।’
আলো লতার সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাসের ভিতরে যায়। লতার সাথে আলোকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে রুহি বনানী। বিড়বিড় করে বলে,

‘এই মেয়েটা তো অনেক পা’জী। আমার মতো ফেমাস মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব না করে ঐ লতার মতো ভূতের সাথে বন্ধুত্ব করল। এটা তো আমার প্রেস্টিজে আঘাত। এটা আমি কিছুতেই মানব না। আলোকে আমার বেস্টু না বানানো পর্যন্ত আমি থামবো না।’
চারটা ক্লাস শেষ হওয়ার পর আলো লতার সাথে হেসে হেসে কথা বলে বাইরে যাচ্ছিল। রুহি বনানী তাদের সামনে এসে বলে,

‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা? চলো আমিও তোমাদের সাথে যাব।’
রুহি বনানীকে দেখে লতা ইতস্তত বোধ করে। মেয়েটা তো তাকে কম অপমান করে নি। আলো বলে,
‘যেতে চাইলে আসতে পারেন। আমরা একটু ক্যাম্পাস ঘুরে দেখব।’

‘আমরা তো ব্যাচমেট এভাবে আপনি করে বলার দরকার নেই। আমাকে তুমি করে বলবে।’
তিনজন একসাথে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে থাকে। এমন সময় তাদের দেখা হয়ে যায় বর্ষর সাথে। বর্ষ আলোকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে। আলোরও ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার জন্য রাগ হয় তার উপর। তাই পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বর্ষ খুব রেগে যায় এই ব্যবহারে,

‘আমাকে এটিটিউড দেখাচ্ছে এই মেয়ে। হাউ ডেয়ার সি?’
বর্ষ ডাক দেয়,
‘এই নতুন মেয়ে দাড়াও ‘
‘আমার নাম আলো।’
‘আচ্ছা সে যাই হোক তুমি এসো এদিকে।’
আলো আসে। বর্ষ আলোকে বলে,

‘আমি তোমার স্যার সম্মান দিতে জানো না। ক্লাসে গল্প করো কেন? তুমি এখানে নতুন জানিনা কোথা থেকে এসেছ। অন্য যায়গার নিয়ম এখানে চলে না। এখানে পড়তে হলে ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হবে।’
‘আমি গল্প করিনি। রুহি বনানী তুমি কিছু বলো।’
রুহি বনানী এগিয়ে এসে বলে,

‘জ্বি, স্যার। আলোর কোন দো’ষ নেই আমিই ওর সাথে কথা বলছিলাম।’
‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। এই মেয়ে আই মিন আলো শোন। এখন থেকে আমায় দেখে সম্মান দেবে আর রাস্তায় যার তার গাড়ির সামনে পড়বে না।’
বর্ষর কথা শুনে আলোর খটকা লাগে। ভালো করে ভেবে দেখে,

‘এইজন্যই কন্ঠস্বরটা এত পরিচিত লাগছিল। এই তাহলে সেই অভদ্র লোক যে সকালে আমাদের গাড়ি দিয়ে ধা’ক্কা দিতে চাচ্ছিল। সুমনা আন্টির ছেলে এত অভদ্র হয় কিভাবে আমি বুঝছি না। যদি ইনি আমার স্যার না হতেন তাহলে এখনই মুখের উপর হাজার টাকার নোটটা ছু’ড়ে মারতাম।’

আলো তার ব্যাগ থেকে হাজার টাকার নোটটা বের করে বর্ষর হাতে দিয়ে বলে,
‘এই টাকাটার আমার কোন প্রয়োজন নেই স্যার। আপনি আপনার কাছে রেখে দিন। এরপর কাউকে ধা’ক্কা দিয়ে চলে যেতে চাইলে কাজে লাগবে।’

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৫

কথাটা বলে আলো লতা ও রুহি বনানীর সাথে চলে যায়। বর্ষ এক হাজার টাকার নোটটা হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
‘এই মেয়েটাকে তো আমি,,,’

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ১৭