বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৮

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৮
শারমিন আক্তার বর্ষা

কানাডায় আসার পর, নিজ খালার মুখে মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে হকচকিয়ে ওঠে রুহানি। সে ভীষণ রাগ দেখায় মেইজি ও ইয়ানার ওপর৷ ইয়ানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আমি চাইনি তুমি ভিন্ন দেশে বসে অযথা চিন্তা করো। তাই ওদের বলতে নিষেধ করেছি। মায়ের কথায় ভীষণ রাগ দেখালো রুহানি। অবশেষে যে কাজের জন্য বাংলাদেশ গিয়েছিলে সে স্বার্থসিদ্ধি করেছো কি না জিজ্ঞেস করল। রুহানি হাত মুঠো করে বসে রইল। ডানে বামে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ না মানে পারেনি বাবা কে খুঁজে বের করতে।

শরীর ক্লান্ত বলে, বিছানার সাথে গা এলিয়ে দিতে ঘুমিয়ে পরে রুহানি। ঘুম থেকে ওঠে আরিশ কে কল দিবে ভেবেছিল কিন্তু সেটা আর হয়নি। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে ইয়ানার শরীর খারাপ করে। তাকে দ্রুত হসপিটালে এডমিট করানো হয়। মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে পরদিন নিজের প্রাইভেট জেটে ইতালি থেকে কানাডা আসেন। ইয়ানা হাসপাতালে ভর্তি। এদিকে কান্না করে বেহাল অবস্থা। মাথা থেকে একদম আরিশের কথা বেরিয়ে গেছে। রুহানির বন্ধু দেরও ইয়ানার সম্পর্কে খবর দিতে পারেনি রুহানি ওরাও কিছু জানে না। দু’দিন ধরে খেয়ে না খেয়ে হাসপাতালের দন্ডি চক্কর কাটছে মেয়েটা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমি এই মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না মামু।’
‘কেন পারবি না? দেখ মেয়ে টা কত সুন্দরী। তোর সাথে খুব ভালো মানাবে।’
‘আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। তুমি কি ভুলে গেছো মামনির ইচ্ছার কথা?’
‘আমি কিছু ভুলিনি। কিন্তু আমি অনির্দিষ্ট কোনো কিছুর আশংকায় তোকে সারাজীবন কুমার রাখতে পারবো না। আমি এটাও জানি না আমার সন্তান আধোও বেঁচে আছে নাকি মা-রা গেছে। বেঁচে থাকলেও সে ছেলে না মেয়ে। এমতাবস্থায় তোকে কিভাবে আমি বলবো তোর মামনির ইচ্ছে পূরণের দ্বায়বার নেওয়ার জন্য?’

‘তুমি যাই বলো না কেন মামু আমি এই মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।’
‘তুই কেন পারবি না? বিয়ে তো তোকে আমি করার জন্য অনুমতি দিচ্ছি।’
‘আমি এ মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না। তুমি বললে আমার আমার ভালো লাগে এমন কাউকে বিয়ে করতে চাই।’
‘নাহহ। আমি বলেছি তুমি বিয়ে করলে ও-কেই করবে। তোমার বউ হলে ও-ই হবে। আমি আমার বন্ধু কে কথা দিয়েছি৷ ওই হবে আমার বাড়ির বউ।’

‘কিছুতেই না মামু। আমি রুহানি কে ভালোবাসি এখন বিয়ে করলে ও-কেই করবো। অন্য কাউকে কখনো না।’
ইয়াসির বাম হাত বুকের রেখে ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। আরিশ পিছু ঘুরে ইয়াসির কে উত্তেজিত হতে দেখে দ্রুত গিয়ে তাকে আগলে ধরে রকিং চেয়ারে বসায়৷ ইয়াসির ভেতরে ভেতরে অসুস্থ উনি একথা লুকিয়ে গেছেন আরিশের কাছে। এখন তিনি উনার অসুস্থতার কথা খুলে বললেন৷ এবং এটা উনার শেষ ইচ্ছা বললেন।

সব শুনেও আরিশ দ্বিতীয় কাউকে বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাজ, আমান, প্রবীর ও ওয়াসিফ নিরবে দেখছে। আরিশ রাজি হচ্ছে না দেখে, ইয়াসির আরিশের পা ঝাপ্টে ধরে জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘আমি তোর পা ধরে বলছি। বিয়ে তে রাজি হয়ে যা। তোর মামুর সম্মান রক্ষা কর।’

নিজের মামার এভাবে পায়ে হাত দেওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় আরিশ। নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় ইয়াসিরের মুখের দিকে, ইয়াসিরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে৷ মামুর চোখের জল মুছে বিয়ে করবে বলে সম্মতি জানাল আরিশ শাহ।
যে মামু তার ছোটো থেকে এত কিছু করেছে সে মামুর চোখে জল ও পায়ে হাত দেওয়ার পর কিভাবে সে বিয়ে তে রাজি না হয়ে পারবে? এতে তো সে সব ইয়াসিরের চোখে স্বার্থপর হয়ে থাকবে।

সাত দিন পর, আরিশের শর্ত ছিল, বিয়ে টা খুবই সাধারণ ভাবে হবে। কিন্তু ইয়াসির কোনো শর্ত শুনেনি৷ অনেক জাঁকজমক ভাবে বিয়েটা হচ্ছে। বাড়ি খুব সুন্দর করো ডেকোরেশন করা হয়েছে৷ আজ সন্ধ্যায় আরিশের মৈথি নামে মেয়ের সাথে হলুদ। আগামীকাল বিয়ে।
এই সাত দিনে বেশ অনেক বার রুহানি আরিশের সাথে কনটেন্ট করার চেষ্টা করছে কিন্তু আরিশ যথাযথ তাকে ইগনোর করেছে। রুহানি কে কষ্ট দিয়ে আরিশ যে বেশ মজায় ছিল তাও কিন্তু নয়। সে নিজেও তিলে তিলে দহনের আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।

সকাল দশটা বাজে- বিয়ে বাড়ির তর্জাব বেশ। আরিশ দরজা বন্ধ করে রুমের মধ্যে বসে আছে। তাকে দেখে বুঝা যায়। সে বিয়ে টা করছে চাচ্ছে না। ভোরেও রুহানির কল এসেছিল মানুষটা রিসিভ করতে পারেনি। কল রিসিভ করে সে বলবে কী?
আমানের ফোন বাজছে, পাঞ্জাবির প্যাকেট থেকে ফোন বের করে দেখল নাজিন কল দিয়েছে। একটা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় আমান। বাহিরে গানের অনেক সাউন্ড আসছে তেমন শোনা যাচ্ছে না।

নাজিন প্রথমত আমানের সাথে কৌশলবিনয় করল। এভাবে দু’জনে কিছুক্ষণ কথা বলল। পরক্ষণে আমান কে জিজ্ঞেস করে কিসের পার্টি করছে ওরা। আমান মুখ ভসকে আরিশের বিয়ের খবরটা বলে দেয় সে৷ নাজিন আমানের মুখে শুনে শিওর হয়। আজ আরিশের বিয়ে।

সবাইকে গ্রুপে মেসেজ দিয়ে রুহানির বাড়ি আসতে বলে। গ্রুপে মেসেজ সিন করে, সবাই ইমার্জেন্সি রুহানির বাড়ি আসে। আরিশ বিয়ে করছে শুনে আকাশ থেকে পরে রুহানি। স্তব্ধ হয়ে যায়। ইয়ানা পুরোপুরি সুস্থ। ওরা আসছে বলে কিচেনে রান্না করছে। আরিশ বিয়ে করছে এমন তাকে কিছু জানায় নি বিষয় টা বিশ্বাস হচ্ছে না মোটেও। আমানের সাথে কলে কথা বলিয়ে দিলো নাজিন। আমানের কথা শুনে বিশ্বাস করে সে। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরে৷ রুহানির চিৎকার করে কান্নার শব্দ শুনে কিচেন থেকে ছুটে আসে ইয়ানা।

পাসপোর্ট ভিসা সমেত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে রুহানি। ওদের মুখে রুহানির খবর শুনে ওর মা ইয়ানা। ২হাজার মার্কিন ডলারের ইমার্জেন্সি ফ্লাইটের টিকিট কাটে। সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পরে ইয়ানা। কান্না করছে। মেয়েটা তার কোন মানুষের খোপ্পলে পড়েছে আল্লাহ জানে।
ইয়ানার বাবা ও মা ইয়ানার খালার ফ্ল্যাটে ছিলেন। চলে যাবেন বলে মেয়ের সাথে দেখা করতে আসেন। এসেই এসব শুনে সবাইকে সাথে নিয়ে নিজের প্রাইভেট জেটে ওঠেন।

পুরো ২৭ঘন্টা ২৭মিনিট পর বাংলাদেশে প্লেন ল্যান্ড করে। (স্যরি এর আগের বার একটু ভুল হয়ে তখন আমি ২৭ঘন্টা না লিখে ১৫/১৬ ঘন্টা লিখে ছিলাম। ভুলের জন্য দুঃখিত।) এক প্রকার ছুটে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত আসে রুহানি। তার জন্য ধম বন্ধ হয়ে ছিল এতক্ষণ। শুধু প্রহর গুনছিল কখন সে নামবে।
রুহানি তাদের এক ঘন্টা আগে এসে পৌঁছিয়েছে৷ এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে একটা ট্যাক্সি ভাড়া নেয়। জেটে বসে শ্যামার মুখে আরিশ সম্মন্ধে শুনে ইয়ানার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। সে জানতে চায় আরিশের মামার নাম কী?
বেশ কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পর শ্যামা লোকটার নাম বলতে পারে না। কেননা সে আরিশের মামার নামটা ভুলে গেছে। এয়ারপোর্টের সামনে থেকে গাড়ি নেয়। শ্যামা এড্রেস জানে। সে ড্রাইভার কে এ.স এর বাড়ির ঠিকানা দেয়।

রুহানি বাড়ির সামনে এসে চমকে ওঠে। বেশ মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য বাড়িটার। মরিচবাতির নানান আলোয় চিকচিক করছে। রুহানি বাড়িতে ঢুকতে চাইলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ইয়াসিরের বাড়ি থেকে বিয়ে হবে। এটা ইয়াসিরের শর্ত ছিল। তাই তার বাড়িতেই বিয়ে টা হচ্ছে। এক রুমে ছেলে তো অন্য রুমে মেয়ে বঁধু সেজে বসে আছে। এখনও কাজী সাহেব আসেনি তার জন্যই অপেক্ষা করা হচ্ছে।

রুহানি জোরাজোরি করতে লাগল ভেতরে যাওয়ার জন্য কিন্তু তাকে কেউ যেতে দিচ্ছে না। বড়লোকের বিয়ে যাকে তাকে তো আর এলাউ করে না। রুহানি নাছোড়বান্দা সে সব রকম চেষ্টা করছে ভেতরে যাওয়ার জন্য এবং জোরে জোরে আরিশ আরিশ বলে ডাকছে। এতে বিরক্ত হয়ে একজন গার্ড বাড়ির ভেতরে যায়। ইয়াসির কে খুঁজে বের করে। তাকে গেইটের ঘটনাটি বলে, ভারী নিঃশ্বাস ফেলে লোকটি কে জানতে চায়৷ গার্ডের মুখে রুহানি নাম শুনে রেগে যায় ইয়াসির৷ কেননা এখন যদি আরিশ শুনে এখানে রুহানি এসেছে তাহলে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না৷ তাই ইয়াসির বলল, ‘মেয়েটাকে তাড়িয়ে দাও।’

পাশ থেকে মৈথির বাবা রাগী গলায় বলল, ‘এমনি এমনি না গেলে মে’রে তাড়াও।’
গার্ড এসে অন্য দু’জনকে একই কথা বলল। এমনিতে তারা রুহানির ওপর বিরক্ত অপর থেকে পারমিশন পেয়েছে৷ তিন জনে হাতের লাঠি দিয়ে রুহানি কে আঘাত করল। একজন পিছন থেকে পিঠে মারছে, অন্য জন সামনে থেকে পায়ে তো আরেকজন কপালে মে’রে কপাল ফাটিয়ে দিলো। আত্মা স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী রা দেখে ভয় পেলো। রুহানি হাঁটু ভাজ করে মাটিতে শুয়ে পরেছে। লোক তিনজন অট্টহাসি তে ফেটে পরল।

গার্ডদের চোখের আড়ালে ওঠে দাঁড়াল রুহানি। চক্ষু আড়ালে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। সাদা জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে। আহত অবস্থায় ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো রুহানি। ড্রয়িংরুমের উত্তর দিকে এক বড় ওয়াল জুড়ে ইয়ানার হাসি উজ্জ্বল মুখের ওয়ালমার্ট। আজকের গেস্ট অতিথি গণ ইয়ানার ছবিটি মন ভরে দেখেছে। কিন্তু সে ছবির দিকে চোখ পরেনি রুহানির।
রুহানি কে দেখে রাগে গজগজ করতে লাগেন মৈথি এর বাবা। উনার আশা উনি মেয়েকে এ বাড়িতে বিয়ে দিবেন তারপর ইয়াসিরের সকল সম্পত্তির মালকিন উনার মেয়ে হবে।

যখন জানতে পারেন এ.স একটা মেয়েকে ভালোবাসে তখন থেকে উনি উঠেপড়ে লাগেন। যে করেই হোক আরিশের সাথে নিজ মেয়ের বিয়ে উনি দিবেনই দিবেন। রুহানি কে উনি চিনি ফেলেন, উনি আগেও একবার দেখে ছিলেন রুহানিকে আরিশের সাথে বাইকে ঘুরতে। তাই এখন তার চিনতে অসুবিধা হয়নি। রুহানির রক্তমাখা মুখটি দেখে বুকের বা পাশে চিলিক দিয়ে উঠে ইয়াসিরের। উনি বুঝেন না, এই মেয়েটার মুখটি দেখলে তার এমন অদ্ভুত হয় কেন? কেনো মেয়েটাকে হার্ট করে কথা বললে সে সব থেকে বেশি হার্ট হয়?

রুহানি সবার কাছে অনুরোধ করছে তাকে জেনো আরিশের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলছে না৷ সবাই তাকিয়ে দেখছে এ জেনো কোনো মেলায় সার্কাস হচ্ছে, দেখা ব্যতিত কারো কিছু বলার নেই।
মৈথি এর বাবা এগিয়ে আসেন। হাত ধরে তাড়িয়ে দিতে চাইলে রুহানি ত্যাড়ামি করে। সে কোথাও যাবে না। রেগে রুহানির গায়ে হাত তুলে মৈথি এর বাবা আকবর খান। ইয়াসির চিৎকার করে গার্ডদের ডাকেন। এবং রুহানি কে নিয়ে যেতে বলেন। বাহিরে চেঁচাচেচি শুনে রুম থেকে বের হয় তাজ। গ্রাউন্ড ফ্লোরে রুহানি কে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে চায়। রুহানি ইয়াসিরের কণ্ঠস্বর শুনে তার দিকে তাকায়। গার্ড চলে আসে৷ এবং উনারা আবারও রুহানির গায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করল। তাজ রুমে আসে, আরিশ কে শুনিয়ে বলে,

‘তোর বিয়ের খবর শুনে রুহানি চলে আসছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে শরীরে অনেক ক্ষত।’
তাজের কথাশুনে দ্রুত বিছানার ওপর থেকে নেমে পরে আরিশ। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত আসে। তখন সে দেখে সত্যি সত্যি রুহানি তার মামুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছে। রুহানির ইয়াসিরের নাম এখনও জানে না শ্যামা ও কখনো বলেনি ‘ও’ কখনো জিজ্ঞেস করেনি৷ ইয়াসিরের সামনে হাত জোর করে বলল, ‘আমাকে একবার আরিশের সাথে দেখা করতে দিন প্লিজ।’

রুহানি কথায় কথায় আবেগি হয়ে ইয়াসিরের হাত ধরে ফেললো। ইয়াসির রাগান্বিত হয়ে রুহানি কে এক ঝাঁকায় ফ্লোরে ফেলে দেয়। সিঁড়ি ভর্তি মানুষ। নিচে নেমে আসতেও পারছে না সে। রুহানি সিঁড়ির দিকে ফিরে মেঝে তে পরে যায়। আরিশের রাগে রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। ওপরে বিয়ের কনে রুম থেকে বেরিয়ে এসে আরিশের পাশে দাঁড়ায়। আরিশের হাত ধরে বলল,

‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? এখানেই দাঁড়ান। ওই ছোটমোটো বিষয় আব্বা কে হ্যান্ডেল করতে দিন।’
আরিশ এক ঝাঁকায় মৈথি এর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। এবং মানুষ জন ঠেলে নিচে নামার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইয়াসির রাগে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘গার্ডস মেয়েটা কে উচিত শিক্ষা দিয়ে এখান থেকে বের করে দাও।’
গার্ডগুলো এগিয়ে যেতে লাগল রুহানির দিকে।

একটা মেয়ের ওপর এত অত্যাচার হতে দেখে সবাই চুপ থাকলেও একজন চুপ থাকতে পারেনি। বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা ও তার বাবা মা, রুহানির বন্ধু বান্ধব। ইয়ানা ও ইয়াসিরের আগের বাড়িটা ইয়াসির এখন বেশ আধুনিক করেছে সেজন্য ইয়ানা প্রথম চিনতে পারিনি৷ বাড়ির ভেতরে ঢুকে একটা মেয়ের সাথে এমন অমানবিক নিষ্ঠুরের মতো নির্যাতন করতে দেখল সে। ফ্লোরে বসে থাকা মেয়ের পিঠ দেখেছে মুখ দেখেনি। সে নিজেকে দমিয়ে রাখতেও পারেনি।
চেঁচিয়ে বলল,

‘ইয়াসির। এটা কোন ধরনের সভ্যতা?’
এত বছর পরও ইয়ানার কণ্ঠ চিনতে বিন্দু মাত্র ভুল হয়নি ইয়াসির। সে পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। আরিশ ও ওপর থেকে দরজার দিকে তাকাল। ইয়ানা কে দেখে চারপাশ জেনো থমথমে হয়ে গেছে। ইয়ানা এগিয়ে আসল, ইয়াসিরের সামনে এসে শাসাতে লাগল, ‘কিভাবে পারো তুমি এসব? একটা মেয়ের বয়সী মেয়েকে এভাবে মারতে তোমার গায়ে বাঁধলো না?’

ইয়াসির কিছু বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে গলায় কথা আঁটকে গেছে। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে উনি। নির্বিকার নির্বাক্য দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানার মুখশ্রীর দিকে সে কত কত কত বছর পর এই মুখটি দেখছে। কত যে আল্লাহর কাছে বলেছে, মৃত্যুর আগে একবার অন্তত সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিবেন। আজ সে ইয়ানা তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে শাসাচ্ছে। রুহানি ফ্লোরে পরে আছে এত মারার খাবার পর কোনো মেয়ের শরীরে শক্তি থাকে? উঁহু না। রুহানির শরীরেও নেই। রুহানি কে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওর নানী। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে এক নজরে তাকিয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পর, হেঁটে আসতে লাগল।
ইয়াসির হাত বাড়িয়ে ইয়ানা কে ধরতে নিলে ইয়ানা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। ইয়াসির নির্নিমেষ চোখে তাকাই বলল, ‘আসলে এই মেয়ে টা ও এখানে আসছিল..।’

ইয়াসির আরও কিছু বলার আগে ইয়ানা ধমক দিয়ে বলল, ‘একটা মেয়ে যে কারণে আসুক না কেনো? তুমি কে তাকে এভাবে মারার?’
ইয়ানার মা হাঁটু ভাজ করে রুহানির সামনে বসে। মহিলার পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে মহিলা ভীষণ বড়লোক। রুহানির সামনে বসায় সবাই কপাল কুঁচকালো। অস্ফুটস্বরে রুহানি বলছে, ‘নান্নাহ?’
মিসেস জিয়াসমিন রুহানি কে তুলে নিজের মুখোমুখি করলেন। নিজের আদুরে নাতনি কে আহত অবস্থায় পেয়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে উনার। চোখ ভরে আসে জলে। রুহানির মাথা নিজের কোলে তুলে নেয়। রুহানি অস্ফুটস্বরে এখনও বলছে, ‘নান্নাহ?’

মিসেস জিয়াসমিন আমতাআমতা করে বলল, ‘রুহি দিদি ভাই। এই তো তোমার নান্নান।’
রুহানি আস্তে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। চোখের সামনে সব ঝাপ্সা দেখছে। বার বার চোখের পলক ফেলছে সে। ইয়াসিরের সাথে তর্ক করছে রুহানি৷ কেন সে একটা মেয়েকে মেরে আহত করেছে? এবং তাকে আরও মারার আদেশ দিয়েছে? ইয়াসিরের ইয়ানার একটা প্রশ্নের ও উত্তর দিতে পারছে না। শুধু চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে এককৃত্রিম হাসির রেখা। রুহানি এখন একটু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আরিশ ওপর থেকে মানুষ জন ঠেলেঠুলে ঠিক ইয়ানার পাশে দাঁড়ালো। অস্ফুটস্বরে বলল, ‘মামনি?’ আরিশের ডাক শুনতে পায়নি ইয়ানা।

রুহানি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল, ‘নান্নাহ। আ…ম আমার মাম্মাহ কোথায়?’
মিসেস জিয়াসমিন শব্দ করে কান্না করে দিলেন। জড়ানো কণ্ঠে চিৎকার দিলেন, ‘ওরে ইয়ানা এদিকে আয়।’
নানির দৃষ্টি ফলো করে পাশে তাকাল রুহানি। দেখল তার মা তারই জন্য লোকটার সাথে মুখে লড়াই করছে। মায়ের ডাক শুনে বিরক্ত হয়ে এক নজর পিছনে ঘুরে তাকাল ইয়ানা। পরক্ষণে আবারও ইয়াসিরের দিকে তাকায়। কিছু বলবে, এমন সময় মনে হচ্ছে কাউকে দেখেছে সে? ভ্রু কুঁচকে অন্যপাশ ঘুয়ে পিছনে তাকাল। আহত চোখে রুহানি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিজ সন্তান কে আহত অবস্থায় দেখে কোনো মেয়ে ই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। রুহানির অবস্থা দেখে ইয়ানা এক চিৎকার দেয়, ‘রুহি?’

ছুটে যায় রুহানির কাছে। গার্ড রা রুহানিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাত ধরে অনেকটা দূরে নিয়ে আসে তখন ও- ওর নানীর নজরে পরে। রুহানির পাশে ধপ করে বসে পরে। রুহানির মাথা কোলে নিয়ে পাগলের মতো ডাকছে ইয়ানা। ইয়ানার অবস্থা দেখে ইয়াসির ও আরিশ কিছুই বুঝতে পারছে না। ইয়ানা এমন বিহেভ কেন করছে?
রুহানি ভারী নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। বলল, ‘মাম্মাহ! আ’ম স্যরি মাম্মাহ। আমি তোমার গুডগার্ল নই। আমি কখনো তোমার কথা শুনিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

এরপর আর কথা বলতে পারেনি রুহানি। রুহানির চুপসে যাওয়ার দেখে ইয়ানা মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে। মিসেস জিয়াসমিন কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘মা। আমার মেয়ে কে বলো ‘ও’ আমার গুড গার্ল। ও-কে বলো চোখ মেলে তাকাতে। আমার মেয়ে চোখ বন্ধ করে আছে মা। আমার রুহানি কে তুমি ডেকে তুলে দাও মা। আমার মেয়ে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। আমার মেয়ে মা। আমার মেয়েকে তুমি তুলে দাও না মা।’

ইয়ানার বাবা ও রুহানির বন্ধুরা দ্রুত ওদের কাছে আসল। আদনান, সাইফ রুহানির থেকে ওর মা ও নানীকে দূরে সরালো। নিশান ও সাইফ দু’জনে রুহানি কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। ইয়ানার বাবা বলে উঠল,
‘নানু ভাই কে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। এখানে বসে কান্নাকাটি না করে চলো সবাই হাসপাতালে। আমার নানু ভাইয়ের কিছু হবে না ইন শা আল্লাহ।’

শ্যামা, নাজিন, আয়রা এগিয়ে গেলো ইয়ানাকে সামলানোর জন্য। রাইসা ও লাবণ্য এগিয়ে যায় মিসেস জিয়াসমিন কে ধরার জন্য। ইয়ানা শ্যামা ওদের উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলো ইয়াসিরের দিকে। সামনাসামনি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইয়ানা কোষে এক চড় মারল ইয়াসিরের গালে। রাগ কমেনি সে জন্য একই গালে আরও একটা চড় মারল। তখনকার ইয়ানার আমার মেয়ে আমার মেয়ে আর্তনাদ শুনে হতবাক হয়ে গেছে ইয়াসির ও উপস্থিত সবাই। ইয়াসির তো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। ইয়ানার হাতে চড় খেয়ে বাস্তবে ফিরে আসে সে।
ইয়ানা মাত্রাতিরিক্ত রাগে চেঁচিয়ে বলল,

‘এই চড়টা আমার তোমাকে ২১বছর আগে মারা উচিত ছিল। তখন যদি মারতাম তাহলে আজ আমাকে ইয়ানা মেহফাজ কে এই দিনটা দেখতে হত না। আমার ফুলের মতো মেয়ের গায়ে এই ২০বছরে আমি একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত দেইনি। আর আজ তুমি তাকে গার্ড দিয়ে পশুর মতো মেরে আহত করলে।

শোনে রাখো ইয়াসির, তোমার জন্য আমার মেয়ের যদি কিছু হয়। আমি তোমাকে জানে বাঁচতে দেবো না। ভুলে যেও না৷ এই ইয়ানা যা বলে তা করে দেখাতেও পারে। আমার মেয়ে রুহির কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না।’
ইয়ানার বাবা এগিয়ে আসলেন। মেয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ইয়াসির স্বপ্ন ও ভাবেনি রুহানি তার ও ইয়ানার একমাত্র ভালোবাসার চিহ্ন তাদের মেয়ে। যদি জানতো তাহলে কি পারতো নিজের সন্তান কে এত কষ্ট দিতে?
সত্যের সম্মুখীন হতে পৃথিবী চারপাশে ঘুরতে লাগল। আরিশ সে নিজেও জানতো না রুহানি তার মামুর মেয়ে। ইয়াসির নিজেকে সামলাতে না পেরে ফ্লোরে বসে পড়ে। রুহানিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। যথা সময়ে ওর ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৭

ইয়াসির কান্না করছেন, নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে বলল, ‘এই জন্যই ও-কে প্রথম দেখে আমার সব চেয়ে বেশি আপন মনে হয়েছিল। ও-র মাঝে আমি আমার ইয়ানার প্রতিচ্ছবি দেখে ছিলাম। এজন্যই ও-কে হার্ট করে কথা শোনানোর পর আমার নিজের ও কষ্ট হচ্ছিল। আর এই জন্য ই আজ ও-র রক্তাক্ত মুখ দেখে আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। ‘ও’ মেয়ে অন্য কেউ নয়। ‘ও’ যে আমার মেয়ে আমার কলিজার টুকরা। আমার মেয়ে কে আজ আমি। হে আল্লাহ আমার দ্বারা আবারও অন্যায় হয়ে গেলো।’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৯