বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২১

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২১
শারমিন আক্তার বর্ষা

– ‘লিসেন ভুল না থাকলে ওইদিন তোমার মতো থার্ডক্লাশ মেয়ের সাথে রাস্তায় বসে গল্প করতাম না। ওইদিন ভুল তোমারও ছিল আমারও ছিল। ভুল করেই দু’জনে দু’জনার সামনে চলে আসছিলাম। সেজন্য কিছুটা সময় তোমার সাথে বসে কথা বলে নিজের গিল্টি ফিলিংটা দমন করেছি।

এর জন্য তুমি সব সময় আমার সামনে এসে আমাকে অপদস্ত করতে পারো না। এরপর এমন বিহেভ করলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। সব সময় নিজের যোগ্যতা হিসেব করে মানুষের সাথে কথা বলতে আসবে। আমার সামনে বারবার এসে আমার সময় নষ্ট করবে না। কথাটি মাথায় ঢুকিয়ে রাখো।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উক্ত কথাটি বলে, রুহানির সামনে থেকে ইয়াসির হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে। অশ্রুসিক্ত চোখে ইয়াসিরের যাওয়ার দিকে তাকাই আছে রুহানি। গলা ধরে আসছে, কণ্ঠনালি দিয়ে টুঁশব্দ টাও বের হচ্ছে না। দেশে আসার পর, শ্যামার পরিবার ছাড়া ইয়াসিরকে কাছের মনে হয়েছিল রুহানির কিন্তু ইয়াসির লোকটা সময়ের সাথে পল্টি নিলো। ভাবতে হাত পা অসাড় হয়ে আসছে রুহানির।

রেস্টুরেন্ট থেকে সকলে হাসিহাসি মুখ করে বের হল। আমান সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পূর্বে নাজিন কে বলে যায়, রাতে জেনো ও’কে কল দেয়। নাজিন মাথা নাড়িয়ে হা বোধক সম্মতি দেয়। আদনান, জুহি কে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিতে যায়। আহিল লাবণ্য কে বিদায় জানিয়ে বাইক নিয়ে চলে যায়।

নিশান, আরিফ ওরা দু’জন সাইফের সাথে পার্কিং স্পটে চলে যায় গাড়ি নিয়ে আসার জন্যে, মেয়েরা সকলে একত্রিত হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় রুহানি খেয়াল করল, একটা কালো গাড়ি থেকে নামছে ইয়াসির। চোখে পরিচিত কিন্তু নাম জানা নেই।

লোকটাকে নামতে দেখে রুহানি ওর বন্ধু দেরকে একটু দাঁড়িয়ে থাকতে বলে, ইয়াসিরের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়। ইয়াসিরের সাথে সাথে আরও দু’জন লোক গাড়ি থেকে নামে। ইয়াসির ও’দুজন লোকের সাথে কথা বলে এগিয়ে যাচ্ছে রেস্টুরেন্টের দিকে। রুহানি হঠাৎ ইয়াসিরের সামনে চলে আসে আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায় ইয়াসিরের সাথের লোক দু’জন। তারা ইংলিশে ইয়াসিরের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করে,

‘ এই মেয়েটা কে? হঠাৎ রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ালো কেন?’
ইয়াসিরের মেজাজ এমনিতে চাঙ্গে ওঠে আছে কোম্পানিতে একটা বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এমপ্লয়ি গুলোর সাথে কথায় বনাবনি হয়নি। লোক দু’জন কে কিছু না বলে, ইয়াসির তার রাগ রুহানির ওপরে ঝাড়লো৷ রুহানিকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুহানির পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আশেপাশের লোকজন উৎসুকভাবে রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে কোনো ফিল্মের শুটিং চলছে। শ্যামা রুহানির কাঁধে হাত রাখল করুণ কণ্ঠে বলে,

‘ উনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। উনার সাথে হুটহাট রাস্তা ঘাটে কথা বলা যায় না। উনার সাথে কথা বলার জন্য আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট লাগে। উনার কথায় কিছু মনে করিস না। আসলে বড়লোক তো তাই অহংকারে পা মাটিতে পরে না।’

শ্যামার হাত কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে রুহানি প্রস্থান করল। সাইফ গাড়ি নিয়ে আসতে গাড়িতে ওঠে বসে। বড় গাড়ি হওয়ায় সকলে এক গাড়িতে জায়গা হয়ে গেলো। রাস্তায় হঠাৎ রুহানির কল আসে। ফোন হাতে নিয়ে ‘মাম্মাহ’ দেখে রুহানি গাড়ি ব্রেক করতে বলে।

গাড়ি থেকে নেমে উল্টো দিকে ঘুরে কল রিসিভ করে। অপরদিকে ইয়ানা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝে যায়। অনুমান করতে পারে মেয়ের অবস্থা। কি হয়েছে জানতে চেয়ে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ তোমার কণ্ঠে রেশ কেনো? তুমি কি কান্না করছো? কি হয়েছে মা কে বলো?’
‘ কিছু হয়নি মাম্মাহ তোমার কথা খুব মনে পরছে।’
‘ আমি তোমার মা রুহানি৷ আমাকে মিথ্যে বলে লাভ নেই। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে আমি তোমার কণ্ঠ শুনে ধরতে পারি। কি হয়েছে বলো?’
গাম্ভীর্য কণ্ঠে কথাটি বলে ইয়ানা। মা’য়ের কথার পিঠে কিছুটা চুপ থেকে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে রুহানি ইয়াসিরের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বলে। মেয়ের মুখের কথা শুনে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে ইয়ানার। গলা শুকিয়ে আসে। শুঁকনো ঢোক গিলে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ লোকটার নাম কী?’
রুহানি লোকটার সম্পর্কে কিছুই জানে না। নামটাও কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। সে জন্য নাম কী বলতে পারল না। ইয়ানা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার বাংলাদেশে থাকার প্রয়োজন নেই। যত তারাতাড়ি সম্ভব ফিরে আসো। ওখানকার মানুষ বড্ড সেলফিশ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুই বুঝে না। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কাউকে আপন করে নিতে জানে ও স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও জানে। আমি চাইনা তুমি ওখানে থেকে এমন মানুষের সাথে আরও পরিচিত হও। ফিরে আসো বাচ্চা মা’র কাছে ফিরে আসো।’

নেটওয়ার্ক সমস্যা কলটা কেটে গেলো। ইয়ানার কথার পিঠে রুহানি আর কিছু বলতেও পারল না। কল কেটে যাওয়ার পর কয়েকবার কল দেয় ইয়ানা প্রতিবার বলে, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

লেকে বসে একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে ইয়াসির কথা বলছে দেখে ইয়াসিরের ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে এ.স কে কল করে। তাকে জানায় ইয়াসিরের কথা। বড় বিজনেস ম্যান হওয়ার পাশাপাশি এ.স এর শত্রুর অভাব নেই। তারা সকলে চাইবে সুযোগ পেলে, ক্ষতি করার। ইয়াসিরের এমন নির্লোভ আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করে এ.স।

বাড়িতে এসে তার মামাকে বোঝায় এভাবে গার্ড ছাড়া বাহিরে যাওয়া সেভ না। তাছাড়া অপরিচিত কারো সাথে মেশা তো একদমই না। আরিশের কথা মাথায় রেখে ইয়াসির রুহানির সাথে দূর্ব্যবহার করছে। ইয়াসিরের ধারণা রুহানি ওদের শত্রু দলের একজন। ওর সাথে মিশে ওদের খবরপাচার করাই রুহানির ধান্দা।

দুই ঘন্টা আগে….
কোম্পানির অধিবেশনে যোগ দেন ইয়াসির। দুই সারিতে বসে আছে কোম্পানির ম্যানেজার ও এমপ্লয়ি। ইয়াসির কিয়দংশ চুপ থেকে শানিতকণ্ঠে বলল,
‘ আমি এ.স কে আমার ইন্ডাস্ট্রির সিও করতে চাই।’

ইয়াসিরের কথা শেষ না হতে মুখ থেকে কথা টেনে একজন বলে উঠল,’ স্যার! এ.স স্যারের ভীষণ রাগ আপনি কিভাবে উনাকে সিও বানাতে পারেন?’
লোকটার সাথে সঙ্গ দিয়ে আরও দুজন আপত্তি জানালো তারা আরিশকে সিও মানবে না। ইয়াসিন গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

‘ আমার কোম্পানির সিও আমি কাকে বানাবো এটা নিতান্ত আমার ডিসিশন। আর সেটা আপনারা মানতে বাধ্য।’
‘ আপনার ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি একা ডিসিশন নিতে পারবেন না স্যার। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, এই ইন্ডাস্ট্রির ৫০% মিসেস ইয়ানার ও আপনার ৫০% আপনার। মিসেস ইয়ানাকে ছাড়া আপনি একা এই ইন্ডাস্ট্রির সিও এ.স কে নির্ধারণ করতে পারেন না।’

দ্বিতীয় সারি থেকে জিএম ওঠে দাঁড়িয়ে কর্কশকণ্ঠে কথাটি বলল। লোকটার কথার পিঠে কোনো কিছু বলতে পারল না ইয়াসির। কিয়দংশ নির্বাক নির্বাক্য বসে থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে চলে যায়। এ.স বদমেজাজি এটা ইন্ডাস্ট্রির সকলে জানে। এবং সে রেগে গেলে কি করতে পারে এটাও সবার জানা।

রুহানির মন খারাপ বন্ধু দের কি ভালো লাগে? উঁহু একটুও না। সবাই মিলে রুহানির মন ভালো করার চেষ্টা করছে। এমন সময় কলিংবেলটা বাজলো। দরজা খুলে দিতে একজন অপরিচিত লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। হাতে একটা পার্সেল নিশ্চয়ই ডেলিভারি ম্যান।

রুহানিকে খুঁজছে, রুহানি আসতে একটা কাগজে সই রেখে পার্সেল টা রুহানির হাতে গুঁজে দিয়ে লোকটা দ্রুত পায়ে চলে যায়। পার্সেল হাতে রুহানি অবাক চোখে নাজিনের দিকে তাকাল। ভেতর রুম থেকে বাকিরা চটজলদি বেরিয়ে আসে। রুহানির হাতে পার্সেল দেখে পিঞ্চ মেরে কথা বলছে। রুহানি রাগি চোখে তাকাল। কর্কশকণ্ঠে বলল,

‘ আমি কি জানি এটা কে পাঠিয়েছে? কোথাও তো কারো নাম লেখা নাই। আমি কিভাবে জানবো আমার জন্য কে আর কেন এটা পাঠাইছে? সবাই এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করছিস কেন? আশ্চর্য!’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২০

বন্ধু বান্ধবী দের এক প্রকার হালকার উপরে ঝাপসা ধুয়ে দেয় রুহানি। রুমের মধ্যে ঢুকে পার্সেলের পেকিংটা খুললো। একটা চিরকুট সহ একটা ডালা প্যাকেজ। চিরকুট টা হাতে নিয়ে রুহানি দেখলো তাতে নিপুণ ভাবে লিখা,,
— ‘আমার পিচ্চি গোলুমলু হাতির বাচ্চাটা তোমার জন্য এই এতগুলা ভালোবাসা।’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২২