বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১২

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১২
শারমিন আক্তার বর্ষা

” মাঝেমধ্যে নিজেকে নিষ্ঠুর মনে হয়। এমনও মনে হয় আমি রুহানির সাথে অন্যায় করছি। এতগুলো বছর ওকে ওর বাবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। আমি স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা ভেবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছি। একটিবার রুহানির কথা ইয়াসিরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু আমি কি করতাম? ইয়াসির আমি চলে আসার সময় একটাবারও আমাকে আঁটকায়নি। একবারও বলেনি, ছেড়ে যেও না। এসব জু’য়া খেলায় হাড়-জিত আমার কাছে কোনো মাইনে রাখে না। ইয়াসির যদি একটিবার আমাকে আটকা তো, সত্যি বলছি আমি মেইজি তাহলে, আমি ম’রে গেলেও ইয়াসির কে একা করে চলে আসতাম না।

আমি ইয়াসিরকে ভুলবার চেষ্টা করেছি, ঘৃণা করতে চেয়েছি কিন্তু এত বছরে আমি তা পারিনি। আমি যত ও’কে ভুলতে চাই ‘ও’ তত আমার মনে পরে যায়। বাবা মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল, আমি জেনো মুভ অন করি। রুহানিকে উনারা দেখবেন। আমার নতুন কারো সাথে, নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য জবরদস্তিও করেছিলেন। বাবার বন্ধুর ছেলে রাজি ছিল, আমার মেয়ে সহ আমাকে বিয়ে করবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু আমি আমার মেয়েকে ছাড়তে পারবো না। ইয়াসিরের জায়গা আমার জীবনে দ্বিতীয় কাউকে দিতে পারবো না বলে, সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ছিলাম। আমি এতগুলো বছর শুধু রুহানিকে বুকে জড়িয়ে দিন পাড় করেছি। আমার মনে বহু কষ্ট চাপা পরে আছে,না পারি কাউকে বলতে আর না পারি দেখাতে। কতশত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছি, একাকি চোখের জল ফেলেছি হিসেব নেই। আমি কখনো চাইনি, রুহানি ওর বাবাকে ঘৃণা করুক।

তাই কখনো ইয়াসিরকে ছেড়ে চলে আসার মূল ঘটনা ওকে বলিনি৷ ও যখন ছোট ছিল ছুটে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে ‘ওর’ বাবার কথা জানতে চাইতো তখন আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠতো৷ উথাল-পাতাল ঢেউ বয়ে যেতো। সত্য টা লুকাতে গিয়ে মেয়ের চোখে স্বার্থপর মা হয়েছি। আমি জানি, সত্য টা জানলে রুহানি ওর বাবাকে ঘৃণা করবে আর তা আমি চাইনা। মানুষ চাইলে সব সম্ভব। রুহানি যদি ওর বাবার সম্মুখীন হয়, তাহলে কি হবে তুমি কল্পনা করতে পারছো মেইজি?”

ইয়ানার হাতের ওপর নিজ হাতটি রাখে মেইজি। নির্মূল কণ্ঠে বলে,
” তুমি যা ভাবছো তা নাও হতে পারে। ওত বড় শহরে রুহানি বেবি ওর বাবাকে খুঁজে নাও পেতে পারে। তাছাড়া তুমিই তো বলেছো রুহানি ওর বাবাকে কখনো দেখেনি।”
কণ্ঠে গাম্ভীর্য, শুঁকনো ঢোক গিলে ইয়ানা বলল,
” মেরাক্কেল বলেও কিছু আছে মেইজি। ভীষণ ভয় করছে। বুকের মধ্যে ধুকধুক করছে।”

বহুদিন পর আজ কোম্পানিতে পা রাখলেন ইয়াসির রেদোয়ান। ইয়াসির কে আসতে দেখে A.S এর এ্যাসিসটেন্ট এগিয়ে গেলো। আরিশের এ্যাসিসটেন্টকে অফিসে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন ইয়াসির। সন্দেহের নজরে তিনি সবার দিকে তাকাচ্ছেন। ফ্লোরের সকল কর্মীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন এক থমথমে পরিবেশ।

ইয়াসিরের সকল প্রোপার্টির দেখাশোনা করে A.S কিংবা বলা যায় সব কিছু A.S এর হাতে। সব কিছু এ.স কে বুঝিয়ে দিয়ে রিটায়ার্ড হয়েছে ইয়াসির। ইতিপূর্বে উনি শেষ কবে অফিসে পা রাখছেন কারো জানা নেই। তবে উনি বেশ গম্ভীর ও রাগী মানুষ সকলের ধারণা। ইয়াসির এ.স এর কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, আরিশ কোথায়?

এ.স এর এ্যাসিসটেন্ট কিছু বলার আগে পিছন থেকে কারো গুরুগম্ভীর কণ্ঠ শুনে ইয়াসির থমকে দাঁড়ালো। পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটার পা থেকে মাথা অব্ধি পর্যবেক্ষণ করে শক্ত গলায় বলল,
” ওয়াসিফ! আরিশ কোথায়?”

ওয়াসিফ মাথা নিচু করে ফ্লোরের ওপরে দৃষ্টি স্থির করে নিঃশ্বাস ফেলল। দু-হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ইয়াসিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। শানিত গলায় বলল,
” আঙ্কেল আপনি হঠাৎ অফিসে আসতে গেলেন কেনো? কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাতে পারতেন। আমি আপনার বাড়িতে চলে আসতাম।”
ইয়াসির রাগী গলায় বলল,

” আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করছি ওয়াসিফ এ.স কোথায়?”
ওয়াসিফ প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে ঘড়িতে টাইম দেখে বলল,
” এ.স ওর টিম মেম্বারদের নিয়ে মিটিং রুমে একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ে আছে। এই বিশ পঁচিশ মিনিটে মিটিং শেষ করে ওর কেবিনে চলে আসবে।”

চার দিন পর,
পুরো দমে শ্যামার বিয়ের তোড়জোড় চলছে। আত্মীয়-স্বজনেরা মোটামুটি সবাই চলে এসেছে। বিয়েটা শ্যামাদের বাড়িতে বসেই হবে। বাড়িতেই ওর বিয়ের সমস্ত রিচুয়াল’স পালন করা হবে। ওর বিয়ের আয়োজনটা মোটামুটি ধূমধাম করেই দেওয়া হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনেরা ছাড়াও মি.মাহিনের বিজনেস পার্টনার, অফিসের এমপ্লোই সহ সবাইকেই প্রায় এই বিয়েতে ইনভাইট করা হয়েছে। শ্যামার বাবা নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো রকম কমতি রাখেনি। শ্যামা যেভাবে বলেছে উনি ঠিক সেই ভাবেই বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছেন।

ডেসিনটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে শ্যামা। বিছানার ওপর বসে, ভ্রু কিঞ্চিত উঁচু করে তাকিয়ে সুক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,
” সকাল সকাল সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস? বিকেলে তো তোর হলুদের ফাংশন।”
ডেসিনটেবিলের মিররের ওপর থেকে নেত্রযুগল রুহানির দিকে তাক করে শ্যামা কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল,
” আমার কিছু জরুরি জিনিস কিনা বাকি রয়ে গেছে। ওইদিন এতএত শপিংয়ের মাঝে খেয়াল করিনি। কাল রাতে সব জিনিস চেক করতে দেখলাম। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস গুলো আনতে পারিনি। আর ওগুলো আমার লাগবেই। তাই শপিংমলে যাবো।”

শ্যামার কথা শুনে চটকরে দাঁড়িয়ে পরল রুহানি। শক্ত গলায় বলল,
” আমিও যাবো। তুই চলে গেলে আমার এখানে একা একা মোটেও ভাল্লাগবে না।”
শ্যামা চোখের কার্নিশে কাজল লাগাতে লাগাতে বলল,
” একা কোথায়? ওরা সবাই তো থাকছে।”

রুহানি বায়না ধরে বলল,
” থাকুক ওরা। তবুও আমি যাবো।”
শ্যামা আয়নাতে এক পলক রুহানিকে দেখে বলল,
” আচ্ছা ঠিক আছে। যা, জাস্ট পাঁচ মিনিটে রেডি হবি।”

একটা শপে এসে, শ্যামা ওর দরকারি জিনিসপত্র গুলো সার্চ করছে। বেশ কয়েকটা পেয়েছে আর কিছু পায়নি। এমন করে খুঁজতে খুঁজতে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সেকেন্ড ফ্লোরে আসে। বেশ কয়েকটা শপ খোঁজার পর, শ্যামা ওর দরকারি সব জিনিস পত্র বুঝে নেয়।

মলের দক্ষিণ দিকে পার্কিং স্পট। শপিংমল থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ পা হেঁটে যেতে হয়। রুহানি শ্যামার সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল, এমতাবস্থায় কোথা থেকে একজন ছুট্টে এসে রুহানির কাঁধের ব্যাগ টা ছু মেরে নিয়ে দৌঁড় দেয়। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায় রুহানি। হা করে দাঁড়িয়ে পরে। পাশে থাকা শ্যামা ‘হেল্প হেল্প’ বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। রুহানি কাঁদো কাঁদো ফেস বানিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বলল,

” আমার ব্যাগ। ওটাতে আমার ফোন পার্স কার্ড সবকিছু ছিল।”
শ্যামা রুহানির হাত ধরে টেনে ধরে দৌঁড়াতে লাগল। হুট করে একজন ছেলে এসে রুহানি ও শ্যামার পথ হ্রুদে দাঁড়ালো। হাতের ব্যাগটা রুহানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” ম্যাম আপনার ব্যাগটা। ”
ছেলেটার হাত থেকে ছ’ মেরে ব্যাগটা নিয়ে নেয় রুহানি। ব্যাগের জিপ খুলে উলটপালট করে দেখতে লাগে ভেতরে সবকিছু আছে কি না! রুহানির চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা মলিন হাসল। মসৃণ কণ্ঠে বলল,
” সব কিছু ভালো করে চেক করে নিবেন মিস রুহানি। তারপর একটু রিলাক্স হয়ে জানাবেন, কোনো কিছু আবার মিস নেই তো।”

ব্যাগের ভেতর থেকে চোখ সরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আরিশের দিকে তাকালো রুহানি। চোখ জোড়া পিটপিট করে শুধালো,
” আপনি আমার ব্যাগ কোথায় পেলেন? তারমানে আমার ব্যাগটা আপনি চুরি করেছেন? আপনার সাহস তো কম না৷ আমার ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন।”

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১১

রুহানির কথাশুনে ভ্রুযুগল কুঁচকানো করে ডানে বামে তাকালো আরিশ। ঠোঁট জোড়া মসৃণ করে বলল,
” এক্সকিউজ মি! আপনি কি আমাকে চোর বলছেন?’
বিঃদ্রঃ ব্যস্ততার জন্য গল্প লিখার সময় পাইনি। দুদিন পর গল্প দেওয়ার জন্য স্যরি। কথা দিচ্ছি আগামীকাল গল্পের পরবর্তী পর্ব’ বড় করে দিবো।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৩